Tuesday, June 30, 2020

শিল্প সাহিত্য ৭৮


মঙ্গলবার ১৬ই আষাঢ় ১৪২৭, ৩০ই জুন ২০২০




কবিতা
নাদিম সিদ্দিকী
রুদ্ধশ্বাস

এই মৃত্যু-মিছিলের দেশে এই কালো মেঘের শহরে
হয়তো একদিন বেলা আড়াইটা বাজবে
একদিন মিডিয়ার হাজারো কর্মী মাইক্রোফোন হাতে
অধির আগ্রহে ভিড় করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে
টিভির সামনে চেয়ে থাকবে পুরো দেশ
কী হতে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পর!
ভাবতে গিয়ে যেন নিশ্বাস আঁটকে যাচ্ছে সবার
কী হতে যাচ্ছে
কী হতে যাচ্ছে এই মৃত্যু-মিছিলের দেশে!

নিশ্চুপ রাতের শেষে যেমন আসে সোনালী প্রভাত
তেমনি একদিন উল্লাসের বার্তা হাতে
আসবেন ডা. মীরজাদী সেব্রিনা।
এ কোনো গণ-অভ্যুত্থানের ব্রিফিং নয়
নয় কোনো টেরোরিস্ট গোষ্ঠীর আত্মসমর্পণের
এ ব্রিফিং জীবনের সাথে মৃত্যুর অনিবার্য যুদ্ধের
তার দিকে চেয়ে থাকবে পুরো দেশ।
সমবেত সকলের উদ্দেশ্যে তিনি বলবেন-
“বিগত চৌদ্দ দিনে দেশে কোনো
কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় নি।”

বলামাত্রই যেন অশ্রুপাতে সিক্ত হবে তার চোখ
অজান্তেই ঝাপসা হয়ে আসবে বৃদ্ধ বাবার চশমার কাঁচ
মাস্ক খুলে সন্তানের কপালে মা খাবে স্নেহের চুমু
শহর জুড়ে ছুঁটবে বিজয় মিছিল
সম্মুখ যোদ্ধাদের সম্মানে উড়ে যাবে যুদ্ধ বিমান।

এই মৃত্যুমিছিলের দেশে এই কালো মেঘের শহরে
হয়তো একদিন বেলা আড়াইটা বাজবে
শাহবাগ পরিবাগ চষে বেড়াবে পাগল প্রেমিক
টিএসসি’র মোরে চায়ের কাপে উঠবে ঝর
কিন্তু, সেদিন আমি বেঁচে থাকবো তো!
বেঁচে থাকবে তো স্বপ্নের বাংলাদেশ!
একদিন যেথায় মেলেছে ডানা ভয়হীন শৈশব।

মো. আরিফুল হাসান 
নীল নক্ষত্র থেকে

নীল নক্ষত্র থেকে আমাদের মুখোমুখী
জলজজীবন, না তৃষ্ণা না ছায়াপথ

তুমি পান্ডুলিপি ভুল কর জানলে আগামী
সারল্যে আমরাও সবুজ আর অপেক্ষার
বিস্ফোরণ ভাবতে ভাবতে তুমি পাখি।

না আগামীর লাবণ্য নয়, তুমি বিস্ময়
বিভাতুর। যেনো তুমি জানতেও পারোনি

তন্ময় বিশ্বাস
অলেখা-অদৃষ্ট

স্রোত উঠেছে -
অভিজ্ঞানহীন!

হিমচাঁপা ফুল ঝরে গেছে বসন্তের আগে!
অভিমানী স্রোতে!

বেদনার মানচিত্রে এখন আকাশ পরিষ্কার।
করোনার নিশানায় শুধু চিৎকার-হাহাকার!

ঈৃথিবী থেকে ক্রমে ঝরে যায়- ওম, লতানো বাতাস
সিন্দুক থেকে চুরি যায় নকশিকাঁথা, যাবতীয় উচ্ছ্বাস!

কোথায় ঠিকানা লুকিয়ে রেখেছ অভীষ্টের?
যেখান দৃশ্যমান বলিরেখাগুলি জড়ো হয়-
লেখা হয়
রক্তাক্ত-অদৃষ্টের!

আহাদ উল্যাহ
হিম হাত

দুটো হিম হাত ঘাড় জড়িয়ে।
ভোর রাতে  যখন বৃষ্টির জল
অবিরাম ঝরে পড়ে পাতা বাহারের
পাতায়। ঘুমের ভিতর জেগে উঠে চেতনা। কাল ঘুমের
মায়াবী কুয়াশা থেকে থেকে
জমে আছে ঘোলা জলের
মত। ধূসর পাথর, সাদা হাড়।
শীতল সাপের মত আমার
ঘাড় জড়িয়ে দুটি হিম হাত।

সাব্বির হোসেন 
দাবি

কিছুক্ষণের জন্য আমায় তোমরা নিষিদ্ধ কর
আমি মুখ খুলে চিৎকার করে বলতে চাই
আর কালো চশমা পরে নয়
মানবতার চোখ দিয়ে পড়তে চাই জীবন সমীকরণ।

জং ধরা কলমের খোঁচায় লিখতে চাই
স্বাধীন বর্ণমালা
লিখতে চাই - আমিও বাঁচতে চাই, আমাকে বাঁচতে দাও
আমি বিশ্বাস করি এ ধরণী আমার পাঠশালা।

ভাষান্তর: কায়েস সৈয়দ
মূল: পাবলো পিকাসো
৮-৯ নভেম্বর ৩৫

বুলফাইটারের
বিদ্যুতালোর
বাল্বজ্যাকেট
অনুস্যূত হয়
সূক্ষ্ম সুইয়ের দ্বারা

কুহেলিকা
উদ্ভাবিত
ষাঁড়ের দ্বারা

১৪ নভেম্বর ৩৫

ইউজেনিয়ার সুগন্ধ
গিটারের তারের
ছোট্ট নিজস্ব প্রার্থনালয়
আচ্ছাদিত
পোস্তদানা
কালো
পান্নায়

২৪ মার্চ ৩৫

পানপাত্র
করপত্র
আমার স্ত্রী
উৎফুল্ল
সশব্দে হাসা সিকতা

২ জুলাই ৩৮

বিন্দু
বিন্দু করে
ফ্যাকাশে নীল
খসে পড়ে
গোলাপের জালিগুলোতে
সবুজ কাজুবাদামের নখাঘাতে

৬ অক্টোবর ৩৬

৩০ এপ্রিল ক্যানভাস # ১৫ ফুট চিত্রশিল্পে মেয়েটি আয়নায় দেখছে নিজেকে
নিচে রাখে একটি চিরুনি কিছু চুল এর দাঁতে এবং তার চুলের মধ্যে কিছু উকুন
পাশাপাশি কিছু উকুন এবং যদি সম্ভব হয় তার প্রকাশ্য চুলে কয়েকটা চুলের কাঁকড়া
(পরিকল্পনায় যুক্ত করতে মনোমুগ্ধকর চিন্তা)

ধারাবাহিক গল্প: দ্বিতীয় অংশ
সে রাতে কেউ ছিলনা
আপন রহমান

সব ভুলে খাওয়া শুরু করে দিয়েছো। তুমি একবার ভেবেও দেখলে না। খাবারটা ভালো নাকি, মন্দ, তবে আমি জানি তোমার খাবারের ক্ষুধাটা মিটে গেলেই তোমার আর একটা ক্ষুধা পাবে। সেটা হলো ইরার ক্ষুধা। তোমার সঙ্গীর ক্ষুধা’। আমি চারিদিকে তাকাতে লাগলাম কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে পেলাম না। আমি প্রশ্ন করলাম আপনি কে? আপনাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন? তিনি সেই অদ্ভুত লোকটার মত খিক্ খিক্ করে হাসতে হাসতে বলল আমাকে তো তুমি দিনে দেখতে পাবে না বৎস। রাতে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে। তখন তুমি সব কিছু জানতে পারবে। নানা ধরনের চিন্তা ভয় আর মুক্তির পথ খুঁজতে-খুঁজতে দিন ফুরিয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করলাম রুম থেকে বের হওয়ার কোন ফল হলো না। দরজা জানালা গুলো যেন লোহাও নয় তার থেকে কঠিন কোন পদার্থ দিয়ে তৈরি, ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এলো। আমি যেন হারিয়ে যেতে থাকলাম। গভীর অন্ধকার আচ্ছন্ন কোন ভিন্ন জগতে। সে অন্ধকার এতই গভীর ছিল যে জাগতিক সকল অন্ধকার তার কাছে তুচ্ছ। আমি বসে আছি। চুপ চাপ বসে আছি। হঠাৎ প্রচন্ড একটা শব্দে দরজাটা খুলে গেল। দরজার দিকে আমার চোখ যেতেই প্রচন্ড এক আনন্দের ঢেউ খেলে উঠলো আমার হৃদয়ে। আরে এ দেখি ইরা! নীল শাড়ী, নীল চুড়ি, নীল টিপে অপরূপ সুন্দর লাগছে তাকে। তার সমস্ত শরীর দিয়ে বের হচ্ছে এক অদ্ভুত আলোক রশ্মি। সে রশ্মিতে মুহুর্তে আলোকিত হয়ে গেল সমস্ত অন্ধকার। ইরা হাসছে। চমৎকার ভঙ্গিতে আমার দিকে চেয়ে হাসছে সে। ওকে দেখে মুহুর্তের মধ্যে আমি ভুলে গেলাম এ কয়টাদিন আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাগুলোর কথা। আমি দৌড়ে গোলাম দরজার কাছে, কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার, আমি ইরাকে দেখতে পাচ্ছি কিন্তু স্পর্শ করতে পারছিনা। আমি ইরার সমস্ত শরীরের উপর হাত বুলাচ্ছি, কিন্তু তার কোন স্পর্শ অনুভব করছি না। ছায়ার উপর হাত বুলালে যেমনটা ঘটে ঠিক তেমনই। স্পষ্ট একটা মানুষকে আমি দেখছি। তাকে ছোঁয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছি। কিন্তু ছুঁতে পারছি না। কী এক অস্বস্তিকর অবস্থা। হঠাৎ আবার সেই অদ্ভুত হাসির শব্দ খিক্ খিক্ খিক্ তুই ভুল করছিস বালক। ও তোর ইরা নয়। ওটা ছায়ামূর্তি। খিক্ খিক্ খিক্ । ছায়ামূর্তি ? তাহলে ইরা, ইরা কোথায় ? ইরা’কে চাস বালক? আমি জানি তুই ইরাকে খুব ভালোবাসিস। তাহলে যা বিরামপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক গোপীনাথ বাবুর কাছে যা। উনিই তোকে ইরার সন্ধান দিতে পারবে। তুই আজ এ ভ‚ত চক্র থেকে মুক্ত। ভ‚তচক্র! সেটা আবার কী ? অত কিছু জানতে চাস না, বালক বিপদ হবে। যা তুই চলে যা, খিক্ খিক্ খিক্। তারপর বিরামপুর আর আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে কেটে গেল অনেক দিন। অদ্ভুত লোকটা আমাকে শুধু বিরামপুর আর আপনার নাম বলেছেন। আর কোন কিছু বলেননি। এদেশে বেশ কয়টি বিরামপুর আছে। খেয়ে না খেয়ে পাগলের মত ঘুরেছি এসব বিরামপুরে খুঁজতে-খুঁজতে আজ সৌভাগ্য ক্রমে পেয়ে গেছি আপনার দেখা। শুরুতে আপনার সঙ্গে একটু বেয়াদবি করছি, এজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী! আসলে ছেলেবেলা থেকেই চরম বিপদ কিংবা দুঃখের মধ্যে আমার মধ্যে কি যেন একটা ঢুকে যায় আর তখনই আমি সকলের সাথে মজা করতে থাকি। তখন দুঃখ কিংবা বিপদ বেমালুম ভুলে যাই। আমার নানী বলতেন আমার উপর নাকি দুষ্টু জিনের আছর আছে। আমি অবশ্য ওসব মানিটানি না। দয়া করে আমার বেয়াদবি ক্ষমা করে আমাকে ইরার সন্ধানটা বলুন জনাব। নীলয়ের কথা শুনতে শুনতে মাষ্টার মশাই অনেকবার গোপনে চোখ মুচেছেন। এটা সে খেয়াল করেছে খুব ভালো ভাবেই। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি মাষ্টার মশাই কেন এমন করছে ? আবার প্রশ্ন করে তাকে বিব্রত করতেও চাইনি। -এতক্ষণ নীলয়ের কথা গুলো তিনি মনোযোগ সহকারে শুনলেন। তারপর কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলেন। হঠাৎ নীরবতা ভেঙ্গে তিনি বলা শুরু করলেন আর এক লোমহর্ষক কাহিনী। ইরা চক্রবর্তী; আমার একমাত্র মেয়ে। একমাত্র সন্তানও, ওর জন্মের সময় ওর মা মারা যায়। তখন আমার বয়স ত্রিশ ছুঁই-ছুঁই। পরিবারের অনেকের পীড়া-পীড়ি সত্ত্বেও ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আর দ্বিতীয় বিয়ের কথা চিন্তা করিনি। তখন সবে নতুন চাকরিতে যোগদান করেছি। (চলবে...)

Monday, June 29, 2020

শিল্প সাহিত্য ৭৭


সোমবার ১৫ই আষাঢ় ১৪২৭, ২৯ই জুন ২০২০




কবিতা
তপনকুমার দত্ত
করোনা কালীন এক লাইনের  দশটি কবিতা

তাই তো জীবন শক্ত করেই বাঁধছে মাস্ক করোনা লড়ায়ে।

করোনা এ এক অদ্ভুত মন খারাপ যাপন।

এখন সময় ভালোকে আঁকড়ে গভীরে থাকার।

এ এক অদ্ভুত সময় মনন গাঁথছে ভিন্ন যাপনলিপি।

বালিশে থাকে না মাথা ঘোর দুর্যোগে জাগে লকডাউন শরীর।

স্বপ্নের ঘোরে দেখি অতীত যাপন।

করোনা আতঙ্কে থমকে আছি আমি আমার পৃথিবীও।

লকডাউন বিধিতে চেনা চোখে কথা বলে দুই মাস্কধারীতে।

লকডাউনের দিন গাছেদের ছায়া দেখি মানুষ বিহীন।
১০
জানালা দরজা খুলে আলো নিই ঘরে করোনা মৃত্যু বাড়ে রাতের আঁধারে।

মজনু মিয়া 
আক্রান্ত সময় 

ক’দিন আগেই ভালো ছিল পৃথিবী, ভালো ছিল মানুষ
পাগলা হাওয়া লেগে পালে, মানুষ হয়ে গেছে বেহুশ।
স্তব্ধ হয়ে আছে পৃথিবীর আনাচে কানাচে আনাগোনা,
কর্মহীন জীবন সদা সংশয় কি হয় কি হয় নিত্য এ ক্ষণ গুনা।
ডাষ্টবিনে এখন আর কুকুরগুলোও দেখি না, ওখানে খাবার নেই
দেককান পাঠে চলে অবরুদ্ধ অবস্থা ভেতরে সুখ হারা এমনিতেই।
অর্থের ঝনঝন এখন কমে আসছে বাহারী ভাব নেই, রঙ তামাশায়
কেউ কেউ দেখে ঘেউঘেউ করে মরছে না খায়ে ওপাড়ার কুকুরগুলো।
বাঁচা দায় হয়েছে এমন আক্রান্ত সময়ে, কবে মিলবে নিস্তার?
কোথাও এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না, কারণ পৃথিবী আক্রান্ত রোগে বিস্তার।

খাতুনে জান্নাত
যাবতীয় সন্তাপ

পথ চিনতে চিনতে সকালগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে ভোর...
বৈশাখ গুজরাতে গুজরাতে চৈত্রের খরায়
টেবিলে চায়ের বাষ্প, সিগারেটের ছাই।
কিটেরা মিলেমিশে গুছিয়ে নেয় সংসার।
এরই ফাঁকে কেউ কেউ লিখে ফেলে অগনিত প্রেমপদ্য।
রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে পাহারাদারের সতর্কিত হুইসেল
অথচ চুরি হয়ে যায় প্রতিদিনের  মনিমুক্তো;
কারও কারও মতো আমরা টুপিতে ঢাকি অন্ধকার ও যাবতীয় সন্তাপ...

শুভ্র সরকার
ফুলের আয়ু নিয়ে, গাছের কি
দুঃখ হয়?


এবং সমস্ত ফুলই তো জারজ!

তার ত্বক
তার আয়ু
তার ভান
তার রুহ
তার ভাষা

তার সমস্ত শরীর জুড়ে ঘাঁ!

অথচ
ফুলের
বিরহে

বুকের ভিতর ঘেমে উঠছে কথারা-


কথোপকথন এমন দরজা;
যার দু’পাশে দু’জন মানুষ, অন্যপাশে ভেবে নিচ্ছে-
নিজেকে...


হাতুড়ির নিচে পেরেকের হৃদস্পন্দন বোঝ?

আহমেদ সুমন 
স্বপ্নচর

একদিন বলেছিলে আমায় ঘরে তুলে নিবে
কিন্তু আজ;  সমাজের দোহাই দিয়ে
ফেলে গেলে একা
এই স্বার্থপর পৃথিবীতে।

তবে কি তখন শুধু মোহ
আর লালসা ছিল?
নাকি লোক দেখানো আবেগ?

আর আজ তুমি বিবেকের কাছে
নিজেকে মিলিয়ে নিচ্ছো
হিসাব কষছো তোমাতে।

আমি চাই না এই ভালোবাসা
সর্বনাশার মূল হোক,
বিধির বিধান অলঙ্ঘনীয়
যাচ্ছে জীবন, যাবেই তো,
কষ্ট নেই তাতে।

ধারাবাহিক গল্প
সে রাতে কেউ ছিলনা
আপন রহমান

তখন প্রায় ভর দুপুর। বিরামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোপীনাথ বাবু একাকি অফিস কক্ষে বসে কী যেন ভাবছেন। সম্ভবত অন্য শিক্ষকেরা যার যার ক্লাসে চলে গেছেন। আমি ওনার রুমের সামনে দিয়ে একবার এদিকে একবার ওদিকে পায়চারী করছি। ভিতরে ঢুকতে কিছুটা সঙ্কোচ হচ্ছে। কেননা; না খেয়ে না নেয়ে, অনাদরে অবহেলায় চেহরার যে শ্রী হয়েছে তা একটা জাত পাগলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। পাছে পাগল ভেবে আমাকে আবার তাড়া না করেন। কিন্তু আমাকে তো ঢুকতেই হবে। তা না হলে ...। অনেক ভেবে চিন্তে অবশেষে পা বাড়ালাম রুমের ভিতর। স্যার আসবো ? -আসবো মানে; এসেই তো পড়েছেন। এসে পড়িনি স্যার এসে দাঁড়িয়েছি। -আচ্ছা ঠিক আছে এবার বসুন। কোথায় বসবো স্যার, চেয়ারে নাকি মাটিতে ? চেয়ারেই বসুন। ধন্যবাদ স্যার, তাহলে বসলাম। -এবার বলুন আপনার জন্য কী করতে পারি? -আমার জন্য তেমন কিছু করতে হবে না স্যার, আসলে আমি এখানে এসেছি আপনার কাছ থেকে কিছু তথ্য জানতে। দয়া করে সেটুকু জানালে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। -আচ্ছা বলুন, কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি? অবশ্য আমার হাতে বেশি সময় নেই ক্লাসে যেতে হবে। যা বলার দ্রুত বলুন। বলছিলাম স্যার, আপনি ইরা নামে কাউকে চেনেন? -ইরা! বিস্মিত চোখে গোপীনাথ বাবু তাকালেন আমার দিকে। তারপর নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বল্লেন হ্যাঁ চিনি-চিনিতো। তবে এত বছর পর আবার সেই পুরনো কাসুন্দি ঘেটতে এসেছেন কেন? বিস্ময়ের সঙ্গে আমি জানতে চাইলাম। -পুরনো কাসুন্দী মানে? চশমাটা মুচতে মুচতে গোপীনাথ বাবু বল্লেন না-না-কিছু না। বলুন আপনি কী জানতে চাচ্ছিলেন। আমি বুঝতে পারলাম গোপীনাথ বাবু কী যেন একটা লুকাচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন করতে সাহস পেলাম না। ওনাকে দেখেই বোঝা যায় উনি কিছুটা রাশ ভারি লোক, পাছে আমার আসল উদ্দেশ্য মাটি হয়ে যায় সেই ভয়ে। আমি বলতে শুরু করলাম। আমার বয়স তখন ২২ বছর। ঢাকার চারুকলায় সবে ভর্তি হয়েছি। ভর্তির কিছুদিন পর ক্যাম্পাসে ইরা নামের এক অপরূপ সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। চমৎকার বন্ধুত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি হয় দু’জনের মধ্যে। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম, প্রেম থেকে বিয়ে। কিন্তু বিয়ের রাতে ঘটল এক অদ্ভুত  ঘটনা। যে ঘটনার কথা চিন্তা করলে, আজও আমার সমস্ত শরীর পাথর হয়ে যায়। বিয়ে করে আমরা উঠেছিলাম আমাদের এক বন্ধুর বাড়িতে। বাড়িটি ছিল একেবারে নির্জন। বন্ধুর বাবা, মা বিদেশ থাকেন। ও থাকে বারিধারায় ওর খালার বাড়িতে। বাড়িটি দেখা-শোনা করে কেয়ার টেকার রহিম খাঁ। রহিম খাঁ ও এক রহস্যময় ব্যক্তি বয়স পঁচাত্তরের কাছাকাছি হলেও বেশ শক্ত সামর্থ্য। খান্দানী গোঁপ, লাল টকটকে গোলাকার দুটো চোখ। কী এক গভীর রহস্যময় তার চাহনি। কিন্তু লোকটা নাকি বোবা কথা বলতে পারে না। কোথা থেকে এসেছে কী পরিচয় কেউ জানে না। একাত্তর সালের এক রাতে নাকি লোকটা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসে ওদের বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিল তখন বন্ধুর বাবা মা দেশেই ছিল। যুদ্ধের পর যখন ওনারা বিদেশ চলে গেলেন। তখন ওকে বলে গেলেন। ‘লোকটা খুব ভালো ওকে কখনও তাড়িয়ে দিস না।’ সেই থেকে আজ অবধি উনি ও বাড়িতে থাকেন। রহিম খাঁ সম্পর্কে এ তথ্য টুকু বন্ধুটি একদিন আমায় বলেছিল। কিন্তু যেদিন ও বাড়িতে উঠলাম সেদিন ঘটল অদ্ভুত সেই ঘটনা। তখন রাত সাড়ে দশটা আমি ইরা, আর নীরব (আমার বন্ধু) আমরা গেট পর্যন্ত সবে পৌঁছেছি। হঠাৎ নীরবের ফোন বেজে উঠল। অপার প্রান্ত থেকে কে যেন বল্ল তার খালা ভীষণ অসুস্থ। নীরব কোন রকম আমাদেরকে লোকটার হাতে তুলে দিয়ে ছুটতে ছুটতে চলে গেল। লোকটা আমাদেরকে দোতলার একটা কক্ষে নিয়ে গেল। কক্ষটা খুলতেই আমি অবাক সমস্ত ঘর চমৎকার করে ফুল দিয়ে সাজানো! লোকটা জানলো কীভাবে? যে আজ আমরা এখানে উঠব। আজ আমাদের বাসর রাত, কিন্তু পরক্ষণে ভাবলাম নীরব নিশ্চয় এনাকে বলেছে এভাবে সাজাতে আমাদের চমকে দিতে এসব ওরই কারসাজি। আর দশটা স্বামী স্ত্রীর মতোই বাসর রাতে বেশ গল্পগুজব আনন্দ ফুর্তি করতে-করতে ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙলো তখন আনুমানিক সকাল দশটা। পাশ ফিরে দেখি পাশে ইরা নেই । এ দিক ওদিক ঘরের কোথা ও তাকে খুঁজে পেলাম না, ঘরের ভিতর থেকে রাতে যেভাবে শিকল এটে দিয়েছিলাম সেভাবেই আটা। আমি চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম কিন্তু কোথাও কোন সাড়া শব্দ কিংবা প্রতিউত্তর পেলাম না, ফোনটাতেও চার্জ নেই ডেড হয়ে পড়ে আছে। ঘরটাতে রাতে আলো দেখেছিলাম কিন্তু এখন আর বিদ্যুৎ কিংবা আলোর কোন অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছি না। দরজায় আঘাত করতে শুরু করলাম তাতেও কোন লাভ হচ্ছে না। ভাঙ্গতে চেষ্টা করলাম তাও পারলাম না, এভাবে চিৎকার চেচামেচির এক পর্যায়ে আমি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লাম যখন জ্ঞান ফিরলো তখন চারদিকে গভীর অন্ধকার। বুঝতে পারলাম গভীর রাত। এখন আর আমার ভয় করছে না। দীর্ঘক্ষণ দুর্গন্ধ যুক্ত স্থানে থাকলে দুর্গন্ধকে আর দুর্গন্ধ মনে হয় না। সেরকম দীর্ঘক্ষণ ভয়ের মধ্যে থাকলে এক সময় আর ভয়কে ভয় মনে হয় না। এটাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আমারও তাই হল। আমি তখন নিজেকে এই ভয়ংকার পরিবেশের সাথে বেশ মানিয়ে নিয়েছি। অন্ধকারটাই যা একটু সমস্যা । তাছাড়া অন্য কোন সমস্যাকেই আর সমস্যা মনে হচ্ছে না। শুধু ইরার জন্যে প্রচন্ড দুঃচিন্তা হচ্ছে। কী অদ্ভুত কান্ড হঠাৎ কাকের পালকের মত অন্ধকার ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠল। আর্শ্চয় ব্যাপার আমি একটু চমকেও উঠলাম না। আগেই বলেছি দীর্ঘক্ষণ ভয়ের মধ্যে থাকতে থাকতে আমার কাছে ভয়কে আর ভয় মনে হচ্ছিল না। কিন্তু একটা জিনিস দেখে আমার ভয়ের অনুভ‚তিটা পূণরায় জাগ্রত হল । হঠাৎ দেখি সেই অদ্ভুত লোকটা ! সেই অদ্ভুত লোকটা আমার সামনে দন্ডায়মান। লোকটা তার লাল চক্ষু দু’টো পাকিয়ে বিশালকার ভ‚ড়িটা দুলিয়ে দুলিয়ে অদ্ভুত শব্দে খিক্ খিক্ করে হাসছে। হাসছে তো হাসছেই। সে এক রহস্যময় হাসি। ভয়ে আমার সমস্ত গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসছে। আমি ক্রমেই আমার নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি। এবং একপর্যায়ে আমি সম্ভবত জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। যখন জ্ঞান ফিরলো হাতের ঘড়িতে দেখলাম ১৩ তারিখ শুক্রবার বেলা ১২ টা ১ মিনিট ৪২ সেকেন্ড। আমি বুঝতে পারলাম তিন দিন তিন রাত পর আমার জ্ঞান ফিরেছে। ১০ তারিখ বুধবার রাতে ঐ অদ্ভুদ মানুষরূপী জন্তুটা আমাকে দর্শন দিয়েছিল। সামনে টেবিলের উপর চোখ পড়তেই মনে এক অন্যরকম আনন্দের উদয় হল। টেবিলের উপর নানা রকম ফল- ফলাদি সহ বড় একবাটি মুরগির রোস্ট দেখে জিবে পানি এসে গেল। বেশ কিছু দিন না খাওয়া। পেটের ভেতরটা ক্ষুধায় চো-চো করছে। জানতাম ৩-৪ দিন কোন ব্যক্তি পানাহার না করলে সে মৃত্যুর মুখে চলে যায়। আমার সে রকম কিছু মনে হলো না কিন্তু প্রচন্ড ক্ষুধাটা অনুভব করছিলাম। আমি দৌড়ে গিয়ে গপা-গপ খাবার গুলো সাবাড় করতে লেগে গেলাম। খাওয়ার এক পর্যায়ে হঠাৎ আমার পিঠের উপর একটি হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। হাতটা স্বাভাবিক মানুষের হাতের মত নয়। প্রচন্ড শীতল একটা হাত, সেই সঙ্গে গভীর একটা কণ্ঠস্বর। ধীরে খাও বৎস, তোমরা মানুষেরা বড় অদ্ভুত! ক্ষুধা পাইলে তোমাদের আর অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত জ্ঞান থাকে না। তখন তোমরা সম্মুখে যা পাও, তাই গিলতে থাকো। যেমন দেখো ক্ষুধার কারণে তুমি তোমার অতীত বর্তমান (চলবে...)

Sunday, June 28, 2020

শিল্প সাহিত্য ৭৬


রবিবার ১৪ই আষাঢ় ১৪২৭, ২৮ই জুন ২০২০




কবিতা
পলিয়ার ওয়াহিদ
মাছের পোশাক

মাছের পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায় মানুষের মন
পাখিরা কি পর হয় সখা পুড়ে গেলে বন?

Fish costume

To wear the dress of fish men's mind travels

Would Birds be outsider, Friends, when forest has burned?

মৌসুমী মিত্র
অন্তরাত্মা

তোমায় খুঁজতে যাইনা আর বাইরে
নিত্যদিনের কাজের মাঝে আছো হৃদয় জুড়ে
তোমাকে খুঁজতে হয় না কোনো ছবিতে
জড়িয়ে আছো আমার হৃদয়খানিতে
ঘরসংসার টুকিটাকি কাজের মাঝে
মনে পড়ে তোমার খুনসুটি
আর জানো তো একলাই হেসে উঠি,
সবাই বলে পাগল নাকি!!
১০ টা বাজলেই মনে হয়, ওষুধটা খেয়েছো তো!
বেরোবার সময় রুমাল, চশমা আর মোবাইল টা নিতে ভুলে যাও নি তো!
তোমার যা ভুলো মন! চলতে গিয়ে আনমনে কখন খাও হোঁচট
আরো কত কি! সব কি যায় বোঝানো...

বুক চাঁপা কষ্টটা ভাতের হাড়ির ঢাকনা খোলা বাষ্পের সাথে দিই মিশিয়ে।
চোখের জলটা ছল করে লুকাই পেঁয়াজের ঝাঁঝে।
আনমনে সব্জি কাটতে বসে আঙ্গুলটা কেটে গিয়ে রক্ত ঝরে।
সেটা কি বুকের রক্তক্ষরণের থেকে বেশী-
সীমন্তিনীর আচড় কাঁটা সেকি ঐ চোখের জলের গোপন দাগের চেয়েও গভীর?
রাত্রি দিনের জপের মালা যে ‘তুমি’
কোনো নাম নয়, শুধু একটা শব্দতে আছো মিশে তুমি
শুধুই ‘তুমি’।

সোমনাথ বেনিয়া
ঊনত্রিশ পয়েন্ট ফাইভ- ১১

সমবেত শক্তিতে মৃত্যুর উলটো পিঠের সমুদ্রে ঢেউ
অবসাদকে লিখতে, হতাশা বুঝতে, প্রেমকাহিনি চুপ
অপরাজিতা ফুটে আছে, গরলের বিস্ময় চিহ্ন ধরি
অতিকষ্টে সকালকে গামছা স্বরূপ কাঁধে ফেলে দাঁড়াই
মেঘলা প্লাবন জানালার গরাদে রাখে মিষ্টি প্রায়
দূরবর্তী মাটির টবে আগাছার দঙ্গল বাঁচার আশা
কে জানে মধ্যরাতে মরু বুকে তুষার যুগের কথা
ছোটো ডোবার ভিতর মারিয়ানা খাতের স্বপ্ন দেখা
কিংবা পায়ের গোড়ালিতে মিছিলের লবণাক্ত স্লোগান
যাওয়াই যায় ভিন্ন পন্থার থেকে রকমফের ঋণ নিয়ে
কার অস্থির ভুলে অফুরান ভাঙি বিন্দুর ছায়াতলে...

নিধি ইসলাম
নির্জনতায়

চারিদিকে কষ্টের আঁধার
স্মৃতিরা খেলা করে মনের গহীনে,
ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছি নির্জনতার আঁধারে
জীবনের সব সুখ দুঃখ হাসি কান্না হারিয়ে।

কত আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিলেম মনের ঘরে
হঠাৎ দমকা বাতাসে সবকিছু হয়ে যায় এলোমেলো
পড়ন্ত বিকেলের রোদ্দূরে হারিয়ে গেল জীবনের মানে!

নির্জনতার অন্ধকারে জীবনের লেনদেনে
থেমে গেছে জীবনের গল্প স্মৃতিরা মিশেছে ধূলিকণায়
বিষাদগ্রস্ত জীবনে ছুঁয়েছে শূন্যতা!
শুনশান জীবনের বারান্দায়
চুপসে যাওয়া কল্পনার অকাল মৃত্যু ঘটে গেলো
আমার অজান্তেই জীবনেরে ফাঁকা রাস্তায়।

এখন কোথাও কোনো আলো নেই
চারিদিক শুধু অন্ধকারে ঢেকে গেছে চরাচর
কল্পনার পাখনায় অসংখ্য জরাজীর্ণ ভার।

ওাস্তায় রাস্তায় মানুষের অবিরাম কোলাহল মুখরিত
তবুও ভালো থাকার অভ্যাসটাই
হারিয়ে গেছে জীবনের খাতা থেকে
এখন শুধু ক্লান্ত পথিকের মত দীর্ঘশ্বাস
ঝরে পড়ে বারংবার অশান্ত হৃদয় মাঝে।

অনিক সাহা
বুভুক্ষ

ব্যস্ত রাজপথ হারিয়েছে তার চিরচেনা রূপ
চেনা শহরের অচেনা আঁধারে
আবছায়ায় দাঁড়িয়ে দুজন
ইতস্ততঃ সন্দিহান!
আমি

‘তুমি... পজিটিভ নও তো?’

‘মানে... অই আর কি,
 ভয়! ’

মৃত্যুময় চারপাশ,
মায়াময় হাতছানি
‘এসো আলিঙ্গন করি বুকে!’

চুপসে যাওয়া মনোমালিন্য এখন হয় খুবই কম!

হাঁটতে হাঁটতে দেখা গেল লকডাউন ভেঙ্গে রাস্তায় মানুষ 
পেটের ক্ষুধা বোঝে না ভাইরাসের,

সামাজিক দূরত্ব ভুলে
তুমি আমি,
তাই ওদের কাতারে দাঁড়াই!

জাহাঙ্গীর আজাদ
গায়ত্রী সন্ধ্যায়

মান ভাঙাতেই মন্ত্র শেখে কি কেউ ?
রাগে অনুরাগে ক্ষোভে অভিমানে তুমি।
তোমার নামটি সাবিত্রী ছিলো তাই
প্রিয় নামে কভু ডাকি নি রজতরেখা,
মান ভাঙাতেই মন্ত্রের চারুপাঠ,
গায়ত্রী শ্লোক তোমার জন্যে শেখা।

অথচ তোমাকে পেয়েছি তিনটি রূপে
চেতন অর্ধচেতন আর অচেতনে,
প্রত্যুষে তুমি ধারণ করো যে রূপ
মধ্যাহ্নেই সে তুমি ভিন্নতরো,
ভর সন্ধ্যায় গলিত স্বর্ণে দেখা
তোমার জন্যে গায়ত্রী শ্লোক শেখা।

মুক্তভাবনা
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়
শুভা গাঙ্গুলি

-আস্সালমআলায়কুম। ঈদ মুবারক আম্মি।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। ঈদ মুবারক তুমি কি আজই চলে যাচ্ছো আলি?
-ণবং সড়স, আজই যেতে হবে আমায়।
-তুমি আজ যেও না, যাওয়াটা পধহপবষ করো।
আলি জানে এটা আম্মার আদেশ, তাই কোনো কথা না বলে টিকিট রিফান্ড করতে চললো।
আম্মার এই ব্যাপারটা পরিবারের সবাই জানে, মাঝে মাঝে আম্মি এইরকম করেন, কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ করে জামা কাপড় পরে বের হয়ে যান, কোন আত্মীয়ের বাড়ী গিয়ে বলেন আজ খুব দরকার পড়লেও তোমরা বাড়ীর বাইরে যেও না।
প্রথমে লোকে গ্রাহ্য করেনি, পরে দেখেছে শুনলেই ভালো হোতো।

মায়েদের এই  ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অন্যান্যদের অপেক্ষা অনেক শক্তিশালী, তা পৃথিবীর ইতিহাসে বারংবার প্রমাণিত। তাই আমরা সিনেমায় যেমন দেখি, অনেক  অনেক দূরে সন্তানের বিপদের পূর্বভাসে মা বিচলিত। এই যে বিপদের পূর্বাভাসের  ইঙ্গিত পেয়ে সতর্ক হবার ইতিহাস এটা আমরা অনেক অনেক ইতর প্রাণীর মধ্যেও দেখে থাকি।

২০০৪ সালের সুনামীর মহাপ্রলয় আমরা দেখেছি, আন্দামান দীপপুঞ্জে এর প্রভাব ভয়ানক হয়েছিলো, প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলো এই প্রদূষণ বিহীন ছোটখাট দ্বীপপুঞ্জ, কিন্তু অবিশ্বাস্য ভাবে বেঁচে যায় সমস্ত বন্যপ্রাণী আর আদিবাসী জরোয়ারা, কারণ তাদের  বহুযুগ লব্ধ অভিজ্ঞতা  থেকে পাওয়া কিছু বিচিত্র অনুভ‚তি সাবধান করে দিয়েছিলো এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আগমনের খবর, আর শ্রীলঙ্কার পাতান্গালা বীচ এর ইয়ালা ন্যাশনাল পার্কেও কোন প্রাণীই হতাহত হয়নি মাত্র দুটো মহিষ ছাড়া তবে ষাট জন ট্যুরিস্ট মারা যায়, সময়মতো সরে যেতে পারেনি। ঠিক সেই সময়ই থাইল্যান্ড এর সমুদ্র উপকুলের এক হোটেলে এক ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী তার মাকে খুব উত্তেজিত ভাবে বলে সে নাকি স্কুলে শিখেছে যে সমুদ্রের জল যদি অস্বাভাবিক রকম পিছনে সরে, তাহলে নাকি ভীষণরকম বিপজ্জনক জলোচ্ছ¡াস হতে পারে। তখনি সেই মা তাঁর ছোট্ট মেয়ের কথা অবহেলা না করে, হোটেল ম্যানেজারকে সতর্ক করেন, ফলে হোটেল খালি করে সকলে অপেক্ষাকৃত  নিরাপদ জায়গায় চলে যান, একটু পরেই সুনামী সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়। আমরা দেখেছি যে কালবৈশাখী আসার পূর্বমুহুর্তে সমস্ত প্রকৃতি স্তব্ধ হয়ে যায়, গাঁয়ে গঞ্জে মানুষ বুঝতে পারে প্রকৃতির এই থমথমে ভাব, আসলে প্রবল কালৈশাখীর পূর্বাভাস, গল্পে সাহিত্যে এই কালবৈশাখীর পূর্বাভাস বিশেষ নৈপুন্য সহকারে নিবেদিত হয়ে থাকে।

উদাহরণ স্বরূপ, গল্পে সাহিত্যে এই অবস্থার ব্যবহার আমরা দেখে থাকি,
 “রমলার থমথমে মুখ দেখিয়া বিলাস বাবু চিন্তিত হইলেন, আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস, দরজা ঠেলিয়া ঘরে পদার্পণ করিবার উপক্রম করিতেই, বজ্রপাত হইলো, যেখান হইতে আসিয়াছো, সেইখানে ফিরিয়া যাও। আওয়াজ বহুদূর বিস্তৃত হইলো, পিছনের ঘর হইতে বিনয় ছুটিয়া আসিলো, বৌঠান দাদা খুঁড়িমার  বদ্যির সাথে চন্দ্রপুরে রাত্রিযাপন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন, অত:পর আজ প্রভাতে গোযানে ফিরিয়াছেন, ঘোমটা টানিয়া রমলা কহিলেন, তুমি যাও ঠাকুরপো।
ঘরে প্রবেশ করিবামাত্র প্রবল বর্ষণ শুরু হইলো, রমলা স্বামীর বক্ষে আছড়াইয়া পড়িয়া তারস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন,”

অতি পরিচিত বারংবার ব্যবহৃত গল্পের প্লট মাত্র। এই পর্যন্ত পড়িয়া আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারি যে সাংসারিক জীবনে, প্রকৃতির নিয়মে পূর্বাভাস আমাদের সতর্ক করিয়া দেয়, সামনে বিপদ, সুধী সাবধান। তাই ভাষাহীন প্রাণীদের আচম্বিতে চালচলনের পরিবর্তন কে অবহেলা করিবেন না। কুকুর, বিড়াল, বিশাল তিমিমাছ, সামান্য গোল্ডফিস, সামুদ্রিক কচ্ছপ ইহারা মনুষ্য জাতি অপেক্ষা অনেক বেশী শুনিতে, দেখতে ও বুঝিতে সক্ষম। উদাহরণ স্বরূপ আমরা বলিতে পারি অপার্থিব জগতের কার্যকলাপ কুকুর বেড়াল, ঘোড়া ইত্যাদি প্রাণী আগে হইতে টের পাইয়া মনিবকে সচেতন করিয়া দিয়েছে এবং কোথাও কোথাও মনিবের প্রাণ পর্যন্ত বাঁচাইয়াছে,

তাহলে একখানি সত্য কাহিনী শুনাইয়া আমার লেখা সমাপ্ত করিতেছি,
একদা এক গৃহ খরিদী করিয়া মালিক কথায় রাত্রি বাস করিতে গেলেন, রাত দুইটায় তাঁহার পোষ্য সারমেয় দরজার দিকে দেখিয়া তারস্বরে চিৎকার জুড়িলো, তিনি উঠিয়া কাহাকেও না দেখিয়া পুনরায় নিদ্রা যাইলেন।
দ্বিতীয় দিন দরজা দমাস করিয়া খুলিয়া গেলো। ধড় মড় করিয়া উঠিয়া বসিলেন, সারমেয় তারস্বরে চিৎকার করিয়া তাঁহাকে ঘর হইতে কাপড় কামড়াইড়া বাহির করিয়া আনিলো। মুহুর্ত পরে ছাদ হইতে বৃহৎ চাঙড়  ভাঙ্গিয়া পড়িলো। কুকুর টি কাহাকেও তাড়া করিয়া ঘর হইতে বাহির করিলো, পূর্বভাস সত্য প্রমাণিত হইলো!

রাসবিহারী দাস এত বলিয়া পুস্তক বন্ধ করিলেন,”

Saturday, June 27, 2020

শিল্প সাহিত্য ৭৫


শনিবার ১৩ই আষাঢ় ১৪২৭, ২৭ই জুন ২০২০




কবিতা
জাহিদুল মাসুদ 
সুখের মৃত্যু

তুমি আমার খুনি হতে যদি
যদি নিজ হাতে খুন করতে আমাকে
তবে মৃত্যুর কুৎসিত বিভীষিকা থেকে
আমি রেহাই পেতাম।
খুব সৌন্দর্যময় মৃত্যু হতো আমার
খুব সুখের মৃত্যু হতো
তোমাকে না পাওয়ার সমস্ত বেদনা
তোমার ককৃত খুনে রাঙা হয়ে উঠতো।

রিয়ানো
নতুন পৃথিবী

নতুন পৃথিবী সাজাবো
নতুন আয়োজনে
সকল যাতনা ভুলে
ভালোবাসা ও যতনে
চেনা পৃথিবীর অচেনা রূপ ধুয়ে

কালকেও নয় কেউ একা,
লকডাউনের অভিশাপ পেরিয়ে
মিলেমিশে সকলে  আমরা
এ পৃথিবীকে করে যাব বাসযোগ্য

অভিজিৎ চক্রবর্তী 
স্বীয়  

অসংখ্য মন্দিরের ভীড়ে
মাড়িয়ে যাওয়া ফুল হয়ে পড়ে থাকি।
পূজো নিতে পারছি না বলে
দুধের বদলে মাটিতে দিচ্ছি গড়াগড়ি।
উঠোনে আজ শোভাবর্ধন সভা চলছে!
বিক্রিত পণ্যের মতো দামী নই,
আমাকে কিনে নেবে কে?
কে দেবে ঘন সন্ধ্যার বুকে ধূপের প্রলেপ!
জন্ম থেকেই সেই সলতে হয়ে জ্বলছি
ব্যবহারের আগেই যাকে নাকচ করেছে পৃথিবী।

মোহাম্মদ আবুল হাচান মিয়া
অস্থির আঁধার

ভোরের আলো
সূর্যের নদী
বাগানে ঘুম ঘুম ফুল!

ফুলেরা দুলে ওঠে
নেচে নেচে
বিষাদ পর্ব অলি!

ফুলেরাও নিজেকে নষ্ট করে, অবুঝ হয়!
সেই ভয়ানক সুন্দর
সকাল
রোদে জ্বলে ওঠে রঙের ছোঁয়া
ভালোবাসার প্রতীক লাল গোলাপ!

হাসে পূবের হাওয়া
মধুর অনুরাগ সুবর্ণ কলস ভাসে নদীজল!

দুয়ারি হিসেব
পাল তোলে ঢেউয়ে ঢেউয়ে
বৃষ্টি ধোয়া চাঁদ!

মুগ্ধ হয় সৌখিন বড়শী;
যেভাবেই
বিলাসী উদ্যান;

বন্দী একুরিয়ামে মাছ!

ভোর বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বসা কাক
কাঁদে স্বভাবের শহর!

অনিন্দ্যকেতন গোস্বামী
অমৃত

কেমন করে ঈশ্বর ধরেন কম্পাসের কাঁটা
কেমন করে উগরে ওঠে বাতি
কেমন করে দিনগুলো সব সামনে এগিয়ে যায়
এক ঈশ্বরই জানেন তিনি শুধু ঈশ্বর প্রজাতি...

তাদের পাড়ায় শব্দ ছিল না কোনো
শব্দ যাপনে অক্ষম ছিল পাড়া
শব্দের গায়ে লেবেল ছিল তা মৃত
অমৃত শুধু শব্দখেকো বখাটে লক্ষ্মীছাড়া

বসতগুলো এমনি করেই বেদনা সিরাপ খায়
বাংলা অথবা তাড়িও খায় খিস্তি উঠলে মনে।
একে অন্যের ইট খসিয়ে ভিত ধ্বসাতে চায়
ভিতগুলো সব ঝাঁপিয়ে তখন বাঁচোয়া বীজ বোনে। 

সাম্য রাইয়ান এর সাক্ষাৎকার

জন্ম ৩০ ডিসেম্বর
জন্ম ও বেড়ে ওঠা: বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায়। সম্পাদনা: লিটলম্যাগ ‘বিন্দু’ (bindu.bangmoy.com)
প্রকাশিত পুস্তিকা:
সুবিমল মিশ্র প্রসঙ্গে কতিপয় নোট (গদ্য), বিগত রাইফেলের প্রতি সমবেদনা (কবিতা), মার্কস যদি জানতেন (কবিতা), হলুদ পাহাড় (কবিতা)।

করোনাকালীন এই সময়ে কেমন আছেন?
ভালো নেই। নিজেকে এখন সার্কাসের ক্লাউন মনে হয়। ভালো থাকার ন্যূনতম আয়োজন এদেশে নেই। জীবন নিয়ে এখানে চলে রাষ্ট্রীয় সার্কাস, যা বন্ধ হওয়া দরকার।
লেখার শুরুটা কিভাবে ?
এলেবেলে লিখতে লিখতেই শুরু। কবে, কীভাবে তা আজ আর মনে নেই। তবে এক দিনের কথা মনে পড়ে, সম্ভবত ২০০৫ এর কোনো এক বিকেল, রাশেদুন্নবী সবুজ আমায় ডেকে বললেন, “তুই তো লিখতে পারিস, এক কাজ কর, ‘স্বাধীনতা তুমি’ নামে একটা কবিতা লিখে দে- একটা প্রতিযোগিতার জন্য।” তো আমি সেদিন ওটি লিখেছিলাম, যদিও শেষপর্যন্ত প্রতিযোগীতায় পাঠানোর তারিখ বেমালুম ভুলে যাওয়ায় আর পাঠানো হয়নি। সম্ভবত ওইই প্রথম, কবিতা লিখবো মনস্থির করে লিখতে বসেছিলাম। এখানে একটি কথা বলে রাখি, ২০১২ পর্যন্ত আমার প্রায় সকল লেখাই আমি ফেলে দিয়েছি।
লিটল ম্যাগাজিন না ফেসবুক কোনটা শ্রেষ্ঠ মাধ্যম, আপনার মতে?
দুইটি ভিন্ন মাধ্যম। একটির সাথে অপরটির তুলনা চলে না।
এই সময়ের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতা পড়েন সমসাময়িক কবিদের?
এমনিতে বই তো পড়িই। তাছাড়া, ‘বিন্দু’ সম্পাদনার সুবাদে প্রচুর নতুন লেখা পড়া হয়। পত্র-পত্রিকায় দুই ধরনের ‘জিনিশ’ কবিতা নামে প্রকাশিত হয়, এক হলো: যা কবিতা, দুই হলো: যেগুলো তা নয়। আমি সবই পড়ি, যা নজরে পড়ে যায়। এই সময়ে প্রচুর ভালো কবিতা লেখা হচ্ছে। এখনকার অনেক কবির কবিতাই আমি পড়তে পছন্দ করি।
কবির সাথে অকবির তফাৎ কতোটুকু?
প্রেমিকার সাথে গণিকার তফাৎ যতোটুকু
পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তখন কী হতে চাইবেন?
‘কোয়ালা’ হতে চাইবো। অস্ট্রেলিয়ার এই প্রাণীটি তার জীবনের ৯৯% সময় খেয়ে আর ঘুমিয়ে কাটায়। ১% সময় সে তার জীবনসঙ্গী খোঁজে। খোঁজার জন্য খুব একটা কিছু ব্যতিব্যস্ত যে সে হয়, তাও নয়। কোনো সঙ্গী না জুটলে সে আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
একজন কবি ও দার্শনিকের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়?
কবি মাত্রই দার্শনিক, কিন্তু দার্শনিক মাত্রই কবি না।
কবির স্বাধীনতা বলতে আপনি কী মনে করেন?
কবির জন্য অতিরিক্ত কোনো স্বাধীনতার দাবি আমি করি না। মানুষের বেঁচে থাকবার প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক স্বাধীনতা থাকলেই হলো।
এপার বাংলার কবিতার ভাষা এবং ওপার বাংলার কবিতার ভাষার মধ্যে পার্থক্য কতটুকু এবং কেন?
এখন তো কোনো পার্থক্য নজরে আসছে না। উভয়ই কলকাতার মান ভাষায় লিখছে। তবে পার্থক্য নজরে আসতো, যদি বাঙলাদেশের জেলায় জেলায় যে ভাষা বৈচিত্র্য, তা এদেশের কবিতায়- সাহিত্যে দৃশ্যমান হতো। 
সাহিত্যের বিশ্বাস আর ধর্মের বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য বা দ্বন্দ্ব কোথায়?
ধর্ম নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
কবিতায় ছন্দের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলুন।
ছন্দ ছাড়া গাছে ফুল ফোটে না, বৃষ্টি ঝরে না। এমনকি শিশুর প্রথম কান্নাও ছন্দ ছাড়া নয়। জীবন ও জীবনহীনতার প্রতিটি সত্যবিন্দুতে রয়েছে ছন্দ। আর এই সব কিছু নিয়েই তো কবিতা
পুরস্কার একজন লেখকের জন্য প্রয়োজনীয়?
পুরস্কারের ক্রেস্ট, মেডেল লেখকের কোনও প্রয়োজনই নেই। কিন্তু টাকাটা খুবই প্রয়োজন।
‘চোখের ভেতরে হামিংবার্ড’ আপনার এ বছর প্রকাশিত কবিতার বই। এটিকে আপনি প্রথম বই বলছেন, তাহলে ‘বিগত রাইফেলের প্রতি সমবেদনা’ বা ‘মার্কস যদি জানতেন’ এগুলোকে কি আপনি অস্বীকার করছেন?
নাহ্, অস্বীকার করবো কেন? হামিংবার্ডের ফ্ল্যাপে সবগুলোর নাম উল্লেখ করেছি তো। ফেব্রæয়ারি মাসে কিছু সংবাদপত্র যখন বইটি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছিলো তখন আমি এ বিষয়ে বলেছিলাম। আবারও বলছি, বাকিগুলো ছিলো পুস্তিকা, এক থেকে দুই ফর্মার চটি। যেমন আমার প্রথম প্রকাশিত পুস্তিকা ‘সুবিমল মিশ্র প্রসঙ্গে কতিপয় নোট’ এক ফর্মার গদ্য সুবিমল মিশ্রকে নিয়ে, তারপর তিনটি কবিতার পুস্তিকা যথাক্রমে ‘বিগত রাইফেলের প্রতি সমবেদনা’, ‘মার্কস যদি জানতেন’, ‘হলুদ পাহাড়’। এরপর চার ফর্মার বোর্ড বাঁধাই করে একদম বইয়ের রূপ দিয়ে প্রকাশিত হলো ‘চোখের ভেতরে হামিংবার্ড’।
বইটি প্রকাশের পর পাঠকদের সাড়া কেমন পেলেন? প্রকাশক নিয়ে কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়েছিলো কি?
আমি লিটলম্যাগের বাইরে আজ পর্যন্ত কোথাও লিখিনি। ফলে জনপ্রিয় হবার তরিকার বাইরে আমার অবস্থান। আর আমি বেসিক্যালি মূর্খ লোক। আমার মতো একজন লেখকের যে সামান্য কিছু কবিতা, গদ্য যে লোকে পয়সা খরচ করে কিনে পড়ে এটাই আমার অনেক বড় পাওয়া। আমি জানি, এঁরা সব সচেতন পাঠক। কেননা, সচেতন পাঠক ব্যতিত কেউ লিটলম্যাগ পড়ে না।
হামিংবার্ড ব্যতীত সবগুলো পুস্তিকাই আমি নিজে ছেপেছি এবং নিজেই বিক্রি করেছি, ফলে পাঠকের সাথে সরাসরি আমার যোগাযোগ হয়েছে, পরিস্থিতিটা নিজে দেখেছি। ‘মার্কস যদি জানতেন’ পুস্তিকাটি তো আমি সম্পূর্ণ পাঠকের পয়সায় ছেপেছিলাম, পাঠক অগ্রিম টাকা দিয়েছিলো প্রকাশের জন্য। আসলে এর মধ্য দিয়ে নিজেকে বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এবার ঘাসফুল প্রকাশনীর মাহাদী আনাম নিজে থেকে দায়িত্ব নিয়ে সবকিছু করেছেন। বিক্রিতেও আমার তেমন হাত ছিলো না। ফলে সরাসরি ব্যাপারটা দেখার সুযোগ এবার হয়নি আমার। কিন্তু অনেকে ফেসবুকে, ওয়েবসাইটে বইটি নিয়ে কথা বলেছেন, আলোচনা লিখেছেন, সেগুলো পড়েছি। আমি এ ভেবেই পুলকিত যে লোকে পয়সা খরচ করে এ বই কিনেছেন, পড়েছেন এবং এ নিয়ে কথাও বলছেন।
কোন কোন লিটলম্যাগে আপনি লেখা প্রকাশ করেন?
শিরদাঁড়া, প্রতিশিল্প, চালচিত্র, দ্রষ্টব্য, বিরাঙ, বয়ান, তৃতীয় চোখ, শাঁখ, ফেস্টুন, দেশলাই, উত্তরা এক্সপ্রেস, খনন, হারপুন, যদিও উত্তরমেঘ, ন্যাপথলিন, অবগুণ্ঠন, বাঘের বাচ্চা, এরকম আরও অনেক লিটলম্যাগে বিভিন্ন সময়ে লিখেছি এবং এখনও এর কোনো কোনটিতে লিখি, তবে গত প্রায় সাত/আট বছর থেকে বিন্দু, জঙশন, ওয়াকিং ডিসট্যান্স আর চারবাকেই নিয়মিত লিখছি।
লিটলম্যাগ ব্যতীত কোথাও লেখা প্রকাশ না করবার কারণ কী?
লিটলম্যাগই সাহিত্য প্রকাশের ঠিক জায়গা বলে আমি মনে করি। অন্য জায়গার কথা বলতে গেলে প্রধানত সংবাদত্রের দিকে আঙুল ওঠে। আমি সাহিত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে ঐসবকে অপাত্র মনে করি। অপাত্রে লেখা দান করতে চাই না। সংবাদপত্র সংবাদ প্রকাশ করবে ঠিকমতো, সেটাই তার কাজ। সাহিত্য প্রকাশ করা তার কাজ নয়।
আপনি ২০০৬ থেকে লিটলম্যাগ ‘বিন্দু’ সম্পাদনা করছেন। কিছুদিন আগে ওয়েবসাইটও হয়েছে বিন্দুর। এত বছর ধরে কেন প্রকাশ করছেন?
আমি বিন্দুর সম্পাদক হলেও বিন্দু আমার একার কাগজ নয়, আমাদের কাগজ, এর সাথে অনেকেই যুক্ত। সকলে মিলে আমরা এটি প্রকাশ করি। প্রথমে বিন্দু যে উদ্দেশ্যে প্রকাশ করেছিলাম তা হলো, আমাদের লিখবার কোনো জায়গা ছিলো না। তাই একটা জায়গা দরকার ছিলো। এত বছর পরে এসেও মনে হয়, আজও কি আছে তেমন জায়গা, যেখানে আমরা হাত খুলে লিখতে পারি? বিন্দুর প্রয়োজনীয়তা আজও রয়েছে এজন্যই যে, আমরা আমাদের লেখাগুলো কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা অন্য যে কোনো শক্তির চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেই এখানে প্রকাশ করতে পারি। এখানে বলে রাখি, দিন দিন লেখক ও পাঠক উভয় দিক থেকেই পরিসর বাড়ছে, যা প্রমাণ করে বিন্দু প্রকাশ জরুরী। আর ওয়েবসাইট (bindu.bangmoy.com) আরও আগেই দরকার ছিলো, নানা সীমাবদ্ধতায় তা করা হয়ে উঠেনি। ২০১৯ এর ২৬ মার্চ তা সম্ভব হলো। এতে আরও অধিক লেখা প্রকাশের এবং পাঠকের কাছে পৌঁছনোর সুযোগ হলো।
সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ ‘শিল্প-সাহিত্য’ পত্রিকাকে। শুভকামনা।

Friday, June 26, 2020

শিল্প সাহিত্য ৭৪


শুক্রবার ১২ই আষাঢ় ১৪২৭, ২৬ই জুন ২০২০



কবিতা
অমিতাভ মীর
হেঁটে যায় সন্ধ্যামণি

মৈনাকের জলপ্রপাত পাহাড় থেকে নেমে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলে নদীর কাছে- নদীও যদি চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দেয়; বলো, ঝর্ণার কি দোষ আছে তাতে?

কাঁখের কলসিতে চোখের সবটুকু আলো ভরে হেঁটে যায় সন্ধ্যামণি দিগন্তের পথ ধরে, প্রগাঢ় অনুরাগে অন্ধকার মৈথুনে মেতে মনের সব রঙ ছিনিয়ে নিয়ে,
যদি সময়ের গল্প পটে এঁকে রাখে; জোছনার দোষ কতটুকু দেয়া যাবে?

বিনিদ্র রাতে আমিও বাতায়নে জেগে হংস মিথুনের মৈথুনের রঙে ভিজে, নিজেকে পুড়িয়ে যাই অনিদ্রার হাতে, তুমি;
বিলাসিতা বোলো না যাপিত এই সময়কে।

শুভ্রা কোনার
আমি আধুনিক

ধানবাদ -- ভারত
আধুনিকতার মোড়ক মুড়ে --তুমি আমি অস্থির,
বলে চলেছি অনর্গল- অন্তরাত্মা বধির,
একলাফে ওপরে উঠি--- একলাফে নীচে, সামাল দিতে আমিও কাবু- বেসামাল তুমিও নিজে
স্বাধীনতা ভাসছে দেখো--- ফাঁকা অন্তরীক্ষে,
আধুনিকতা চেপে ধরে- রেখেছি কেমন বক্ষে।
আমি ধবল হয়ে চেয়েছিলাম বাঁচতে---
চেয়েছিলাম চেতনার বিকাশ ঘটাতে।
শূন্য হয়ে রয়েছি সব একাকী---
বহমান মরীচিকা সভ্যতার প্রেক্ষাপটে।
তবুও তুমি কি যেন--- বলতে চাও আমায়, আমি শুনবো না ভেবেও-- বার বার ফিরে তাকায়।
আজকাল কেউ পথে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয় না,
গুমরে ওঠে স্নিগ্ধ নিশ্বাস আধুনিকতার বাতাবরণে
আমি-তুমি আধুনিক হয়ে বসে আছি কিনারায়,
ভুলে গেছি সব সত্য-মিথ্যে---
শুধু বেঁচে আছি--- অন্যের ইশারায়।।

জাহাঙ্গীর ডালিম 
বর্ষার প্রেম

বর্ষণ মন্দ্রিত সন্ধ্যায়
ভিজে ভিজে
হতে হবে একসায়
ই-ভরা ভাদরে ভাদরে
জ্বর বিনে গতি নেই আমার ?
ঠিক এখনটায় তুমি যদি আসতে
ওগো দরদিয়া
এক খানা কালো কুচ কুচেছাতা

শীলা ঘটক 
য়তো এটাই জীবন 

কখনো কখনো একটা হৃদয় আকাশ হয়ে যায়
একটা মন নদী হয়ে যায়
এক টুকরো অভিমান বয়ে আনে বৈশাখের নতুন উষ্ণতা।
হয়তো এটাই জীবন।
কখনো কখনো কিছু রাগ সাইক্লোন হয়, কালবোশেখের গোধূলিতে।
কিছু চুপ করে থাকা কথারা
গান অথবা স্লোগান হয়
কালের বিবর্তনে!
হয়তো হয়তো-বা!
অনুভবে অনুরণনে
বুকের মাঝেই রেখো তাকে।
ভালো-বাসা যদি না দিতে পারো
ভালোবাসাটুকু দিও তাকে।
হয়তো এটাই জীবন।
কিছু দুঃস্থের কান্না আর্তের চিৎকার
পৌঁছায় না সহায়তার হাত
কেঁদে ওঠে মন
হয়তো এটাই জীবন!
কিছু অন্যায় কিছু অবিচার
মানতে পারেনা মন
ছিন্নভিন্ন করে রক্ত দিয়ে মুছে দিতে চায় মন
এই কলঙ্কিত ক্ষণ!
পিছুটানে অক্ষমতা
হয়তো এটাই জীবন।

রুহুল আমিন (রনি)
হাটে হাঁড়ি ভাঙা

বেলাশেষে কোথায় হারিয়ে যাবো কে জানে?
সবাই স্বার্থপরতা দেখায়,
কেউ কেউ দেখায় উদারতা!
কে জানে?
কোথায় হারিয়ে যাবো আমরা......

অন্যায়ের বিচারটা কার গরমে,
যেনো কিছুই হয়নি!
মোরলরা সব টাকার গরমে ভাবসে গেছে।
কে জানে?
কোন বেলায় কোকিল আমারে ডাক দেয়!
যতোদিন থাকবে তুমি, থাকবে হাতে শক্ত লাঠি,
কে জানে?
কার কপাল পুড়বে, পড়বে সেদিন পিঠে লাঠি।
দেখবে আগে বিবেক, দেখবে সুধী করবে বিচার,
ভাঙবে হাটে হাঁড়ি।

ভাষান্তর: কায়েস সৈয়দ
মৌগিনস সুবিশাল দিগন্ত
১২ সেপ্টেম্বর ৩৭
মূল: পাবলো পিকাসো

জাহাজঘাটে বিহারের শেষে
ক্যাসিনোর পিছনে ভদ্রলোক
যথেষ্ট বিনীত পরিপাটি খুব
তার ভাজা
গলিত মলমূত্রের ব্যাগ খায়
তার প্যান্টের ডোরাকাটা
থুথু ফেলে অমায়িকভাবে

সমুদ্রের মুখে
জলপাইয়ের দাগ
তার প্রার্থনাকে
মাল্যাকারে সুতায় গাঁথে
ফ্ল্যাগ গ্রিলিং এর রশিতে

শপথ বাক্য শেষে
যা আলোকিত করে দৃশ্য
সংগীতটি আড়াল করে
তার পাকস্থলী রঙ্গভূমিতে
এবং মুক্ত করে
এর ভয়
ভীমরূলের দেহ থেকে
ছড়িয়ে পড়ে পা
পাখাটি তার মোম গলায়
নোঙরের উপর

অণুগল্প
চম্পাকলির দিনরাত্রি
স্বপঞ্জয় চৌধুরী

শহরের ব্যস্ততম রাস্তা তার পাশে একটি পার্ক। পার্কে লাগানো সারি ঝাঊগাছ, নানা পদের দেশি বিদেশী ফুলের গাছ। প্রাত ভ্রমণে বুক ভরে নিশ্বাস নেয়ার একটি জায়গাই আছে ফ্রিডম পার্ক। এখানে সবাই বুক ভরে স্বাধীন ভাবে নিশ্বাস নিতে পারে। যারা এখানে নিয়মিত মর্নিং ওয়াকে আসেন তারা হয়তো দেখে থাকবেন। একটা দশ বারো বছরের মেয়ে প্রতিদিন ভোর বেলা এখানে শিউলি ফুল কুড়াতে আসে। ফুল ভালোবাসে এজন্য নয়, এ ফুল কুড়িয়ে ওরা মালা তৈরি করে। শুধু ও নয় ওর মতো অনেকেই ফুল কুড়ায় এই পার্কে। মেয়েটির নাম চম্পাকলি। জন্মের সময় দাদি নাম রাখতে চেয়েছিল চম্পা আর নানি রাখতে চেয়েছিল কলি। নাম রাখা নিয়ে সেকী বিশাল বাহাস। তারপর বাপ বুদ্ধি দুইজনের নামই চ‚ড়ান্ত করেন -ওর নাম হবে চম্পাকলি। আজ দাদি, নানি, বাপ কেউই বেঁচে নেই। ভিটে বাড়িটাও গিলে খেয়েছে নদী। বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো তাকে এই ফ্রিডম পার্কে ফুল কুড়াতে হতো না। প্রতিটি শিউলি ফুলের ভেতর সে এক একটি ভাতের দানার ছবি দেখতে পায়।

ওদের মহাজন কলিমুদ্দি সরদার। বিশজনের ফুল কুড়ানো ও ফুল চুরি করার একটা টিম আছে। ফুল কুড়িয়ে মালা বিক্রি করে কমিশন দিতে হয় কলিমুদ্দিকে। দুইশ টাকা ফুল বেঁচলে পঞ্চাশ টাকা কলিমুদ্দির। এভাবে প্রতিদিন বিশজনের কাছ থেকে মোট এক হাজার টাকা কমিশন আদায় করে কলিম। চম্পাকলির মা বাসায় কাজ করে। চম্পাকলি ফুল বিক্রি চাল, ডাল, তেল, নুন এসব কিনে নিয়ে যান। গায়ে গতরে বড় হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। মায়ের তাই অনেক চিন্তা। এভাবে আর কতদিন ফুল বিক্রি করে চলবে। আর কয়েক বছর গেলে তাকে গার্মেন্টস এ চাকরি নিতে বলবে। আজ খুব বেশি বেচা বিক্রি হয়নি। শহরের মানুষগুলো বেরসিক হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। ফুল কেনা কমিয়ে দিয়েছে। এখন প্রেমিক প্রেমিকারা পার্কে যায় না। তারা ঘুরতে যায় রেস্টুরেন্ট অথবা সিনেপ্লাক্সে। তার উপর দেশে নাকি কী এক ভাইরাস এসেছে তাই রাস্তাঘাটে গাড়ি ঘোড়া মানুষজন দিনদিন কমে যাচ্ছে। সামনের সপ্তাহ থেকে নাকি গাড়ি ঘোড়া সব বন্ধ করে দিবে। তখন কী হবে? মায়ের কামাই চলে যায় ঘর ভাড়া দিয়াই। আগে মা পাঁচ- ছয়টা বাসায় কাজ করতো। গেলোবার টাইফয়েড হয়ে শরীরের বল কমে গেছে। ভারী জিনিস উঠাতে পারেনা তেমন। দুই তিনটা পুরোনো বাসায় তাকে কাজে রেখেছে। তাই বাধ্য হয়েই তাকে ফুল বিক্রি করতে হয়। নতুবা তাদেরকে না খেয়ে থাকতে হবে।

সপ্তাহ খানেক পর শহরে লকডাউন ডাকা হলো। চম্পাকলির মা শোমেলাকে বেতন দিয়ে আপাতত এক মাসের জন্য বিদায় দিয়েছে। বেতনের টাকা বস্তির ঘর ভাড়া দিয়েই শেষ। ফুল বিক্রি বন্ধ। রাস্তায় গাড়ি নেই মানুষ নেই। পুলিশ যাকে দেখছে তাকেই লাঠি পেটা করছে। কলিমুদ্দিরও ধান্দা বন্ধ। এদিকে শোমেলার শরীরেও জ্বর। ঘরে চাল ডাল নেই। শুনেছে বড়লোকেরা নাকি রাস্তায় এসে চাল, ডাল, আটা, মুড়ি দিয়ে যাচ্ছে। চম্পাকলি খাবারের সন্ধানে ঘরের বাহির হয়। অনেক ক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়েও কোন ত্রাণদাতার দেখা পেলোনা। আজ তাদের না খেয়ে থাকতে হবে। মায়ের জ্বর বাড়ছে ক্রমশ। একটা ওষুধ পাতি কিনে দিবে সেই টাকাও নাই। বিষণ্ন মনে সে বস্তিতে ফিরে আসে। বস্তির মোড়ে কলিমুদ্দির সাথে দেখা। কলিমুদ্দি নাকি নতুন কোন ব্যবসা বাহির করছে শর্টকাটে ইনকাম। চম্পাকলি তার কাজের কথা জিজ্ঞাসা করে। কলিমুদ্দি খিল করে হেসে বলে। এই ব্যবসা হইলো ত্রাণের ব্যবসা। যাবি ত্রাণ নিবি সেইখান থিকা আমারে কমিশন দিবি, যাবি? চম্পাকলি সরল মনে মাথা নাড়ে। সে কলিমুদ্দির সাথে পাশের গলিতে এক অভিজাত বাড়ির ভেতরে যায়। দারোয়ানকে আগে থেকেই বলা আছে সব। দারোয়ান কলিমুদ্দির দিকে তাকিয়ে বুড়ো আংগুলের থামস আপ দেখায়। চম্পাকলির বাড়ির ভেতরে পা রাখা মাত্রই তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো। পাঁচতলা ফ্ল্যাটে ওকে ঢুকিয়ে দিয়ে নিচে চলে আসলো কলিমুদ্দি। ফ্ল্যাটের মালিক শরাফত সাহেব বউ বাচ্চাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন গ্রামের বাড়ি। চম্পাকলিকে আনার জন্য তাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন। এমন সুরভিত না ফোটা ফুলের দাম পাঁচ হাজার টাকায় বিকোলো? চম্পাকলির নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সে পালাতে পারছেনা,  চিৎকার দিতে পারছে না। তার মতো দূর্বলদের জন্য এ পৃথিবী নয়। যে এতদিন ফুল কুড়িয়ে সংসার চালিয়েছে সে আজ নিজেই ফুল হয়ে গেছে। এক ঘণ্টা পর মাথা নিচু করে সে ফ্ল্যাট থেকে বেড়িয়ে আসে। তার চুল উস্কো খুস্কো, চোখ বিধ্বস্ত নীড় ভাংগা পাখির মতো। কলিমুদ্দি তার হাতে এক হাজার টাকার দুটো নোট ধরিয়ে দেয়, দারোয়ানকে এক হাজার টাকা দেয়। আর পকেট থেকে গুলের কৌটা টাবের করে ঠোঁটের ভিতর গুল গুজতে গুজতে বলে আমি কাউরে ঠকাই না। হে হে হে। চম্পাকলি এলোমেলো চুল গুচ্ছ খোঁপা করে নেয়। বাজার থেকে চাল, ডাল আর মায়ের জন্য ওষুধ কিনে নিয়ে যায়। তার পা গড়িয়ে পড়ছে ফিনকে ফিনকে কাচা রক্ত।

Thursday, June 25, 2020

শিল্প সাহিত্য ৭৩


বৃহস্পতিবার ১১ই আষাঢ় ১৪২৭, ২৫ই জুন ২০২০




কবিতা
এম. এম. বাহাউদ্দীন
বিচার চাই

আমিও একদিন জয়নাল হাজারীর মতো তোমার বিচারের দাবীতে রাজ পথে দাঁড়াবো অনামিকা।
হৃদয়ের চুক্তি ভঙ্গের দায়ে টানাবো ব্যানার।
জড়ো করে ফেলবো সমস্ত ভগ্ন হৃদয়ের মানুষ।
রাজ পথের গাড়ি আটকে করে দেবো হরতাল।
যে সমস্ত কবিদের ঠকিয়ে ধরেছো রাজ হাত,
তারাও দাঁড়িয়ে যাবে রাস্তায় হাতে হাত রেখে।

কোর্টের বারান্দা, কলেজের মাঠ, আর্ট গ্যালারী,
একুশের বই মেলা, বিজয় উৎসব, বা শোক সভা,
কিছুই করতে দেবো না আমি, না মানলে দাবী।
শিশুর ভুমিষ্ট হওয়া বা রোগগ্রস্থের চির প্রস্থান,
সব কিছু থমকে দাঁড়াবে করোনার লক ডাউনের মত।

অনশন করবো আন্না হাজারীর মত আমৃত্যু।
না। দাবী না মানা পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির হাতেও স্পর্শ করবোনা পানি বা ফলের জুস।
তুমি বা তোমরা স্বামীর বুকে শুয়ে শুয়ে
টেলিফোনের ওপাশ থেকে দেবে শান্তনা।
আমরা কিছুতেই তা মানবোনা।

পৃথিবীর ইতিহাসে, দেয়াল লিখনীতে,
তোমাদের নাম উঠে যাবে গভীর ঘৃণায়।
তবুও রাজ পথ অবরোধ করবো তোমার বিচারের দাবীতে।
জয়নাল হাজারী, হেলাল হাফিজ, হেফজুর রহমান,
বা হালের চির কুমারেরা থাকবে সে মিছিলের অগ্রভাগে।

মোশরাফি মুকুল 
শারীরিক দূরত্ব

তোমাকে গোলাপি মাস্ক ভেবে সেঁটে নিচ্ছে যারা উর্বর ঠোঁটের চতুর্দিকে
এবার তাদের তীব্র রসায়ন এবং শারীরবৃত্তের বিজ্ঞাপন থামাতে বলো।
আমরা সামাজিক দূরত্বের পরিধি বাড়ানোর কথা বলছি,
খুলে ফেলছি শারীরিক দূরত্বের জিপার।

নষ্ট আঙুল দিয়ে ভ্রষ্ট নগর মেপে দেখি-
এখানে মূলত পাথরকুচির মতো কাণ্ড ও পাতা ছাড়া ফুল-ফল, শরীর বলে কিছু নেই।

সুজাউদ্দৌলা
বৈকালিক

উড়োজাহাজের মতো ফড়িংগুলি ইতস্তত
উড়ছে বিকেলের স্নিগ্ধ বাতাসে
কালো যুদ্ধবিমানের মতো একটি ফিঙে
ঠোঁটে গেঁথে নিয়ে বসছে মেহগনি গাছে
ফটোসাংবাদিকের মতো আমি দেখছি
ক্যামেরাবিহীন; ছবি তোলার দায় ছাড়া-

প্রণব কুমার চক্রবর্তী
অজস্র কথামালা

তার শরীরের পরতে পরতে ধরা
                          অজস্র কথামালা...
মনের অন্দরে ধরা আছে
কিছু বিমূর্ত ঘটনার
                          ছায়াময় স্মৃতি...

কঙ্কালসার এই উলঙ্গ সময়ের
চোখের তারায়
থমকে দাঁড়িয়ে আছে
                        পূর্ণিমার চাঁদ...

বিধ্বস্ত
বিপর্যস্ত

সংক্ষিপ্ত অবসরের ফাঁকেই
ভালোবাসার বাসন্তিকা ট্রেন
ডাক পেয়ে
                      চলে যায় দূরের গন্তব্যে
রেখে যায়
পথের দু’ধারে
পোড়ামাটির সব ঘর-বাড়ি, গেরস্থালি আর
নিদ্রাহীন দিবারাত্রির কাব্য

কেঁপে ওঠে অন্ধকারের রোদ

অজস্র কথামালার ঘাড়ে চেপে
ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে দিনের নিস্তব্ধতা...

মীর সাহাবুদ্দীন
সাড়ে তিন হাত নিচ

পৃথিবীর জনসংখ্যা যত দ্রুতো বেড়েছে
তার অর্ধেক সময়ে মিলিয়ে যাচ্ছে মানুষ
বিশুদ্ধ অক্সিজেনের টানাপড়া
মস্তিষ্ক ছিদ্র করলে মিলে নেটওয়ার্ক

মানুষ থেকে এলিয়েন
বৃক্ষ থেকে পশু
ক্রমাগত সবাই মিশে যাচ্ছে
রেখে  যাচ্ছে কংক্রিট ভবন ও দলিল
অথচ কেউ খবর নিতে পারছেনা
সাড়ে তিন হাত নিচের

ভাষান্তর: কায়েস সৈয়দ
আজ ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫
ডন জেইম সাবার্তেস এর জন্য তাঁর সাধু দিবসে 
মূল: পাবলো পিকাসো


১.
আমার দাদির বড় বলগুলো
জ্বলজ্বল করে কাঁটাঝোপের মাঝে
এবং যেখানে যুবতী মেয়েরা ঘুরে বেড়ায়
ঘুরন্ত শানপাথর তাদের শিষ-ধ্বনি শান দেয়

২.
সসিজ যা তুই ঠেলে দিস
তোর সেনোরার পোঁদের উপর
অনুভূত কামফলের মতো
এক্সত্রেমাদুরা’র মতো রুদ্ধশ্বাস

৩.
মোরগের টকটকে লাল
আর গভীর ক্ষতের যাজক
রসুন ও অর্থের জন্য এক চোখসহ
ভালোভাবে ঝুলন্ত ছেলেদের যুগল

৪.
সেই চেয়ারগুলোতে যেখানে গীর্জার সন্ন্যাসীনি ও ঘণ্টাবাদক
ফেলেছিলো তাদের প্যান্ট
হিসহিস করে গরম মধু তাদের পোঁদে
যতক্ষণ না তারা তাদের ক্রুশ টানে ও নাচে

অণুগল্প
আকাঙ্ক্ষা
লোকমান হোসেন 

ইন্সপেক্টর রশিদ বারান্দা দিয়ে পায়চারী করছেন। কিন্তু পায়চারী ফোরাচ্ছে না। অথচ খুনী তখনও ঘরের মধ্যে। বুকশেলফের পেছনে হামাগুড়ি দিয়ে বসে আছে। লাশটা মর্গে এখনো। ডোম প্রস্তুতি নিচ্ছে কাটাকুটির। ডাক্তার সাহেব এখনো আসেননি।

ইন্সপেক্টর রশিদ তদন্ত কাজে খুবই দক্ষ। দেশের বেশ চাঞ্চল্যকর কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের সুরাহা করেছেন তিনি। মার্ডার মিস্ট্রি গুলে খাওয়া মানুষ। তবুও এ কেসটা আগাচ্ছে না।

নিপাট ভদ্রলোক সাইমন সাকিব। একটা বহুল প্রচলিত দৈনিকের সম্পাদক। মাঝে মাঝে টিভি চ্যানেলে টকশোতে অংশ নিতেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে খ্যাতি ছিল। হয়তো সেখান থেকেই শত্রুতার সূত্রপাত। ভিন্নমতের উপর শ্রদ্ধা, সহনশীলতা এদেশে নেই বললেই চলে।

দরিদ্র ছমিরন সারাদিন ভিক্ষা করে যা যোগাড় করে তাই দিয়ে দিনাতিপাত করে। একদিন রেলস্টেশন এ ভিক্ষা করার সময় স্টশনের পুরনো ওয়েটিং রুমের বাথরুমে একটা লোককে খুন হতে দেখে ফেলে সে। তারপর থেকে তাড়া খেয়ে নিরুদ্দেশ হয় ছমিরন।

কোন একটা বিশেষ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্রের আঘাতে মারা যায় ওই এলাকার প্রবীণ একজন মানুষ। খুনীরা ক্ষমতাসীন দলের শ্লোগান দিতে দিতে চলে যায়। অতঃপর সেখানে সৃষ্টি হয় একের পর এক হত্যাযজ্ঞ।

অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে তারা সবাই এক জায়গায় বন্দী।

নানা ধরণের বিচিত্র সব চরিত্র নিয়ে সবসময় ভাবনায় থাকেন নাফিস আহমেদ। স্ট্রোক জনিত কারণে হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মনে হতে থাকে, আহা চরিত্রগুলোকে যদি কোনো ভাবে মুক্তি দেয়া যেত!

অন্তিম মুহূর্তে একজন থ্রিলার লেখকের আর কি চাওয়ার থাকতে পারে!

Wednesday, June 24, 2020

শিল্প সাহিত্য ৭২


বুধবার ১০ই আষাঢ় ১৪২৭, ২৪ই জুন ২০২০




কবিতা
রহমান মুজিব
মল্লিকপাড়া 

সুস্বাদু ডাল-ভাত সানকিতে রেখে যায় তৃপ্তির ঢেকুর
আত্ম নির্মাণের পথে পা রেখে ভাবি-আমিও আবার
লক করা প্রোফাইল খুলে সুঁতো কাটা ঘুড্ডি হবো
যদিবা গন্ধমের অমার্জনীয় পাপে ফুটে প্রণয়ের গোলাপ

আমার যে স্বরুপ-কাঁচা মুদ্রায় ঝনঝন করে উঠে
অবজ্ঞার যে আমজনতা- ঘাম ঝরানো দিনের দেবতা
তাদের গন্ধ, স্পর্শ টিপে টিপে আজ ঘণীভুত
করে নিতে চাই আমার প্রতিস্বর, আমার জন্মভিটা-মল্লিকপাড়া 

একদিন দূরন্ত হাওয়ার শাঁশাঁ আমায় ভবঘুরে পথে
রেখে এসেছিল, মেঘর সতীর্থ হয়ে উড়েছি আকাশ
হতে আকাশে আর মুখস্ত করেছি ঠিকানাহীন ভ‚গোল

কোথায় যাব-মজাখালের তলানীতে আটকে থাকা
পিতৃপুরুষের প্রেম, একান্নবর্তীর শেকল ছেঁড়া হাহাকার

কোথায় যাব-শষ্য রঙে সাজানো কাঁথায় মায়ের নকশা
আঁকা গ্যালাক্সি, নত হয়ে থাকা সংসারের বোবা বৃক্ষ

কোথায় যাব-নিমাই মাঝি বিলের দাড়িয়াবান্দার ছক
গোধুলির মায়া রংয়ে আঁকা সন্ধ্যার বাড়ি ফেরা

কোথাও যেতে পারিনা, রাতের কণ্ঠে আমার অতীত
ধরে ঝাঁকি দেয় কৃষাণীর মেয়ে, পোয়াতির ঘ্রাণ সে,
মুখে গোলাধানের হাসি- ইচ্ছে করে আজো তাকে নিয়ে বাঁচি

অপার অরণ্য
পয়গাম্বর

শুনেছি বাপ-দাদারা নাকি বেজায় গরীব আর
ঋণগ্রস্থ ছিলেন
রাক্ষুসে পেট গিলে নিত অনাহারী নাড়ি-ভুড়ি
ক্ষুধার্ত সূর্যের রঙ আর নদীর নাব্য মেখে তাদের
আঙুল হয়ে উঠত ধারালো ত‚র্যনিনাদ
এভাবেই সুতীক্ষ্ন উজ্জ্বলতায় পাকা ধান কাটতেন তারা
এখন বাপ-দাদারা বড়লোক হয়েছেন
ধারালো তাদের অস্ত্র ও আভিজাত্যের স্ফুলিঙ্গ
ধর্ষিতার বোঁটায় কামড় খেয়ে বলেন- বাতাবিলেবুর
বাম্পার ফলন!
ফণাধর সাপ প্রশ্নবোধক সুসজ্জায় সুন্দর- ম্লান
চেঁচায় নাগরিক, নারীবাদ,
হাঁসে উপাসনালয়, শাণঘর
কাঁদে রোবটবিজ্ঞান, শপিংমল
বেদগ্রন্থ ও শরীয়া মোতাবেক প্রকাশ্যে পয়গাম্বর
স্বৈরাচারী ছুঁড়ি পরম্পরায় খুন করো নিঃস্পৃহ
যোনিপথ ও নিরীহ নির্বিষ পালক!

রাজীব পাল
ভ্রমণ

নিজের ভেতর ক’পা চুবিয়ে হাঁটা দিলে হে?
চু কিত্ কিতে কাটা দাগ ডিঙিয়ে ফেরা
সন্ধেরা, ও পায়ের পাতায় কুঁকড়ে যাওয়া,
কতটুকু ভ্রমণ মেপেছো বুকের ভঙ্গুরতায়?

লক্ষ যোনি, হাঁপিয়ে ওঠো, শ্বাসকষ্টের
শ্বাসযন্ত্রে নামিয়ে রাখা ঘোড়ার মাথা
স্বপ্ন দেখুক ঘাসের মাঠ, সূর্য ডুবে যাচ্ছে
নিজের ভেতর হেঁটে ফিরে আসছো কি?

সাব্বির হোসেন
আঁধার থেকে আলোয়

এই শহরের প্রত্যেকটি অলিগলি
দরজা, জানালা, দেয়ালের কার্নিশে
এঁটে থাকা ভেন্টিলেটর,
বিছানার চাদর,
ড্রেসিংরুমের বোবা চিরুনি,
বেসিনের আয়না,
আর চুমকি বসানো লাল পার্সে
জ্বলতে থাকা কালো টিপ
আমার নিত্যকার বিষাদের সাক্ষী।

এক একটি হিংস্র নটরাজের থাবায়
বিকিয়েছি পুষ্পমঞ্জরি
এলিয়েছি বসন্তের টগবগে শরীর
নখের আগ্রাসনে
রাজপথ থেকে রাজপথে
চৌকাঠ থেকে পালঙ্কে
আঁধারের মৃত শিল্প হয়ে
সময়ে অসময়ে ঘড়ির কাঁটার
ইশতেহার হয়ে।

আমি মুনিয়া,
তবুও স্বপ্ন দেখি হয়তো একদিন
কবির বনলতা হব
হয়তো হব ডার্ক লেডি অফ শেক্সপিয়ার
নিষ্প্রাণ প্রতিমা আবার জীবন্ত হবে
দুর্লভ ফুল হয়ে স্বজন সভ্যতায়।

ছোটগল্প
খুন
রিয়ানো

একটা আধ ভাঙ্গা চৌকি। কিছু ছাড়পোকা। একটা পুরনো টেবিল। পোকায় খাওয়া কিছু একাডেমিক বইপত্র। ধুলাবালি। নষ্ট হওয়া টেবিল ল্যাম্প। দেয়ালজুড়ে মাকড়সার জাল। এলোমেলো পড়ে থাকা জামাকাপড়। বন্ধ জানালা। একরাশ বিষণ্নতা। দম বন্ধ করা অন্ধকার।

ছেলেটাডুবে আছে এসবের ভেতর। কেটে গেছে ২৮ টি বছর। ডুবে যাওয়ার কাল শুরু হওয়ার পর থেকে ঘড়ির কাঁটার সাথে সাথে ডুবছে তো ডুবছেই। কিন্তু সে কি মরতে চায়?

বোধহয় না। তাইতো রোজ রাতে আঁকড়ে ধরে সিগারেট। রোজ রোজ সিগারেটের পয়সাটা জোগাড় করাও এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।

ক্রিং! ক্রিং!
সমস্ত নীরবতাকে তীব্র শক্তিতে পদানত করে আগুনের মতো ঝলসে উঠলো ফোনের রিংটোন। সিগারেটের আগুন ছাড়াও ঘরে তৈরী হলো আলোর উৎস। আর তার নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়াও তৈরী হলো নতুন শব্দ। ছেলেটা চিন্তায় ডুবে ছিল। বাস্তবে ফিরতে যতখানি সময় লাগলো, তারই মাঝে ফোনটার শব্দ থেমে গেল।

কে ফোন দিয়েছে? দেখার জন্য ফোনটা হাতে নিতেই আবারও সেই আলোর ঝলকানি, সঙ্গে তীব্র শব্দে।
ছেলেটা ফোনের কাছে মুখ নিয়ে বললো- হ্যালো!
ওপাশ থেকে ভেসে এলো অন্য একটা কণ্ঠস্বর। উচ্ছ্বাসে প্রাণবন্ত, তার মতো প্যাঁতপ্যাঁতা নয়। উচ্ছ¡াসভরা কণ্ঠস্বরের  মালিক তার বন্ধু- চাকরিটা হয়ে গেছে আমার!

একটা ধাক্কা। হজম করতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগলো তার। একসাথেই ইন্টারভিউ দিয়েছিলো তারা। বন্ধুর চাকরি হয়েছে, তার হয়নি!
ইন্টারভিউ বোর্ডে সেদিন কেতাদুরস্ত এক ভদ্রলোক তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘আচ্ছা, আপনার চোখের নিচে অমন কালশিটে দাগ কেন? নেশা-টেশা করেন বুঝি?’
সে জবাব দিতে পারেনি। প্রতিরাতের মতো আজও যখন সে ডুবে আছে, তখন সেই স্মৃতিটা তাকে আরেকটু ডুবিয়ে দিলো। ডুবতে ডুবতেই বন্ধুকে অভিনন্দন জানালো সে। বিনিময়ে পেল আশার বাণী আর সান্ত¡না।
‘তুই দুঃখ করিস না দোস্ত, চেষ্টা কর। এক জায়গায় না এক জায়গায় চাকরি হয়েই যাবে!’
এমন মূল্যবান উপদেশ! তাকে বাধ্য হয়েই একখানা হাসি উপহার দিতে হলো।

বন্ধু ফোন রাখলো। আসলে সবাই এখন ব্যস্ত। ব্যস্ত তার প্রেমিকাও, যে একসময় ছিলো তার ব্যস্ততার কারণ, এখন সব ব্যস্ততাই তাকে ছুটি দিয়ে চলে গেছে। মাসের পর মাস চলে গেলেও একটা চাকরি সে জোগাতে পারেনি -এই অজুহাতে।
চলে গেছে টিউশন, হাত খরচের একমাত্র উৎস। চলে গেছে সুখ।

এখন এই পৃথিবীতে অল্প ক’জনই নিয়মিত তার খোঁজ নেয়। এ তালিকায় প্রথমেই আছে তার বাড়িওয়ালি। রোজ সকালে দরজায় শব্দ কওে দেখে সে আছে কিনা। ব্যস, এতোটুকুই!

থাকগে, সে বোঝায় নিজেকে, না-ই জিজ্ঞেস করুক আমি কেমন আছি, কি অবস্থায় আছি, অন্তত আছি কিনা এটা তো খেয়াল রাখে! তার অস্তিত্বের খেয়াল রাখার জন্য এই যে একটা মানুষ আছে, এটা তাকে বেশ স্বস্তিÑ দেয়। সেই স্বস্তির বিনিময়ে সে অনুভব করে, তার সঙ্গী ছাড়পোকারা ক্ষুধার্ত হয়ে আছে। তাদের খাদ্য দেয়া প্রয়োজন।
খেয়াল হয়, আরে! ক্ষুধার্ত হয়ে আছে আরো কিছু প্রাণী! রোজ রোজ খাদ্যের জন্য চেঁচায় তারা। অন্য ভাষায় এটাকে বলা যায় তাগাদা। সকাল হলেই যে তার অস্তিত্বের খেয়াল রাখে, তাকে দিয়ে শুরু হয়। এরপর আছে মুদি দোকানদার, চা ওয়ালা, বাদামওয়ালা--- আরো কত কে! সকলকে নিজের অস্তিত্বটা জানান দিয়ে একটা সিগারেট জোগাড় করে ছাদের একাকী রুমটায় ফিরে আসে সে। সকলের শান্তির জন্য রোজ একটু বেরোতে হয় তাকে। ‘আমি আছি!’ হাজিরা দেয়ার পর কিছুক্ষণের জন্য লেকচার। এরপর বিদায় নিতে হয় তার কাছ থেকে। এরপর আরেকজন। এরপর আরেকজন!

‘ আছি!’ আছি! আছি!’ তবু যেন সে নেই! শহর যখন সন্ধ্যার অন্ধকারে ডুবতে শুরু করে,তখন তার মাথার ভেতর কে যেন চিৎকার করে, ‘আমি কি সত্যিই আছি...?
‘আমি কি সত্যিই আছি?’
‘আমি কি সত্যিই আছি?’

ওহ! সে কি যন্ত্রণা! এমন লাগে কেন? সে ছুটতে থাকে। এ গলি, সে গলি ছুটতে ছুটতে যেখান থেকে ছোটা শুরু করেছিলো, সেখানে এসেই থামে। কারণ, পৃথিবী গোলাকার। হাঁপাতে হাঁপাতে পকেট হাতড়ে ঘরের চাবি বের করে। বিক্রির মতো জিনিসের সংখ্যা ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। পুরনো তালা কেউ কেনে কিনা, জানতে হবে।
বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ঘরটায় ছেলেটা শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ায়। চৌকির মচমচ  করা শব্দ তাকে জানায়, তোমার ওজন কমে আসছে।
সিগারেটের অপ্রয়োজনীয় অংশটা ফেলে সে টেবিলের কাছটায় গিয়ে দাঁড়ালো। অল্প সময়েই খুঁজে পেল নতুন পত্রিকায় যত্ন সহকারে মুড়ে রাখা চকচকে জিনিসটা। অন্ধকারেই তার ঔজ্জ্বল্য অনুভব করে। হাতের তালুতে ঘষে উপভোগ করে জিনিসটার ধার। পরীক্ষা করে ওজন। আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায় তার অন্তরে। খুব সহজেই ব্যবহার করা যাবে এমন একটা জিনিস সেটা। ‘চমৎকার!’
তার মতো শীর্ণকায় ব্যক্তির পক্ষে খুব কঠিন কিছু নয়।

এলাকার যে বড় ভাই এই অত্যন্ত চমৎকার কিন্তু মূল্যবান জিনিসটা তাকে উপহার দিয়েছে, তাকে মনে মনে ধন্যবাদ জানায় সে। জিনিসটাকে পরম মমতায় বুকে আগলে রাখে, চুমু খায়। চোখ বুজে চলে যায় সময়ের কিছুটা পেছনে।
ছোটবেলায় তার মা তাকে বলেছিলো, ‘বাবা, ব্লেডের মত ধারালো হবি। যাতে করে সামনে যত বাঁধা আসবে, সব কেটে কুটে বেরিয়ে যেতে পারিস!’ কিন্তু না। সে ব্লেডের মতো ধারালো হতে পারেনি। কারণ বাবা তার জন্য কোন হীরার টুকরা রেখে যাননি। তাই তাকে এ সমস্ত বড় ভাইদের দেয়া ধারালো জিনিসের সাহায্য নিতে হয়।

‘বাধা!’ ‘বাধা!’ ‘বাধা!’

সে বেশ কয়েকবার শব্দটা উচ্চারণ করে।

হ্যাঁ আসলেই তো! ‘বাঁধা।’
পাঁচ মাসের জমে থাকা ঘরভাড়া একটা বাঁধা।
মুদি দোকানের বাকির খাতা একটা বাঁধা।
চা ওয়ালার দাগওঠা চায়ের কাপ আরেকটা বাঁধা।
এমনি বাঁধা বাদামওয়ালা, লন্ড্রি দোকান, ভাতের হোটেল......উফফফ! তাকে এসব বাঁধা কেটে বেরিয়ে আসতেই হবে! তাই সে টুক করে দরজা খোলে। শব্দ না করে সিঁড়ি বেয়ে হেঁটে যায় নিচের দিকে। এ সময় তার মনে হয়, সে যেন একটু একটু করে ভেসে  উঠছে। সিঁড়ির প্রতিটা পদক্ষেপে পানির ওপরে দেখা যাচ্ছে  সূর্যালোকের প্রতিফলন।

দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাই সে বাড়িওয়ালির ফ্ল্যাটের কলিংবেলে চাপ দেয়।

Tuesday, June 23, 2020

শিল্প সাহিত্য ৭১


মঙ্গলবার ৯ই আষাঢ় ১৪২৭, ২৩ই জুন ২০২০




কবিতা
অভ্র আরিফ
ভুল

ইন্টারভ্যু বোর্ডে আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো,
“পৃথিবীর রাজধানীর নাম কী?”
আমি মনে করতে পারলাম না।
তারপর জিজ্ঞেস করলো, “ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান কোথায় জানেন?”
আমি এটাও ভুলে গেলাম। অথচ আমার ভুলে যাওয়ার কথা না
অথচ আমরা রাত জেগে এসব মুখস্ত করি।

ফিরতিপথে ট্রেনের সিটে মাথা হেলিয়ে মনে হলো,
পৃথিবীর রাজধানীতো আমার হৃদয়
ব্যবিলনের শূন্য উদ্যান আমার মস্তিষ্ক
নিজেকে ধিক্কার দিলাম। কী আশ্চর্য!
জীবনের দেনা শোধে মানুষ অনায়াসেই হৃদয় আর মস্তিষ্কের কথা ভুলে যায়!

সারাটা যাত্রাপথে আসন্ন ভুলের মাশুল ভাবতে ভাবতে
ত্রিশটা স্টেশন পার হয়ে আমি গন্তব্যে নেমে যাই।
কিন্তু একী! এ রুক্ষ, ধূসর, ঊষর গন্তব্যস্থল কখনো আমার নয়
আমার দেশ-  পাহাড়, সমুদ্র ও সবুজের দেশ।
বুঝলাম, ভুল টিকেটের যাত্রী হয়ে ভুল গন্তব্যে পৌঁছে গেছি
ততক্ষণে আঁধার ঘনিয়ে সন্ধ্যা নামে প্রায়।

ভুল স্টেশনের যাত্রীদের কেউ আর কোনোদিন ফেরত নেয়না।
আমার সমুদ্র আর সবুজ পাহাড়ের জন্য আমি নিঃশব্দে কাঁদলাম।

অতঃপর, নিয়তিকে মেনে নিয়ে এবং কিছু করার না পেয়ে
রুক্ষ-ধূসর ঊষর জমিতে হৃদয় ও মস্তিষ্কের ব্যবহার করে
আমি পাহাড়, সবুজ ও সমুদ্রের আবাদ শুরু করলাম।

সুমন মন্ডল
প্রতিবন্ধক জীবন 

নিজেই নিজেকে খুঁজে চলেছি সারাক্ষণ
কোথাও গিয়ে মনে হচ্ছে খামোখা নাটক করছি
আমি এক অন্য আমি হওয়ার চেষ্টা করছি
নিজেকে ধীরে ধীরে ভুলতে শুরু করেছি
সত্যিই কী পৃথিবী আরেকটু সহজ হতে পারতো না?
জানি বাস্তবটা কঠিন
তবে কিছু মানুষ সেটিকে আরও দুর্ভেদ্য করে তুলেছে
কেন এই লোক দেখানো কার্যকলাপ?
যে যা তাকে সেরকমভাবে বাঁচতে দেওয়া কী খুব অন্যায়ের?

শুভ্র সরখেল
নিশ্চুপ গল্পের নায়িকা

আমার সামনে এরকম করো না
প্রেমের স্বাদ মনে পরে
তোমাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি
ভালো লাগে না - এই ভেবে--- যে তুমি আছো ঠিকই---
কিন্তু অনেক দূরে--- পাবো না কখনো ।
এরকম আর করো না
মনে পরে সব কিছু
যা হয়েছিলো
কিংবা
যা যা আর হতে পারতো।

নীহার জয়ধর
কাপুড়ে কথা 

তোমার কাপুড়ে কথা কেটে নিয়ে পীরানে পাতলুনে
আমি অপেক্ষা করি,
শাড়ির উপত্যকা বা ঘনিষ্ট অন্তর্বাসে
একই বাতাস খেলবে,
আমারই মনোমত ।

আঁশের নিবিড়ে যাইনি কখনো
দেখিনি পর্দার পেছনের গল্প
পাট-মেস্তার ক্ষেত, কাপাস বাগান
অথবা গুটিপোকার ঘর ভেঙে কীভাবে লাস্য পায় সূতা ...

এখন সাইকেলে ওড়না,
বাইকে স্পর্শকাতর স্কার্ফ,
সাহসী অভিমানে বক্ষবন্ধনী,

অথবা চুল না বাঁধার সেই প্রতিজ্ঞায় সেদিন
ঋতুমতীকে আড়াল করছিল যে একাকী বস্ত্র
তারপর নেমে আসা ছায়াপথ ব্যাপী কৃষ্ণকরুণা
সেদিন আমি শুধুই অনুজ দুঃশাসন।

এমন মিথ, মহাকাব্য, ইতিহাস শেষ হয়ে গেলে
সমর্পিত চোখ ক্ষেতের পাশে বাকল বা আঁশে

তোমার সূতার খবর চাই
ভাত কাপড়ের থালায় প্রায়শ্চিত্ত সাজাব
একটা সেতুর জন্য,
তোমার কাপড় তোমার মাপেই নতজানু হবে
আগামী শীতে শরীর- হৃদয়ে  সে উষ্ণতা মুখোমুখি পেতে।

২৪-২৮ নভেম্বর ৩৫
মূল: পাবলো পিকাসো
ভাষান্তর: কায়েস সৈয়দ

আগুনের জিহ্বা বাতাস দেয় মুখে
বাঁশির ভিতর
পেয়ালা যা গান গায় এক খোঁট
নীল ছুরির ক্ষত
আলতোভাবে আলতোভাবে
বসানো বিছানার চোখে
অন্তর্লিখিত এর মাথার ভেতর জেসমিন সুশোভিত
ফোলার অপেক্ষায় ওড়না
স্ফটিক টুকরা
আলখাল্লার ভাঁজে বাতাসে মোড়ানো দুই হাতলের তরোয়াল
ঘামছে মাথা
অন্ধ ব্যক্তির মাঝে রুটি তুলে দেওয়া এবং বেগুনি রঙের ঘুঘু
এর অসদাচারণ জ্বলন্ত ঠোঁটের বিরুদ্ধে শক্তভাবে ঠাসা
শিঙের সাথে দুমড়ানো
বিদায়ী অঙ্গভঙ্গি দিয়ে স্পোকিং করা ক্যাথিড্রল
থাকা ছাড়াই মূর্ছা যাওয়া তার হাতে
একটি পলক যা ফোটে একান্তে
প্রভাত রেডিও যা তার চুম্বনে
ছবি তোলে শয্যাশায়ী রোদের
মৃত্যুর সময় থেকে বের করে সুগন্ধ
এবং চলে যায় কোনো পৃষ্ঠা জুড়ে উড্ডয়নে
ফুলকে করে তোলে অশ্রুসিক্ত
এবং টেনে এনে দেয় দীর্ঘশ্বাসের ডানার মাঝে
এবং ভয় পায় যা এখনো হাসতে পারে
ছুরি যা লাফ দেয় আনন্দের জন্য
ঠিক এখন এই দিন পরিত্যক্ত ভাসমান
যেকোনো উপায়েই এটা হতে চায় যথার্থ
এবং কূপের শীর্ষে প্রয়োজনীয় মুহুর্ত
একটি কান্না গোলাপ
সেই হাতের জন্য রঙিন যা তাকে ছুড়ে ফেলে নিচে
একটি ছোট্ট অভিনয় খ্রিস্টীয় প্রেমের

অণুগল্প
শহরের ভেতরের শহর
কৃষ্ণেন্দু দাসঠাকুর

মেয়ের খালি একটাই প্রশ্ন- “বাবা, এককথায় তুমার কোলকেতাকে কেমন লাইগে?” “আরে আমি কি তুর মতো লিখাপড়া জানা ম্যাইয়া মানুষ যি তুর মতো ওমনধারা কথা বলতে পারব। এই যি ‘পশ্নো’ তারপর হলো গিয়ে ‘এককুথায়’ ইসব কথায় তো আমার মুখ থেকা ভালো করে বের হয়লাকো।”

সি শুনে মেয়ের পরথম পরথম ইমুন ধারা হাসতো... তা বইললে হবে না হাসলে যেন মুখ থেইক্কা মুক্ত ঝরে পড়ে। মেয়েটা হওয়ার পর চম্পা বইললে- “শোনো, আর ছেলেপুলে লোবো না... ইকেই মাইনুষের মতো মাইনুষ কইরবো।” আমি বইললাম- “বেশ তাইই হবেক।”

বিড়িটা ধরিয়ে আপনমনে কথা বলতে বলতে প্রভু খেয়াল করেনি কখন পৌরসভার আর্বজনার গাড়িটা এসে গেছে। গাড়িটা ফাঁকা করে চলে গেলে, ও সেখান থেকে প্লাস্টিকের প্যাকেট, জলের বোতল, মদের বোতল তাছাড়াও টুকটাক নানান জিনিস আলাদা করে বস্তায় ভরবে। গাড়িটা আস্তে আস্তে ডালার পেছন দিকটা উঁচু করছে, আগে বেলচায় করে লোকেই ফেলতে, এখন আপনা-আপনি পড়ে; আগে অবাক হয়ে ওদিকে তাকিয়ে থাকত, এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। ও এখন হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওর সারাদিনের রোজগারের রসদ ঠিকঠাক পড়ছে কিনা।

গাড়ির ডালাটা নামতে নামতে যেন রাস্তার উপর উঠছে, ও একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়লো। অন্যদিন ওর আসতে দেরি হয়ে যায়, আজ সক্কাল সক্কাল চলে এসেছে; অন্যেরা আসার আগেই ও কাজ হাসিল করে চলে যাবে। 

প্রথমে গিয়েই একটা বড়ো ক্যারিপ্যাকেটে হাত দিল। এরকম প্যাকেট থাকলে ওর বেশ আনন্দ হয়। কারণ ওতে অনেক জলের বোতল একসাথে থাকে। আবার কোন মদের আসরের হলে, বড়ো অঙ্কের টাকাও পাওয়া যায়, “একি প্যাকেটটা হাত দিতেই এরকম নড়ে উঠল কেন?”

অতিসন্তর্পণে প্যাকেটের বাঁধা মুখটা খুলে ফেলল, “একটা আস্ত বাচ্ছা মেয়ে, মইনে হচ্ছে অখনই হইছে। কি গায়ের অং। একুনো বড়ো ঘইরের মেয়ে না হয়ে যাই না।” প্রভুর হাত পা কিরকম হিম হয়ে আসতে লাগলো। “এটা কি কারও পাপের ফইসল, নাকি মেয়ে হইছে বুলেই-” ও খুব ভয় পেয়ে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে গুমরে উঠল। নিজের মেয়ের উদ্দেশ্যে বলতে থাকলো-“ওরে তুর প্রশ্নের এককথায় উত্তর আজ আমি দিতি পারব। সি তুই যতই লিখা পড়া করিস। আজ মুখ্য প্রভুর কথাকে কাটতে তুই তো ছাড় গোটা কোইলকেত্তা পারবেক লাই।” 

Monday, June 22, 2020

শিল্প সাহিত্য ৭০


সোমবার ৮ই আষাঢ় ১৪২৭, ২২ই জুন ২০২০




কবিতা
সুবীর দাস
ভাত হত্যা হলে 

একহাত ধরে দারু টানে, আরেক হাত ধরে গরু ।
ভাত হত্যা হয় বলে, ধর্মাবতার, শেষ দূরে থাক বিচার কি হতে পারে শুরু ?
কে সে আসামী ?
ধরো অন্ধ ও বধির রাষ্ট্রের মতো আমি।।
যে আমার চোখে পৃথিবীর সেরা কবিতা ---
বিজ্ঞান নয়, ধর্মের বটিকা চিবুতে চিবুতে উপভোগ করি বিজ্ঞাপন বা বিনোদন বিচিত্রা !
বিধিনিষেধ ? মায়ের ভোগে
অভিকর্ষ টানে বিবর্তন যোগে !

যখন কথা বলে উলঙ্গ বাজার ঈশ্বরের চেয়ে বড় সত্য!

কাজী আতীক
বদলে যাচ্ছে সামাজিক সংস্কৃতির ধরন

এই কিছুদিন আগেও পশুর শিং আর মানুষের কনুই
একই কাজে ব্যবহৃত হতো, অর্থাৎ বলা যায় সমার্থক ছিলো
অথচ এই সংক্রমণ সময়ে বদলে গেছে কনুইয়ের ব্যবহার
এখন কনুইয়ে কনুই ঠেকিয়ে হয় উষ্ণ সম্ভাষণ
হাত মেলানো ইদানিং তলপিতলপা সহ সমাজচ্যুত প্রায়।

আগে ঘরে না এসে সামনে থেকে আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব
এমনকি পরিচিত কেউ চলে গেলে মন খারাপের বিষয় হতো
আর এখন ঘরের বাইরে দাঁড়িয়েই কুশল বিনিময়টা দস্তুর।

মাজহার জীবন 
সন্ধ্যাবাতি

তুমি যেন সন্ধ্যাবাতির শিখা
কোনো এক গাঁয়ের কুড়েঘরে
মৃদু হাওয়ায় হাওয়ায় দোল খাও
একটা জলন্ত জিহ্বা যেন
গুনগুনাও প্রেমের কাসিদা
আমি সেই আশিক
তোমার ইশকের ডাকে
পতঙ্গের মত ঢলে পড়ি তোমার কোলে
এক অনিবার্য ধ্বংসের আয়োজনে

সন্ধ্যাবাতি সবার আলো
প্রিয় মরণ আমার,
প্রিয় মাসুক আমার

রুদ্র সাহাদাৎ 
আবার আমাদের দেখা হবে

দেহপাঠের রচনা পড়তে গেলেই রিরংসা জাগে
উদবাস্তু মন পালাতে চায়,
জীবনের সীমানা পেরিয়ে আরো দূর বহুদূর,
কোনো অজানায়, আমাদের দেহপাঠ হয়নি
                                      আজও
এই বসন্তেও।

কখন কী বলছি, কখন কী করছি, ঈশ্বর জানে।

প্রতিক্ষায় থেকো, এই করোনাকাল গেলে
আবার আমাদের দেখা হবে।

তন্ময় পালধী
অনুভূতি

নক্ষত্রের বিছানায় শুয়ে
একটা একটা তারার অবয়বে,
তোমার লাবণ্যদ্যুতি ঝলমলিয়ে উঠছিল যখন,
আমি ধ্রুবতারা হয়ে থাকতে চেয়েছি।
চেয়েছি চাঁদের মতো স্নিগ্ধ হব
আঙিনা জুড়ে খেলা করব সারাক্ষণ
তুমি সেই স্নিগ্ধ জোছনায় স্নান করতে করতে,
আমার গভীরে ডুবে যাবে।
ভেবেছি গভীর হব পাতালের মতো,
যেখানেই দাঁড়াও আমারই ধারক পাবে,
আমি সেই ভার বহন করতে করতে,
তোমাতে আমাতে লীন হব।
লীন হয়ে যাবে সময়ের স্রোত-
সম্পর্কের পাড় ছুঁয়ে,
সামনের দিকে তোমার পরিণতি বোধে-
আমি সমুদ্র হয়ে সব মান অভিমান শুসে নেব।
 ----------------------------------------- কথা
                                                       
বসন্ত বাতাস যখন মন ছুঁয়ে খেলা করতে চায়,
গহীন হৃদয়ে, তখন কথাগুলোর মিষ্টতায়,
তীব্র আসক্তি ঝরে পড়ে চোখ মুখ দেহ বেয়ে। স্পর্শের ও গন্ধ আছে
আছে শব্দহীন অনাবিল প্রশান্তির অনুভব,
সে কথা বুঝতে বুঝতে কথাতেই ঘোর ভাঙে।
এসবই অলীক কল্পনা নিছকই স্বপ্নের মায়াজাল,
হিসেবী সম্পর্কের রসায়নে,
ভাষার রাজমহল যেভাবে রচেছিলে তুমি,
সে মগ্নতায় ডুবে ছিল আমার আমিত্ব,
টুপটাপ ঝরে পড়া বৃষ্টির মতো রাঙানো কথায়,
ঘুণধরা! তবু প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে চায়।

মুতাকাব্বির মাসুদ
চোখের লাশ

এখানে এই চোখের বেলকনিতে
এক চিমটি আলো ছিলো
এক ঝাঁক আলোমতি জোনাক ছিলো
ভালো ছিলাম ভালোই আছি!
তোমায় নিয়ে ভালো থাকবো বলে এখন আমি
একেবারে গ্রহণের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি!
চোখের জলে তোমার চোখের আলোয়
আমার এ পথচলা!
অন্তর বাহিরে কেবল
কখনো আলো কখনো আঁধারের খেলা!
তোমার আমার অতি নিকটবর্তী সম্পর্কের
দূরবর্তী মধ্যগগনে, আজ এই মধ্যবয়সে
বয়সী চশমার অনুদ্বেগ শরীর বেয়ে,
কেবলই নামে সমুদ্রের হিমশীতল দুর্বোধ্য
বরফ পেঁজার বিন্দু
তোমারই অনুদানে পাওয়া
অনধিগম্য আলোর শরীরে খেলে
আজ মৃত আলোর কণা
আলোর ঘরে আলোর দ্যোতিত আঁধার
তাহলে আমি কি দেখেছি চোখের আলোয়
তোমারই চোখের লাশ?

মিলন ইমদাদুল
প্রিপারেশন অব সুইসাইড

আত্মহনন বিষয়টা মোটেও এতোটা সহজ নয়-
যতোটা না মুখে বলা যায় !
আত্মহত্যায় অবশ্যই পূর্ব প্রস্তুতি থাকা একান্ত প্রয়োজন।

কোন একদিন বুকভরা ব্যথা নিয়ে ভাবলেন-
নিষ্ঠুর এ পৃথিবীতে বাঁচবার ইচ্ছে নেই আপনার!
ভেবেচিন্তে সত্যিই ঠিক করলেন নিজেকে হত্যা করবেন কোন ঔষধে!
কিংবা জনমানবহীন একটি দোচালা ঘরে ফ্যানে
চুপচাপ ঝুলিয়ে পরবেন!

পরেরদিন কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে
নির্জনে চললেন শক্ত মজবুত রশি হাতে!
এবং কাঁপা কাঁপা হস্তে টুলে দাঁড়ালেন,
ফাঁসিটা গলায় ঝুলানোর প্রায় ত্রিশ সেকেন্ডে পূর্বে-
সহসা মনে পরলো...

গত মেলায় কেনা প্রিয় বইটি এখনো পড়া হয়নি-
অতঃপর নেমে পরলেন মেঝেতে
ফ্রেশ হয়ে নিলেন এবং বইটি পড়লেন আপনমনে,
তৃতীয় দিন আপনার সত্যিই মনে হলো-
“আত্মহত্যার চেয়ে বেঁচে থাকাই বরং শ্রেয়”!

ছোটগল্প
সংক্ষিপ্ত জীবন
মাহমুদুল হক আরিফ

খুব কম দিন নীলু খালা আমার খালুকে কাছে পেয়েছে। আমি বড় হওয়ার পর বুঝতে পারি এটা একরকম সেক্রিফাইজ। কাজের সূত্রে খালুজান মধ্যপ্রাচ্যের মরুভ‚মি অঞ্চলে থাকতেন, তিন বছর বাদে বাদে আসতেন। প্রায় আঠের বছর তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। নীলু খালার ছয় ছেলেমেয়ে। তাদের বয়সের পার্থক্য তিন বছর করে। খালু কর্ম জীবনে দেশে এসেছেন ছয়বার। বছরে একুশ দিন ছুটি পেতেন কিন্তু প্লেন ফেয়ারের কথা বিবেচনা করে এক সাথে তিন বছরের জমানো ছুটি- নয় সপ্তা হাতে নিয়ে তিনি দেশে ফিরতেন। খালু ছুটি কাটিয়ে চলে যাওয়ার পর খালার শরীরে একটা পরিবর্তন আসতো। তিনি প্রতিবার খালার জঠোরে একটি বীজ বপন করে যেতেন, তার রেখে যাওয়া চিহ্ন বেড়ে উঠতো খালার শরীর বেয়ে। খালু প্রতিবার ফিরে এসে দেখতেন তার নতুন সন্তানটি উঠোনে আলতো পায়ে হাঁটছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। একটা খেলনা হাতে তুলে দিয়ে বলতেন মাশাল্লা আল্লার নেয়ামত। অগন্তুককে দেখে বাচ্চাটি গুটিগুটি পায়ে দৌঁড়ে পালাতো। খালু শাসকের মতো দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে গর্বিত চোখে তার বংশের বিস্তার দেখতেন। ছেলে-মেয়েদের ডেকে, জরিয়ে ধরে উষ্ণ হতেন, ওম নিতেন। কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তাপ দিতেন। তারপর একটা আর্ম চেয়ারে বসে আমীরের ঢংয়ে পর্শীদের খেজুর খুরমা, বড়দের জন্য জায়নামাজ, ছোটদের জন্য চকলেট চুইংগাম বিলি বণ্টন করে একটা সময় উঠে দাঁড়াতেন। এক জীবনের সঞ্চয়- তাঁর কষ্টসাধ্য শ্রমের টাকায় একচালা ইটের বাড়িটা কতটা পোক্ত হয়েছে ঘুরেঘুরে দেখতেন! বাড়ির চতুরদিকে আর্মি জেনারেলের মতো পা ফেলতেন এমন এক ভঙ্গি করতেন এ সাম্রাজ্য তার।

খুব অনভিপ্রেত কথাগুলো বিবৃতির মতো বলতে থাকে সাদেক। ও জীবনের মানে খুঁজছে। এক জীবনে মানুষের কাজ কী? মিনিংফুল লাইফের মানে কী? ইদানীং ভাবছে আর মানুষের জীবনকে সারসংক্ষেপ করে বলছে। এমন লোককে কে মনে রাখবে? কেন মনে রাখবে? মরে গেলে আমরা আর মনে রাখি না কেন? উত্তর খুঁজছে! পরিবারের একমাত্র কাজ কী বংশ বিস্তার! রুস্তমকে জোরকণ্ঠে স্বর বাড়িয়ে আরেক কাপ করে চা দাবি করে- সাদেক। 
বসে থেকে শুনছিল মতি। সে বলল তোমার স্টেটমেন্টে একটা বিষয় খুব পরিষ্কার। 
কী? 
খালুর প্রতি তোমার কোন ক্ষোভ আছে। বিবৃতিটা বিচার করলে দেখবে বিদ্বেষে ঠাসা। তুমি সংক্ষেপে তাঁর বিরুদ্ধে উত্তেজনা তৈরি করছো। 
সাদেক কিছুতেই মানতে নারাজ। বললো নীলু খালার জীবনটা তো আরো সংক্ষেপ! 
কী রকম!
খালার জীবনে সে ছয়বার আতুরঘর দেখেছে পারস্যদেশ দেশ থেকে এসে বিশ বছরে খালু তাকে আর কোন ঘর দেখাতে পারেনি। কোথাও বেড়াতে নিয়ে যায়নি। খালা বাপের বাড়ি আর নিজের বাড়িতেই পুরো একটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। যদি জিজ্ঞেস করতাম খালা তোমার বাইরের দুনিয়া দেখতে ইচ্ছে করে না?
উত্তরে খালা বলেছিল একবার তোর খালুকে বলেছিলাম সমুদ্র কেমন একবার দেখাবা? তোর খালু ঐ বার বাড়ির পাচিলটা আরো দুই ফিট উঁচু করে দিয়ে যায়। বললাম কেন? বলেছিল তাঁর আমীরের ঘরে মেয়ে সন্তান হওয়ার পর পাচিল আরো উঁচু করে দিয়েছিল। সে বার লিলি জন্ম গ্রহণ করেছিল।

আমার নীলু খালা জীবন ভর আমীরদের সংস্কৃতি টেনে নিয়ে গেছে। তাঁর দীর্ঘ বেঁচে থাকা জীবনের আলোচনা, এক কাপ চায়ের গল্পের চেয়েও সংক্ষিপ্ত!

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক