শুক্রবার ২৫শে বৈশাখ ১৪২৭, ৮ই মে ২০২০
কবিতা
জাবেদ ভূঁইয়া
নিজের প্রতি নিজে
বিছিন্ন ভ‚খন্ড হতে তীব্র ক্ষুধা নিয়ে কবিতার দম না আসা রাতে নিজেদের ভিতরে মাংসের গন্ধে কী এক যাদু চলছে! পাঁচটা দশক গেলো! তবুও স্বাস্থ্য, খাদ্য কার্ড নাই ঘরে! যুদ্ধের ভিতরে কী এমন রঙিলা দৃশ্য ছিলো-- মানুষ মরে গেলো! মানুষ দাম পেলো না শুধু! নেতারা আজ মিথ্যাবাদী রাখাল ছেলে! স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর দিয়ে যে পাখিগুলো ওড়ে তাদেরও অসুখ হয়! মন্ত্রণালয়ের দামী গাড়ি এসব থামাতে পারে না! নিজেদের মৃতদেহে বসবাস করে একটি গান লিখেছি আয়ু ও রুটির। প্রতিবেশীর লজ্জা-মুখ আজ প্রেমিকার কাতরতা মতন শরীরে প্রকাশ্য ঝুঁলে ঝুঁলে ডাকছে! বাজারে আমাকে যারা বিক্রি করতে নিয়ে গিয়েছিলো-- যারা আমার হাতে দানকৃত খাবার তুলে দেয়-- এখনও যারা ঘরে বসে পাখির মাংস খাচ্ছে-- আমি তাদের মনে রাখছি মনের খাতায়! এই বিছিন্ন ভ‚খন্ড হতে একদিন আমরা বের হয়ে যাবো! মানুষের কাতারে দাঁড়াবো, মেশিনের বিপরীতে আমাদের খাদ্য পানীয় জোগান হবে! কালো ঘর থেকে দূরের ও কাছের মানুষ সবাই সমান!
রাবাত রেজা নূর
কারাগার
আমার নিজস্ব একটা জলডুবি কারাগার আছে।
বেদনার কারখানা।
সেখানে বিরহ বেদনার উর্বর কার্পাস বীজ বোনা;
ফোটে বেদনার ডুবুডুবু জলফুল।
বহে বারোমাস্যা বেদনার মায়ু নদী ক‚লক‚ল।
বিষাদের দিনলিপি ছুঁয়ে মধুক‚পী ঘাস বুকে নিয়ে দিন রাত বসবাস। ভুলি নিজ জন্মের পাপপূণ্য ইতিহাস; বিলকুল।
সাপের মতো অন্ধকারে বুকপায়ে হাঁটি।
এখানে আকাশ গুমড়ে মেঘ আসে না;
চাঁদ তার জোৎস্নার ধবল দুধ ঢালে না
অন্ধকারে হাতড়ে খুঁজি আমার কুঁড়েঘর; মাটি।
জলডুবি কারাগারে সীমানা প্রাচীর নেই
বেঁচেও মরে গেছে কয়েদি; যে এসেছে সেই।
সজল কুমার টিকাদার
ছেলেবেলার পেয়ারা গাছ
ছেলেবেলার ভিতর একটা পেয়ারা গাছ আছে।
আমি তার ঘাড়ে উঠি; এডাল থেকে ওডালে যাই
কচিপাতা চিবোই, পেয়ারা খাই।
সে কেবল প্রিয়ার মত শরীর পেতে রাখে।
এভাবে উড়তে উড়তে কখন যেন
ঠোঁটে নখে হয়ে যাই পাখি!
আর, ছেলেবেলার সে গাছ
তখন শুধুই সবুজ আকাশ!
আদিত্য আনাম
জী, বন এক জীবনের ছদ্মনাম
ঘুমন্ত বন মারিয়ে যাচ্ছে উদাসী পা
ভোলা পথ পালিয়েছে গন্তব্য নিয়ে।
অন্ধকার ভেঙে ভেঙে জোনাকির আলো
একা
এক
বিষণ্ন
প্রতীকী
মন-
উড়ছে অবরুদ্ধ হাওয়ায় বিলাপ করে করে।
আকাশে বিধবা চাঁদ চেয়ে আছে কাজল চোখে
কেউ নেই তার; ছিলো না কেউ গোটাল ব্রহ্মাণ্ড কখনো!
পাপড়ির দানার মতো জোছনার নির্যাস
ঝরছে
কালো
কান্নার
জলের
মতো
টুপটাপ; ক্রমাগত নিরুপমায়।
ঘুমন্ত বন- মন তবুও জীবন্ত
তার স্বপ্নের ভিতর দিয়ে দৌড়াচ্ছে এক প্রেমিকা হরিণ
প্রেমিক হরণিটি আজ নিখোঁজ বনে
তার কাঁচা মাংস ও ঘ্রাণ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে শিকারী কেউ!
এভাবে কারো প্রেম কেউ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়?
হায়! শিকারী হায়!
তবু- শিকারীরও প্রেম থাকে প্রেমিকা থাকে
ওভাবে তারও প্রেম কেউ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়?
কারো মহামূল্য হৃদয় কারো একটুকরো খাবার
পৃথিবী
আজ
এক
বিপন্ন
রাক্ষস
যেন-
দূরে, গাছের ডালে ঝুলে আছে কারো একান্ত কেউ
Oh! God, Who Are
You?
Oh! God, What The
Fuck!
ওহ্,
তুমি কি জানো একটা হৃদয়ে কতগুলি প্রলেপ থাকে?
কতগুলি দুঃখ পোড়ালে একটা হৃদয় গঠিত হয় তুমি কি জানো, প্রভু?
দিগি¦দিক দিকেরা ফিকে হয়ে আছে
দূরে, ঠিক মেঘলা কফিনের কাছে
স্থির, পড়ে আছে বিগত সূর্যের লাশ।
The Night Like The Black Ocean
Our Lonely Souls Are Swimming
Swipe
এখানে জীবন্ত সাঁতার কেটে জেনেছি
রাতের অপাঠ্য অন্ধকারে সমস্ত রঙের রঙ এক
ফুলের মৌনতা জুড়ে সব মৃত মৌমাছি-
জীবন এক দীর্ঘ অবহেলা
আর ঘোলা ঘোলা দুর্বোদ্ধ বন।
অনুবাদ: মাজহার জীবন
মূল: ইলহান চুমাক
কুর্দিশ কবি ইলহান সামি চুমাকের জন্ম ১৯৭৩ সালে তুরস্কের বিঙ্গল প্রদেশে। নিষিদ্ধ ঘোষিত পিকেকে কুর্দিশ মিলিশিয়ার সদস্য সন্দেহে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ২২ বছর বয়সে ১৯৯৪ সালে গ্রেফতার হয়ে ২৬ বছরের জেল খাটছেন। জেল থেকেই তিনি আটটি কবিতাগ্রন্থ লিখেছেন। Geldim Sana (I Came to You) কবিতাগ্রন্থের জন্য জিতেছেন সুননুর সেজুর সাহিত্য পুরস্কার। পরে তিনি বলেছেন, অত্যাধিক নির্যাতন করে তাঁর কাছ থেকে দোষ স্বীকার করিয়ে নিয়েছে তুরস্ক সরকার। ২০০৭ সালে ইউরোপীয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটস তাঁর বিচারকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। কবিতাটি ক্যারোলিন স্টকফোর্ড কৃত ইংরেজি থেকে অনূদিত।
জীবন মিথ্যা বলে না
আমি এখন চাঁদ আর স্রোাতের মাঝে
আমি এখন আর্তনাদ আর গুঞ্জনের মাঝে।
শিশুকালে ছিলাম শিশুর মতোই শিশুর প্রতিলিপি,
আর ছিলাম মায়ের ডালিম-মুখের হাসিতে বন্দী।
জানালা দিয়ে আলো-ভরা বাগানে তাকাতাম যখন,
দেখতাম হাত দিয়ে ফল পাড়ার দৃশ্য- সে হাতের দর্শন,
সে সময় তখনও আমরা ব্যাঙের ডাক শুনতে পেতাম,
যুবতীরা যখন আমার জীবন ছুঁয়ে গেছে,
তখন ঝিলের রঙ ছিল নীল- নীলের মূল্য জানতাম আমি।
জীবনে চলার পথে বেদনা কি আমি তা বুঝেছি এখন।
অণুগল্প
শূন্যতা
শামসুল কিবরিয়া
এটা কোনভাবেই বিশ্বাস হয় না যে প্রিয় বন্ধু পার্থ আর কোনদিন আমাদের সাথে কথা বলবে না।বিশ্বাস হবেই বা কেমন করে। গতকাল সন্ধ্যায়ও আমরা একসাথে বসে মনা ভাইয়ের চায়ের দোকানে বসে কত উজির নাজির মেরেছি। সে আড্ডায় পার্থ তার তীব্র প্রাণশক্তি নিয়ে বরাবরের মতোই হাজির ছিল। আমাদের দেয়া যুক্তিগুলোর অনেকগুলোকেই পাল্টা যুক্তি দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল।
সে এমনই। মাঝে মাঝে তার এমন আচরণ খারাপ লাগলেও তা আমাদেরবন্ধুতার সাথে খাপ খাইয়ে গিয়েছে। আর এটা বলতে আমাদের কারোরই কখনও দ্বিধা হয়নি যে তার পড়াশোনা জানার ব্যাপ্তি আমার , রওশন আর প্রাঙ্গণের চেয়ে বেশি বলে তার কথার ওজন অন্য বন্ধুদের কথার চাইতে বেশি হয়। তবু কেউ কাউকে ছেড়ে দিতে রাজি হই না । এসব তর্ক-বিতর্ক, যুক্তি পাল্টা যুক্তির ভেতর দিয়ে আনন্দ হিল্লোলে ভেসে যাওয়া আমাদের জীবনযাপনেরই অংশ হয়ে উঠেছে। এই পার্থ এখন আর মনা ভাইয়ের চায়ের দোকানে বা কলেজ রোডে বা স্টেশন রোডে আমাদের সাথে বসে আর কথা বলবে না এটা কিভাবে মেনে নেবেমন?
ভোরে রওশনের ফোনে এমন একটি খবর পেয়ে আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। তার কথা যেন আমার সবকিছু এলোমেলো করে দেয় মূহুর্তেই। বারবারই রওশনকে বলতে থাকি এটা সত্য হতে পারে না। কিন্তু ব্যক্তিগত আবেগই কি সব? পার্থ যে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে এটাই বাস্তবতা। পাগলারে এমন কাজ কেন করতে গেলি। কেন নিজের হাতে নিজেকে মারতে গেলি- ফোন না কেটেই আমি বলে ফেলি। ওপাশ থেকে রওশনের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তাড়াতাড়ি বের হয়ে পার্থদের বাসায় যাওয়ার কথা বলে সে কল কেটে দেয়।
পার্থদেরবাসায় পৌঁছে দেখি এই ভোরেই লোকজন এসে গেছে। এরা তাদেরই প্রতিবেশী। পার্থর ঝুলন্ত দেহটা ইতোমধ্যে কেটে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। পুলিশ এসে ঝামেলা করতে পারে তবু তাকে বিভৎস অবস্থায় ঝুলতে দেখে তার বাবাই নাকি কাকে দিয়ে নামিয়ে এনেছেন। আশেপাশে জড়ো হওয়া মানুষগুলোর মনে যেন একটি প্রশ্নই ঝুলে আছে- ছেলেটা কেন এভাবে মরতে গেল? ঘটনার আকস্মিকতা যেন সবাইকে বিমূঢ় করে দিয়েছে।
পার্থ কোন সুইসাইড নোট রেখে যায়নি। তার মুখ দিয়ে কোনদিন ভুলেও বেরিয়ে আসেনি যে সে আর বাঁচতে চায় না। বন্ধুরা এক অপরের বথা অনেককিছু জানলেও গোপনতম কথাটি কি আর জানা সম্ভব হয়? পার্থর কথাও আমরা জানতে পারিনি।
এখন আমরা ভাবছি এটা কি হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা নাকি দীর্ঘদিন ধরেই সে এ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। নিজের সাথে এমন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল যাতে সে পরাজয় বরণ করে।
কলেজের পড়াশোনা ভালো যাচ্ছিল না বলে একাধিকবার বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে আর বাবার টাকার শ্রাদ্ধ করেছে। এটা কি তার মনে গভীর কোন প্রভাব ফেলেছিল? নাকি একই সাথে কলেজে ভর্তি হওয়া অবন্তিকে নিজের করে পাওয়ার ব্যর্থতা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল? নাকি বাবার সাথ চাচাদের সম্পর্কের জটিলতা- যা দীর্ঘদিনের বন্ধু হওয়ার কারণে আমরা অনেকটাই জানি- তার মনে কোন বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল? তার আত্মহত্যার জন্য কোন কিছুরই আসলে যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাই না।
এরপর পুলিশ আসে । আইনি প্রক্রিয়াগুলা শেষে তার দাফন হয়। আমরা শেষ হওয়া পর্যন্ত থেকে একত্রে বেরিয়ে আসি এরপর হাঁটতে হাঁটতে নিজেদের অজান্তেই চলে যাই মনা ভাইয়ের দোকানে। পার্থর সাথে এখানেই একান্ত সময় বেশি কাটানোর কারণেই হয়তো আমাদের পা সেদিকে চলে যায়। এরপর আমরা চলে যাই কলেজ রোডে, সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে চলে আসি স্টেশন রোডে। আমরা টের পাই আমাদের সাথে সাথে চলছে এক বিশাল শূন্যতা।
No comments:
Post a Comment