শনিবার
৬ই আষাঢ় ১৪২৭, ২০ই জুন ২০২০
কবিতা
মাহফুজুর রহমান লিংকনএই তো কয়েকদিন আগে মধ্যরাতে...
আহ্লাদি জ্যোৎস্না শহরের ওপাশ থেকে
কবিচুলের সিঁড়ি বেয়ে ধেয়ে এসে...
নিমজ্জিত চোখে
মহিলা কলেজ পার হতেই
জেলা শহরের নীল রঙে ভীত হয়ে যায়।
সঙ্গীহিনা - ভীত জ্যোৎস্নার বিশ্বস্ত সাথী
কবি একা!
কবি, পার্কের দীঘির দিকে এগুতেই
একটি কুকুর মধ্যরাতে স্ত্রীসঙ্গ ত্যাগ করে
মিশে যায় ছবির মতন...
নববধূ তারপর বর, দুই, তারপর এক,
আদম এবং ইভ, তার সঙ্গী, চাঁদ তারপর সূর্য।
জ্যোৎস্না; কবি এবং কুকুর মিলে
নিষ্প্রাণ শহরের পাথুরে ঘুমকে
ভেঙ্গে দেয় নিখুঁত ঠোঁটের বাঁধাই করা
শাণিত বাণীতে!
সিদ্ধার্থ সিংহ
অক্সিজেন সিলিন্ডার
যে দিকে তাকাচ্ছি
দেখছি, সবাই ছোট্ট ছোট্ট অক্সিজেন সিলিন্ডারের ট্রলি
টানতে টানতে যাচ্ছে
বাজারে... অফিসে... বিয়ে বাড়িতে...
বইয়ের ব্যাগ নয়, নানান রং আর ডিজাইনের
অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে
কেউ হামাগুড়ি দিচ্ছে
কেউ দোল খাচ্ছে
কেউ হা ডু ডু খেলছে
রাতে ঘুমানোর সময়েও সবার নাকে লাগানো
অক্সিজেন মাস্ক।
যে দিকে তাকাচ্ছি
সে দিকেই এই একই দৃশ্য
কিন্তু বুঝতে পারছি না
সালটা কত!
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়
শোধন
ধুলোর ঘূর্ণিতে যে মুখ আঁকা তার নাম ধূলি।
জলের চক্র থেকে তৈরি মুখের নাম দিই জলদা।
মেঘের পাহাড়ে আঁকা মুখ মেঘবতী ছাড়া আর কী?
ঘন জঙ্গলে যে মুখ সবুজ আঁকে তাকে বলি শ্যামলী।
দূরের পাহাড় বা কুয়াশায় যে টানে তার নাম অধরা।
ছলাৎছল জলের নূপুর যে কন্যা হরিণশিশুর মতো
চঞ্চল ছন্দ ধরে নাচে না ডাকলেও সে মৃগনয়না।
নীরস মরুর দমফাটা তৃষ্ণায় যে মুখ জলের চিকন
ছলনার গন্ধমাখা বাঁচার স্বপ্নসুখ আলেয়া তুমি।
এতগুলি মুখ বা মুখোশ ডানায় গাঁথা গতির জীবন।
কোন রসায়নে প্রতিটি কন্যামুখ এক ও একক ?
পবিত্র মুখের আলো মুছে দিতে আগুন বা কালিমা
কয়েকটি ধর্ষণকামী জীব নরকের অন্ধকার মাখে
তাদের জন্য কিছু ঘৃণা আর সর্বভুক আগুনদহন।
মহৎ সেই কাজের নাম রাখি জঞ্জালশোধন।
আপন রহমান
কবিজনম
কবিরা বড্ডবেশি সুখ পিয়াসী হয় কিন্তু দু:খের সাথে গড়ে ওঠে তাদের নিগূঢ়তম সম্পর্ক!
কবিজনম মানেই -
বিচ্ছিন্নতা, বেদনা, বিষাদ, বিরহ, বন্দী আর ব্যবচ্ছেদ।
এ জনম এমনিই জনম
যে জনম থেকে চাইলেই পালানো যায়না, ঈশ্বর নিজেই অন্ধকারে মুড়ে রাখেন ফেরার পথ!
কবি স্রষ্টা! (না ঈশ্বর নয়)
কবিতা পবিত্রতম সৃষ্টি!
যাকে ছুড়ে ফেলা যায়না
ছেড়ে থাকা যায়না।
কবির বুক বড় পবিত্রতম বুক
যেখানে থাকে সমুদ্র্রর মত গভীরতম ভালবাসা।
কবির মস্তিষ্ক মহত্তম কিছু
যেখানে থাকে ঈশ্বর প্রণীত মহত্তম সংকলন।
কবিরা নদী ও নক্ষত্রের কথা বলেন,
মানুষ এবং পৃথিবীর পক্ষে কখনও কখনও জ্বলে ওঠে কবির বারুদীয় কলম!
কবির শব্দের বারুদীয় বিস্ফারণে
কখনও বা কেঁপে ওঠে শোষকের চেঁয়ার!
কবি শ্রমিক-শব্দ শ্রমিক
যে শ্রমের মূল্য তথাকথিত সমাজ, সভ্যতা কখনও দেয়নি।
কবি প্রেমিক- বিরহী প্রেমিক
প্রেম আর ভালবাসাহীনতায়
ভুগতে-ভুগতে অধিকাংশ কবির জনম হয়ে ওঠে- বিরহী প্রেমের পূর্ণদৈর্ঘ্য রূপকথা!
কবি মানেই, নিশি মানব -নিশাচর-চাঁদমানুষ।
-কবিতার পরিচর্যা করতে করতে
কখন যে কেটে যায় এক একটি রাত!
অবশ্য-
কবিদেরও মাঝে মাঝে ঘুম পায়
ঘনঘন হাই ওঠে,
তবুও
কবিরা ঘুমাতে পারেনা
শব্দ ও ছন্দের ভাঙা -গড়া করতে করতে কখন যে শুকতারাটা বিলীন হয়ে যায় আকাশের গর্ভে ;
কবি ও কবিতা পায়না তা টের!
কবিদের সঙ্গী হয় কবিতা
প্রেম হয় কবিতার সঙ্গে
কবি আর কবিতার মিতালী চলতে থাকে রাতের গোপনে।
এভাবেই একে-দুইয়ে-তিনে
চলতে থাকে কবিজনম...
গল্প
মোগল চপ্পলস্বপঞ্জয় চৌধুরী
অফিস থেকে ফিরছে মোকসেদ। তার হাতে খালি টিফিন ক্যারিয়ারের বাটি আর একটা কালো রঙের রঙচটা ছাতা। সে অন্য মনস্ক হয়ে হাঁটছিল আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। মাসের শেষ সামনের শুক্রবার একটা বিয়ের দাওয়াত আছে। ছোট সালার বিয়ে। একমাত্র শ্যালক না গেলে বৌয়ের কথা শুনতে হবে। পকেটের অবস্থা আত্মীয় স্বজন বুঝবে না। টাকা পয়সা নাহয় ধার করে যাওয়া গেল বিয়েতে। কিন্তু বিয়েতে কত মানুষ আসবে যাবে একটা ভালো জামা কিংবা জুতো কোনটাই নাই তার। জামাটা না হয় লন্ড্রী থেকে ভাড়া নেয়া যাবে কিন্তু জুতো পাবে কই। আজীবন সে মোগল চপ্পল এর স্যান্ডেল পড়েই কাটিয়ে দিচ্ছেন। পন্সের উপর হলুদ রঙের ছোপ-ছোপে দাগ। হলুদ রঙের জুতোর বেল্ট ছোটবেলা থেকেই এই কোম্পানির পন্স পড়ে আসছে। নাম মোগল চপ্পল হলেও। এতে কোন মোঘলীপনা নেই। আছে দারিদ্রের উপহাস। তার বাবা তাঁর চেয়েও দরিদ্র ছিল। তারা দু’বেলা খেত এক বেলা উপোস করতো। খুব কমদিনই তারা তিন বেলা খেতে পেরেছে। তার বাবাও এ কোম্পানির পিয়ন ছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর তার চাকরিটা তিনিই করছেন। সংসারে এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ, খাবার খরচ বাড়ি ভাড়া এসব দিয়ে মাসে এক টাকাও থাকেনা। তাই তিনি প্রতিদিন ৪ কিলোমিটার হেঁটে অফিস করেন। আজ বিকেলে খুব একটা ভ্যাপসা গরম পড়েছে। তার হাই প্রেসারের সমস্যা আছে। গরম পড়লে অতিরিক্ত ঘেমে যান।
হঠাৎ কোথা থেকে একটা বড় আকৃতির ট্রাক এসে তার সামনে হার্ডব্রেক করে। অল্পের জন্য রক্ষা। মোকসেদ ভয়ে লাফিয়ে উঠে। তার টিফিন বাটি তিনটা তিন দিকে ছুটে গেছে। মানুষজন এসে তাকে গালমন্দ করছেন। ট্রাকড্রাইভার মারার জন্য তেড়ে আসেন। কয়েকজন যুবক বাঁধা দেন। মোকছেদ ঘাম মুছতে মুছতে বলে- আসলে বাবারা আমার শরীরটা ভালো না। তাই একটু অন্য মনস্ক ছিলাম। ট্রাকড্রাইভার ট্রাকে উঠে ট্রাক স্টার্ট দেয়। লোকজন যে যার কাজে চলে। হাঁটতে গিয়ে মোকসেদ টের পায় তার মোগল চপ্পল এর একটা পন্সের বেল্টের বল্টু ছিঁড়ে গেছে। সে হাঁটতে পাড়ছেনা। ছিঁড়ে স্যানডেলটা হাতে নিয়ে হাঁটছেন। একটু দূরেই একজন মুচি বসেছিল রাস্তার পাশে। মোকেছেদ মুচির কাছে গিয়ে বলে আগেটার মতো এইটারও পেরেক লাগাইয়া দাও। মুচি তার দিকে তাকিয়ে একটা প্রশস্ত হাসি জুড়ে দেন। চাচা জোড়াতালি দিয়া আর কতদিন চলবেন। একটা নতুন জুতা কেনেন। আমার কাছে সেকেন্ড হ্যান্ড জুতা আছে। কালি কইরা দিলে কেউ বুঝতে পারবোনা নতুন না পুরাতন। মোকছেদ কিছু বলেনা। ছোট ছেলের জুতা ছিড়ে গেছে অনেক দিন থেকে বলছে জুতোর কথা। কিনে দিতে পারছেনা। তাই ভাবলেন এই মুচির কাছ থেকে যদি একটা সেকেন্ড হ্যান্ড জুতা পাওয়া যায়। মুচি পন্সের বেল্টে একটা কৃত্রিম বল্টু সেলাই করে দেয়। মোকসেদ স্যাকেন্ড হ্যান্ড জুতোর দাম জিজ্ঞাসা করে। মুচি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে। এইটা চোরাই জুতা। মার্কেটে নতুন কিনতে গেলে হাজার টাকার উপরে পড়বো। আমারে তিনশ টাকা দিলেই চলবো। মোকসেদের মুখে চিন্তার ছাপ। তার চিন্তিত মুখ দেখে মুচি বুঝতে পারে। এইটা আপনের জন্য শুধু এখন একশো দেন বাকীটা পরে দিলে দিলেন না দিলে নাই। দেখেন পায়ে লাগে কিনা। মোকছেদ আর তার ছেলের পায়ের মাপ প্রায় একই। সে পায়ে দিয়ে দেখে সাইজ ঠিক আছে। একশত টাকা দিয়ে একটা পেপারে জুতো জোড়া মুড়িয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা দেন।
মোকসেদের ছেলে জুতো পেয়ে খুশি হয়। সে ঘরের ভিতর এমাথা থেকে ওমাথা হেঁটে হেঁটে ট্রায়াল দেন। ঠিকই আছে কিন্তু একটু পুরান পুরান লাগতাছে। মোকসেদ হেসে বলে নারে পাগল এইডার কালারই এমন। দেখতে দেখতে শ্যালকের বিয়ের দিন চলে আসলো। শ্যালক নতুন সরকারি তৃতীয় শ্রেণির পদে চাকরি পেয়েছে। ঘুষ লেগেছ পাঁচ লাখের মতো। বিয়ে করে যৌতুক নিয়ে টাকা উসুল করবে। তার উপর বিয়েতে সবাইকে পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে সবাই যাতে ক্যাশ টাকা দেয়। মোকসেদ তার অফিসের কলিগ সোবাহানের কাছ থেকে দেড় হাজার টাকা ধার করেছে। এক হাজার দিবে বিয়েতে আর পাঁচশো যাতায়াত খরচ। কিন্তু তার একটা ভালো স্যান্ডেল নেই। এই জোড়া তালি দেয়া মোগল চপ্পল পড়লে মানসম্মান যে আর থাকবে না। তাই ছেলে বুদ্ধি করেছে। বাবা বিয়ে বাড়ি থেকে একটু দূরে থাকবে। নিজে আগে খাওয়া শেষ করে তারপর বাবার সাথে জুতো পরিবর্তন করবে।
জুম্মার নামাজ শেষ করে পরিবার নিয়ে বিয়েবাড়ি রওয়ানা দিল মোকসেদ। বউ বাচ্চা আগে গেল রিসিপশনে গরমের মধ্যে কোট পড়ে দাঁড়িয়ে আছে তার শ্যালক মজনু মিয়া। কাবিন আগেই হয়ে গেছে আজ বৌভাত। মজনু একটা কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলে দুলাভাই কই? মোকসেদের বউ চম্পা একটু ইতস্তত হয়ে বলে। তোর দুলাভাই আসতাছে একটা জরুরি কাজ শেষ কইরা। মজনু একটু বিরক্তি মাখা হাসি দিয়ে বলে আজকে ছুটির দিনে তার আবার কিসের জরুরি কাজ। চম্পা ছেলে মেয়ে নিয়ে ফাস্ট ট্রিপেই খেয়ে ওঠে। তারপর ছোট ছেলে হোসেনকে বলে তোর বাবা দাঁড়াইয়া আছে রোদের মধ্যে তাড়াতাড়ি যা। হোসেন বাবার কাছে গিয়ে জুতো পরিবর্তন করে নেয়। মোকসেদ হোসনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে- বাবা খাইছো ঠিকমতো। হোসেন মাথা নেড়ে বলে হ আব্বা খাইছি। মোকসেদ বিয়ে বাড়িতে চলে যায়।
রাস্তায় একা একা হাঁটছে হোসেন। তার পায়ে মোগল চপ্পল। সে হাঁটতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেনা। মুচির কাছ থেকে সেলাই করার পরও দু’বার ছিড়েছে। পন্সের বেল্টে পেরেক লাগানো আছে। বারবার সে পেরেকের গুতো খাচ্ছে। তার চেতনায় ধরা পড়ে বাবাকে কতদিন সে এই জুতো নিয়ে ঠাট্টা করেছে। নতুন জুতোর জন্য বাবাকে কতদিন মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে সে। এ জুতো পড়ে কান স্বাভাবিক মানুষ হাটতে পারবে না। তার বাবাতো একজন অস্বাভাবিক মানুষ। কোন দিন নিজের চাহিদা, নিজের কষ্ট সন্তানদের বুঝতে দেননি। রোদ, বৃষ্টি মাথায় করে সারা জীবন পায়ে হেঁটে অফিস করেছে। এই মোগল চপ্পল পায়ে দিয়ে। আজ সে বুঝতে পারছে বাবার না বলা কথাগুলো। তার বুকের ভেতর দুমরে মুচরে থাকা কষ্টগুলো তাকেও যেন তাড়া করছে। অজান্তেই হোসেনের চোখে জল চলে আসে। সে মোগল চপ্পল খুলে খালি পায়ে হাঁটতে থাকে।
No comments:
Post a Comment