মুক্তগদ্য

শিল্প সাহিত্য ৭৬


ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়
শুভা গাঙ্গুলি

-আস্সালমআলায়কুম। ঈদ মুবারক আম্মি।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। ঈদ মুবারক তুমি কি আজই চলে যাচ্ছো আলি?
-ণবং সড়স, আজই যেতে হবে আমায়।
-তুমি আজ যেও না, যাওয়াটা পধহপবষ করো।
আলি জানে এটা আম্মার আদেশ, তাই কোনো কথা না বলে টিকিট রিফান্ড করতে চললো।
আম্মার এই ব্যাপারটা পরিবারের সবাই জানে, মাঝে মাঝে আম্মি এইরকম করেন, কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ করে জামা কাপড় পরে বের হয়ে যান, কোন আত্মীয়ের বাড়ী গিয়ে বলেন আজ খুব দরকার পড়লেও তোমরা বাড়ীর বাইরে যেও না।
প্রথমে লোকে গ্রাহ্য করেনি, পরে দেখেছে শুনলেই ভালো হোতো।

মায়েদের এই  ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অন্যান্যদের অপেক্ষা অনেক শক্তিশালী, তা পৃথিবীর ইতিহাসে বারংবার প্রমাণিত। তাই আমরা সিনেমায় যেমন দেখি, অনেক  অনেক দূরে সন্তানের বিপদের পূর্বভাসে মা বিচলিত। এই যে বিপদের পূর্বাভাসের  ইঙ্গিত পেয়ে সতর্ক হবার ইতিহাস এটা আমরা অনেক অনেক ইতর প্রাণীর মধ্যেও দেখে থাকি।

২০০৪ সালের সুনামীর মহাপ্রলয় আমরা দেখেছি, আন্দামান দীপপুঞ্জে এর প্রভাব ভয়ানক হয়েছিলো, প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলো এই প্রদূষণ বিহীন ছোটখাট দ্বীপপুঞ্জ, কিন্তু অবিশ্বাস্য ভাবে বেঁচে যায় সমস্ত বন্যপ্রাণী আর আদিবাসী জরোয়ারা, কারণ তাদের  বহুযুগ লব্ধ অভিজ্ঞতা  থেকে পাওয়া কিছু বিচিত্র অনুভ‚তি সাবধান করে দিয়েছিলো এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আগমনের খবর, আর শ্রীলঙ্কার পাতান্গালা বীচ এর ইয়ালা ন্যাশনাল পার্কেও কোন প্রাণীই হতাহত হয়নি মাত্র দুটো মহিষ ছাড়া তবে ষাট জন ট্যুরিস্ট মারা যায়, সময়মতো সরে যেতে পারেনি। ঠিক সেই সময়ই থাইল্যান্ড এর সমুদ্র উপকুলের এক হোটেলে এক ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী তার মাকে খুব উত্তেজিত ভাবে বলে সে নাকি স্কুলে শিখেছে যে সমুদ্রের জল যদি অস্বাভাবিক রকম পিছনে সরে, তাহলে নাকি ভীষণরকম বিপজ্জনক জলোচ্ছ¡াস হতে পারে। তখনি সেই মা তাঁর ছোট্ট মেয়ের কথা অবহেলা না করে, হোটেল ম্যানেজারকে সতর্ক করেন, ফলে হোটেল খালি করে সকলে অপেক্ষাকৃত  নিরাপদ জায়গায় চলে যান, একটু পরেই সুনামী সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়। আমরা দেখেছি যে কালবৈশাখী আসার পূর্বমুহুর্তে সমস্ত প্রকৃতি স্তব্ধ হয়ে যায়, গাঁয়ে গঞ্জে মানুষ বুঝতে পারে প্রকৃতির এই থমথমে ভাব, আসলে প্রবল কালৈশাখীর পূর্বাভাস, গল্পে সাহিত্যে এই কালবৈশাখীর পূর্বাভাস বিশেষ নৈপুন্য সহকারে নিবেদিত হয়ে থাকে।

উদাহরণ স্বরূপ, গল্পে সাহিত্যে এই অবস্থার ব্যবহার আমরা দেখে থাকি,
 “রমলার থমথমে মুখ দেখিয়া বিলাস বাবু চিন্তিত হইলেন, আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস, দরজা ঠেলিয়া ঘরে পদার্পণ করিবার উপক্রম করিতেই, বজ্রপাত হইলো, যেখান হইতে আসিয়াছো, সেইখানে ফিরিয়া যাও। আওয়াজ বহুদূর বিস্তৃত হইলো, পিছনের ঘর হইতে বিনয় ছুটিয়া আসিলো, বৌঠান দাদা খুঁড়িমার  বদ্যির সাথে চন্দ্রপুরে রাত্রিযাপন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন, অত:পর আজ প্রভাতে গোযানে ফিরিয়াছেন, ঘোমটা টানিয়া রমলা কহিলেন, তুমি যাও ঠাকুরপো।
ঘরে প্রবেশ করিবামাত্র প্রবল বর্ষণ শুরু হইলো, রমলা স্বামীর বক্ষে আছড়াইয়া পড়িয়া তারস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন,”

অতি পরিচিত বারংবার ব্যবহৃত গল্পের প্লট মাত্র। এই পর্যন্ত পড়িয়া আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারি যে সাংসারিক জীবনে, প্রকৃতির নিয়মে পূর্বাভাস আমাদের সতর্ক করিয়া দেয়, সামনে বিপদ, সুধী সাবধান। তাই ভাষাহীন প্রাণীদের আচম্বিতে চালচলনের পরিবর্তন কে অবহেলা করিবেন না। কুকুর, বিড়াল, বিশাল তিমিমাছ, সামান্য গোল্ডফিস, সামুদ্রিক কচ্ছপ ইহারা মনুষ্য জাতি অপেক্ষা অনেক বেশী শুনিতে, দেখতে ও বুঝিতে সক্ষম। উদাহরণ স্বরূপ আমরা বলিতে পারি অপার্থিব জগতের কার্যকলাপ কুকুর বেড়াল, ঘোড়া ইত্যাদি প্রাণী আগে হইতে টের পাইয়া মনিবকে সচেতন করিয়া দিয়েছে এবং কোথাও কোথাও মনিবের প্রাণ পর্যন্ত বাঁচাইয়াছে,

তাহলে একখানি সত্য কাহিনী শুনাইয়া আমার লেখা সমাপ্ত করিতেছি,
একদা এক গৃহ খরিদী করিয়া মালিক কথায় রাত্রি বাস করিতে গেলেন, রাত দুইটায় তাঁহার পোষ্য সারমেয় দরজার দিকে দেখিয়া তারস্বরে চিৎকার জুড়িলো, তিনি উঠিয়া কাহাকেও না দেখিয়া পুনরায় নিদ্রা যাইলেন।
দ্বিতীয় দিন দরজা দমাস করিয়া খুলিয়া গেলো। ধড় মড় করিয়া উঠিয়া বসিলেন, সারমেয় তারস্বরে চিৎকার করিয়া তাঁহাকে ঘর হইতে কাপড় কামড়াইড়া বাহির করিয়া আনিলো। মুহুর্ত পরে ছাদ হইতে বৃহৎ চাঙড়  ভাঙ্গিয়া পড়িলো। কুকুর টি কাহাকেও তাড়া করিয়া ঘর হইতে বাহির করিলো, পূর্বভাস সত্য প্রমাণিত হইলো!

রাসবিহারী দাস এত বলিয়া পুস্তক বন্ধ করিলেন,”


শিল্প সাহিত্য ৫৯

ভিতরমানুষ, সাইকোসিস ও মা
সাজ্জাদ সাঈফ

জ্যোৎস্নার থোকা থোকা আলোরহস্যে ডুবতেছে চারধার, আমরা দুজনে চুপ, যেনো ভারী এক পাথর দুইজনের হৃদপিন্ডরে তলায়ে দিতেছে কোনো অস্থিরতায়, দুইজনে চুপ।

দুইজনে মানে আমি আর সে, দুইটা রূপ এক আমি’র। মানে নিজের ভিতর কথা বলা না বলা আলোছায়ায় আরেক ‘আমি’ মুখোমুখি। অনেকদিন পর যেমন কোনো আত্মজিজ্ঞাসায় বিব্রত লাগে মানুষের, অতীত মনে করে। এই এক স্বগত জার্নি। কতোদিন আগেকার কথা। তখন মা বেঁচে ছিলেন। আমি ছিলাম ঘটিবাটিহীন বেকার। না কাজকাম, না প্রেমটেম, না প্রতিষ্ঠা। বন্ধুরা একে একে এখানে সেখানে থিতু হইতেছে তখন। আর মায়ের কারসিনোমা, বাবার স্ট্রেস। তমার বিয়ের সব ঠিকঠাক। একের পর এক চাকরিতে ইস্তফা আর বিজনেসে ল্যাং, সব মিলিয়ে আমি নিরুপায় বার্ডেন একটা।

সব কথা চুপচাপ ইশারায় বলে যাচ্ছে ভিতরমানুষ। আজকের জ্যোৎস্নায় কেমন একটা পাড়াবেড়ানি আবছায়া ভাব। সারাদিন সামান্থার পাশে ওর মাকে একটু পরপর ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখেছি, মন বিচিত্র সব এঙ্গেল থেকে দৃশ্যের পর দৃশ্য হাজির করতেছে মগজে। এই কয়দিন আগেই গ্রাম থেকে সামান্থার স্কুলের গ্রীস্মকালীন ছুটি কাটিয়ে ফিরলাম আমরা। আমাদের একমাত্র মেয়ে। ক্লাস নাইন। বাবার নিঃসঙ্গ মুখ রেখে আমরা ঢাকায় ফিরতেই মেয়ের জ্বর। মিতা এমনিতেই হাই সুগারে ভুগতেছে অনেকদিন, তার ওপর মেয়ের অসুখ বাঁধলে প্রচন্ড ঘাবড়ে যায়, জ্বর একবার নামে তো আরেকবার কাঁপুনি দিয়ে আসে, তড়িঘড়ি করে ডাক্তার-টেস্ট-এডমিশন, টাইফয়েড ফিভার।

মা-মেয়েকে নার্সিং হোমে রাতের খাবার খাইয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত গভীর এবং ততোধিক গম্ভীরও। মেয়ের জ্বর সামান্য নিয়ন্ত্রণে এলেও হঠাৎ কি জানি হলো ওর আচরণে, এই চুপ এই ক্ষিপ্ত, ঘুম উধাও, নিজের গায়ে আঘাত করতেছে তো কারণ ছাড়াই কেঁদে ফেলতেছে, ডাক্তারের বক্তব্য বলতেছে টাইফয়েড সাইকোসিস মানে টাইফয়েডজনিত মনোবৈকল্য। নিজের ভিতরমানুষটা চেঁচিয়ে ওঠে আমার। সাইকোসিস শব্দটা আমার পরিচিত, মায়ের শেষ কতোগুলা দিন এই শব্দে কাতর ছিলো মনে পড়তেছে বারবার।

কাল সকালে জমা দিতে হবে অফিস-রিপোর্ট। ল্যাপটপে ডাটা এন্ট্রি করতে বসতেই সেই ভিতরমানুষের পায়চারি বুকে। মাকে মনে পড়তেছে বারবার। টিভির ভলিউম কমিয়ে দিলাম। ইয়েমেনে সৌদী আগ্রাসন, আফ্রিকায় ইবোলা এন্ডেমিক, লক্ষ লক্ষ শরণার্থী নিয়ে বাংলাদেশ-মায়ানমার ক‚টনৈতিক টানাপোড়েন। মনে হইতেছে সমস্ত ফাঁদ গুটাইতেছে নিয়তি। মাকে মনে পড়তেছে।

মায়ের শেষযাত্রার সঙ্গী ছিলো সাইকোসিস, ভিতরে যেনো হাতুড়ি পিটাইতেছে কেউ, বুকে ধড়ফড় ভাব কাজ করতেছে, মা আমার আর মিতার বিয়ে মেনে নেন নাই শেষমেশ, সামান্থার জন্মের সময়টাও গোপণ রাখছিলাম আমরা, ততোদিনে মায়ের কারসিনোমা কোলন ধরা পড়ে গেছে, ডাক্তাররা কোলন ক্যান্সার বলে সিদ্ধান্ত নেয় কেমোথেরাপির, এই অবস্থায় মেয়ের জন্মের সংবাদও মাকে ক্ষিপ্ত করবে এই আশংকা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো। কেননা মা মৃত্যু অবধি মিতার মুখ দেখতে চাইতেছিলেন না। নিজের ভিতর অপরাধবোধ ভারী হচ্ছিলো আমারও।

সামান্থার চেহারাটা দিনকে দিন আম্মার চেহারার ধাঁচ নিতেছে, আজকাল আম্মার কথা মনে হইলেই মেয়ের মুখটা দেখি। মেয়ে আমার খুব জেদী হইছে, দাদীর মতন, একরোখা। আর মেয়ের সাইকোসিস মানে মনোবৈকল্য নিয়ে সারাদিন ঘাবড়ে থাকা মিতার খাওয়া দাওয়া এক প্রকার বন্ধের উপক্রম। আম্মার চেহারাটা ভাসতেছে তো আব্বার নিঃসঙ্গ বার্ধক্য, মেয়ের সাইকোসিস, চিন্তার ওজনে মাথাটারে শক্ত পাথর মনে হইতেছে আমার।

আমার ধর্মভীরু মা কি এইসব দেখতেছেন জ্যোৎস্নার ওই পাড় হতে? আর সাইকোসিস, আমার প্রতি মায়ের খেদ নাকি? মেয়ের মনোজগতে সেই খেদ আইসা জায়গা নিলো শেষে? মা আমাদের ক্ষমা করেন নাই লাস্টলি?

শিল্প সাহিত্য ৫৭

রেওয়াজ আছে প্রথার- সিংহভাগই কুপ্রথা, কুসংস্কার
এম. তামজীদ হোসাইন 

অন্য কেউ যেন আমাদের আচরণে কষ্ট না পায় এমন আচরণ করা উচিৎ। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কুসংস্কার, কুপ্রথা, অনৈতিক ঐতিহ্য এখনো চলমান রয়েছে। দেদারসে চলছে দুর্বলের ওপর সবলের চাপিয়ে দেওয়া ইচ্ছে। আমি বলবো সমাজে এসব বিদ্যমান কুপ্রথাগুলো ইঙ্গিত দেয় এটা আমাদের নিচু মন মানসিকতা।

বিবাহ প্রথায় এমন কিছু কুসংস্কার, কুপ্রথা প্রচলিত আছে যেগুলো সত্যি কখনো আমাদের মনের উৎকৃষ্টতার পরিচয় বহন করে না। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এসব প্রথা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ধর্মের দোহাই দিয়েও এসব প্রথা বলবৎ রাখতে এই অঞ্চলের মানুষ দ্বিধাবোধ করেন না। তারা খুব ভালো করেই জানে যে এসব ভণ্ডামি ছাড়া কিছুই নয়। তারপরও এসব কুসংস্কার, কুপ্রথার দৃষ্টান্ত তাদের কাছে অনেক মূল্যবান।

আগে শুনতাম মানুষ বউকে মারধর করে যৌতুকের জন্য। যৌতুক বিরোধী আইনের বাস্তবায়ন হচ্ছে দেখে সমাজের এসব কীটরা ভিন্ন উপায়ে যৌতুক প্রথা এখনো বলবৎ রেখেছে! মানুষের লোভের একটা সীমা থাকা উচিৎ। বিয়েকে আমরা যতই একটা শুভ কাজ বলি না কেন এর পেছনে কিছু মানুষের মাঝে লুকিয়ে থাকে কিছু অশুভ মতলব। এসব অশুভ মতলবের পেছনে দায়ী সমাজের এক শ্রেণির অসৎ কুশিক্ষিত মানুষরা। সংসার ভাঙ্গনের জন্য এসব অশুভ কাজগুলোই যথেষ্ট। যার সাধ্য আছে সে বিয়েতে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করুক তাতে কোন আপসোস বা আপত্তি নেই। কিন্তু যখন মেয়ে পক্ষ ছেলে পক্ষকে এবং ছেলে পক্ষ মেয়ে পক্ষকে চাপ সৃষ্টি করে কিছু আদায়ের চেষ্টা করেন তখন যতই সমঝোতায় এসে বিয়ে হউক না কেন দুই পক্ষের মধ্যে মনোমালিন্য কিন্তু সারাজীবন থেকেই যায়। সাধ্যের বাইরে গিয়ে অহেতুক খরচ করে বিয়ের পরও সমাজের কুসংস্কার, কুপ্রথার রেওয়াজের কথা বলে এটা সেটা চাওয়া এটা যে কতটা নিকৃষ্ট কাজ সত্যি উৎকৃষ্ট মনের না হলে কেউ বুঝবে না। এটা যে শুধু অযৌক্তিক চাওয়া তা না। এটা একটা জবাই করে ছিনতাই করারও নামান্তর নিকৃষ্ট কাজ।

উন্নত দেশের বিয়েতে সাধ্যমতো, মনের ইচ্ছে মতো যা করে তাতেই দু’পক্ষ খুশি থাকে। সেসব দেশে কুরবানির গরুর মতো বিয়েতে দর কশাকশি হয় না। আর আমরা আধুনিকতার কথা বলে বিয়েতে যতসব অপচয় করি। সারাজীবনের অর্জিত আয় পর্যন্ত বিয়েতে খরচ করতে হয় এমন অনেক সমাজ রয়েছে। শ্বশুর বাড়িতে মেয়ের সম্মানের কথা ভেবে চাপের মুখে পড়ে অনেক বাবাকে সব সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে নিঃস্ব হয়েছে এমনও অনেক নজির রয়েছে। আমাদের সমাজের মধ্যে এমনও নিকৃষ্ট সমাজ রয়েছে। এসব কাজ কিন্তু আড়ালে কেউ করে না। এসব নির্লজ্জ, অনৈতিক কার্যকলাপ আমাদের চোখের সামনেই অহরহ ঘটছে। সবাই এসবকে মাথা নিচু করে মেনে নিচ্ছি। রেওয়াজ আছে বা প্রচলন আছে ডায়ালগে চলছে এসব কর্মকাণ্ড। ভুক্তভোগী হচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ। এই কুসংস্কার, কুপ্রথার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে সমাজে ডিভোর্সের সংখ্যা দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে।

প্রচলিত এসব কুপ্রথা না মানলে নাকি সমাজের কাছে সম্মান থাকে না! অথচ যাদের কাছে অন্যায়ভাবে এটা সেটা চাওয়া হয় তাতে নাকি তাদের সম্মান বিনষ্ট হয় না। বরং এতে নাকি সম্মান তাদের আকাশচুম্বী হতে থাকে। নুন্যতম বিবেকবোধ থাকলে মানুষ এসব কাজ করতে পারে। সত্যি হাস্যকর হলেও এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। এসব যে ভণ্ডামি আমরা সবাই বুঝি। কিন্তু কেউ মানি না। এভাবে চলতে পারে না কোন সমাজ। সমাজ ব্যবস্থায় এমন কুপ্রথা ক্রমাগত চলছে বলেই দিনদিন মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ কমে যাচ্ছে। ছোটরা বড়দের সম্মান করে না কারণ বড়রা যে যার মতো যা খুশি তাই করছে। আদর্শিক মূল্যবোধ বলতে সমাজে কিছুই নেই। সবাই সবকিছু বুঝে। কিন্তু কেউ আদর্শিকভাবে পরিবর্তন হয়নি বলে সবাই বিপথগামী হচ্ছে। মহল্লায় বখাটে ছেলেকে শাসন করবে কে? এমন যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ হাতেগোনা কয়েকজন। সবার প্রতি একটাই অনুরোধ এমন রেওয়াজ আছে প্রথা মানতে গিয়ে নিজের আত্মসম্মানবোধকে হত্যা করবেন না। সুন্দর পরিবার, সমাজকে এভাবে গলা টিপে হত্যা করবেন না। যতটুকু পারেন সবাইকে সহযোগিতা করুন। অন্যের প্রতি সহমর্মিতা দেখান। তবেই সেই পুরনো সুখ, শান্তি আবারও ফিরে আসবে।

শিল্প সাহিত্য ৪৭  শনিবার ১৬ই জ্যৈষ্ঠ ১৪২৭, ৩০ই মে২০২০

চুপকথা

আতিকুর রহমান হিমু


অনেকগুলো দৃশ্য একটা শব্দের ভিতর আটকে পরে। শুরু হয় ঘোরকেমন যেন একটা জ্বর-জ্বর ভাবশরীরেরক্তে। নিজের সাথে কথাবলানিজের মুখোমুখি দাঁড়ানো। হৃদকম্পন বেড়ে যায়বুকের ধুকপুক। অদ্ভূত হীম আলো ডানা মেলে বোধে। এক চমকে সবগুলো পালক ঝরিয়ে মিলিয়ে যায় ধূসরেঅন্ধকারে। জলের শব্দপাখির পালকমাটির ঘ্রাণফুলের সুভাসনর্দমার পাশের অশ্লীল বাতাসডাস্টবিনের আশটে গন্ধ। অনেকগুলো মানুষউপমানুষতাদের জোড়ায় জোড়ায় চোখচোয়ালতাদের শরীরের রঙচুলের ভাঁজকথা বলার ধরণতাদের বিচিত্র রক্ত। কয়েক জন নারী তাদের চিবুক-চুল-স্তনতাদেরকে ঘিরে থাকা লোককথাতাদের চোখের অতলে লুকিয়ে রাখা রূপকথা। সব যেন কেমন একটা ছবি হয়ে যায়। বায়োবীয় ক্যানভাসে বিচিত্র সব রঙবিচিত্র শৈলীশিল্পকথার দীর্ঘ ইতিহাসের মতো গল্প। গল্পের ভেতরের গল্পগল্পের বাইরের গল্প। সব যেন কয়েকটি শব্দের একটা পংক্তির মধ্যে আটকে পরে। শুরু হয় ভাঙচুর ভেতরে ভেতরেবাতাসের শব্দেজলের শব্দেমেঘ  মানুষের শব্দেনদীর বয়ে যাবার শব্দেকান্না চোখ  সমুদ্রের শীল্পিত শব্দেআলো অথবা অন্ধকারের একটা ট্রেন প্রকাণ্ড শব্দে বোধের ভেতর দিয়ে ডুকে পরে হৃদপিণ্ডে। রক্তে রক্তে ছড়িয়ে পরে একটা গভীর অসুখ। এমন সব অসুখ কি লিখিয়ে নেয় কবিতা?

দৃশ্যালয়ে ভেসে ওঠে অতীকায় কোন কোন দুপুর। স্কুল ফেরা শৈশবদুলে ওঠা সাঁকোশৈশব বা তারও আগেকার সময়। মাতৃগর্ভের কাল আঁধারের যাপন চিত্রবা তারও আগের পিতার প্রজাপতি পর্ব। আবার ফিরে আসা প্রেমিকার গ্রীবার ভেতরপার্কের নির্জন বেঞ্চিতেচৌরাস্তার জ্যামেনগরীর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুখিসুখি চেহারার বারে। ব্যাপনে-সাঁতারে ঘুমিয়ে পরা। কোন এক গ্রামঝিঁঝিঁ ডাকা দুপুরএকজোড়া ধূসর ঘুঘুকয়েকটা চড়ুইসবুজ ঘাসে ঢাকা পথে পথে হেঁটে যাওয়া। হঠাৎ দূর্বার ভেতর থেকে লাফদিয়ে উঠে আসা খরগোসের মতো বেড়িয়ে পরে হারানো প্রেমিকের অবয়ব। হেঁটে যাওয়া এক সাথে জলের গভীরে। এক টুকরোআকাশকয়েকটা ছেড়া ছেড়া মেঘঅপেক্ষমান চৈত্রের চৌচিরভমি। জলেরতৃষ্ণা। মস্তিষ্কে আলো আর আঁধারের দ্বন্দ্বকিছু রেখারূপ-অরূপ। প্রার্থনায় মগ্ন হয় চোখ। জলের অপেক্ষায় অদৃশ্য ল্যান্ডস্কেপকখন নামবে ঝুমবৃষ্টি?

কবিতা  জীবন একই জিনিসের দুই রকম উৎসারণ

কবিতার কথা প্রবন্ধে জীবনানন্দ দাশ বলেন: ‘কোন প্রাক নির্দিষ্ট চিন্তা বা মতবাদেও জমাটদানা থাকেনা কবির মনে-কিংবা থাকলেও সেগুলোকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র করে থাকে কল্পনার আলো  আবেগকাজেই চিন্তা  সিদ্ধান্তপ্রশ্ন  মতবাদ প্রকৃত কবিতার ভিতর সুন্দরীর কটাক্ষের পিছনে শিরাউপশিরা  রক্তের কণিকার মতো লুকিয়ে থাকে যেন। লুকিয়ে থাকেকিন্তু নিবিষ্ট পাঠক তাদের সে সংস্থান অনুভব করেবুঝতে পারে যে তারা সংগতির ভিতর রয়েছেঅসংস্থিত পীড়া দিচ্ছেনাকবিতার ভিতর আনন্দ পাওয়া যায়জীবনের সমস্যা ঘোলা জলের মূষিকাঞ্জলির ভিতর শালিকের মতো স্নান না করে বরং যেন করে আসন্ন নদীর ভিতর বিকেলের শাদা রৌদ্রের মতোসৌন্দর্যও নিরাকরণের স্বাদ পায়!’

সৌন্দর্যের স্বাদ কেমনপ্রশ্নের ভেতর দিয়ে আবার তলিয়ে যাওয়া গভীরের গভীরে। নন্দনতত্ত¡কে কি কোন সংজ্ঞায় আটকানো যায়?

শ্যাওলা লাগা সব মুখ জলের অতল থেকে উঠে আসেআবার হারিয়ে যায়

জলের তলে। শান্ত দীঘিতে ঢিল ছুড়লে যেমন ঢেউ ওঠে আবার মিলিয়ে যায় জলজ ধ্যানে। মস্তিষ্কের গভীর থেকে উঠে আসা হাজার হাজার বছর আগেকার সব স্মৃতি। প্রস্তর যুগের পাহাড়ের গায়ে আঁকা আঁকিবুকিঅরণ্যচারী জীবন শিকারের দৃশ্যবলীজ্যোৎস্না রাতের জল কথা পুরুষ  রমণীর পরস্পরের ভিতর ডুকে পরা। নদীর কাছাকাছি আসা জলের সাথে নেমে যাওয়ামানচিত্র বদল। পলিমাটির ঘ্রাণে ঘুমিয়ে পরা রূপকথার সবুজে। বিগত শীত আর ঋতুবর্ষাকয়েকটা বসন্তঅতীত থেকে উঠে আসে এক টুকরো রাত। গাঙচিলের ডানা ঝিলধরা আকাশদূরের সব তারাতারাদের মৃত দৃশ্যমৃত তারাদের যাপিত জীবন। জীবন বদল। রাতের সব রঙমেঘ  শিশির। শিশির ভেজাঘাসঘাসের গন্ধহলুদ-নীল-বেগুনি ফুল। ঘাসফুলের ভিন্ন ভিন্ন রঙ ভিন্ন ভিন্ন কারুকাজ। যেন মগধ থেকে কৈলাশ-চাম্পা-কৌশাম্বী-মহামতী পেরিয়ে বুদ্ধের খুঁজে পাওয়া শ্রাবস্তির জেতবন। তারপর আবার ডুবে যাওয়া নিজের অতলে। ধূসর অতীত থেকে ব্যথিত বর্তমানে নয়সংকীর্ণ ভবিষৎ নয়এর বাইরে কোথাও চলে যাওয়া। হয়তো কোনো এক শূন্যতা সময়ের হিসেবে যা ধরে রাখা যায়না। এই যে লিখতে লিখতে যাওয়ামূলত নিজেকেই লিখা। সামন্ত যুগে মানুষ দেবতাদের যে গল্প লিখতো পদ্যে-শ্লোকে তা মূলত মানুষের গল্প। আর প্রাককাল থেকে চলে আসা শয়তানের উপকথাতাও মানুষের। গীতায়শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কর্মফল ত্যাগ করতে বলেছেন। গৌতমবুদ্ধ জানিয়েছেন নিবার্ণের পরম আনন্দ। শূন্য হয়ে মানুষ যখন ঈশ্বরকে কল্পনা করেন তখন মূলত সে নিজেকেই খুঁজে পায়- রূপে-অরূপে। এই রূপ-অরূপ চিত্রায়ণের আকাঙ্খায় কবি ডুব দেন নিজের অতলে।

আলো-আঁধারের অতল থেকে একটা শ্যাওলা লাগা ছায়া এসে দাগ কেঁটে যায় পাণ্ডুলিপিতে। কখনো হয়তো বা কবিতা হয়ে ওঠে তবুও একটা আকাঙ্খা থেকে যায়পূর্ণতায়। নিজের অতলের নিবিড় শূন্যতাকে ধরার জন্যই মানুষ নতজানু হয় নিজের কাছেমগ্ন হয় শিল্পের আলো অথবা আঁধারে.....

একটা উজ্জ্বল পঙক্তি জন্ম নেয়। একটা কবিতার ভ্রমণ বাড়তে থাকে বোধে।


1 comment:

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক