সোমবার
১৫ই আষাঢ় ১৪২৭, ২৯ই জুন ২০২০
কবিতা
তপনকুমার দত্তকরোনা কালীন এক লাইনের দশটি কবিতা
১
তাই তো জীবন শক্ত করেই বাঁধছে মাস্ক করোনা লড়ায়ে।
২
করোনা এ এক অদ্ভুত মন খারাপ যাপন।
৩
এখন সময় ভালোকে আঁকড়ে গভীরে থাকার।
৪
এ এক অদ্ভুত সময় মনন গাঁথছে ভিন্ন যাপনলিপি।
৫
বালিশে থাকে না মাথা ঘোর দুর্যোগে জাগে লকডাউন শরীর।
৬
স্বপ্নের ঘোরে দেখি অতীত যাপন।
৭
করোনা আতঙ্কে থমকে আছি আমি আমার পৃথিবীও।
৮
লকডাউন বিধিতে চেনা চোখে কথা বলে দুই মাস্কধারীতে।
৯
লকডাউনের দিন গাছেদের ছায়া দেখি মানুষ বিহীন।
১০
জানালা দরজা খুলে আলো নিই ঘরে করোনা মৃত্যু বাড়ে রাতের আঁধারে।
মজনু মিয়া
আক্রান্ত সময়
ক’দিন আগেই ভালো ছিল পৃথিবী, ভালো ছিল মানুষ
পাগলা হাওয়া লেগে পালে, মানুষ হয়ে গেছে বেহুশ।
স্তব্ধ হয়ে আছে পৃথিবীর আনাচে কানাচে আনাগোনা,
কর্মহীন জীবন সদা সংশয় কি হয় কি হয় নিত্য এ ক্ষণ গুনা।
ডাষ্টবিনে এখন আর কুকুরগুলোও দেখি না, ওখানে খাবার নেই
দেককান পাঠে চলে অবরুদ্ধ অবস্থা ভেতরে সুখ হারা এমনিতেই।
অর্থের ঝনঝন এখন কমে আসছে বাহারী ভাব নেই, রঙ তামাশায়
কেউ কেউ দেখে ঘেউঘেউ করে মরছে না খায়ে ওপাড়ার কুকুরগুলো।
বাঁচা দায় হয়েছে এমন আক্রান্ত সময়ে, কবে মিলবে নিস্তার?
কোথাও এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না, কারণ পৃথিবী আক্রান্ত রোগে বিস্তার।
খাতুনে জান্নাত
যাবতীয় সন্তাপ
পথ চিনতে চিনতে সকালগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে ভোর...
বৈশাখ গুজরাতে গুজরাতে চৈত্রের খরায়
টেবিলে চায়ের বাষ্প, সিগারেটের ছাই।
কিটেরা মিলেমিশে গুছিয়ে নেয় সংসার।
এরই ফাঁকে কেউ কেউ লিখে ফেলে অগনিত প্রেমপদ্য।
রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে পাহারাদারের সতর্কিত হুইসেল
অথচ চুরি হয়ে যায় প্রতিদিনের মনিমুক্তো;
কারও কারও মতো আমরা টুপিতে ঢাকি অন্ধকার ও যাবতীয় সন্তাপ...
শুভ্র সরকার
ফুলের আয়ু নিয়ে, গাছের কি
দুঃখ হয়?
১
এবং সমস্ত ফুলই তো জারজ!
তার ত্বক
তার আয়ু
তার ভান
তার রুহ
তার ভাষা
তার সমস্ত শরীর জুড়ে ঘাঁ!
অথচ
ফুলের
বিরহে
বুকের ভিতর ঘেমে উঠছে কথারা-
২
কথোপকথন এমন দরজা;
যার দু’পাশে দু’জন মানুষ, অন্যপাশে ভেবে নিচ্ছে-
নিজেকে...
৩
হাতুড়ির নিচে পেরেকের হৃদস্পন্দন বোঝ?
আহমেদ সুমন
স্বপ্নচর
একদিন বলেছিলে আমায় ঘরে তুলে নিবে
কিন্তু আজ; সমাজের দোহাই দিয়ে
ফেলে গেলে একা
এই স্বার্থপর পৃথিবীতে।
তবে কি তখন শুধু মোহ
আর লালসা ছিল?
নাকি লোক দেখানো আবেগ?
আর আজ তুমি বিবেকের কাছে
নিজেকে মিলিয়ে নিচ্ছো
হিসাব কষছো তোমাতে।
আমি চাই না এই ভালোবাসা
সর্বনাশার মূল হোক,
বিধির বিধান অলঙ্ঘনীয়
যাচ্ছে জীবন, যাবেই তো,
কষ্ট নেই তাতে।
ধারাবাহিক গল্প
সে রাতে কেউ ছিলনাআপন রহমান
তখন প্রায় ভর দুপুর। বিরামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোপীনাথ বাবু একাকি অফিস কক্ষে বসে কী যেন ভাবছেন। সম্ভবত অন্য শিক্ষকেরা যার যার ক্লাসে চলে গেছেন। আমি ওনার রুমের সামনে দিয়ে একবার এদিকে একবার ওদিকে পায়চারী করছি। ভিতরে ঢুকতে কিছুটা সঙ্কোচ হচ্ছে। কেননা; না খেয়ে না নেয়ে, অনাদরে অবহেলায় চেহরার যে শ্রী হয়েছে তা একটা জাত পাগলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। পাছে পাগল ভেবে আমাকে আবার তাড়া না করেন। কিন্তু আমাকে তো ঢুকতেই হবে। তা না হলে ...। অনেক ভেবে চিন্তে অবশেষে পা বাড়ালাম রুমের ভিতর। স্যার আসবো ? -আসবো মানে; এসেই তো পড়েছেন। এসে পড়িনি স্যার এসে দাঁড়িয়েছি। -আচ্ছা ঠিক আছে এবার বসুন। কোথায় বসবো স্যার, চেয়ারে নাকি মাটিতে ? চেয়ারেই বসুন। ধন্যবাদ স্যার, তাহলে বসলাম। -এবার বলুন আপনার জন্য কী করতে পারি? -আমার জন্য তেমন কিছু করতে হবে না স্যার, আসলে আমি এখানে এসেছি আপনার কাছ থেকে কিছু তথ্য জানতে। দয়া করে সেটুকু জানালে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। -আচ্ছা বলুন, কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি? অবশ্য আমার হাতে বেশি সময় নেই ক্লাসে যেতে হবে। যা বলার দ্রুত বলুন। বলছিলাম স্যার, আপনি ইরা নামে কাউকে চেনেন? -ইরা! বিস্মিত চোখে গোপীনাথ বাবু তাকালেন আমার দিকে। তারপর নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বল্লেন হ্যাঁ চিনি-চিনিতো। তবে এত বছর পর আবার সেই পুরনো কাসুন্দি ঘেটতে এসেছেন কেন? বিস্ময়ের সঙ্গে আমি জানতে চাইলাম। -পুরনো কাসুন্দী মানে? চশমাটা মুচতে মুচতে গোপীনাথ বাবু বল্লেন না-না-কিছু না। বলুন আপনি কী জানতে চাচ্ছিলেন। আমি বুঝতে পারলাম গোপীনাথ বাবু কী যেন একটা লুকাচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন করতে সাহস পেলাম না। ওনাকে দেখেই বোঝা যায় উনি কিছুটা রাশ ভারি লোক, পাছে আমার আসল উদ্দেশ্য মাটি হয়ে যায় সেই ভয়ে। আমি বলতে শুরু করলাম। আমার বয়স তখন ২২ বছর। ঢাকার চারুকলায় সবে ভর্তি হয়েছি। ভর্তির কিছুদিন পর ক্যাম্পাসে ইরা নামের এক অপরূপ সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। চমৎকার বন্ধুত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি হয় দু’জনের মধ্যে। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম, প্রেম থেকে বিয়ে। কিন্তু বিয়ের রাতে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। যে ঘটনার কথা চিন্তা করলে, আজও আমার সমস্ত শরীর পাথর হয়ে যায়। বিয়ে করে আমরা উঠেছিলাম আমাদের এক বন্ধুর বাড়িতে। বাড়িটি ছিল একেবারে নির্জন। বন্ধুর বাবা, মা বিদেশ থাকেন। ও থাকে বারিধারায় ওর খালার বাড়িতে। বাড়িটি দেখা-শোনা করে কেয়ার টেকার রহিম খাঁ। রহিম খাঁ ও এক রহস্যময় ব্যক্তি বয়স পঁচাত্তরের কাছাকাছি হলেও বেশ শক্ত সামর্থ্য। খান্দানী গোঁপ, লাল টকটকে গোলাকার দুটো চোখ। কী এক গভীর রহস্যময় তার চাহনি। কিন্তু লোকটা নাকি বোবা কথা বলতে পারে না। কোথা থেকে এসেছে কী পরিচয় কেউ জানে না। একাত্তর সালের এক রাতে নাকি লোকটা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসে ওদের বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিল তখন বন্ধুর বাবা মা দেশেই ছিল। যুদ্ধের পর যখন ওনারা বিদেশ চলে গেলেন। তখন ওকে বলে গেলেন। ‘লোকটা খুব ভালো ওকে কখনও তাড়িয়ে দিস না।’ সেই থেকে আজ অবধি উনি ও বাড়িতে থাকেন। রহিম খাঁ সম্পর্কে এ তথ্য টুকু বন্ধুটি একদিন আমায় বলেছিল। কিন্তু যেদিন ও বাড়িতে উঠলাম সেদিন ঘটল অদ্ভুত সেই ঘটনা। তখন রাত সাড়ে দশটা আমি ইরা, আর নীরব (আমার বন্ধু) আমরা গেট পর্যন্ত সবে পৌঁছেছি। হঠাৎ নীরবের ফোন বেজে উঠল। অপার প্রান্ত থেকে কে যেন বল্ল তার খালা ভীষণ অসুস্থ। নীরব কোন রকম আমাদেরকে লোকটার হাতে তুলে দিয়ে ছুটতে ছুটতে চলে গেল। লোকটা আমাদেরকে দোতলার একটা কক্ষে নিয়ে গেল। কক্ষটা খুলতেই আমি অবাক সমস্ত ঘর চমৎকার করে ফুল দিয়ে সাজানো! লোকটা জানলো কীভাবে? যে আজ আমরা এখানে উঠব। আজ আমাদের বাসর রাত, কিন্তু পরক্ষণে ভাবলাম নীরব নিশ্চয় এনাকে বলেছে এভাবে সাজাতে আমাদের চমকে দিতে এসব ওরই কারসাজি। আর দশটা স্বামী স্ত্রীর মতোই বাসর রাতে বেশ গল্পগুজব আনন্দ ফুর্তি করতে-করতে ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙলো তখন আনুমানিক সকাল দশটা। পাশ ফিরে দেখি পাশে ইরা নেই । এ দিক ওদিক ঘরের কোথা ও তাকে খুঁজে পেলাম না, ঘরের ভিতর থেকে রাতে যেভাবে শিকল এটে দিয়েছিলাম সেভাবেই আটা। আমি চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম কিন্তু কোথাও কোন সাড়া শব্দ কিংবা প্রতিউত্তর পেলাম না, ফোনটাতেও চার্জ নেই ডেড হয়ে পড়ে আছে। ঘরটাতে রাতে আলো দেখেছিলাম কিন্তু এখন আর বিদ্যুৎ কিংবা আলোর কোন অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছি না। দরজায় আঘাত করতে শুরু করলাম তাতেও কোন লাভ হচ্ছে না। ভাঙ্গতে চেষ্টা করলাম তাও পারলাম না, এভাবে চিৎকার চেচামেচির এক পর্যায়ে আমি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লাম যখন জ্ঞান ফিরলো তখন চারদিকে গভীর অন্ধকার। বুঝতে পারলাম গভীর রাত। এখন আর আমার ভয় করছে না। দীর্ঘক্ষণ দুর্গন্ধ যুক্ত স্থানে থাকলে দুর্গন্ধকে আর দুর্গন্ধ মনে হয় না। সেরকম দীর্ঘক্ষণ ভয়ের মধ্যে থাকলে এক সময় আর ভয়কে ভয় মনে হয় না। এটাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আমারও তাই হল। আমি তখন নিজেকে এই ভয়ংকার পরিবেশের সাথে বেশ মানিয়ে নিয়েছি। অন্ধকারটাই যা একটু সমস্যা । তাছাড়া অন্য কোন সমস্যাকেই আর সমস্যা মনে হচ্ছে না। শুধু ইরার জন্যে প্রচন্ড দুঃচিন্তা হচ্ছে। কী অদ্ভুত কান্ড হঠাৎ কাকের পালকের মত অন্ধকার ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠল। আর্শ্চয় ব্যাপার আমি একটু চমকেও উঠলাম না। আগেই বলেছি দীর্ঘক্ষণ ভয়ের মধ্যে থাকতে থাকতে আমার কাছে ভয়কে আর ভয় মনে হচ্ছিল না। কিন্তু একটা জিনিস দেখে আমার ভয়ের অনুভ‚তিটা পূণরায় জাগ্রত হল । হঠাৎ দেখি সেই অদ্ভুত লোকটা ! সেই অদ্ভুত লোকটা আমার সামনে দন্ডায়মান। লোকটা তার লাল চক্ষু দু’টো পাকিয়ে বিশালকার ভ‚ড়িটা দুলিয়ে দুলিয়ে অদ্ভুত শব্দে খিক্ খিক্ করে হাসছে। হাসছে তো হাসছেই। সে এক রহস্যময় হাসি। ভয়ে আমার সমস্ত গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসছে। আমি ক্রমেই আমার নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি। এবং একপর্যায়ে আমি সম্ভবত জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। যখন জ্ঞান ফিরলো হাতের ঘড়িতে দেখলাম ১৩ তারিখ শুক্রবার বেলা ১২ টা ১ মিনিট ৪২ সেকেন্ড। আমি বুঝতে পারলাম তিন দিন তিন রাত পর আমার জ্ঞান ফিরেছে। ১০ তারিখ বুধবার রাতে ঐ অদ্ভুদ মানুষরূপী জন্তুটা আমাকে দর্শন দিয়েছিল। সামনে টেবিলের উপর চোখ পড়তেই মনে এক অন্যরকম আনন্দের উদয় হল। টেবিলের উপর নানা রকম ফল- ফলাদি সহ বড় একবাটি মুরগির রোস্ট দেখে জিবে পানি এসে গেল। বেশ কিছু দিন না খাওয়া। পেটের ভেতরটা ক্ষুধায় চো-চো করছে। জানতাম ৩-৪ দিন কোন ব্যক্তি পানাহার না করলে সে মৃত্যুর মুখে চলে যায়। আমার সে রকম কিছু মনে হলো না কিন্তু প্রচন্ড ক্ষুধাটা অনুভব করছিলাম। আমি দৌড়ে গিয়ে গপা-গপ খাবার গুলো সাবাড় করতে লেগে গেলাম। খাওয়ার এক পর্যায়ে হঠাৎ আমার পিঠের উপর একটি হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। হাতটা স্বাভাবিক মানুষের হাতের মত নয়। প্রচন্ড শীতল একটা হাত, সেই সঙ্গে গভীর একটা কণ্ঠস্বর। ধীরে খাও বৎস, তোমরা মানুষেরা বড় অদ্ভুত! ক্ষুধা পাইলে তোমাদের আর অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত জ্ঞান থাকে না। তখন তোমরা সম্মুখে যা পাও, তাই গিলতে থাকো। যেমন দেখো ক্ষুধার কারণে তুমি তোমার অতীত বর্তমান (চলবে...)
No comments:
Post a Comment