শিল্প সাহিত্য ৭৬
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়
শুভা গাঙ্গুলি
-আস্সালমআলায়কুম। ঈদ মুবারক আম্মি।-ওয়ালাইকুম আসসালাম। ঈদ মুবারক তুমি কি আজই চলে যাচ্ছো আলি?-ণবং সড়স, আজই যেতে হবে আমায়।-তুমি আজ যেও না, যাওয়াটা পধহপবষ করো।আলি জানে এটা আম্মার আদেশ, তাই কোনো কথা না বলে টিকিট রিফান্ড করতে চললো।আম্মার এই ব্যাপারটা পরিবারের সবাই জানে, মাঝে মাঝে আম্মি এইরকম করেন, কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ করে জামা কাপড় পরে বের হয়ে যান, কোন আত্মীয়ের বাড়ী গিয়ে বলেন আজ খুব দরকার পড়লেও তোমরা বাড়ীর বাইরে যেও না।প্রথমে লোকে গ্রাহ্য করেনি, পরে দেখেছে শুনলেই ভালো হোতো।
মায়েদের এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অন্যান্যদের অপেক্ষা অনেক শক্তিশালী, তা পৃথিবীর ইতিহাসে বারংবার প্রমাণিত। তাই আমরা সিনেমায় যেমন দেখি, অনেক অনেক দূরে সন্তানের বিপদের পূর্বভাসে মা বিচলিত। এই যে বিপদের পূর্বাভাসের ইঙ্গিত পেয়ে সতর্ক হবার ইতিহাস এটা আমরা অনেক অনেক ইতর প্রাণীর মধ্যেও দেখে থাকি।
২০০৪ সালের সুনামীর মহাপ্রলয় আমরা দেখেছি, আন্দামান দীপপুঞ্জে এর প্রভাব ভয়ানক হয়েছিলো, প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলো এই প্রদূষণ বিহীন ছোটখাট দ্বীপপুঞ্জ, কিন্তু অবিশ্বাস্য ভাবে বেঁচে যায় সমস্ত বন্যপ্রাণী আর আদিবাসী জরোয়ারা, কারণ তাদের বহুযুগ লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া কিছু বিচিত্র অনুভ‚তি সাবধান করে দিয়েছিলো এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আগমনের খবর, আর শ্রীলঙ্কার পাতান্গালা বীচ এর ইয়ালা ন্যাশনাল পার্কেও কোন প্রাণীই হতাহত হয়নি মাত্র দুটো মহিষ ছাড়া তবে ষাট জন ট্যুরিস্ট মারা যায়, সময়মতো সরে যেতে পারেনি। ঠিক সেই সময়ই থাইল্যান্ড এর সমুদ্র উপকুলের এক হোটেলে এক ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী তার মাকে খুব উত্তেজিত ভাবে বলে সে নাকি স্কুলে শিখেছে যে সমুদ্রের জল যদি অস্বাভাবিক রকম পিছনে সরে, তাহলে নাকি ভীষণরকম বিপজ্জনক জলোচ্ছ¡াস হতে পারে। তখনি সেই মা তাঁর ছোট্ট মেয়ের কথা অবহেলা না করে, হোটেল ম্যানেজারকে সতর্ক করেন, ফলে হোটেল খালি করে সকলে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায় চলে যান, একটু পরেই সুনামী সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়। আমরা দেখেছি যে কালবৈশাখী আসার পূর্বমুহুর্তে সমস্ত প্রকৃতি স্তব্ধ হয়ে যায়, গাঁয়ে গঞ্জে মানুষ বুঝতে পারে প্রকৃতির এই থমথমে ভাব, আসলে প্রবল কালৈশাখীর পূর্বাভাস, গল্পে সাহিত্যে এই কালবৈশাখীর পূর্বাভাস বিশেষ নৈপুন্য সহকারে নিবেদিত হয়ে থাকে।
উদাহরণ স্বরূপ, গল্পে সাহিত্যে এই অবস্থার ব্যবহার আমরা দেখে থাকি, “রমলার থমথমে মুখ দেখিয়া বিলাস বাবু চিন্তিত হইলেন, আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস, দরজা ঠেলিয়া ঘরে পদার্পণ করিবার উপক্রম করিতেই, বজ্রপাত হইলো, যেখান হইতে আসিয়াছো, সেইখানে ফিরিয়া যাও। আওয়াজ বহুদূর বিস্তৃত হইলো, পিছনের ঘর হইতে বিনয় ছুটিয়া আসিলো, বৌঠান দাদা খুঁড়িমার বদ্যির সাথে চন্দ্রপুরে রাত্রিযাপন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন, অত:পর আজ প্রভাতে গোযানে ফিরিয়াছেন, ঘোমটা টানিয়া রমলা কহিলেন, তুমি যাও ঠাকুরপো।ঘরে প্রবেশ করিবামাত্র প্রবল বর্ষণ শুরু হইলো, রমলা স্বামীর বক্ষে আছড়াইয়া পড়িয়া তারস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন,”
অতি পরিচিত বারংবার ব্যবহৃত গল্পের প্লট মাত্র। এই পর্যন্ত পড়িয়া আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারি যে সাংসারিক জীবনে, প্রকৃতির নিয়মে পূর্বাভাস আমাদের সতর্ক করিয়া দেয়, সামনে বিপদ, সুধী সাবধান। তাই ভাষাহীন প্রাণীদের আচম্বিতে চালচলনের পরিবর্তন কে অবহেলা করিবেন না। কুকুর, বিড়াল, বিশাল তিমিমাছ, সামান্য গোল্ডফিস, সামুদ্রিক কচ্ছপ ইহারা মনুষ্য জাতি অপেক্ষা অনেক বেশী শুনিতে, দেখতে ও বুঝিতে সক্ষম। উদাহরণ স্বরূপ আমরা বলিতে পারি অপার্থিব জগতের কার্যকলাপ কুকুর বেড়াল, ঘোড়া ইত্যাদি প্রাণী আগে হইতে টের পাইয়া মনিবকে সচেতন করিয়া দিয়েছে এবং কোথাও কোথাও মনিবের প্রাণ পর্যন্ত বাঁচাইয়াছে,
তাহলে একখানি সত্য কাহিনী শুনাইয়া আমার লেখা সমাপ্ত করিতেছি,একদা এক গৃহ খরিদী করিয়া মালিক কথায় রাত্রি বাস করিতে গেলেন, রাত দুইটায় তাঁহার পোষ্য সারমেয় দরজার দিকে দেখিয়া তারস্বরে চিৎকার জুড়িলো, তিনি উঠিয়া কাহাকেও না দেখিয়া পুনরায় নিদ্রা যাইলেন।দ্বিতীয় দিন দরজা দমাস করিয়া খুলিয়া গেলো। ধড় মড় করিয়া উঠিয়া বসিলেন, সারমেয় তারস্বরে চিৎকার করিয়া তাঁহাকে ঘর হইতে কাপড় কামড়াইড়া বাহির করিয়া আনিলো। মুহুর্ত পরে ছাদ হইতে বৃহৎ চাঙড় ভাঙ্গিয়া পড়িলো। কুকুর টি কাহাকেও তাড়া করিয়া ঘর হইতে বাহির করিলো, পূর্বভাস সত্য প্রমাণিত হইলো!
রাসবিহারী দাস এত বলিয়া পুস্তক বন্ধ করিলেন,”
শিল্প সাহিত্য ৫৯
সাজ্জাদ সাঈফ
শিল্প সাহিত্য ৫৭
রেওয়াজ আছে প্রথার- সিংহভাগই কুপ্রথা, কুসংস্কার
এম. তামজীদ হোসাইন
শিল্প সাহিত্য ৪৭ শনিবার ১৬ই জ্যৈষ্ঠ ১৪২৭, ৩০ই মে২০২০
চুপকথা
আতিকুর রহমান হিমু
অনেকগুলো দৃশ্য একটা শব্দের ভিতর আটকে পরে। শুরু হয় ঘোর, কেমন যেন একটা জ্বর-জ্বর ভাব; শরীরে, রক্তে। নিজের সাথে কথাবলা, নিজের মুখোমুখি দাঁড়ানো। হৃদকম্পন বেড়ে যায়; বুকের ধুকপুক। অদ্ভূত হীম আলো ডানা মেলে বোধে। এক চমকে সবগুলো পালক ঝরিয়ে মিলিয়ে যায় ধূসরে; অন্ধকারে। জলের শব্দ, পাখির পালক, মাটির ঘ্রাণ, ফুলের সুভাস, নর্দমার পাশের অশ্লীল বাতাস, ডাস্টবিনের আশটে গন্ধ। অনেকগুলো মানুষ, উপমানুষ, তাদের জোড়ায় জোড়ায় চোখ, চোয়াল, তাদের শরীরের রঙ, চুলের ভাঁজ, কথা বলার ধরণ, তাদের বিচিত্র রক্ত। কয়েক জন নারী তাদের চিবুক-চুল-স্তন, তাদেরকে ঘিরে থাকা লোককথা, তাদের চোখের অতলে লুকিয়ে রাখা রূপকথা। সব যেন কেমন একটা ছবি হয়ে যায়। বায়োবীয় ক্যানভাসে বিচিত্র সব রঙ, বিচিত্র শৈলী, শিল্পকথার দীর্ঘ ইতিহাসের মতো গল্প। গল্পের ভেতরের গল্প, গল্পের বাইরের গল্প। সব যেন কয়েকটি শব্দের একটা পংক্তির মধ্যে আটকে পরে। শুরু হয় ভাঙচুর ভেতরে ভেতরে; বাতাসের শব্দে, জলের শব্দে, মেঘ ও মানুষের শব্দে, নদীর বয়ে যাবার শব্দে, কান্না চোখ ও সমুদ্রের শীল্পিত শব্দে- আলো অথবা অন্ধকারের একটা ট্রেন প্রকাণ্ড শব্দে বোধের ভেতর দিয়ে ডুকে পরে হৃদপিণ্ডে। রক্তে রক্তে ছড়িয়ে পরে একটা গভীর অসুখ। এমন সব অসুখ কি লিখিয়ে নেয় কবিতা?
দৃশ্যালয়ে ভেসে ওঠে অতীকায় কোন কোন দুপুর। স্কুল ফেরা শৈশব, দুলে ওঠা সাঁকো, শৈশব বা তারও আগেকার সময়। মাতৃগর্ভের কাল আঁধারের যাপন চিত্র; বা তারও আগের পিতার প্রজাপতি পর্ব। আবার ফিরে আসা প্রেমিকার গ্রীবার ভেতর, পার্কের নির্জন বেঞ্চিতে, চৌরাস্তার জ্যামে, নগরীর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুখিসুখি চেহারার বারে। ব্যাপনে-সাঁতারে ঘুমিয়ে পরা। কোন এক গ্রাম, ঝিঁঝিঁ ডাকা দুপুর, একজোড়া ধূসর ঘুঘু, কয়েকটা চড়ুই, সবুজ ঘাসে ঢাকা পথে পথে হেঁটে যাওয়া। হঠাৎ দূর্বার ভেতর থেকে লাফদিয়ে উঠে আসা খরগোসের মতো বেড়িয়ে পরে হারানো প্রেমিকের অবয়ব। হেঁটে যাওয়া এক সাথে জলের গভীরে। এক টুকরোআকাশ, কয়েকটা ছেড়া ছেড়া মেঘ; অপেক্ষমান চৈত্রের চৌচিরভ‚মি। জলেরতৃষ্ণা। মস্তিষ্কে আলো আর আঁধারের দ্বন্দ্ব; কিছু রেখা, রূপ-অরূপ। প্রার্থনায় মগ্ন হয় চোখ। জলের অপেক্ষায় অদৃশ্য ল্যান্ডস্কেপ; কখন নামবে ঝুমবৃষ্টি?
“কবিতা ও জীবন একই জিনিসের দুই রকম উৎসারণ”
‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধে জীবনানন্দ দাশ বলেন: ‘কোন প্রাক নির্দিষ্ট চিন্তা বা মতবাদেও জমাটদানা থাকেনা কবির মনে-কিংবা থাকলেও সেগুলোকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র করে থাকে কল্পনার আলো ও আবেগ; কাজেই চিন্তা ও সিদ্ধান্ত, প্রশ্ন ও মতবাদ প্রকৃত কবিতার ভিতর সুন্দরীর কটাক্ষের পিছনে শিরা, উপশিরা ও রক্তের কণিকার মতো লুকিয়ে থাকে যেন। লুকিয়ে থাকে; কিন্তু নিবিষ্ট পাঠক তাদের সে সংস্থান অনুভব করে; বুঝতে পারে যে তারা সংগতির ভিতর রয়েছে, অসংস্থিত পীড়া দিচ্ছেনা; কবিতার ভিতর আনন্দ পাওয়া যায়; জীবনের সমস্যা ঘোলা জলের মূষিকাঞ্জলির ভিতর শালিকের মতো স্নান না করে বরং যেন করে আসন্ন নদীর ভিতর বিকেলের শাদা রৌদ্রের মতো, সৌন্দর্যও নিরাকরণের স্বাদ পায়!’
সৌন্দর্যের স্বাদ কেমন? প্রশ্নের ভেতর দিয়ে আবার তলিয়ে যাওয়া গভীরের গভীরে। নন্দনতত্ত¡কে কি কোন সংজ্ঞায় আটকানো যায়?
শ্যাওলা লাগা সব মুখ জলের অতল থেকে উঠে আসে; আবার হারিয়ে যায়
জলের তলে। শান্ত দীঘিতে ঢিল ছুড়লে যেমন ঢেউ ওঠে আবার মিলিয়ে যায় জলজ ধ্যানে। মস্তিষ্কের গভীর থেকে উঠে আসা হাজার হাজার বছর আগেকার সব স্মৃতি। প্রস্তর যুগের পাহাড়ের গায়ে আঁকা আঁকিবুকি, অরণ্যচারী জীবন শিকারের দৃশ্যবলী; জ্যোৎস্না রাতের জল কথা পুরুষ ও রমণীর পরস্পরের ভিতর ডুকে পরা। নদীর কাছাকাছি আসা জলের সাথে নেমে যাওয়া; মানচিত্র বদল। পলিমাটির ঘ্রাণে ঘুমিয়ে পরা রূপকথার সবুজে। বিগত শীত আর ঋতুবর্ষা, কয়েকটা বসন্ত; অতীত থেকে উঠে আসে এক টুকরো রাত। গাঙচিলের ডানা ঝিলধরা আকাশ, দূরের সব তারা, তারাদের মৃত দৃশ্য; মৃত তারাদের যাপিত জীবন। জীবন বদল। রাতের সব রঙ, মেঘ ও শিশির। শিশির ভেজাঘাস, ঘাসের গন্ধ, হলুদ-নীল-বেগুনি ফুল। ঘাসফুলের ভিন্ন ভিন্ন রঙ ভিন্ন ভিন্ন কারুকাজ। যেন মগধ থেকে কৈলাশ-চাম্পা-কৌশাম্বী-মহামতী পেরিয়ে বুদ্ধের খুঁজে পাওয়া শ্রাবস্তির জেতবন। তারপর আবার ডুবে যাওয়া নিজের অতলে। ধূসর অতীত থেকে ব্যথিত বর্তমানে নয়, সংকীর্ণ ভবিষৎ নয়; এর বাইরে কোথাও চলে যাওয়া। হয়তো কোনো এক শূন্যতা সময়ের হিসেবে যা ধরে রাখা যায়না। এই যে লিখতে লিখতে যাওয়া; মূলত নিজেকেই লিখা। সামন্ত যুগে মানুষ দেবতাদের যে গল্প লিখতো পদ্যে-শ্লোকে তা মূলত মানুষের গল্প। আর প্রাককাল থেকে চলে আসা শয়তানের উপকথা, তাও মানুষের। গীতায়শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কর্মফল ত্যাগ করতে বলেছেন। গৌতমবুদ্ধ জানিয়েছেন নিবার্ণের পরম আনন্দ। শূন্য হয়ে মানুষ যখন ঈশ্বরকে কল্পনা করেন তখন মূলত সে নিজেকেই খুঁজে পায়- রূপে-অরূপে। এই রূপ-অরূপ চিত্রায়ণের আকাঙ্খায় কবি ডুব দেন নিজের অতলে।
আলো-আঁধারের অতল থেকে একটা শ্যাওলা লাগা ছায়া এসে দাগ কেঁটে যায় পাণ্ডুলিপিতে। কখনো হয়তো বা কবিতা হয়ে ওঠে তবুও একটা আকাঙ্খা থেকে যায়; পূর্ণতায়। নিজের অতলের নিবিড় শূন্যতাকে ধরার জন্যই মানুষ নতজানু হয় নিজের কাছে; মগ্ন হয় শিল্পের আলো অথবা আঁধারে.....
একটা উজ্জ্বল পঙক্তি জন্ম নেয়। একটা কবিতার ভ্রমণ বাড়তে থাকে বোধে।
অসাধারণ লিখেছেন
ReplyDelete