Friday, June 19, 2020

শিল্প সাহিত্য ৬৭


শুক্রবার ৫ই আষাঢ় ১৪২৭, ১৯ই জুন ২০২০




কবিতা
আবু জাফর সৈকত
বচন

নীরিক্ষার ভারে ভারে আপনার তত্ত¡ বড় বেশি জালাতনের কারণ হয়ে পড়েছে।
নয় ছয় বুঝিয়ে অন্যের লেজ কাটতে ব্যস্ত। এইবার একটু ক্ষান্ত দিন। প্লিজ!

শ্রমিক বুঝেনা জ্ঞান; শ্রমের মূল্য চায়-
আন্দোলনের ব্যয় না বাড়িয়ে চায় কাজ
দীনাতিদীন মৃত্যুপ্রহর অথবা অভিশাপ চায় না
শাসন আসন থেকে মজুরের পাশাপাশি একটু মৃদু হাসি।

জাহাঙ্গীর জয়েস 
বিষকাঁটা

আমাদের যত্নে গড়া স্বপ্নগুলোও কখনো কখনো বিষকাঁটা হয়ে ওঠে :
আমাদের তুচ্ছ চাওয়া- পায়ে হাঁটা পথ, জলাশয় মেঘমুক্ত আকাশ কিংবা চায়ের কাপেও কারো কারো স্বেচ্ছাচারী হাসিতে ফুটে ওঠে রক্ত!

মিথ্যা মহিমায় আজ কোনো বিকার নেই
অপমানে, নির্যাতনে আজ কোনো বিকার নেই
অনাচারে, অবিচারে আজ কোনো বিকার নেই

আজ আনন্দ বিক্রয়মূল্যে : কতো বেশি দাম উঠলো; রঙিন পোশাকে আজ ঢেকে রাখি বিষকাঁটা!

রাহুল বর্মন
পাহাড় প্রেম...

একটা গাঢ় কালো রঙের অন্ধকার...
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠে যায়,
কালচে নীল হয়ে মেশে তারাদের ছায়াপথে।
আকাশের বুকে এক ঝাঁক জোনাক বিন্দু!
আমি ঘাসের নরম গালিচায় শুয়ে স্বপ্নের জাল বুনি,
পাহাড়ের রূপকথাময় বাস্তবে!

একটা নিস্তব্ধতার ঘোর... পাহাড়ি রহস্য...
মিশে যেতে থাকে আমার চারপাশে, হাওয়ায়... গাছগাছালিতে... সারা পাহাড় জুড়ে!
গহসা কোনো নাম না জানা উদাসীন পাখির ডাক...
আমার স্বপ্নের জাল বোনা থমকে যায়,
আমি তখন বাস্তব থেকে দূরে.. অনেক দূরে...

একটা আরাম... ভীষণ ভালোলাগা...
হঠাৎ সমুদ্র তার গভীরতার দোহাই দিয়ে তর্ক বাধায়; বলে,
“বেশ তো ছুটে এসছিলে আমার কাছে এক মনখারাপী মরশুমে!”
আমি বিনা বাক্যব্যয়ে জিতিয়ে দিয়ে পাহাড়কে!
আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করি,
আমার স্বপ্ন প্রসারিত হয় পাহাড়ি শীতঘুমে...

খাতুনে জান্নাত
বৃষ্টিমুখ

বৃষ্টিতে ভেসে যায় হুতাশন
অপরিচিত ঝনাৎকারে পড়ে থাকা কাৎরা কাৎরা সময়ের
সহগামী কম্পন,
জাগ্রত শিল্প,
অনুরণনের সুনিবিড় পাঠশালা ছুঁয়ে-
ফাৎনা কাঁপিয়ে চলছে বৃষ্টি ঝমঝম
কদম ফুলের নিমগ্নতা মিশে যায়
অস্তিত্বের রোয়াওঠা উঠুনের স্রোতে...

অসুখ ও আমাদের মাঝে বৃষ্টি প্রাচীর

চুপিসারে তোমার কণ্ঠ ভালো থাকার মিষ্টি রিমঝিম
সন্তানের চোখের মতো আগ্রহী ভোর
মায়ের চকচকে চোখে শুভ হোক নন্দন কালের গল্প,
হাতে ভেজা পাতার চিঠি
গন্ধরাজ মুখ যেন কবিতার সিম্পনি
ক্রন্দনের দাগ-মোছা গীতালি বাতাস...

মহাশূন্যতার কোল ভারী করে বেঁচে থাকার আগামী
বিভোর হবার শাগ্রাম, পাহাড়পুরের ইতিকথা;
বৃষ্টিতে মিশে থাকে দ্রাবিড় জীবন-
ফসলের আদিবাসে লেখা মনুষ্য ইতিহাস...

তন্ময় বিশ্বাস
জীবন

বেদনা-বৃক্ষ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে সুঁই নদীতীরে-
জল ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে যায় রাত!
চোখের কোনায় জমে ওঠা স্মৃতির-মন্দিরে
শ্বেতপত্রে লিখে রাখা  ঝিল্লির নাম!

ধানের ছড়ার উপর যে শব্দ ব্রহ্মত্বের উপলব্ধি এনেছিল-
সেই ম্লান শব্দ ক্রমে  গিলছে জীবন, রূপকথার-আত্মহীনতা,
জীবন-তো হস্তান্তরযোগ্য নয়, প্রিয়তমা!

এখন অশ্রুর সিঁড়ি বেয়ে কষ্ট নেমে আসে বুকে,
জারজ গাছের মত ফলহীন পড়ে থাকে জীবন!
মেঘেদের ব্যাথা লাগে! বৃষ্টির আঘাতে  ঝরে যায়-
বুকের মাঝে লুকিয়ে থাকা সমস্ত ওম!

তবু, শেষ চিঠি লেখা হয় শেষ ট্রেন চলে যায় কবরের
শূন্যতা ঘেসে-
হাঁক দেয় কোলাহল, যন্ত্রণার নতুন উৎসস্থল!
জীবন এগিয়ে চলে জীবনের নামে!

মৃণাল কান্তি পণ্ডিত
বিজয় রথ

ভীষণ অবাক লাগে
প্রথিবীর এই নতুন রূপ দেখে
আধুনিকতার যাঁতাকলে
মানুষ যেন বদলে গেছে
আবেগের বিবর্ণ প্রহর ঘিরে
বেদনার সিঁড়ি বেয়ে।
কষ্টগুলো আহত পাখির মতো
ছটফট করেই বাঁচে;
প্রতিশ্রুতির আলপনা
মনের সীমারেখা টানে
স্বপ্ন-মনে প্রতীক্ষার প্রান্তরে নীরবে অশ্রু ঝরে।
মাতাল কোনো ঝড়ো হাওয়ায়
ক্লান্ত সভ্যতার সাথে
মূক ইতিহাসের মতো
লৌকিকতা আজ বিদ্রুপের মৌন হাসি হাসে।
বৃদ্ধ পিতা-মাতা আজ জীবনের বোঝা
ছেলের হাতে পিতা খুন নিত্য হেথায় ঘটে
সন্তান মেয়ে হলে ছুঁড়ে ফেলে ডাস্টবিনে
দ্বেষ-হিংসা মন্ত্রণায় মালা গেঁথে,
সম্পর্কগুলো অথর্ব বিকলাঙ্গ জোড়াতালি দিতে দিতে।
একালের মানুষ সুখের সঞ্চারে
মনুষ্যত্ব রেখেছে দূরে,
বিভোর মানুষ ঘুরে ফিরছে বিজয় রথের আশে।

সাঈদুর রহমান লিটন
এক আকাশ রোদন

চোখে ভাল দেখা যায়না আজ
চোখের ছানি, পাহাড় ছুঁয়েছে
এক বিকেল, এক সন্ধ্যা নতুবা রাত।

খুব যে বেশি পথ পারি দেওয়া তা নয়
বরং কত ঘাটে ফেলেছি নঙর,
পড়ন্ত দুপুর হিসেব কষেণি,
গুনে গুনে তবু ও পড়ছি নামতা।
স্মৃতিভ্রম মানুষ।

সত্যি বলছি আজো আদর্শলিপি মনে আছে,
মন চষে যায়, স্মৃতির পড়ে রাখে লাঙল
ফসল ফলেছে বটে আদর্শ ফলেনি মোটে।

এক আকাশ রোদন আজ সঙ্গী
স্মৃতিরা কোলাকুলি করে ঝাপসা চোখে
রাতের তারা নীরব সাক্ষী, আজ আর আকাশে তারা নেই, মেঘেরা নিয়েছে আশ্রয়।

অণুগল্প
সাহস
রুখসানা কাজল

চকচকে ফ্ল্যাটের পাঁচতলা। 
ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র তানিম ঝুম বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে পড়াশুনো  করছে। রাত ফুরোলেই বায়োলজি এক্সাম। ইউট্রাসের গঠন আঁকতে আঁকতে তানিম পেন্সিল ছুঁড়ে ফেলে দেয় । বৃষ্টির তান্ডবের সাথে ও ঘরে আবার মার খাচ্ছে ওর  মা। ভাল লাগে না আর। রোজ রোজ মাকে পর্যুদস্ত দেখতে একটুও ভাল লাগে না ওর। 

খুব ছোটবেলায় মায়ের ফোলা কপাল, আহত ঠোঁট দেখে ও জানতে চাইত, কি হয়েছে মা ? কে মেরেছে তোমাকে ? 
মা তখন ম্লান হেসে জানাত, অই রাক্ষস এসেছিল রাতে। তুমি তখন ঘুমুচ্ছিলে বাবা। 
আমাকে ডাকলে না কেন ? আমি মেরে দিতাম রাক্ষসকে। মা তখন কি যে সুন্দর করে হাসত। হাসতে হাসতেই বলত, তুমি বড় হয়ে ওঠো। দেখো রাক্ষস তখন পালিয়ে যাবে ভয়ে। 

তানিম এবার ও লেভেল দিচ্ছে। রাক্ষসটাকে চিনতে পেরেছে। কিন্তু কিছু করতে পারছে না। ওর চোখের জল রক্তের মত জমে যাচ্ছে দু’চোখে। যেদিন মা মার খায় সেদিন তানিমের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে। মাথায় ঘোমটা দিয়ে ঢেকে রাখতে চেষ্টা করে কালশিটে পড়া ফোলা মুখ। 

অনেক ভেবেছে তানিম, আব্বু কেন এমন করে ? অথচ খুব যে খারাপ মানুষ তা নয় । তানিম যেটুকু বুঝতে পেরেছে, তাহলো ক্লাশ নাইনের ফাইন্যাল পরীক্ষা দিয়ে আম্মু তার এক সহপাঠি বন্ধুর সাথে  সমুদ্র দেখবে বলে পালিয়ে  গেছিল।  প্ল্যান করেছিল কক্সবাজার যাবে। সমুদ্র দেখে আবার তারা ফিরে আসবে। দোষ হচ্ছে, আম্মুর সহপাঠি ছিল একজন ছেলে।


এ ঘটনার পর তানিমের নানানানু আর দেরি করেনি। আম্মুকে ঢাকায় এনে দ্রুত বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। বিয়ের সময় আম্মুর সমুদ্র দেখার তিনদিনের এডভেঞ্চারের কাহিনীটি তারা গোপন করে গেছিল। তানিমের যখন ছ’মাস বয়েস, সে সময় আম্মুর বাবার বাড়ি চাঁদপুর বেড়াতে গিয়ে কিভাবে যেন জেনে গেছিল আব্বু।  

আম্মুর আর পড়াশুনা হয়নি। বহুকষ্টে এসএসসি পাশ করতে পেরেছিল। তারপর তানিম হলো। আম্মু তানিমকে কোলে নিয়ে আবার পড়তে চেয়েছিল। আব্বু নাকি তখন রাগ রাগ হয়ে বলেছিল, অনেক হয়েছে। ছেলে ফেলে আবার কার সাথে পালিয়ে পাহাড় দেখতে চলে যাবে ! এবার ঘরসংসার কর। 

দরোজা খোলার শব্দ হয়। আব্বু বা আম্মু কেউ হয়ত বেরিয়েছে। ডাইনিং এর লাইট জ্বলে উঠতেই তানিম ওর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ফ্রিজের পাশের জানলা দিয়ে এক পশলা বিদ্যুৎ চমক দিয়ে যায়। 

তানিমের আব্বু অবাক হয়।  বিব্রত মুখে জানতে চায়, তুই ?  কি লাগবে তোর ? পানি খাবি? 
না তোমার সাথে কিছু কথা আছে আব্বু । ড্রইং রুমে এসো। ছেলের শান্ত ঠাণ্ডা গলা শুনে গ্লাস হাতেই ড্রইং রুমে এসে বসে। তানিম সরাসরি প্রশ্ন করে, আব্বু তুমি কি চাও মেরিনা আক্তার আন্টির মত আম্মুও তোমাকে ছেড়ে চলে যাক ?  

এবার হাত কেঁপে ওঠে ওর আব্বুর। টেবিলে গ্লাস রেখে অদ্ভুত চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে। অই মুহুর্তে কোন উত্তর দিতে পারে না। ছেলের চোখে আগুন । অথচ কি শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুইচবোর্ডের পাশে।
আব্বু বিহেভ ইয়রশেল্ফ। আম্মু ত কখনো তোমার পাস্ট নিয়ে কিছু বলে না। আমি কিন্তু আম্মুকে নিয়ে বেরিয়ে যাবো। ওয়ার্ড ইজ ওয়ার্ড।

No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক