বুধবার ৯ই বৈশাখ ১৪২৭, ২২ই এপ্রিল ২০২০
ক বি তা
শফিক সেলিম
সোনার মাকরি
মাকে আমি কখনো সাজতে দেখিনি
ঠোঁটে লিপস্টিক
স্নো বা পাওডার
লম্বা চুলের ফিতা বা ক্লিপ
পায়ে দেয়ার আলতা
এগুলোর মায়ের কিছু ছিলো না
তবে মায়ের একটা কানের মাকরি ছিলো
স্বর্ণের
মা সেটা পড়ে ভাঙ্গা আয়নায় মুখ দেখে চুল আচঁড়াতো
এটাই তার সর্বোচ্চ সাজুগুজু
মা আমার পরীক্ষা আগামী মাসে
তারপর মা তার কানের মাকরি খুলে
রসো কর্মকারকে দিয়ে বলতো - দুই মাস পরে নিয়া যামু;
সুদ নিয়া ঘুরামু না, দাদা
তয় এতো ট্যাকা দিবার পারুম না, দিদি
২৫'শ লাগবো আমার। দেও, দাদা, পুলার পরীক্ষা
সময় মতোই দিয়া দিমু
না, দিদি, আমি পারুম না
দেও, দিমানি তো কইলাম
যা পারুম না, তা চাইলে ক্যামনে দিমু
তুমি যাও, আমার কাম আচে
রসো কর্মকার কাজে মন দেয়
মা বসে থাকেন; কালো বিবর্ণ মুখ
আমি তার আঁচল ধরে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকি
বাইরে আসি, হোটেল থেকে পানি খাই
ক্ষুধায় পেট পুরে যেতে থাকে
প্রতিবারই রসো দা সে চেনা মাকরির খাটিত্ব পরীক্ষা করতেন এবং ওজন দিতেন
মা গুনে গুনে আমার হাতে টাকাগুলো দিতেন
লজ্জ্বায় আপমানে আমি ছোট হয়ে যেতাম
এখনো পরীক্ষার শব্দটি শুনলেই মায়ের মাকরির কথা মনে পড়ে
ভয়ে লজ্জ্বায় আমি ছোট হয়ে যাই
পরীক্ষার প্রতিশব্দ কি তবে মায়ের কানের পাঁচআনা
সোনার মাকরি
সঞ্জয় আচার্য
বাঁশিওয়ালা
একদিন চালফুটো ফাঁকা ঘরে
দায়রাবান্দা খেলতে খেলতে শিশুকে সে বলল-
এসো এবার চোর পুলিশ খেলি।
তখন থেকে শুরু লুকোচুরির গাজন উৎসব।
এ লুকায় তালকুঠুরীতে তো ও অন্ধক‚পে-
এ কার্ণিশ আড়ালে, সে তখন
পিছন দ্বারে।
এইভাবে কেটেছিল পুরো চড়ককাল
খেলার সমগ্রতা শিশু তখনো শেখেনি,
খোঁজার নামে আলটপকা শূণ্য ঘরে ফুঃ দিয়ে সে
কত যে ধূলো ওড়ালো-কত যে ভাইরাস...
এমন উলঙ্গ হয়নি কখনো ঘর
সেই শূণ্য ঘর তখন থেকেই হ্যামলিন হয়ে বাঁশির জাদুতে রসাতলে টেনে নিয়ে চলেছে আমাদের।
জ্যো তি র্ম য় মু খো পা ধ্যা য়
দাহপর্ব
ভাবতে ভাবতে আঘাতগুলো সব বাসি হয়ে আসে
আঘাত বলতে, নিজেকে দাহ করতে করতে
যা কিছু ডোমের লাঠি...
পুড়িয়ে পুড়িয়ে নিভিয়ে ফেলেছি নিজেকে
তবু, সেই অতৃপ্ত নাভি
আজও আগুন খেয়ে চলে
অপার অরণ্য
প্রচ্ছদ ও প্যাচাল
চোখের দূরবীনে ঘুমন্ত স্বপ্ন। শিশুগাছ।
লেবুপাতার আচ্ছন্ন হাওয়া দোল খায় ভেতরে।
টুপটুটিয়ে ঝরে শরণার্থী শিশির। বুকসেলফে কিছুটা আলোর আস্ফালন। মনে মনে একটি লাশ সিগারেটে আগুন ধরালো।
অদূর তাবুর নিচে শব্দবাগান। বসন্তের খইফোটা মুখ। কনকচাঁপার চাপাচাপা কিছু নিজস্ব ঘ্রাণ বইয়ের পাতায়, পাজরে। মুখ দেখে মনে হতে পাওে শ্বেতকরবী। পাঠক আসে,যায়। উল্টেপাল্টে খনন করে কবি ও কবিতার মধ্যস্থ অন্তরায়।
কী ভুলে বই খোলবার আগেই কয়েকশোবার মগ্ন হই প্রচ্ছদপৃষ্ঠায়। কে জানে এতোকাল বই নয়Ñ
হুবহু দাম দিয়ে কিনেছি প্রচ্ছদ। কিংবা ভুলবশত প্রচ্ছদ ভরে আনি কবিদের যাবজ্জীবন।
কেউ একজন চেঁচায়: মানুষের মগজ সত্বেও মানুষের সঙ্গে বেমানান তুমি।
জানি বই নিগীর্ণ নয়। প্রচ্ছদে উঠে আসে যাবতীয় হিমরাতের হাড়গোড়। এরকমই কথা ছিলো যেন বৃক্ষ হয়ে জন্মাই।
বাড়ি ফিরে দেখি বহুদোষে মুদ্রিত ঘরগুলো না-ওড়ার শোক নিয়ে চিল হয়ে গেছে। তখন হঠাৎ মনে পড়ে আরেকজনের কথা।
বলেছিলোÑ দরজার রঙ সন্ন্যাস অথবা সমুদ্র হলে গাছেদের ঘর থাকতে নেই।
ভাষান্তর: কায়েস সৈয়দ
মূল: হোর্হে লুইস বোর্হেস
চতুষ্পদী শ্লোক
অন্যান্য সবাই মারা গেলো, তবে সব ঘটেছে অতীতে
সময়টা এখন সুপ্রসন্ন মৃত্যুর জন্য
আমিও কি হতে পারি তা, ইয়াকুব আলমনসুরের একটি বিষয়
আমি কি মরে যাবো, যেভাবে মরেছে গোলাপ, অ্যারিস্টটল?
গল্প
জামা
আমিনুল ইসলাম সেলিম
নূরগঞ্জ প্রতিনিধি অনন্য জাহেদ মাউথপিস নিয়ে প্রস্তুত। তার গায়ে মোটা পিপিই, মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক, হাতে গ্লাভস। প্রেস টিভির সংবাদ উপস্থাপিকা ইরিকা জান্নাত বলছেন-দর্শক, এই মুহুর্তে আমাদের নূরগঞ্জ প্রতিনিধি জাহেদ রয়েছেন নবপল্লী ইউনিয়ন পরিষদের সামনে যেখানে চাল চুরির অপরাধে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে চেয়ারম্যান মোদাচ্ছের হাওলাদারকে। জাহেদ, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? -জান্নাত, আমি শুনতে পাচ্ছি।’ জাহেদ রিপোর্টিং শুরু করলেন। জান্নাত এবার মূল প্রশ্নে এলেন, -জাহেদ, আপনি কি আমাদের বলতে পারবেন, গণপিটুনির সময় হাওলাদারের পরনে কী ছিলো? -হ্যাঁ জান্নাত, ধন্যবাদ। আসলে আমি যেটা বলতে চাচ্ছি আসলে, সেটা হলো, মানে, এলাকাবাসী এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা আমাকে যেটা আসলে বলছিলেন, তাতে আসলে এটা বোঝা যায়, আসলে তার পরনে যা ছিলো, তা কারো আসলে দৃষ্টিগোচর হয়নি।’ -জাহেদ, জাহেদ আপনি থামেন। আপনি কি বলতে চাচ্ছেন- তিনি, মানে আমার বলতে খুব লজ্জা করছে, মানে তিনি কি উলঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন? -না জান্নাত। বিষয়টা আসলে এ রকম নয়। আসলে, আমাকে আসলে একজন প্রত্যক্ষদর্শী যেটা বলছিলেন, সেটা হলো- তার পরনে আসলে কোনো কাপড় ছিলো না। এ বিষয়ে আমি আসলে জানতে চাইলে একজন আসলে আমাকে জানাচ্ছিলেন যে, তাকে আসলে উলঙ্গ হয়েছিলেন বলা ঠিক হবে না আসলে...’ জান্নাতের মেজাজ কিছুটা লাফালাফি করে। উপরে নিচে। তিনি বলেন, ‘আহা জাহেদ, কী বলছেন বুঝতে পারছি না! আচ্ছা, আমাদেরকে আপনি কি এটা বলতে পারবেন, মানে, যে লোকটা আপনাকে বলেছে যে, চেয়ারম্যানকে উলঙ্গ হয়েছিলো বলা যাবে না, সে আসলে চেয়ারম্যানের সহযোগী কিনা এবং চেয়ারম্যান বিষয়ে তার আর কী বক্তব্য ছিলো? জাহেদ... -হ্যাঁ, জান্নাত। না, মানে তারা, মানে ঐ লোকটিসহ অন্য আরও কমপক্ষে তিনজন আসলে আমাকে নিশ্চিত করেছেন যে, তার পরনে আসলে অনেক আগে থেকেই আসলে কাপড় ছিলো না।’ এবার উপস্থাপিকা পুরোপুরি বিরক্ত। -আচ্ছা জাহেদ, থামেন। আমরা জানতে পেরেছিলাম যে চেয়ারম্যান পলাতক রয়েছেন, আপনি কি জানতে পেরেছেন, তিনি কোথায় পলাতক রয়েছেন? জাহেদ, জাহেদ, হ্যালো, হ্যালো, জাহেদ, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? -অপর প্রান্ত থেকে স্পষ্ট কোনো সাড়া না পাওয়ায় লাইন কেটে দিয়ে ইরিকা জান্নাত আবার দর্শকমুখি হলেন, -দর্শক, আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, আমাদের প্রতিনিধি কী বলতে চেয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, তার পরনে অনেক আগে থেকেই কাপড়, মানে জামা ছিলো না। তাহলে একটা কাপড়হীন লোককে গণপিটুনি দেয়া কতোটা যুক্তিসঙ্গত, আমাদের অবশ্যই ভেবে দেখা উচিত। দর্শক, আমরা এবার একটা ছোট্ট 'চুতরা পাতার বিড়ি' ব্রেক নিচ্ছি। ফিরছি আরও সঙবাদ নিয়ে। সঙ্গেই থাকুন।’
পু ন র্পা ঠ
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
খুব কাছে এসো না
খুব কাছে এসো না কোন দিন
যতটা কাছে এলে কাছে আসা বলে লোকে
এ চোখ থেকে ঐ চোখের কাছে থাকা
এক পা বাড়ানো থেকে অন্য পায়ের সাথে চলা
কিংবা ধরো রেল লাইনের পাশাপাশি শুয়ে
অবিরাম বয়ে চলা ।
যে কাছাকাছির মাঝে বিন্দু খানেক দূরত্বও আছে
মেঘের মেয়ে অতো কাছে এসোনা কোন দিন
দিব্যি দিলাম মেঘের বাড়ীর, আকাশ কিংবা আলোর সারির।
তার চেয়ে বরং দূরেই থেকো
যেমন দূরে থাকে ছোঁয়া, থেকে স্পর্শ
রোদ্দুরের ব্কু, থেকে উত্তাপ
শীতলতা, থেকে উষ্ণতা
প্রেমে, খুব গভীর ম্যাপে যেমন লুকিয়ে থাকে ভালোবাসা
তেমন দূরেত্বেই থেকে যেও-
এক ইঞ্চিতেও কভু বলতে পারবে না কেউ
কতটা কাছা কাছি এসেছিলে বলে দূরত্বের পরিমাপ দিতে পারেনি পৃথিবী।
No comments:
Post a Comment