বৃহস্পতিবার ২৮শে জ্যৈষ্ঠ ১৪২৭, ১১ই জুন ২০২০
কবিতা
শুভ্র সরখেলপ্রেম
কদম ফুলের জ্বরের বিছানায়
তোমার ক্ষুদ্র যৌন যাপন !
আমার রঙিন নখের প্রতি তোমার এতো আগ্রহ ?
একটু স্নিদ্ধ প্রেম দিতে পারো আমায়?
যেখানে শুধু একটু ঘুম হতে পারে ঈশ্বরের পথ---
কিংবা---
প্রেম ?
মৃত্যু কতটা সত্যি হলে তোমার প্রেমের অবয়ব হতে পারে শূন্য ?
আমার মনের হাঁড়িতে নীল চুলের পরীরা নৃত্য করে আবিরাম ।
আসো না আরেকবার আমরা মিথ্যে বলি---
সত্যের মতো করে আরেকবার!
মিলন ইমদাদুল
আমার মৃত্যুর পর
মৃত্যুর পর আমার লাশ প্রথম যখন বাড়িতে নিয়ে আসলো স্বজনেরা-
আমার মা তখন কান্নায় বিভোর,বাবা অঙ্গান হয়ে গেলেন মিনিটেই !
কাঁদলেন পাড়া পড়শি অনেকেই কিন্তু আমার বোন-
না আমার বোনটি কাঁদতে পারেনি একটুও !
আসলে আমার এমন অকাল মৃত্যু ও মানতে পারেনি মোটেও
আত্মীয় স্বজন সবাই আসলো, আমাকে গোসল করানো হলো!
সবাই আমাকে শেষবার দেখতে ইচ্ছুক-
আর আমি বাবাকে দেখতে ইচ্ছুক!
মনে হচ্ছে কতোকাল ধরে বাবাকে দেখিনা-
লাশটিকে খাঁটিতে রেখে সোজা চললাম বাবার ঘরে-
না সেখানে বাবা নেই ,
বোনকে বললাম বাবা কোথায়?
ও আমার কথার কোনো জবাব দিলো না!
ছুঁটে চললাম কলপাড়ে দেখি বাবা শুয়ে আছেনÑ
আর দু’চার জন পানি ঢালছেন বাবার মাথায়!
আমি জিঙ্গেস করলাম কি হয়েছে বাবার ?
আমার কথার কেউ কোনো উত্তর দিলোনা-
যেন কেউ কিছু শুনছেই না!
আমি রাগ করে পুনরায় খাটিতে এসে শুয়ে পড়লাম!
আমার চোখে প্রচুর ঘুম, যেন কতোকাল ঘুমাইনা একা
মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে
আচ্ছা মা কি এখনো কাঁদছে, আমার শোকে!?
সরকার অরুণ কুমার
তবে এবার যাই
দেখবার মতো মুখ নাই
সব মুখ বুজে থাকা ডাকের বাক্স।
নির্জনের সময় এসে হাওয়া দিয়ে যায়
শিরায় এসে ধাক্কা খেয়ে আবার
ফিরে যায় সন্মোহনী।
তপ্তদেহে ছুঁয়েছিলাম উড্ডীন বক্ষমুখ
যা জন্মসূত্রে
পিছু নিয়ে ঘুরছে অনন্ত উন্নয়ন
যেখানে রক্ত ছুঁয়েছে হারামের স্রোতে
কোনো প্রকার নালিশ ছাড়াই।
প্রিয় ঠোঁটের কাছে নেমে আসে উন্মত্ত চুমু
এই তো ব্যক্তিগত পবিত্রতা ...
একচক্ষু ঈশ্বর অবাক তাকান
বিষণ্ন সময় চলতে থাকে ...
কে যেন বলে ওঠে, “তবে এবার যাই”
কায়েস সৈয়দ
কহর
বৃষ্টি
ধানক্ষেত
দুপাশে অরণ্য
পিচঢালা পথে ছড়ানো ছাতার সৌন্দর্য
এ’পথ ধরে স্বর্গে যাওয়া যেতো,
যেখানে যাচ্ছি সেটা স্বর্গ নয়, শহর!
কামরুন নাহার রুনু
আলো হবো আলো
আশ্বিনের পূর্ণিমা তিথিতে করেছি স্বর্গবাস
ওগো জ্যোৎস্না-ভরা অভিমানী রাত
এখন আমার যতো রঙ-রূপ সবই তোমার দেয়া
আজ চোখের জলছবিতে শুধুই তোমার আসা-যাওয়া।
এই কৌমুদী রাতে দিগন্তের প্রশস্ত বুকে
আকাশের দেয়াল ডিঙিয়ে একঝাক উল্কাপিণ্ড
তৃষ্ণার্ত মরুভ‚মির বুক বরাবর জলের কারুজ মন
ছুঁইয়ে দিলো পাথরের বুক, আর সেই থেকে
এক-সমুদ্র ভালোবাসার রঙ নতুন করে জন্ম নিলো।
পৌষের সোহাগী কাচের জানালায়
আঙ্গুলে আঁকি যুবতী রাতের নিঃশ্বাস
কোজাগরী জ্যোৎস্না ছুঁয়ে চাঁদের গায়ে
আঁকা দেখি তোমার ত্রিভুজশৈলী...
অণুগল্প
শেষ ইচ্ছেজাহিদুল মাসুদ
এক ফাঁসির আসামীকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আপনার জীবনের শেষ ইচ্ছা কি? আপনি কি বিশেষ কারও সাথে দেখা করতে চান?’
আসামী উত্তর দিল, না।
‘আপনি কি বিশেষ কোন খাবার খেতে চান?’
‘না।’
‘আপনার জীবনের কি এমন কোন সাধ ছিল যা এখনো পূরণ হয়নি?’
‘মৃত্যুকে সামনে রেখে মানুষের মাথায় এসব চিন্তা আসে কি করে?’
‘তাহলে আপনার বিশেষ কোন ইচ্ছা নেই?’
‘আছে। কিন্তু তা আপনারা পূরণ করতে পারবেন না।’
‘বলুন, শুনি।’
‘আমি একবার মৃত্যুকে দেখে ফিরে আসতে চাই। দেখাতে পারবেন?’
‘বলেন কি! তা কি করে হয়? তবে একটা গবেষণা সংস্থা আছে, ‘নেয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স’। কিছু রুগী এই গবেষণায় মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসে। কিন্তু পুরোপুরি মৃত্যুর পর কেউ ফিরে আসে না। সর্ব শক্তিমান ছাড়া এ ক্ষমতা মানুষের নেই।’
‘তাহলে আমার কোন শেষ ইচ্ছে নেই।’
মুক্তগদ্য
সাজ্জাদ সাঈফ
জ্যোৎস্নার থোকা থোকা আলোরহস্যে ডুবতেছে চারধার, আমরা দুজনে চুপ, যেনো ভারী এক পাথর দুইজনের হৃদপিন্ডরে তলায়ে দিতেছে কোনো অস্থিরতায়, দুইজনে চুপ।
দুইজনে মানে আমি আর সে, দুইটা রূপ এক আমি’র। মানে নিজের ভিতর কথা বলা না বলা আলোছায়ায় আরেক ‘আমি’ মুখোমুখি। অনেকদিন পর যেমন কোনো আত্মজিজ্ঞাসায় বিব্রত লাগে মানুষের, অতীত মনে করে। এই এক স্বগত জার্নি। কতোদিন আগেকার কথা। তখন মা বেঁচে ছিলেন। আমি ছিলাম ঘটিবাটিহীন বেকার। না কাজকাম, না প্রেমটেম, না প্রতিষ্ঠা। বন্ধুরা একে একে এখানে সেখানে থিতু হইতেছে তখন। আর মায়ের কারসিনোমা, বাবার স্ট্রেস। তমার বিয়ের সব ঠিকঠাক। একের পর এক চাকরিতে ইস্তফা আর বিজনেসে ল্যাং, সব মিলিয়ে আমি নিরুপায় বার্ডেন একটা।
সব কথা চুপচাপ ইশারায় বলে যাচ্ছে ভিতরমানুষ। আজকের জ্যোৎস্নায় কেমন একটা পাড়াবেড়ানি আবছায়া ভাব। সারাদিন সামান্থার পাশে ওর মাকে একটু পরপর ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখেছি, মন বিচিত্র সব এঙ্গেল থেকে দৃশ্যের পর দৃশ্য হাজির করতেছে মগজে। এই কয়দিন আগেই গ্রাম থেকে সামান্থার স্কুলের গ্রীস্মকালীন ছুটি কাটিয়ে ফিরলাম আমরা। আমাদের একমাত্র মেয়ে। ক্লাস নাইন। বাবার নিঃসঙ্গ মুখ রেখে আমরা ঢাকায় ফিরতেই মেয়ের জ্বর। মিতা এমনিতেই হাই সুগারে ভুগতেছে অনেকদিন, তার ওপর মেয়ের অসুখ বাঁধলে প্রচন্ড ঘাবড়ে যায়, জ্বর একবার নামে তো আরেকবার কাঁপুনি দিয়ে আসে, তড়িঘড়ি করে ডাক্তার-টেস্ট-এডমিশন, টাইফয়েড ফিভার।
মা-মেয়েকে নার্সিং হোমে রাতের খাবার খাইয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত গভীর এবং ততোধিক গম্ভীরও। মেয়ের জ্বর সামান্য নিয়ন্ত্রণে এলেও হঠাৎ কি জানি হলো ওর আচরণে, এই চুপ এই ক্ষিপ্ত, ঘুম উধাও, নিজের গায়ে আঘাত করতেছে তো কারণ ছাড়াই কেঁদে ফেলতেছে, ডাক্তারের বক্তব্য বলতেছে টাইফয়েড সাইকোসিস মানে টাইফয়েডজনিত মনোবৈকল্য। নিজের ভিতরমানুষটা চেঁচিয়ে ওঠে আমার। সাইকোসিস শব্দটা আমার পরিচিত, মায়ের শেষ কতোগুলা দিন এই শব্দে কাতর ছিলো মনে পড়তেছে বারবার।
কাল সকালে জমা দিতে হবে অফিস-রিপোর্ট। ল্যাপটপে ডাটা এন্ট্রি করতে বসতেই সেই ভিতরমানুষের পায়চারি বুকে। মাকে মনে পড়তেছে বারবার। টিভির ভলিউম কমিয়ে দিলাম। ইয়েমেনে সৌদী আগ্রাসন, আফ্রিকায় ইবোলা এন্ডেমিক, লক্ষ লক্ষ শরণার্থী নিয়ে বাংলাদেশ-মায়ানমার ক‚টনৈতিক টানাপোড়েন। মনে হইতেছে সমস্ত ফাঁদ গুটাইতেছে নিয়তি। মাকে মনে পড়তেছে।
মায়ের শেষযাত্রার সঙ্গী ছিলো সাইকোসিস, ভিতরে যেনো হাতুড়ি পিটাইতেছে কেউ, বুকে ধড়ফড় ভাব কাজ করতেছে, মা আমার আর মিতার বিয়ে মেনে নেন নাই শেষমেশ, সামান্থার জন্মের সময়টাও গোপণ রাখছিলাম আমরা, ততোদিনে মায়ের কারসিনোমা কোলন ধরা পড়ে গেছে, ডাক্তাররা কোলন ক্যান্সার বলে সিদ্ধান্ত নেয় কেমোথেরাপির, এই অবস্থায় মেয়ের জন্মের সংবাদও মাকে ক্ষিপ্ত করবে এই আশংকা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো। কেননা মা মৃত্যু অবধি মিতার মুখ দেখতে চাইতেছিলেন না। নিজের ভিতর অপরাধবোধ ভারী হচ্ছিলো আমারও।
সামান্থার চেহারাটা দিনকে দিন আম্মার চেহারার ধাঁচ নিতেছে, আজকাল আম্মার কথা মনে হইলেই মেয়ের মুখটা দেখি। মেয়ে আমার খুব জেদী হইছে, দাদীর মতন, একরোখা। আর মেয়ের সাইকোসিস মানে মনোবৈকল্য নিয়ে সারাদিন ঘাবড়ে থাকা মিতার খাওয়া দাওয়া এক প্রকার বন্ধের উপক্রম। আম্মার চেহারাটা ভাসতেছে তো আব্বার নিঃসঙ্গ বার্ধক্য, মেয়ের সাইকোসিস, চিন্তার ওজনে মাথাটারে শক্ত পাথর মনে হইতেছে আমার।
আমার ধর্মভীরু মা কি এইসব দেখতেছেন জ্যোৎস্নার ওই পাড় হতে? আর সাইকোসিস, আমার প্রতি মায়ের খেদ নাকি? মেয়ের মনোজগতে সেই খেদ আইসা জায়গা নিলো শেষে? মা আমাদের ক্ষমা করেন নাই লাস্টলি?
সত্যি অনবদ্য হয়েছে!
ReplyDelete