অপার অরণ্য

অপার অরণ্য

দুটি অ-কবিতা 

১.
মৌসুমি রোদের নির্জনতা খুন করে হুহু বুকের মধ্যে
বিষাদ বাজায় ঘুঘুপইখ,
ওসব নাকি দলীয়করণ।
কয়েকপ্রস্থ কর্পোরেট দেয়ালিকা ছিঁড়ে
কার সাথে বসবো একটি বিকেল
কার শুদ্ধ ডাকনাম হৃদয়ের রাষ্ট্র নায়ক?

পার্লামেন্টের বাজেট শেষে যেকোন রাতে কুরিয়ে
নেয়া যায় শরীরী প্রেসনোট- নোনাস্বাদ!

২.
প্রতিশ্রুতিপত্র জমা হয়
অনাবাদী জমির শরীরে ফাঁপে অনাবৃষ্টি
ধারালো পৃথিবী কেটে কেটে আমাদের আঘাত করলে
কেউ কেউ খুব সহজাতভাবে
নিজেকে নিঃশেষ করে অবিকল কর্পুরের মতো
একটি ঘুণপোকা চুপচাপ স্তব্ধ জলচোখে ঘুমায়।

বেঁচে থাকা আর ভালো থাকার ফারাক খুঁজতে
খুঁজতে পূর্ণিমা লেগে আসে
দ্বিতীয় চোখ ভাবে ‘ব্যক্তিগত’ কিছু নেই
গাছ হবার স্বপ্ন, ঘুমের ক্যাসেট, নষ্টস্মৃতি...
পেটেভাতে সহজ বলে ওরা ভালো থাকে
ওদের ভালো থাকা দেখে-
স্টেশনকে ‘কেমন আছো’ জিজ্ঞেস করা হয়নি আর।

ঋতুশূন্য মা’র শৈশব

লাঙ্গল-শুশ্রুষায় কৃষক যেমন রক্ষা করে জমি
তামাম নির্জনতা গিলে সুঁইয়ের পরে সমুদ্র তুলে মা
সেলাই করেন আমাদের যাপন।
পান থেকে খসলেই চুন বাবার লিকলিকে চোখ
ফোঁসফোঁস করে-
কেমন নির্বান্ধব আর সঙ্গীতশূন্যতায়
বাবা বুঝতেই পারেনা মা আসলে ফোঁড় কাটেন
ঋতুচক্রের ফাঁপা হাঁড়পাজর। 

কাঁথার অন্দরে আশৈশব লুকিয়ে রাখার সন্দেহে
এক বর্ষায় চুরি করে সুঁই হই
দেখতে যাই কড়ুই রোদে সইয়ের সঙ্গে মা পুতুল
খেলত কিনা
উঠতি বয়সের দস্যিপনা কি ঋতুস্রাব এলে মা’ও ঠোঁটে
অযত্নে বসত কিনা কাঠফড়িংয়ের লাল
এসব খোঁজ তল্লাসির ফাঁকফোকরে বসন্ত লেগে যায়
কোন হঠাৎ গাওয়া কোকিলে মা কণ্ঠ দিল কিনা
তন্নতন্ন করেও এই ঋতুটি উদ্ধার করা গেলো না!
পাড়াত মেয়েরা খোঁপায় গল্প গুজে
কোঁচর ভরে চালভাজা খায়
মা তখন যত্ন করে গোয়ালঘরে গরু তোলেন
ডালিমতলার শুকনো পাতা নরম হাতে সরিয়ে রাখেন
মা’র আকাশে মেঘ নেই- গান নেই পাখিদের উড়বার
শরৎ এর বুক চিঁড়ে ফুটে থাকে যুগলযুঁথী
একজন গ্রীষ্মের তাপতড়িৎ ছুঁয়ে ছুঁয়ে কেটে যায় অন্যান্য ঋতু

কোথাও কোন পুকুরঝাপে নেই
সন্ধ্যা নামলে চোখপলান্তি— তাও
তালগাছে পাকে তুখড় ভাদ্রমাস
শীতকাটা সুখে কুয়াশায় পাখিদের আহ্লাদী নাচ
সব ঠিকঠাক সবখানে, হায়!
সমস্ত শৈশব জুড়ে মা হয়েছেন উনুনের পেটে
জ্বলজ্বলন্ত কাঠ!

সুঁই-জীবন থেকে বেরিয়েই
গলা টিপে দেই মা’ও বোবা থাকার ব্যামো
এখন সুনসুনিয়ে কাঁথা সেলাই কালে
মা’র নিশ্চুপ ঠোঁটে নামে অলৌকিক ভোর,
ঋতুমঙ্গল গান।

অণুকবিতা গুচ্ছ

কদমফুল

বর্ষার বিয়ে। পাত্রপক্ষের দাবি মেয়ে জ্যোৎস্নাফুল
কিন্তু ঘরকানা। পুরুষমানুষ- অত রঙঢঙ না হলেও
দিব্যি মাসাল্লাহ। অতএব, বৃদ্ধা বাবার বৃদ্ধকাল
নিলামে তুলে বিক্রি হবে বৃদ্ধাঙ্গুল। মেয়েমানুষ-
জন্মের পাপ! ভোরবেলা জানলা ভেঙে দেখা গেল
ঘরভরা কালো কালো কদম ফুটে আছে

চিঠি চিতার আগুন
------------------
ভালো আছো নীল?
একটা মুখস্ত উত্তর। তারপর বরফগলা চোখ, মাথার
মগজে গাঁথা সহস্র চুপচাপ কিছু চিৎকার আর ছিঁড়ে
যাওয়া হৃৎপিণ্ড সেলাই করতে করতে দুদিকেই
বিচ্ছিন্ন হয় মুঠোফোনের অদৃশ্য তার...

মেঘ জানে না চৈত্রবাহার কোথায় কেমন কোনখানে
চিঠি মানেই চিতার আগুন মন জানে!

চুমু
--------
কপাটের ওপাশে কট্টর রোদ। বাতাসের নিমন্ত্রণে
জানালায় বৃষ্টি। বারান্দায় গৃহকর্তার ঠোঁটে ঘরনির
তুমুল তুফান-  সমূহ তচনচ। এই দৃশ্যে যুগলমাছ
পাখি হয়ে যাবে...

অপ্রেম
---------
আমার থেকে বেশি তোমাকে।
-পৃথিবীতে এই বাক্য প্রথম শুনলাম!
চাবুকের চেয়ে চুমুকের শব্দ বেশি জানো না!
-নৈঃশব্দ্য দিয়ে জড়িয়ে ধরতে শুধু, আর?
দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী ব্যথা, একসমুদ্র জলের নাচন আর যুদ্ধাহত পেখমের রক্তপল্লব তো খোলাই  রেখেছিলাম।

-কোথাও লেখা ছিলনা বিন্দুমাত্র।
ডুব দাও। থেকেও না-থাকার অর্থ আর কোথাও লেখা হবে না।



তারকাঁটা

নিরুত্তর ছত্রাক পেরিয়ে রক্তের ভেতরেও কিছু কিছুু
হা-হুতাশ ঢুকে গেছে আজ
শুধু পূর্ণ পকেট হাত দিলে সাপ সাপ ভ্রম হয়
মানুষের মুখ যেন ঘুঘুধরা ফাঁদ
বেলকনিতে আসেনা হৃদয়ভুক চাঁদ
তবু পাতাদের পাখিদের মানুষের দিকে দেখি
মানুষেরা নাই-
এই বিরহজীবন, কাঁটাছেঁড়া মুখ
এতো অসহ্য অসুখ নিয়ে বুকে কোন পাড়ে দাঁড়াই!
জানি মানুষের ভেতরে কাঁটা
শূন্যের ভেতরেও কাঁটাকাঁটা মানুষ
বাতাসে পতাকার বিলাসী বিলাপ
সীমান্তের প্রকাশ্য নৈরাজ্যের কাছে
উড়ে যায় আত্মনির্জন মানুষের শব
দূরত্ব ঋণ নিয়ে সব রাত মরে গেলে শুধু
মানুষের পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র দেয়াল!


পয়গাম্বর

শুনেছি বাপ-দাদারা নাকি বেজায় গরীব আর
ঋণগ্রস্থ ছিলেন
রাক্ষুসে পেট গিলে নিত অনাহারী নাড়ি-ভুড়ি
ক্ষুধার্ত সূর্যের রঙ আর নদীর নাব্য মেখে তাদের
আঙুল হয়ে উঠত ধারালো ত‚র্যনিনাদ
এভাবেই সুতীক্ষ্ন উজ্জ্বলতায় পাকা ধান কাটতেন তারা
এখন বাপ-দাদারা বড়লোক হয়েছেন
ধারালো তাদের অস্ত্র ও আভিজাত্যের স্ফুলিঙ্গ
ধর্ষিতার বোঁটায় কামড় খেয়ে বলেন- বাতাবিলেবুর
বাম্পার ফলন!
ফণাধর সাপ প্রশ্নবোধক সুসজ্জায় সুন্দর- ম্লান
চেঁচায় নাগরিক, নারীবাদ,
হাঁসে উপাসনালয়, শাণঘর
কাঁদে রোবটবিজ্ঞান, শপিংমল
বেদগ্রন্থ ও শরীয়া মোতাবেক প্রকাশ্যে পয়গাম্বর
স্বৈরাচারী ছুঁড়ি পরম্পরায় খুন করো নিঃস্পৃহ
যোনিপথ ও নিরীহ নির্বিষ পালক!

**********************
সূত্রপাত

আমার কিশোরকালের মেয়েরা ঋতু দিয়ে বুক ঢাকত
আর খড়া দিয়ে চোখ
সূত্রমতে বর্ষায় তাদের জল থাকে না বুকে
নদীর যৌবনে বুকের ওড়নায় তুলে আনে মাছ
প্রথম চড়–ইভাতি এমন ওড়না পেতে বসা
আয়োজন থাকলেই এরপর থেকে
লালকিশোরির ওড়না খুঁজতে থাকি

কলেজি মেয়েরা মাদুর পেতে পিকনিক বানালে
ওড়না খুঁজতে গিয়ে তাদের বুকের দিকে তাকাই
একেকটি দুঃখী পর্বত যেন বুকের মধ্যেই ঘুমায়
মুঠো মুঠো আন্দোলনের ডাক
বুক থেকে বেরিয়ে আসে কণ্ঠসঙ্গীত
বাজে নিরাপদ সড়কের দাবি
বুকের মধ্যে কোটাবিরোধ দপদপিয়ে জ্বলে

আজ আগুনচাপ স্মৃতিশোক ঢেকে নিতে
মেয়েরা বুজি বুকের উপর ওড়না পেঁচিয়ে রাখে?
সেই থেকে আমিও নরম, লাজুক ঘাসফুল
কোথাও আর চড়–ইভাতি হলে ওড়না খুঁজি না
লেপ্টে গজা ঘাস-মাটিতে ফুটতে থাকি


পা দুটো পদ্মচিহ্নযুক্ত জন্মের দিকে

কয়েকটা পদ্মপাতার নিচে জমিয়ে রাখছি ঘুম
মাঝরাত্তিরে এসে আলো নিবিয়ে যাও
পুনরায় আলোর টানে হাটুঘেরে স্তব্ধ অন্ধকারের চোখ
বাইরে শ্রাবণের জল
কদমে চুপচুপ শহর ও মনমিয়া গ্রাম
ভিতরে খর চৈত্রের মত কারো বুক পুড়ে অপরাহ্নে,
ভিজে না।
সমস্তরাত পোষা বিড়ালের ম্যাও-
বুকের মাঠে কানঘেষে বকুল ঝড়া শব্দ
শব্দের বুকে আরও কিছু নৈঃশব্দ
সমস্তরাত কড় গুনছি আঙুলে আঙুলে
উপহারগুলো তুলে নাও গোপনে
হয়ত ফুটব পদ্মজাত হয়ে।

তাদের- যে দিনগুলো সঙ্কায় দ্যুদুল্যমান 

ওগো দুপুরশোকে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়
গৃহবন্দির গান গাইতে গাইতে গৃহে যাও
ফিরে চলো ব্যাথা ও ব্যাধির শুশ্রুষার দিকে
শোনো বোবা ঠোঁট- এই মর্মরে উদাসীন মানুষের কাছে হাত পেতে ভালোবাসা চেওনা'কো আর
মোহনীয় বুকজুড়ে মহামারি- শূন্যতার ঘ্রাণ
মনে হলো, তোমাদের পাশাপাশি আরও দুটি হাত
নিভৃতে একা একা এই রূপসী আঁধার
তুমি ভালো থাকো সুরভিত নদী
ভালো থাকো পূর্ণিমায় ঝলসানো চাঁদ

জিয়ারত

সিঁথানের কিনারে সাতভাঁজ করে আনি ক্ষুদা ও খবিসের সুচতুর দাঁত
আফিমে আমিষে ওরা সাজায় ভোজ-টেবিল
এবং ঘরবন্দি বহুবিধ সজ্জা আরাম কেদারায়
ফেরেশতার চুরি করা চালডালতেল বোবা হয়ে দেখে কঙ্কালের ক্ষুদা
বিপরীত খুলেছে সাগরলতা ডলফিনের প্রাঞ্জল নাচ
শহরের কাকচিল কুকুরেও জেনে গেছে তা
অথচ সব অনলাইনে গজিয়েছে প্রসন্ন শস্যের দান
ঘুমঘড়ি শুয়েছে পাশে। কবর ও শ্মশানের ঘুম নেই তবু
কারা যেন ছুটছে অই শতাব্দির দশদিক- দ্যাখো
তেল নেই। নুন নেই। চুলায় জ্বলেনি লাল আগুন
জ্বলজ্বলন্ত আধাঁরেও স্বেচ্ছায় যারা করোনাকে ছোঁয়
তারপর, জীবিতের জিয়ারত সেরে দলে দলে ঘরে আসে আলখেল্লা পরা অবাস্তব পৃথিবীর আয়ু

প্রচ্ছদ ও প্যাচাল

চোখের দূরবীনে ঘুমন্ত স্বপ্ন। শিশুগাছ।
লেবুপাতার আচ্ছন্ন হাওয়া দোল খায় ভেতরে।
টুপটুটিয়ে ঝরে শরণার্থী শিশির। বুকসেলফে কিছুটা আলোর আস্ফালন। মনে মনে একটি লাশ সিগারেটে আগুন ধরালো।
অদূর তাবুর নিচে শব্দবাগান। বসন্তের খইফোটা মুখ। কনকচাঁপার চাপাচাপা কিছু নিজস্ব ঘ্রাণ বইয়ের পাতায়, পাজরে। মুখ দেখে মনে হতে পাওে শ্বেতকরবী। পাঠক আসে,যায়। উল্টেপাল্টে খনন করে কবি ও কবিতার মধ্যস্থ অন্তরায়।
কী ভুলে বই খোলবার আগেই কয়েকশোবার মগ্ন হই প্রচ্ছদপৃষ্ঠায়। কে জানে এতোকাল বই নয়-
হুবহু দাম দিয়ে কিনেছি প্রচ্ছদ। কিংবা ভুলবশত প্রচ্ছদ ভরে আনি কবিদের যাবজ্জীবন।
কেউ একজন চেঁচায়: মানুষের মগজ সত্বেও মানুষের সঙ্গে বেমানান তুমি।
জানি বই নিগীর্ণ নয়। প্রচ্ছদে উঠে আসে যাবতীয় হিমরাতের হাড়গোড়। এরকমই কথা ছিলো যেন বৃক্ষ হয়ে জন্মাই।
বাড়ি ফিরে দেখি বহুদোষে মুদ্রিত ঘরগুলো না-ওড়ার শোক নিয়ে চিল হয়ে গেছে। তখন হঠাৎ মনে পড়ে আরেকজনের কথা।
বলেছিলো- দরজার রঙ সন্ন্যাস অথবা সমুদ্র হলে গাছেদের ঘর থাকতে নেই।

No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক