Monday, June 1, 2020

শিল্প সাহিত্য ৪৯


সোমবার ১৮ই জ্যৈষ্ঠ ১৪২৭, ১লা জুন ২০২০




ক বি তা
আনিকা তামান্না
অন্তত একবার দেখা হোক

অন্তত একবার আমাদের দেখা হোক
আমি আপনাকে বসন্তের একটা গোধুলি বিকেল উপহার দিতে চাই,
যেখানে শহরের কোনো কোলাহল থাকবে না
রাস্তার দুপাশে থাকবে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া গাছ
আপনি খানিকটা ফুল নিয়ে আমার কানে গুজে দিবেন
দুজন মুগ্ধ হয়ে কোকিলের ডাক শুনবো।
অন্তত একবার আমাদের দেখা হোক
আপনি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমাকে একটা সন্ধ্যা উপহার দিবেন
তারপর কিছু কবিতা পড়ে শুনাবেন,
আমি বায়না ধরব আরো কিছুটা সময় থাকার জন্য।
অন্তত একবার আমাদের দেখা হোক
আপনার দেওয়া ভালোবাসা দিয়ে
আমি তিল তিল করে একটা পাহাড় বানিয়েছি, তা দেখাতে চাই
আকাশ সমান ভালোবাসি আপনাকে
এই কথা শুনার পর আপনার অনুভ‚তি কেমন হয় তা বুঝতে চাই।
আচমকা একদিন হুট করেই বৃষ্টি নামল
আনমনে আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি,
আপনার কথা মনে পড়ছে খুব
আপনার জন্য আমার মন খারাপ
অন্তত এই কথা বলার জন্য হলেও
একবার আমাদের দেখা হোক!

সোমের কৌমুদী
মুখোশ

শুধু ভালোবাসার জন্যই ভালোবাস
দায় থেকে ভালোবাসা নিলে সৃষ্টি,
সে ভালোবাসার উপর সেঁটে যায় মুখোশ।
ঔদ্ধত্য
হীনমন্যতা
বৈপরীত্য
সে মুখোশের আড়ালে করে বাস।
একটু ভিন্ন মতেই মুখ থেকে খসে পড়া মুখোশ দেখি।

ভালোবাসা না হলে ভালোবাসাকে ভালো রাখার  জন্য
সময় শেষে সে ভালোবাসা বুকে মারে ছুরি,
হৃদয়ে জন্ম নেয় ভালোবাসাহীন ক্ষত।
অশান্তি
কিংবা জীবন জুড়ে
আত্মগ্লানি।
ভালোবাসার জন্য মানুষ নাই, মুখোশ শত শত।
মানুষ না পেয়ে মুখোশের গায়ে মানুষের ছবি আঁকি।

সাব্বির হোসেন
ম্যানগ্রোভ 

ভালোবাসি চঞ্চলা রমণীর হাসি; চিত্রা হরিণ
ভালোবাসি সাগরের তীর ঘেঁষে বেড়ে ওঠা ম্যানগ্রোভের বাঘিনীর প্রসব বেদনার কান্না।
ভালোবাসি নরম মাটির আলগোছে ডুবে থাকা বন্য পশুদের পদচিহ্ন
জানাই শত কোটি প্রণাম।

বাঙালির গভীর ধমনীতে নিমন্ত্রণ তোমার
যদিও আমি মুখ লুকিয়ে বাঁচি
এই কৃত্রিম জীবনে সাধ্যহীন কামনায়
তবুও বলছি আজও শুনে নাও
পাহাড়ের কোলে স্বপ্ন দেখে ফুরায় দুপুর।

কলের শব্দ, হিংস্র খুনি বসতি, বিষাক্ত তরল আর ধারালো কুড়াল সব সময়ের মেপে যাওয়া ক্ষণিকের অতিথি
ভয় নাই ভয় নাই
তুমি প্রেমিকা আমার চোখে
শিল্পের দীর্ঘতর দেবতাত্মা
তাই বলছি-
কখনও সময় পেলে চলে এসো
আমার বুকে
অন্ধকার শীতল বিহ্বল প্রান্তে
আলোকময় লাইট হাউজ ডিঙ্গিয়ে
দেখি তোমার সুশ্রী মুখচ্ছবি প্রভাতে।

শৈশবে দেখেছি কুয়োর জল
দেখেছি চিকচিক বালুকায় নদীর চর
শুঁকেছি বাদাম পাতার ঘ্রাণ
যদিও আমি টানা বর্ষণের কামনায় আপ্লুত হইনি কখনও
তবুও দেখেছি বেলা শেষে ধুয়ে যায় কাঁকর মাটি আর ভিনদেশি পাথর
গাঙ্গেয় বদ্বীপের মুগ্ধ কাজল হয়ে হেসে ওঠে ঈশ্বর, তোমার ভেতর।

রাজীব পাল
পিছনে অন্ধকার

গেরুয়া রঙের বিকেল ফুটছে যেন
এখন কি তবে একতারাতে আঙুল ছোঁয়ানোর সময়?
এদিকে কৌটায় তো এখনও সাপের নড়াচড়া, ফোঁস...
সঞ্চয় ঘিরে রাখে অসংখ্য কিলবিল
পাশ ফিরে জেগে থাকে আত্মগোপন
পিছনে অন্ধকার,  স্বপ্নদোষ মেশানো কলকল শব্দে ঢেউয়ের মতো ঝাঁপায়

একতারা রে, তোর বেজে ওঠার লগ্ন
বয়ে গেল যে, যতটুকু গেরুয়া ফুটছে
বিকেল নিভিয়ে ঝরে যাবে সন্ধ্যেয়...

ভাষান্তর: কায়েস সৈয়দ
মূল: জঁ ককতো
শ্রদ্ধা এরিট সাটির প্রতি

মিসেস হেনরি রুশো
দড়িতে বাঁধা বেলুনে ওঠেন
হাতে ধরেন একটি গুল্ম
এবং কাস্টমস অফিসার রুশো
পান করেন ক্ষুধা-উদ্রেককারী পানীয়

চাঁদের সাথে সাথে ফুলে ওঠে
এলোভেরা
হাতলওয়ালা চেয়ার
সুন্দর ওই স্যুট এবং
সুন্দর পাতার উপর সুন্দর চাঁদ

আফ্রিকান সিংহ
বস্তার মতো বড়ো তার পেট
আফ্রিকার সিংহ
প্রজাতন্ত্রের পাদদেশে
খেয়ে ফেলে গাড়ির ঘোড়া

অন্ধকার সাপুড়ের বাঁশিতে
প্রবেশ করে চাঁদ
তোলপাড়, ঘুমন্ত অবন্থায়,শোনে
মিষ্টি বাঁশির বাইরে বেরিয়ে আসে
নাশপাতি আকৃতির কামড়

রহিম উদ্দিন
গল্পটি করুণার

আজ যে গল্পটি বলবো এটা কেবল করোনার গল্প নয়; করুণার গল্পও বটে। সরকারি একটা চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের প্রায় সবজায়গায় গিয়েছি এটা বলতে না পারলেও প্রায় সব উপজেলার মানুষের সাথে মিশেছি এটা বলতে পারি। পৃথিবীতে মানুষের শ্রেণিবিভাগ সে অনেক আগে থেকেই চলে এসেছে। তবে, এই শ্রেণিভেদের কাছে আমাদের মানবিকতা কখনো কখনো উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে দাড়ায়। আবার সেই মানবিকতার  মৃত্যুতে কখনো কখনো মানুষ হয়ে যায় কুকুর হায়েনার চেয়েও ঘৃণ্য ও জঘন্য রকম খারাপ। বাংলাদেশ সরকার করোনার মহামারি থেকে বাঁচার জন্য দশদিনের জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে দেখে অনেকেই এখন গ্রামের বাড়িতে কিংবা ঢাকা শহরের বাসায় কার্যত গৃহবন্দী। আমরা চাকুরেরা আছি চাকরিরত। গতকাল আমিও আমার দলের সকলে টহলে বের হয়েছি। সরকারের পক্ষ থেকে আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গণপরিবহন লকডাউনের পাশাপাশি সকল প্রকার দোকানপাট ও বিপনি বিতান বন্ধ থাকবে। তবে, সেক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় দব্য ও ওষুধের ফার্মেসি এবং সরকার ঘোষিত কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। আমরা সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক স্থানীয় প্রশাসনকে সহয়তার জন্য একসাথে কাজ করার জন্য মাঠে নেমেছি। আমরা যখন টহলে বের হয়েছি, আমাদের দলের নেতৃত্বে দিচ্ছিলেন উপজেলা কর্মকর্তা জিন্নাত আরা। আমরা কিছুদূর হেটে কিছুদূর গাড়িতে, এইভাবে স্থানীয় রাস্তাঘাট ও বাজার এলাকায় টহল দিচ্ছি। পুরো এলাকা জনমানব শূন্য, নেই কোন শহুরে গোলমেলে বেসুরে শব্দ ও সমাগম, নেই কোনা গাড়ির হর্ন,  বিরক্তির সাইরেন। যেতে যেতে আমরা ঢুকে পড়লাম স্থানীয় একটা বাজারের পথে। দলের ম্যাজিস্ট্রেট পাওয়ার প্রাপ্ত উপজেলা কর্মকর্তা নির্দেশ দিলো সবাইকে বাজারের একটু আগেই গাড়ি থামাতে। বাকিটা পথ আমরা বাজার পর্যন্ত হেঁটে যাবো। কেননা, গাড়ির শব্দে স্থানীয় কেউ যদি বাজারে জমায়েত করে কিংবা বিনা প্রয়োজনে ঘুরাফেরা করে তারা সরে যেতে পারে। আমরাও নির্দেশ মতো গাড়ি থামিয়ে নেমে গেলাম। লোকজন আমাদের দেখে বুঝতে পেরেছে। কেউ কেউ কেনাকাটা করছে। কেউ বা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে বাড়ির পথে কিংবা আড়ালে পা বাড়িয়েছে।  হঠাৎ আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হয় দুইজন বৃদ্ধ লোক। আমরা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার আগে ম্যাজিস্ট্রেট এগিয়ে গেলো তাদের দিকে।

ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞেস করল, ‘এই আপনারা এখানে ঘুরাফেরা করছেন কেন?’
বয়স্ক বৃদ্ধলোক দুটির মুখে তখন কোন কথা বের হচ্ছে না।

এই পরিস্থিতিতে কথা বের না হওয়া স্বাভাবিক।   আর্মি পুলিশ একসাথে। তাদের সামনে যদি অন্য বড় মাপের একজন অফিসার গ্রামের একজন সাধারণ মানুষকে নিজের নামও জিজ্ঞেস করে, সেক্ষেত্রে তার কাছে আমতা আমতা করা ছাড়া উত্তর দেবার মত হিতাহিত জ্ঞান কিংবা শক্তি থাকে বলে মনে হয় না। তাদের নিরবতা দেখে জিন্নাত আরা খুব রাগান্বিত হয়ে উচ্চস্বরে বলল, কান ধরো, কান ধরো দুজনে।

কথাগুলো শুনে, বয়স্ক বৃদ্ধলোক দুটির তখন শরীর প্রায় অবশ হয়ে আসছিলো। চোখ জোড়া তাদের ধীরে ধীরে লাল হয়ে এলো। তারা কে কী করবে ভেবে না পায়। এমন সময় ম্যাজিস্ট্রেট আবারো চেচিয়ে উঠলো, এখনো কান ধরেননি?

অসহায় বৃদ্ধ লোকদুটি মাথা নিচু করে নিজেদের কান ধরেছে। রক্তাক্ত চোখ দিয়ে অঝোরে জলের স্রোাত বইছে। শিশিরের রাতে টিনের চাল বেয়ে টুপ টুপ শব্দে ঝরে পড়া স্বচ্ছ জলের মতো, দু’জোড়া চোখের পবিত্র পানি ঝরছে ভাঙ্গা চোয়ালের দুপাশ বেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট তখন নিজের মোবাইলে তাদের কয়েকটা ছবি তুলেছে। ভিডিও করেছে। তারপরও, তাদের এভাবে দাঁড়িয়ে রেখে সামনে দিকে হাঁটা শুরু করেছে। আমি এতক্ষণে লোক দুটির সামনে আসতে পারলাম। ম্যাজিস্ট্রেট, অনেক দূর এগিয়ে প্রায় অন্যদিকে মোড় নিয়েছে।

আমি বললাম, চাচা, কান ছাড়েন। হাত নামান। যদিও তাদের একজন কে জিজ্ঞেস করলাম, কী নাম আপনার?
বললো, দবির উদ্দিন।
চাচা, আপনারা জানেন, ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ, তারপরও বের হয়ে কয় গেছেন?
বাজান, আমরা গরিব মানুষ, ঘর থেকে বের না অইলে খামু কী? ঘরে যা খাওন আছে, কোন রহমে আইজকে রাইত চলবো। তাই, নামায পড়ে বাজারে আইলাম, দেখি, কেউনি কোন কাজে ডাহে। তো, বাজান, তোমরা আমাদের যে শাস্তি দিয়েছো, তা আমরা মাথা পাইতে নিলাম। আমাদের তারপরও কোন কাজকাম দিবানি? না হলে,আমাদের যে না খাইয়া মরা লাইগবে।

এতক্ষণ, চাচার চোখের পানি দেখেছি, এখন আমার চোখের কোণেও জল জমেছে, নোনাজল। আরেকটু হলে ঝরে পড়বে, বাধভাঙ্গা পানির স্রোতের মতে অঝোরে।
বিষয়টি বুঝতে পেরে শুধু এতটুকু বলেছি; ‘চাচা, চলি’ আর নিজের অপারগতা ও সীমাবদ্ধতা রেখার দংশনে দংশিত হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করেছি, এই আমি শোষক না শোষিতদের দলে।

No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক