Friday, July 31, 2020

শিল্প সাহিত্য ১০৯

শুক্রবার ১৬ই শ্রাবণ ১৪২৭, ৩১ই জুলাই ২০২০




কবিতা
অপার অরণ্য
ঋতুশূন্য মা’র শৈশব

লাঙ্গল-শুশ্রুষায় কৃষক যেমন রক্ষা করে জমি
তামাম নির্জনতা গিলে সুঁইয়ের পরে সমুদ্র তুলে মা
সেলাই করেন আমাদের যাপন।
পান থেকে খসলেই চুন বাবার লিকলিকে চোখ
ফোঁসফোঁস করে-
কেমন নির্বান্ধব আর সঙ্গীতশূন্যতায়
বাবা বুঝতেই পারেনা মা আসলে ফোঁড় কাটেন
ঋতুচক্রের ফাঁপা হাঁড়পাজর। 

কাঁথার অন্দরে আশৈশব লুকিয়ে রাখার সন্দেহে
এক বর্ষায় চুরি করে সুঁই হই
দেখতে যাই কড়ুই রোদে সইয়ের সঙ্গে মা পুতুল
খেলত কিনা
উঠতি বয়সের দস্যিপনা কি ঋতুস্রাব এলে মা’ও ঠোঁটে
অযত্নে বসত কিনা কাঠফড়িংয়ের লাল
এসব খোঁজ তল্লাসির ফাঁকফোকরে বসন্ত লেগে যায়
কোন হঠাৎ গাওয়া কোকিলে মা কণ্ঠ দিল কিনা
তন্নতন্ন করেও এই ঋতুটি উদ্ধার করা গেলো না!
পাড়াত মেয়েরা খোঁপায় গল্প গুজে
কোঁচর ভরে চালভাজা খায়
মা তখন যত্ন করে গোয়ালঘরে গরু তোলেন
ডালিমতলার শুকনো পাতা নরম হাতে সরিয়ে রাখেন
মা’র আকাশে মেঘ নেই- গান নেই পাখিদের উড়বার
শরৎ এর বুক চিঁড়ে ফুটে থাকে যুগলযুঁথী
একজন গ্রীষ্মের তাপতড়িৎ ছুঁয়ে ছুঁয়ে কেটে যায় অন্যান্য ঋতু

কোথাও কোন পুকুরঝাপে নেই
সন্ধ্যা নামলে চোখপলান্তি— তাও
তালগাছে পাকে তুখড় ভাদ্রমাস
শীতকাটা সুখে কুয়াশায় পাখিদের আহ্লাদী নাচ
সব ঠিকঠাক সবখানে, হায়!
সমস্ত শৈশব জুড়ে মা হয়েছেন উনুনের পেটে
জ্বলজ্বলন্ত কাঠ!

সুঁই-জীবন থেকে বেরিয়েই
গলা টিপে দেই মা’ও বোবা থাকার ব্যামো
এখন সুনসুনিয়ে কাঁথা সেলাই কালে
মা’র নিশ্চুপ ঠোঁটে নামে অলৌকিক ভোর,
ঋতুমঙ্গল গান।

অ। জ। য়   রা। য়
নববর্ষে শতবর্ষের মৃত্যুদূত

তুমি আর এসো না ফিরে অশুভ ছায়া রূপে এমন সুন্দর অবনী পরে
প্রতি শতবর্ষের মৃত্যুদূত হয়ে প্রাণ কেড়োনা যাও চলে দূর বহুদূরে
শ্যামল প্রকৃতি আজ হাসে না হারিয়েছে রূপ দখিনা সমিরণে দোলেনা মুকুল
পুষ্প কাননে সুগন্ধি ফুলের সৌরভ ছড়ায় না নিস্তেজ জুঁই মালতি বকুল
কোকিলের কুহু ছন্দ মন ভরে না তার আনন্দ চারিদিকে বিমূর্ত করুণ সুর
নবান্নের উঠোনে কাকেরা হাহাকার ধ্বনি তুলে ধবলীর গলায় স্বর ভঙ্গুর! 
নীল অম্বর ক্ষণে ক্ষণে কাল মেঘে ঢাকা পড়ে বিস্তর পাকা ফসলের মাঠ
কালবৈশাখীর ভয় কৃষকের বুক কেঁপে ওঠে যতদূর চোখ রুদ্ধ পথঘাট।
নতুন দিনে নতুন পার্বণ স্বস্তিহীন মানুষের প্রাণ দিগন্তে নেই রবির প্রদ্যোত
ঘোর অমানিশার আঁধার চারিদিক ছেয়ে গেছে নববর্ষেও তুমি শতবর্ষের মৃত্যুদূত।

সৌম্যজিৎ আচার্য
তোমাকে বলা হয়নি

তোমাকে বলা হয়নি, শেষ ট্রেনটা পেয়ে গেছি। ট্রেন একটা অচেনা প্ল্যাটফর্মে এসে থেমেছে। এ প্ল্যাটফর্মে নদী আছে। তাই নেমে যাচ্ছি। নদীতে পা ডুবিয়ে গোটা শীতকাল এবার এখানেই কাটাব আর আমার পা শ্যাওলা হয়ে ভেসে যাবে মোহনায়...

তোমাকে বলা হয়নি, চিড়িয়াখানা আর জেলখানার পাঁচিল দুটোই সমান উঁচু। আমি তাই ওদের নেমপ্লেট বদলে দিয়েছি। দুটোর পাহাড়াদারই আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। ওদের বোলো না, আজ রাতে আমি অ্যাসাইলামের দেয়ালে হিসি করতে যাচ্ছি। ও দেয়ালেও বৃষ্টি হয়নি বহুদিন...

তোমাকে বলা হয়নি, শব্দরা চায়নি, তবু লেখা ছেড়ে চলে যাচ্ছি দূরে। কবিতা আমায় ফ্যাকাসে করে দিয়েছে। আমার প্রতিটা কবিতাই ও-পজিটিভ। আমি এত রক্তাক্ত লেখা লিখতে চাইনি কোনোদিন... কাউকে বোলো না, আজকাল আমার সারা গায়ে জ্যোৎস্না গাছ বেড়ে উঠছে...আলো ভরে উঠেছে... আমার আর চাঁদ ভাল লাগছে না। আমি জলের নীচে সাঁতার কেটে চলে যাচ্ছি মোহনায়...

রুদ্র  সাহাদাৎ 
প্রথম  মৃত্যুর পূর্বে আমাকে কেউই চিনতো না

প্রথম মৃত্যুর পূর্বে আমাকে কেউই চিনতো না 
তখোন গহিন অরন্যে আমি একাই ছিলেম তা- কিন্তু না
কতো ধর্মের কতো বর্ণের কতো জাতি ছিলো 
জাতিসংঘ সব জানে, শুধু মানুষের মন বোঝে না।
বেরসিক মানুষ সমাজের জঞ্জাল, 
ডাস্টবিনে পড়ে থাকা আবর্জনার মতন।
কি আশ্চর্য, এখনও  অনেকেই আমাকে চিনে না...

চন্দনা রায় চক্রবর্তী
লক্ষণ রেখা

প্রসবের রক্ত জল সাঁতরে উঠে আসা
কিছু অন্তর্জলি ছবি, ভাষা, কল্পনা...
অনায়াস শারীরিক পরিক্রমা পার করে
মনের কুণ্ঠার দরজায় অবিরাম কড়া নাড়ে।
শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটে,
আগ্রাসী চুম্বনের জ্বরতপ্ত উষ্ণতা,
কপট রাগের অজুহাতে
ছায়া বিস্তারের চতুভৌতিক সীমা বজায় রাখে।
দু’বাহুর দুরত্বে শারীরিক সংশ্লেষেও দোটানায়।
বারোমেসে ধুলো পড়া সংস্কার,
কুন্ডলী পাকিয়ে পড়ে থাকে,
আশ্বিনের অশ্বগন্ধার রূপকল্পে।
চারিদিকে অবগাহনের মন্ত্রে ভেসে যায়
অন্তর্লীন আমিত্বের জোলো ইঁদারার জল।
ধ্রুব তারার আলোয় নতুন করে পথ চেনা
গন্ডীর লক্ষণ রেখা পার করে অচেতন মন
পৃথিবীর যাবতীয় ঋদ্ধিই এপিটাফ হয় তখন।

অণুগল্প
এবং কুমুদ
শুভা গাঙ্গুলি

কুমুদিনী ছাদে তাঁহার মেঘসদৃশ কেশদাম শুকাইতেছিলেন, তিনি প্রত্যহ দুপুর দুইটা হইতে চার ঘটিকা ছাদে ঘুরিয়া ঘুরিয়া গান করিতে করিতে তাঁহার চুল শুকান। কুমুদিনী ঊনত্রিশ বৎসর বয়স্কা বাল্যবিধবা, বাল্যে ছয় বৎসর বয়সে কুলীন প্রথায় বিবাহ নয় বৎসরে বৈধব্য যোগ, কুমুদ স্বামীকে চিনিত না, মরিলে বিন্দুমাত্র দুঃখিত হয় নাই, পিতৃদেবের স্বচ্ছল অবস্থা তাই তাহার জীবন সুখেই কাটিত, কিন্তু তাহাকে তখনকার নিয়ম কানুন অনুযায়ী  গৃহবন্দী হইয়া থাকিতে হইতো।

গল্প এই পর্যন্ত ঠিক ছিলো, কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো কুমুদের দাদা বিলাত হইতে তিনটা পাশ করিয়া ফিরিয়া আসিলে, সে আসিয়া কহিলো কুমুদ লেখাপড়া শিখিবে, কেবলমাত্র নির্জলা উপবাস করিয়া জীবন কাটাইবে না।

বিদ্যাসাগর মহাশয় মেয়েদের শিক্ষা নিয়া অনেক ব্যবস্থা করিয়াছেন, কুমুদ বিদ্যালয়ে যাইবে আর পড়াশোনার পাশাপাশি শিল্পকর্মও শিখিবে, খেলাধুলাও করিবে। রায় বাড়ীতে বড় ছেলের কথা মান্য করা হইতো, তাই কুমুদের বন্দীদশা ঘুচিলো কিন্তু অন্য অশান্তি দেখা দিলো। তাহার বয়সী মেয়েদের অভিভাবকরা এই রীতিকে প্রশ্রয় দিলো না ফলে কুমুদ সখীহীন হইলো, কিন্তু কুমুদ দমিবার পাত্রী নয়। সে সকলকে বুঝাইয়া গুটি কতক ছাত্রী জোগাড় করিলো, পড়াশোনায় মোটামুটি ভালোই ছিলো, ইস্কুল পাস করিলে দাদা পুনরায় বিবাহের চেষ্টা করিতে লাগিলো, ততদিনে। বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবা বিবাহ আইন পাশ করিযাছেন, সেই হেতু দাদা বোনের বিবাহের জন্য ব্যস্ত হইলো।

কুমুদ ছোটবয়সে বিবাহ নামক প্রণালী সম্পর্কে কোনো ধারণা করিতে পারে নাই, এখন দেখিলো এবং বুঝিলো আইন পাশ হইলেও বাল্য বিধবার বিবাহ সহজ নহে, নারী ঘরে পচিয়া মরিবে কিন্তু বাহিরের জগতে যাইতে পারিবে না।
কুমুদ দুই একবার দাদার কথা মানিয়া পাত্রপক্ষের সামনে বসিলো, কিন্তু তাহাদের প্রথা  শুনিয়া নিজেই নাকচ করিলো।

কুমুদ নিজেই গ্রামের মেয়েদের লেখাপড়ার পাঠ দিয়া তাহাদের মানসিক শক্তি বাড়াইতে লাগিলো, নানারূপ কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোবৃত্তির বাহিরে যে একটা সুস্থ জগত আছে সে তাহাদের শিখাইলো, এ কাজে তাহাকে প্রচুর অসুবিধার সামনে পড়িতে হইলেও সে পশ্চাদপদ হয় নাই।

এত অবধি গল্প মোটামুটি ঠিক চলিতেছিলো, এইবার ঘটনায় নয়া মোড় আসিয়াছে, কুমুদিনীর পাশের বাড়ীতে কোলকাতা হইতে এক মাষ্টার আসিয়া ছেলেদের স্কুলে জয়েন করিয়াছে, বিশ বছরে গ্রামে প্রচুর উন্নতি হইয়াছে, মেয়েদের ইস্কুল ছেলেদের ইস্কুল সব কিছুই কুমুদ আর ওর দাদার আন্তরিক প্রচেষ্টায় গঠিত হইয়াছে, মেয়েরা এখন চারদেয়ালের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অশিক্ষিত গৃহবন্দী অবস্থায় দিনযাপন করে না, জ্ঞানের আলো গ্রামে প্রবেশ করিয়াছে।

খোঁজ লইয়া জানা গেছে নতুন মাষ্টার এখনও বিবাহ করে নাই সাংসারিক কারণে, এক্ষণে সে ছাদে বিচরণরত কুমুদকে দেখিয়া কিঞ্চিত বিচলিত হইয়াছে, সম্ভবত: সমাজসংস্কারক কুমুদ এবং সংসারসুদারক মাষ্টার কুমুদের দাদার পরামর্শে একত্র থাকিবে।

কুমুদ দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্না সুন্দরী এবং স্বাধীনচেতা, সাধারণ জনতার ভাষায় দজ্জাল কিন্তু মানুষটির কাজে সারা গ্রাম উৎসাহিত। অলিখিত লকডাউন হইতে নারী জাতিকে মুক্তি দিয়াছে।।

ধারাবাহিক গল্প
পচন
স্বপঞ্জয় চৌধুরী

ছয়
এরপর আরো দুইবছর কেটে গেলো। পচনের শরীরে কুষ্ঠরোগীদের মতো ফোস্কা দাগ উঠতে লাগলো। মাঝে মাঝেই জ্বর আসে। ডাক্তার বলেছে সুচিকিৎসার প্রয়োজন। কুষ্ঠ ছোঁয়াচে রোগ এই আতঙ্কে ওর সাথে কেউ মিশতে চায় না। এমনকি ওর মা কুসুমও ওর থেকে যেন খানিকটা দূরে সরে যাচ্ছে। মানুষের বাড়ি কাজ করে ওর চিকিৎসা খরচ মেটানো সম্ভব নয়। তাই ওকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে শুয়ে বসে ভিক্ষা করতে হয়। কেউ হয়তো দু’চার আনা দেয় কেউ আবার আতঙ্কে সরে যায়।  দিন শেষে যা কামাই হয় তা দিয়ে ওষুধ পথ্য কেনা হয় না। অবশ্য একটি এনজিও ওর চিকিৎসা খরচ বহনের আশ্বাস দিয়েছে। বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও নাকি চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় এ খবরও জানে পচন। কিন্তু তবুও সেসব চিকিৎসা সেবা নেয় না। কারণ কুষ্ঠ রোগকে পুঁজি করে ভিক্ষার মাধ্যমে কিছু পয়সা কামাই করে যদি দুগ্ধদাত্রী মাকে একটু আর্থিক সহয়তা করা যায়। রোগ ভালো হয়ে গেলে সুস্থ্য মানুষকে কেউ ভিক্ষা দেবে না। ( চলবে...)

শিল্প সাহিত্য ১০৮

বৃহস্পতিবার ১৫ই শ্রাবণ ১৪২৭, ৩০ই জুলাই ২০২০




কবিতা
শুভ্র সরখেল
লালা গালিচার কেচ্ছা 

এই পথে এসো
স্নিগ্ধতা পাবে!
দিন শেষে প্রেমের পুঁথি মালা হারিয়ে যেতে পারে কথিত রাষ্ট্রের নকশা থেকে!
তবুও এই পথে এসো
অনেক শান্তি পাবে আশা করি।

এই পথের ধুলোয়
রঙের ষড়যন্ত্র পাবে!
দিন শেষে কষ্টের থালা নিয়ে দ্বিধায় পরতে পারো ঠাকুমার রান্নার ঝাল নিয়ে!
তবুও এই পথে এসো
অনেক বিশ্বাস পাবে আশা করি!

এই পথের দূরে কেউ থাকে না
নিঃসঙ্গতা পাবে!
দিন শেষে অন্তত কারো হাসির ভেতর লুকানো ভুতের পোট্রেট দেখা যায় না!
তবুও এই পথে এসো
অনেক গুলো নিজেকে খুঁজে পাবে আশা করি!

অনিক সাহা
জারুল গাছ ও দু’কাঁধে জমে থাকা দুঃখ

১.
মা যেন ছিল ছোট্ট উঠোনটিতে গড়ে ওঠা জারুল গাছ
আমরা সবাই আগাছার ন্যায় বেড়ে উঠেছি!
ভাগ বসিয়েছি মাটি থেকে পাওয়া জল, খাদ্য ও খনিজে...
মা পরম মমতায় হেসে দিয়েছিল ঠাঁই।। 
ঝড়ের মৌসুমে গাছটির বড় বড় ডাল ভেঙ্গে পড়তো,
একা একাই জারুল গাছটি আগলে রাখতো আমাদের!
আমরা ভাবতাম,
জারুল গাছটি কি বোকা?

২.
দু’কাঁধে জমে থাকা দুঃখগুলোকে আরো ভারী করে দিয়ে আমরা বসে পড়তাম বাবার দু’কাঁধে...
ঝড় এলে মাটি পিচ্ছিল হয়ে মাঝে মাঝে কাঁদা হয়ে যেত,
কিন্তু আগাছাগুলোর কোন ক্ষতি হয়নি

৩.
আজ ব্যস্ত নগরীতে ভীষণ ব্যস্ত জীবন... 
সেই জারুল গাছটি জোছনা রাতে এখনো মস্ত ছায়া হয়ে থাকে পুরো উঠোন জুড়ে
বাবার কাঁধ থেকে দুঃখগুলো গামছা দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছি কতবার...
পারিনি....
না পারাগুলো ফুল হয়ে ফুটতে থাকে একটা
দুইটা... তিনটা... এমনি অসংখ্য...
আমরা দুই ভাই অবাক চোখে দেখি কেবল
ওদিকে ঝড় আসলে বাবা এখনো উঠান থেকে কুড়িয়ে নেয় দুঃখগুলো!

বঙ্গ রাখাল
বিষাদী পেরেক

তোমাকে মনে পড়ল-নিঝুম রাতে
যখন একা একা ঘুমায়-পাশ শূন্য
তুমি বলেছিলে- ফুলের মালা আনতে
আমি নিয়ে এসেছি ফুল-বাগানকুসুম
কিন্তু দেখ-
তুমি আমি কেমন বন্ধি

হাতে-পায়ে বিষাদের বিদ্ধ পেরেক
চল-ফুলের মালা গাঁথি
তুমি-আমি বরণ করি হিমায়িত নিজেকে।

পার্থ সারথি চক্রবর্তী 
ক্ষুদ্র-বৃহৎ

ওড়ার জন্য আকাশও কখনো ছোট পড়ে যায় 
বাস করার জন্য একটা মন
সে তুলনায় কিছুই না 

এক জীবন বাঁচার জন্য কত আর্তি
কত আকুতি, কত মিনতি
অথচ বাঁচার জন্য একটা জীবন 
যথেষ্ট নয় মোটেও, বরং অনেক ছোট

কত স্বপ্ন  দেখা বাকি, কত কিছু বোঝা বাকি 
কত বন্ধুত্ব অধরা, কত মন না-ছোঁওয়া 

এক সুদীর্ঘ, তৃপ্তির ঘুমে যেন কেটে যায় 
এক আস্ত পাখিজীবন, 
খুঁটে খুঁটে তুলে আনা অভিজ্ঞতায়
ভরে ওঠে সময়ের ঝুলি

প্রহরগুলো কাটে যেন শূন্যে তাকিয়ে থেকে 
সকালের হলদে রোদ মেখে
সোনালী বিকেলের অন্তহীন অপেক্ষায় 
ধ্রুপদী সঙ্গীতের রাগাশ্রয়ী মূর্ছনায়
দুলতে থাকা প্রহরের ঝিল্লিসুতোয় 

খাঁচার থেকে বেরিয়ে এলে
আকাশ সত্যিই ছোট মনে হয়



সোমের কৌমুদী
নৌকার পাটাতনে ঘুমায় প্রহর

ভরা যুবতী নদীর বুকে ছলাৎ ছলাৎ জল 
শুদ্ধ করে তোলে দু’তীরের সবুজকে
সবুজকে করে তোলে আরো সবুজ, করে তোলে প্রাণবন্ত। 
দিগন্তহীন নীল আকাশ নিজেকে হারায় নদীর জলে।

নদীর বুকের ছলাৎ ছলাৎ জলে 
সদ্য নির্মিত রঙিন পালতোলা নৌকা এগিয়ে চলে
পাটাতনে ঘুমন্ত কাশফুল সকাল
রঙিন পালের ছেঁড়া খোপ স্নিগ্ধ সকালকে বিমর্ষ করে তোলে।  

নৌকা ছুটে চলে প্রহরের পর প্রহর পেরিয়ে
গ্রামের পর গ্রাম পাটাতনে খুঁজে নেয় আশ্রয়
মহাকালের মত দীর্ঘ দুপুর শেষে একটা সোনালী বিকাল
হেলে পড়ে পাটাতনে, বিমর্ষ সকালের মাঝে নিজেকে লুটায়।

প্রহরের শেষে প্রহর আসে, শেষ হয় অষ্টপ্রহর 
নৌকা ছুটে চলে, এগিয়ে যায় সামন থেকে আরো সামনে
সোনালী বিকাল ফের মিলে স্বচ্ছ শুভ্র প্রাতে
তবু রাত আসে না, আঁধার ভেড়ে না নৌকার পাটাতনে।

অভ্র আরিফ
ইদানীং মানুষ

মানুষ ততটুকু যায়, যতটুকু তার হৃদয় চায়
শিশুর নরোম গালের মতো  
হৃদয়ে, দেখো কি নিপূণ ক্ষত!
এ হৃদয় নিয়ে আমি কার কাছে যাই...
গাঙুরের জলে ভেসে ভেসে চলে গেলাম বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে জীবনানন্দের চোখ খুঁটে খায় ধানশালিক
আর সেলফি তুলে বনলতা সেন।
বস্তুতঃ মানুষ এখন কোথাও যায় না। এরা হৃদয় খায়...

মীর সাহাবুদ্দীন 
মা মানে নদী, নদী মানে বহমান- মহাযুদ্ধ 

আমাকে তুমি কি মনে করেছ অন্ধকার নাকি-
আলো; ভাবতে ভাবতে সময় পেরিয়ে গেল
আমি কি হব, কি আমার আগামী!
ভাল্লুক বা মাকড়সা হেরে গিয়েও জিতার গল্প শোনেছ
নাকি খরগোশ আর কচ্ছপের
কিছু ঠাওর করতে পারনি; কেননা -
মানুষের মুখে না শব্দটাই সবচেয়ে বেশি
যার চাকচিক্য হাইট খই ফোটা কথার প্রাচুর্য বেশি
ভালোবাসার সকল মানুষ তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

বাবা বলতেন এটুকু আসার জন্য
হাঁটতে হাঁটতে জুতোর তলা ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল 
একটা শার্ট দিয়ে বছর কাটিয়েছি 
মাষ্টারি করে জীবনটা তালি দিয়েছি
এসবের কিছুই শুনতে ভালো লাগেনি
কেননা চোখ ফোটে আলো দেখেছি এবং-
শূন্যে সবুজ ও লাল পেয়েছি
চারদিকের পরিবেশে আলো আর রঙিন মানুষকেই দেখেছি
দিনশেষে আমি আমার মাকেই ভাবি
আমিও চাইতাম আমার মায়ের-
অনেক গুলো শাড়ি থাকুক লাল নীল ও গোলাপি 
মায়ের কোন চাহিদা পাইনি কেননা তিনি বাবাকে বুঝতেন। 

বাবা হঠাৎ করে এক পীরের প্রেমে পড়ে
গুটিয়ে যায় কিছু মানুষ থেকে ভালোবাসা থেকে
হয়তো কিছু অন্ধ ধার্মিকতাও তখন তাকে খেয়ে ফেলেছিল

গৃহ যুদ্ধ আমার কখনো পছন্দ ছিলনা
ফ্যামেলি কোলাহল মনে হত মহাযুদ্ধ
নারী মানে নদী নদী মানে বহমান
আমিও মায়ের আঁচল বাইতে বাইতে হয়ে উঠি ধৈর্যশীল
এখনো চলছি যত ভাবছি পৃথিবীর ঘরে ঘরে মহাযুদ্ধ তত বেড়ে চলছে...

ধারাবাহিক গল্প
পচন
স্বপঞ্জয় চৌধুরী

পাঁচ
এরপর এগারো বছর কেটে গেলো। ফুলমন বিবি পটল তুলেছে প্রায় ছয় বছর আগে। কুসুম যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছে কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে সলিমকে। বস্তির মানুষ অবশ্য ওর নাম দিয়েছে পচন। ওর পচন নামের আড়ালে ভালো নাম আব্দুস সলিম ঢাকা পড়ে গেছে। 
সবাই ওকে পচন নামে ডেকেই স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করে বেশি। কুসুমও ওকে এখন পচন নামে ডাকতে শুরু করেছে। অবাধ্য এ ছেলেটি সারাদিন পথে পথে ঘুরে বেড়ায় আর কুসুম মানুষের বাড়িতে ঝি এর কাজ করে খেটে মরে। ব্র্যাক স্কুলে ওকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়েছে। স্কুলে একদিন যায় তো তিনদিন যায় না। ওর বয়সী আরো অনেক ছেলেদের সাথে রাস্তায় রাস্তায় ঘুড়ে বেড়ায়। রোদে পোড়ে, বৃষ্টিতে ভেজে আবার কখনোবা বুড়িগঙ্গার ময়লা পানিতে ঝুপাঝুপ ডুব দিয়ে সেরে নেয় গোসল। বাসে উঠে বলে ভাড়া নেই, হেলপার এক চপেটাঘাত দিয়ে নামিয়ে দেয়। পরের স্টপেজে এরকম আরো নানা ঘটনা ঘটিয়ে থাকে অবাধ্য বালক পচন। 
ইদানিং বিড়ি সিগারেটের পশ্চাৎদেশ কুড়িয়ে টান দিতেও নাকি শুরু করেছে। মাঝেমধ্যে গঞ্জিকাসেবকদের কাছ থেকে এক দুটান ভাগও পেয়ে থাকে। ময়লা সাদা রঙের ছেঁড়াফাটা গেঞ্জি ও হাফপ্যান্ট পরিহিত বালক পচনকে মাঝে মাঝে গার্লস স্কুলের সামনে দেখা যায় কারো কাছ থেকে আইসক্রিম চেয়ে খেতে। ওর ভাষ্য মতে আফারা খুব ভালো হয় চাইলেই দেয় কিন্তু ভাইয়ারা দেয় ধমক তাই তেনাগো কাছে চাই না। কখনোবা রাতের বেলায় একা একা ঘুরে বেড়ায় ঢাকার রাজপথে। মাঝরাস্তার আইল্যান্ড ধরে দু’হাত দু’পাশে প্রশস্ত করে শৃঙ্খলমুক্ত পাখির মতো যেন উড়ে যায় দূরে। (চলবে...)

Wednesday, July 29, 2020

শিল্প সাহিত্য ১০৭


বুধবার ১৪ই শ্রাবণ ১৪২৭, ২৯ই জুলাই ২০২০




কবিতা
মৃনাল কান্তি বিশ্বাস
ক্ষুধার বিপ্লব

আমি সাত-রাস্তা মোড়ের রিক্সা চালক শামসের আলী
লকডাউনের জনশুন্য শহরের রাস্তায় কর্মহীন একজন
কয়েকদিন হলো কোনো রোজগার নেই
মাথার  উপর সাত সাতটা মানুষের ভার ।

আমি ক্লান্ত নই তবু
যদিও, অনাহাওে আছি আজ!
বউটা আমার ফিরবার পথ চেয়ে-
তিন বছরের লতুটা না খেয়ে আছে সকাল থেকে।
বৃদ্ধা মা অসুস্থ্য, অন্ধ বাবা  অপেক্ষায়---
সাত বছরের অবুঝ ছেলেটা খাবারের লোভে তাকিয়ে থাকে, ওর বাবা কখন ফিরবে  ?
এগারো বছরের মায়ের মত মেয়েটা, কিছুই বলেনা---
ওর বাবার অক্ষমতার কথা ভেবে।

আমি রিক্সা চালক শামসের আলী ভিক্ষাবৃত্তি বুঝিনা।
এ হাসপাতাল থেকে ঐ ক্লিনিকে ছুটে গেছি রক্ত বেঁচবো বলে
কেউ- তাও কিনলো না!

এবার শুধু একটা ধারালো অস্ত্র চাই
হয় নিজেকে মারবো, না হয় জবাই দেব পুঁজিবাদ।

আমি অতশত বুঝিনা
কিসে কত অপরাধ! কেনই বা হব বিপদগামী?
ক্ষুধার  যন্ত্রণায়---
সমস্ত শহরের পুঁজিবাদ বিক্রি দেব নিলামে।
কচু কাটা করব সব মজুদদার, কসাইখানার চাতালে।
কেউ অভুক্ত থাকলে ক্ষুধার পরিমাণে রক্ত নেব
ছোট্ট লতুটা অনাহারে থাকলে শান্তিধাম মোড় থেকে জ্বালবো আগুন!
তাতে কে পুড়লো?  আর কে হল দগ্ধ! বুঝিনা,
আমার শুধু-
এক কেজি চাল আর দু-মুঠো ডাল চাই।

কেউ খাবে---
কেউ খাবেনা---
কেউ ঘাম ঝরাবে? কেউ থাকবে আরামে---
তা হবেনা---

সামুয়েল মল্লিক 
ফরমালিন ভোর

সবুজ বাতাস চুরি করেছে দলবদ্ধ কর্পোরেট চোর।
সাথে নিয়ে গেছে চড়ুই-এর কিচিরমিচির,
মধুক‚পী ঘাস আর খয়েরি শালিকের পালক।
একদিন ভোরে ঘুম ভেঙে দেখি চারপাশে ধোঁয়ার আসর
বিস্বাদ কমলার মতো ঝুলে আছে ফরমালিন ভোর
সবুজ বৃক্ষরাজির মাথা নেই শুধু পড়ে আছে খন্ডিত ধর।

কমল কুজুর 
কাক ডাকা ভোর

তারপর,
কচুরিপানার আড়ালে আড়ালে লুকিয়ে বেড়ানো
ডাহুকের বিরহী ডাক
তুমি শুনতে পাও এখনো?
নাকি তোমার কর্ণযুগলে শুধুই করে প্রবেশ
কোকিলের বসন্ত রাগ?

মাছরাঙ্গার ঠোঁটের ফাঁকে আটকে থাকা
পুঁটি তোমায় কাঁদায় হররোজ
এসব বিলাসিতা তোমায় মানিয়ে যায় বেশ,
মাছরাঙ্গা নৃশংস নয়
সে শুধু বাঁচতে চায়।

তার চেয়ে বরং অনেক বেশি দায়ী এই আকাশ
বেলা অবেলায় সাদা নীল হলুদের খেলা খেলে
অভাগাদের স্বপ্ন দেখিয়ে যায়,
তারাও সমুদ্রস্রোতের মতোন
স্বপ্ন দেখে
বাসা বাঁধে বালুচরে
থরে থরে
সাজানো স্বপ্নসাধ তাই অল্পেই
ভেঙে ভেঙে লুটিয়ে পড়ে।

তোমার কাক চোখের গভীরতা তবু
আমাকে ডেকে নিয়ে যায়
বারবার
সেই বিষণ্ন নদীটির ধারে
অল্প একটু হাঁটুজল যেখানে
কাপলা ফোটায় মিষ্টি হাসি মেলে।

শম্পা পাল 
যে নদী জন্মের আগেই কবিতা হয় 

গনগনে রুপকথা হয়েছি
লিখতে চাইলে লিখতে পারো
তবে অণু কবিতা নয়
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কবিতা লিখতে হবে
শিরোনাম দিতে হবে যে নদী জন্মের আগেই কবিতা হয়
তারপর সিন্ধু, ব্যাবলিন, মিশর
আমি সব গুছিয়ে নেবো
শুধু নদী ভাঙনের আগে
বেহালাটা আমার হাতে দিও ----

অণুগল্প

অভাবনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা
রানা জামান

তৃণভোজী প্রাণীদের সারিটা বেশ লম্বা। সবাই চারপেয়ে। সবাইকে বিষণ্ন দেখাচ্ছে। ওদের কাউকে না কাউকে বাঘ ধরে নিয়ে এসেছে। এতক্ষণে খেয়ে ফেলেছে কিনা বুঝতে পারছে না। ওরা এ-ও ভাবছে যে খেয়ে ফেললে ওদেরকে দেখা করার জন্য খবর দেবে কেনো?

সারির প্রথমে আছে একটা জেব্রা। শেয়ালের ইশারা পেয়ে গুহার ভেতরে ঢুকলো জেব্রাটা। গুহার ভেতরটায় আলো-আঁধারের মিশ্রণ। ঐ আলো-আঁধারে একটা নেকড়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুকটা কাঁপছে ওর। ইতিপূর্বে ও কখনো কোন নেকড়ের এতো কাছে আসে নি এবং কোন নেকড়ে ওদের কাউকে এতো কাছে পেয়ে হামলে না পড়ে ছেড়ে দেয়নি। সে এ-ও ভাবছে: ভয় পেয়ে এখান থেকে পালিয়ে গেলে ভাইটাকে তো খাবেই, ওকেও খুঁজে পেয়ে ওখানেই খেয়ে ফেলবে। সৃষ্টিকর্তা কী দেহ দিয়েছে ওদের-এরা দেখলেই হামলে পড়ে ওদের উপর ছিড়ে-ফেড়ে খাওয়ার জন্য। এসব ভাবতে ভাবতেই জেব্রাটা গুহার আরো গভীরে ঢুকলো।

ওখানে একটা বাঘকে বসে থাকতে দেখে জেব্রার হৃৎস্পন্দন বাড়তে শুরু করলো। মনে মনে বললো: সব রাক্ষস এক জায়গায় কেনো? ভাইকে ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে ভাগবে নাকি? আপনি বাঁচলে বাপের নাম?
তখন বাঘটা বললো, ভয় নেই জেব্রা, তোমাকে খাবো না। তোমার ভাইকেও খাই নি।
জেব্রা বিনয়ের সাথে বললো, আশ্বস্থ করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ব্যাঘ্র মহাশয়।
-কী ব্যাপার? প্রাগৈতিহাসিক কালের সম্বোধন কেনো? বাঘ স্যার বলো, শার্দুল স্যারও বলতে পারো। যাকগে।
যেজন্য তোমাদের ডেকেছি।
-বলুন শার্দুল স্যার!
বাঘ মুচকি হেসে বললো, আদিপিতা থেকে শুরু হয়েছে আমাদের শিকার ধরার জন্য ছুটাছুটি। আমরা কখনো কোন খাবার পাতে পাই না। প্রচণ্ড ছুটাছুটি আর দৌড়াদৌড়ির পর একটা শিকার ধরে ওটাকে মারার পর খেতে শুরু করবো না শ্বাসপ্রশ্বাস সামলাবো! কী একটা অবস্থা তখন! পৃথিবী এখন অনেক এগিয়েছে। খাবারের পেছনে ছুটাছুটির দিন শেষ করতে হবে। তাই সিংহ মহারাজের সাথে আলোচনা করে আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেটাই তোমাদের জানাবো। তখন তোমরাও আমাদের দেখে ভয়ে ছুটাছুটি করবে না।
জেব্রা অত্যন্ত খুশি হয়ে বললো, তাহলে সিদ্ধান্তটা তাড়াতাড়ি বলুন শার্দুল স্যার!
তুমি প্রতি মাসে দশটা দু’পেয়ে প্রাণী দেবে। খবরদার! বক দেবে না কখনো! বকের গায়ে শুধু হাড্ডি! তুমি তোমার গোত্রের সবাইকে এই ম্যাসেজটা জানিয়ে দেবে।
আমার ভাই শার্দুল স্যার?
পাঁচটা মুরগি দিয়ে নিয়ে যাবে। যাও এখন। পরেরটাকে পাঠাও।
জেব্রা গুহা থেকে বের হয়ে কারো কথার জবাব না দিয়ে ঢুকে গেলো জঙ্গলে।

চিত্রা হরিণটা শেয়ালের ইশারা পেয়ে ভেতরে ঢুকে নেকড়ে দেখে কাঁপতে লাগলো থরথর করে। মনে মনে বললো: যেহেতু জেব্রা বেরিয়ে গেছে অক্ষত দেহে, সেহেতু ওর-ও কিছু হবে না।
নেকড়ে নরোম গলায় বললো, আরেকটু ভেতরে যাও চিত্রা। ওখানে মহামন্ত্রী বাঘ বসে আছে।
বাঘের নাম শুনে কাঁপুনি বেড়ে গেলো চিত্রা হরিণের। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলো সেখানেই।
পতনের শব্দে বাঘ এগিয়ে এসে নেকড়েকে বললো, নাকেমুখে পানি ছিটিয়ে ওর জ্ঞান ফেরাও নেকড়ে।

এভাবে একের পর এক তৃণভোজি প্রাণী গুহায় ঢুকে বাঘের নির্দেশ নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে জঙ্গলে।

এক সময় খরগোশ ঢুকলে বাঘ ক্ষেপে গিয়ে বললো, তুইও লাইনে এসেছিস? তুই তো আমার কাচ্চি বিরিয়ানি!
তোকে তো রেহাই দিতে পারি না! বলেই বাঘটা খরগোশকে খপ করে ধরে দুই কামড়ে খেয়ে ফেললো চিবিয়ে। একটা পায়ের কিছু অংশ থাবা ফসকে মাটিতে পড়ে গেলে নেকড়েটা দ্রুত তুলে পুড়ে নিলো মুখে।

তখন গুহা কাঁপিয়ে একটা হাতি ভেতরে ঢুকে বললো, আমিও ঘাস খাই। আমাকে ডাকলে না কেনো বাঘ। তুমি তো এখন মহামন্ত্রী!
তখন মহারাজা সিংহ এসে বললো, আপনি আমার মন্ত্রীপরিষদের সম্মানিত সদস্য। আপনি কল্যাণ মন্ত্রী ঐরাবত।
ঐরাবত বললো, বাহ! তাহলে আমার খাবার এনে দেবে কে?

ধারাবাহিক গল্প
পচন
স্বপঞ্জয় চৌধুরী

চার
বস্তিতে হৈ চৈ পড়ে গেছে। ফুলমন বিবির ঘরে কুড়িয়ে পাওয়া নবজাতক শিশু। সবাই এক নজর দেখতে ভিড় জমালো ফুলমন বিবির ঘরে। হৈ চৈ ঠেলে বস্তির মাতবর ঘরে ঢুকলো। কোন পাপের বীজ ঘরে আনছো ফুলমন? যেইখান থিকা নিয়া আসছো সেইখানে রাইখা আসো। বুড়া বয়সে ঝামেলা করার দরকার কী? অন্য একজন জোয়ান বললো এইডাতো মানুষের মতো কথা হইলোনা মাতবর সাব। শত হইলেও এইডা মানুষের বাচ্চা, কুত্তা বিলাইয়ের বাচ্চা না। সকলেই মাথা নেড়ে বলে, হ ঠিকই কইছো। অন্য একজন বৃদ্ধা মহিলা বললো- তোমরা কি খালি প্যাঁচালই পারবা? বাচ্চাডারেতো আগে বাঁচানো লাগবো নাকি? ওর দুধ খাওনের ব্যবস্থা করো। অন্য এক মহিলা বললো- এইমুহূর্তে ওরে মায়ের দুধ দেওন লাগবো। কিন্তু দুধ দিব কেডায়? বলে ওঠে অন্য এক মহিলা। ঘরের ভিড় আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এক বৃদ্ধা বলে উঠলো, আচ্ছা কুসুমেরতো দুধের বাচ্চাডা মইরা গেলো। ওর কাছে নিলেতো মনে হয় কাম হইতো। অন্য এক বৃদ্ধা হাহুতাশ করে বলে- আরে, পর পর দুই বাচ্চা মরলো তারপর গত হপ্তায় গাড়ির তলে পইড়া ভাতার মরলো, ওর কি এহন মাতা ঠিক আছে? ওতো একটা পাগলি! একথা বলতে না বলতেই কেউ একজন ভিড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। কেউ একজন ঠাট্টা করে বলেছিল, তোর ছেলে ফিরে এসেছে। একথা শুনেই ও ছুটে আসে। দে আমার পোলারে, দে বুড়ি। এই বলেই ফুলমনের কাছ থেকে নবজাতকটিকে চিলের মতো ছোঁ মেরে কোলে নেয় কুসুম। সকলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে যার যার ঘরে ফিরে যায়।
(চলবে...)

Tuesday, July 28, 2020

শিল্প সাহিত্য ১০৬


মঙ্গলবার ১৩ই শ্রাবণ ১৪২৭, ২৮ই জুলাই ২০২০




কবিতা

শঙ্কর ঘোষ
যে পথ ঘুরে গেছে 

ওই পথে গেলে কি তাকে পাওয়া যেত?
মাঝে পথ আটকে কিছু সমুদ্র - বন স্থির পাথরের মতন।
ওই পথে কি হেঁটে যাওয়া যেত
সরীসৃপ মন বলে ওঠে - স্থবির আমি অখণ্ড আমি - গভীর ঘুমে ক্লান্ত।
সেও তো বেশ কয়েক দ্বীপ পর,
দেখো তুমি যেতে পারো আমার সাথে যদি তুমি সব ক্লান্তি নাও আমার।
প্রসঙ্গহীন সমাজ ব্যস্ত ভ্রাম্যমানের বাসা নড়াতে,
পবিত্র প্রেত সুপ্ত- রোমাঞ্চিত মনে।
ভয় পাও... ভয় পেতে শেখো।
বিকেলের পরে ওই ভাঙা পাঁচিলের ধারে নামবে ছায়া একটু বাদে,
ওই ছায়া-ঘেরা-বিকেলে ওই পথে গেলে হয়তো তাকে পাওয়া যেত ।।

মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী 
হাওর দ্বীপপুঞ্জের শহরে

প্রতিদিন মিশে থাকি হাওর দ্বীপপুঞ্জের শহরে
যেখানে সন্ধ্যা নামে নৈসর্গিক নানান রূপের ডানামেলে।

যেখানে আষাঢ় পূর্ণিমা রাতে, মেঘেদের সাথে চাঁদ হাসে
বৃষ্টিভেজা রাতে অজানা অনুভ‚তিরা হৃদয়ে বাসা বাঁধে।

বিস্তৃর্ণ হাওরে উত্তাল ‘আফাল’ সমুদ্র রূপে আঁচল পেতে ধরে
ইচ্ছেগুলো মিশে থাকে অথৈ জলের আছড়ে পড়া ঢেঁউয়ে।

খুব ইচ্ছে করে যেতে শহরের সুরমা রিভারভিউয়ে
যেখানে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্যের দেখা মেলে।

নদীর এ তীওে প্রেমিক যুগলের অতৃপ্ত বাসনারা পূর্ণতা পায়,
চন্দ্রাালোকিত ঝলমলে জলরাশি যেন লুকোচুরি খেলায়!

এখানে বসে বাউলেরা হাসনরাজা, দূর্বিন শাহ, রাধা রমন,
শাহ আবদুল করিম লহরিতে মেতে ওঠে
কবিতায়, প্রেম, আড্ডায়, তরুণেরা জলরাশি উপভোগ করে তন্ময় হয়ে।

আমি সেখানেই বার বার ছুটে যাই,
যেতে মন চায়,
মন পড়ে থাকা সেই প্রিয় ঠিকানায়।
পড়ন্ত বিকেলের গোধূলি লগ্নে
কবি মোমিনুল মউজদিনের জল-জ্যোৎস্নার শহর পাড়ায়।

সাকিব শাকিল
অন্ধ হরিণ

তোমার হৃদয়ের ভেতরে গোল্লাছুট খেলতে খেলতে হারিয়ে গেছে অন্ধ হরিণ;
কোনো এক অজানা দূরের মাঠে-
মাঠ পেরিয়ে সে ঘুমিয়ে গেছে বিজন বনের বুকে।
এই গুম গুম হাতকড়া খেলা উপেক্ষা করে
ঠিকই ফিরবে আমাদের সমৃদ্ধির হরিণ।
ঘরে ফেলে আসা সেই শাবকের কসম!
কসম এই ঘাটির
কসম এই রক্তাক্ত মাটির
আমাদের ঘৃণার চোখেই চুরমার হবে বাঘিনীর ডেরা
মৃতরাও যোগ দেবে যোগ দেবে ভীতরাও
এই আতঙ্ক ও ত্রাসের অরণ্যে একদিন
হরিণ বিক্ষোভ দেখা দেবে।

সিয়ামুল হায়াত সৈকত 
ব্যাকরণ

যেসব গানের মুখস্থ ঠোঁট পড়তে পারি
এমন বৃষ্টিপাত হলে, নিকটবর্তী গাছ বাতাস ধরে।
আর চুম্বকের বোধ এসে দাঁড়াতে পারে মাঝখানে
ঠিক যেমনঃ হাত রাখলে নিজেকে জানতে দেয়

তোমাকে নিয়ে আমার আগ্রহ নেই
সময়ের মিনার উঁচুতে বসে সংকেতবিজ্ঞান পড়েনা।
জানতে চাইলে পড়ে ব্যাকরণ
দৈর্ঘ্য-প্রস্থ শুক্রবার নিয়ে আসে। ঘুম আসেনা।

মোহাম্মদ আবদুর রহমান
ভিখারি

আমি ভিখারি
এ কথা তোমাকে কে বলেছে?
নাকি আমাকে দেখে এসব কথা বলছ
আরে আমার জীর্ন পোশাকের ভেতর
বসবাস করে পরম প্রিয় মান-সম্মান
তার দিকে তাকিয়ে খালি পেটেও
হাসতে পারি কোটি টাকার হাসি
তুমি কোন দিন হাজার টাকার হাসি হাসতে পেরেছ?
হিসাব করে দেখ একবার
আর যদি না পাও
তবে বুঝো কে ভিখারি?

ধারাবাহিক গল্প
পচন
স্বপঞ্জয় চৌধুরী

তিন
শহরের অন্যতম নার্সিং হোম নিরুপমা নার্সিং হোম। এই নার্সিং হোমে বাচ্চা ডেলিভারির একটা সুনাম রয়েছে। রাত নয়টা পাঁচ। পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখে নেন লোপার বাবা। মোবাইল পকেটে রাখতেই ফোন বেজে ওঠে। মোবাইলে নম্বর ভেসে উঠতেই আজাদ সাহেব গর্জে ওঠেন “সান অফ এ বিচ আমি তোকে পুলিশে দেব। কেন তুই আমার মেয়ের সর্বনাশ করলি?” মোবাইলের ওপাশ থেকে প্রতারক ও লম্পট প্রেমিকের কণ্ঠ “দেখুন আংকেল এযুগে এগুলো কোনো ঘটনাই নয়, বাচ্চা ফেলে দিয়েছেন ভালোই করেছেন। এখন ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দিন।” আজাদ সাহেব ক্ষিপ্ত কণ্ঠে- শাট আপ বাস্টার্ড, বলে মোবাইল বন্ধ করে দেন। নার্সিং হোমের আয়া আজাদ সাহেবের কাছে এসে কানে কানে বলে “স্যার কাম কমপ্লিট”। আজাদ সাহেব পকেট থেকে দুটো পাঁচশত টাকার নোট বের করে দেন। আয়া বিরক্তির স্বরে বলে- আমারে কি ভিক্ষুক পাইছেননি স্যার? এইজন্যই এইসকল রিক্সের কামে যাইতে চাই না। চুপ করো, ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বলেন আজাদ সাহেব। এরপর পকেট থেকে আরো দুটি পাঁচশত টাকা বের করে দেন। এবার আয়া তার দন্ত প্রদর্শন করে। আজাদ সাহেব নার্সকে ডাকলেন। নার্স ব্যস্ততা নিয়ে বললেন, জ্ঞান ফিরেছে স্যালাইন চলছে। শরীর অনেক দুর্বল, বেশি কথা বলবেন না। (চলবে...)

পাঠ প্রতিক্রিয়া

‘একাত্তরের যুদ্ধবীর’ তিন যুদ্ধবীরের বীরত্বগাথা ইতিহাস আশ্রিত এক জীবনোপাখ্যান
আশিস রহমান

করোনাকালে অবসর সময়ে পড়ে শেষ করলাম সুনামগঞ্জের লেখক-গবেষক ও সাংবাদিক মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী'র লেখা সদ্য প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই 'একাত্তরের যুদ্ধবীর'। নাগরী প্রকাশনী প্রকাশিত ১২৭ পৃষ্ঠার এই বইটির প্রচ্ছদ করেছেন আল নোমান।

সুনামগঞ্জের দুই জন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিম, আব্দুল মজিদ ও একজন বীরাঙ্গনা নারী যোদ্ধা কাকঁন বিবির যুদ্ধকালীন অবদানসহ তাদের জীবনের বিভিন্ন দিক স¤পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। উল্লেখ্য, এই তিনজন মুক্তিযোদ্ধাই সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার বাসিন্দা। বইয়ের লেখক এই তিনজন মুক্তিযোদ্ধার সান্নিধ্য এসেছিলেন। যে কারণে প্রাসঙ্গিক ভাবেই বইটির লেখায় লেখক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের আশ্রয় নেওয়ার পাশাপাশি এই তিন বীর মুক্তিযোদ্ধার বীরত্ব গাথা বিভিন্ন যুদ্ধের জবানি হুবহু তুলে ধরছেন।

বইটির শুরুতেই এসেছে একজন পাহাড়ি সংগ্রামী নারীর কথা। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশের নত্রাই গ্রামে এক খাসিয়া পরিবারে জন্ম নেওয়া নারী কাঁকাত হেনুইঞ্চিতা। জুম চাষী এই নারী জীবনের নানান টানাপোড়ন, ভাগ্য বিড়ম্বনা, প্রেম, ধর্মান্তরিত হওয়া, বিয়ে, গুপ্তচরবৃত্তি ও শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠা সবই সুনিপুণ ভাবে একাত্তরের যুদ্ধবীর বইটিতে বিধৃত হয়েছে। লেখক নিখুঁতভাবে ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সীমান্তের ওপারের পাহাড়ি কন্যা কাঁকাত হেনুইঞ্চিতা থেকে উঠে এসে এদেশের একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিবেটি হয়ে ওঠা বীরাঙ্গনা কাঁকন বিবিকে। স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিবর্তিতে কাঁকন বিবির মানবেতর যাপিত জীবনের দুঃখকষ্টময় দিনগুলোর কথাও একাত্তরের যুদ্ধবীরে ফুটে উঠেছে। কাঁকন বিবির জন্ম, কৈশোরকাল, বিয়ে, পাক ব্যাংকারে সম্ভ্রমহানি ও যুদ্ধযাত্রা, গুপ্তচরবৃত্তি, যুদ্ধপরবর্তী জীবন, সংগ্রামী নারীর স্বীকৃতি, সর্বোপরি তার আত্মজীবনী বিধৃত হয়েছে বইটিতে।

বীরাঙ্গনা কাকঁন বিবির পরেই এসেছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিম বীর প্রতীকের প্রসঙ্গ। অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী আব্দুল হালিম বীর ছিলেন একাত্তরের উত্তাল মুহূর্তে বয়সে টগবগে এক তরুণ শিক্ষার্থী। দেশমাতৃকার টানে এই তরুণ সিলেট টেকনিক্যাল কলেজ ক্যা¤পাস থেকে পালিয়ে এসে পরিবার স্বজনদের ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। অন্যান্য সতীর্থদের সাথে তিনিও ভারতে ট্রেনিং নিয়ে বিভিন্ন সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। সাহস ও বীরত্ব দেখিয়েছেন। আব্দুল হালিম শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা-ই নন একজন সৌভাগ্যবান মানুষ ছিলেন। ভাগ্যের ফেরে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ৫ বার বেচেঁ ফেরেছেন। মৃত্যুর মুখ থেকে পাঁচবার ফিরে আসা চাট্টিখানি কথা নয়। শত্রুদের মোকাবেলায় নিজের শরীরে গ্রেনেড বেধে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেন। যা এখনো কল্পনানীত এবং একজন নিখাদ দেশ প্রেমিকের পক্ষেই শুধু সম্ভব। যুদ্ধকালীন সময়ে এই বীর যোদ্ধা ছাতকের জাউয়া সেতু ধ্বংসে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেন। একাত্তরের যুদ্ধবীর বইয়ে সঙ্গত কারণেই লেখক তাকে ছাতকের জাউয়া সেতু ধ্বংসের নায়ক হিসেবে অবিহিত করেছেন। অসীম সাহস ও বীরত্বের ফলশ্রুতিতে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিমকে স্বাধীনতা পরবর্তীতে বীরপ্রতীক খেতাবে সম্মানিত করা হয়। বইটির এই অংশে বীরপ্রতীক আব্দুল হালিমের জন্ম, বেড়ে ওঠা, কৈশোর কাল, যুদ্ধে অংশগ্রহণ, যুদ্ধ পরবর্তী জীবন পর্যায়ক্রমে তুলেধরা হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিমের পর তার সহযোদ্ধা আব্দুল মজিদ বীর প্রতীকের প্রসঙ্গ এসেছে। হালিম ও মজিদ দুজনই ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একই এলাকার বাসিন্দা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও এই দুই বন্ধু একসাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। কাধে কাধ মিলিয়ে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছেন। সবকটি বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধে হালিম ও মজিদ দুজনই পর¯পরের সাথী যোদ্ধা হিসেবে একসাথে অংশগ্রহণ করেছেন। কি আশ্চর্য মিল দুজনের মধ্যে! তারা একই সাথে যুদ্ধ করেছেন এবং একই যুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ একইসাথে বীরপ্রতীক খেতাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। আব্দুল মজিদ ছোট্ট বেলা থেকেই দূরন্তপনা ছিলেন। সংস্কৃতির প্রতি বিশেষ টান ছিলো তার। মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগেই ৬০ এর দশকে তার শৈশবে তিনি ‘রাজপুতের ছেলে’ নামক সফল মঞ্চ নাটকে সেনাপতি রঘুদেবের চরিত্রে অভিনয় করে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাতকের রাউলি ব্রীজ ধ্বংস, সোনাপুরের কাভারিং ফায়ার, জাউয়া সেতু ধ্বংসের অভিযান, ঝাওয়া সড়ক ও রেলসেতু ধ্বংস অভিযান, রায়ত গ্রামের যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব ও সাহস দেখিয়েছেন তিনি। বুরকি যুদ্ধে তার দুঃসাহসী রণকৌশল যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের খেসারত স্বরূপ তার বসতবাড়ি, ফসলিজমি ও ফলজবৃক্ষ সম্পূর্ণ ভাবে আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাক বাহিনী ও তাদের দোসররা। বইটিতে পূর্ববর্তীদের ন্যায় আব্দুল মজিদেরও জন্ম, বেড়ে ওঠা, কৈশোরকাল, যুদ্ধে অংশগ্রহণসহ যুদ্ধপরবর্তী জীবনের বিভিন্ন দিক বিধৃত করেছেন লেখক।

সর্বোপরি বীরাঙ্গনা কাকঁন বিবি, আব্দুল হালিম বীর প্রতীক ও আব্দুল মজিদ বীরপ্রতীককে ভালোভাবে জানতে এবং তাদের বীরত্ব গাথা যুদ্ধের স্মৃতি রোমান্থনের জগতে প্রবেশ করতে পাঠকের জন্য একটি পছন্দের বই হতে পারে একাত্তরের যুদ্ধবীর। এক্ষেত্রে লেখক ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার। যারা মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রের রোমাঞ্চকর ঘটনা পড়তে ভালোবাসেন তারা এই বইটি পড়ে মজা পাবেন। বইটি অনলাইন পরিবেশক রকমারি ডটকমেও পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া সুনামগঞ্জের পৌরবিপনীর মধ্যবিত্ত থেকেও বইটি সংগ্রহ করতে পারবেন।

Monday, July 27, 2020

শিল্প সাহিত্য ১০৫

সোমবার ১২ই শ্রাবণ ১৪২৭, ২৭ই জুলাই ২০২০



কবিতা
আনোয়ার হোসেন বাদল
ক্ষয়ে যাওয়া চোখ

বিমূঢ়তা কাটিয়ে যখন দিঘির জলের দিকে তাকাই
দেখি তার কাজল চোখের টলটলে জলে
গ্রীক দেবী সাইকি’র প্রেম খেলা করে
আমার তখন ক্ষয়ে যাওয়া চোখ
আমার তখন ডুকরে ওঠা বিকেল
কেন যে সেইসব দিন-রাত্রি পালক ঝরা ডানার সাথে জড়িয়ে ছিলো!
আমিতো এরোস নই
ওহে সাইকি, আমিতো চাইনি হতে প্রেমের দেবতা
প্রকৃতির খেয়ালী এক সৃষ্টি আমি
কোনদিন শিখিনি এতটুকু ছল
যে চোখে পাথর ছিলো, ভালোবাসা ছিলোনা সেখানে 
যে চোখে প্রেম ছিলো সেতো এক বিবর নয়ন
ছিলোনা জলের নদী অথবা আকাশ
তাকে আমি রেখেছিলাম খুব গোপনে একাকী তার সাথে কে করেছে দেখা!
বিমূঢ়তা কাটাতে চলে গেছে রৌদ্রের কাল
চলে গছে শীতল বৃক্ষ আর বনানীর সুনিবির ছায়া
এখন আমার পাশে কাঁদে কোনজন
মাটিতে পড়েনা কেন তাহার ছায়া!
সেকী তবে মৃত কেউ?
শতাব্দীর প্রেতাত্মা, অথবা কায়া?
ছায়া-কায়া দুই-ই ছিলো চির অচেনা
ভালোবাসা-প্রেম সব সুদূর অতীত
তবু কেন সে এসে দেখা দিয়ে যায়!
আমিতো কিউপিড নই; প্রেমের দেবতা!
সাইকি’র প্রেমে পড়ে ছুঁড়ে দেবো
মধুময় তীড়!
আমার জীবন কই? সেতো এক বেদনা গভীর!

তন্ময় পালধী
যে বৃত্তে ভাসতে ভাসতে

আসক্তির মাত্রা ভরপুর হলে
তাকে যে যতই মোহ বলে ভাবুক
আমি বলি প্রেম।
যে বৃত্তে ভাসতে ভাসতে উত্তোরণ ঘটে
বিবর্ণ পৃথিবী থেকে
রঙিন অমানুষতা থেকে
এক সোনালি সকাল।

আসক্তি যদি নাই থাকে
মায়া প্রেম ভালবাসায় সন্দেহই জাগে।

সোয়েব মাহমুদ
মন্ত্রীসভা এবং বাজে কবিতা

একদিন ছেনাল বেশ্যার উরুতেও জায়গা হবে না নগরপিতার।
একদিন শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকবে দশ-দশটা শুয়োর,
ওরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে করুণা করে ঘুমাতে বলবে।  
একদিন শহরের আনাচে কানাচে 
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মশাগুলো-
কালো কোটের দালালকে চ্যাঙদোলা মশারী টানিয়ে 
ফুটো করে ঘোরাবে নগরময়- শেখাবে 
উত্তর- দক্ষিণ উত্তর- দক্ষিণ।
একদিন সব কিছু-
সব কিছু ছাপিয়ে সব শেয়ারবাজারের 
কারসাজিকারীদের স্থান হবে হাইকোর্ট মাজারে,
ওদের সাথে তখন শুধুই কথা বলবে কাগজের মুখ -টাকা।
একদিন ওয়াসার প্রধানের মেয়ের বিয়ে হবে-  
বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ ঠিক মতন পাওয়া যায়নি 
বিধায় কবুল বলবার ৫ মিনিট পর নিকাহবিচ্ছেদ ঘটে যাবে।
একদিন দুর্নীতি দমন কমিশনার দেখবেন তার জিপারে
সরল বিশ্বাসে ঝরে গেছে তার দন্ড, 
উইপোকা কিলবিল করছে  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পা’দুকায়।
একদিন বন্যার পানি নেমে গেলে- 
একদিন বাংলাদেশ ব্যাংক শুন্য হয়ে গেলে 
তামিম ইকবাল আর দরবেশবাবা জানবেন আবেগে 
আমরা হিসেব কষতে ভুলে যাই- 
একটা সময় এলে ভাবি 
আমাকে কোথাও জবাবদিহিতার কিছু নাই।
একদিন এইসব বাজে কবিতা লিখতে লিখতে - 
প্রধানমন্ত্রীর হাসিতে হাসি মিলিয়ে 
হাসতে হাসতে আমিও 
বসে যাবো হয়ে একাডেমি প্রধান - 
অথবা বিকলাঙ্গ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র- 
নিয়োগ দিতে থাকবো অথর্ব গো-বেষক, অনুবাদক।
সোনার বাংলায় ঝলমল ঝলমল করবে 
ষাট বছর আগেকার ক্লাসিক অথচ 
বাংলা যাবে না কোথাও,
বাংলা থাকবে না কোথাও!
একদিন সারা পৃথিবীর মানুষ - 
আস্তিক হয়ে উঠবেন- 
ঈশ্বরভীতি সৃষ্টি হবে- 
কারণ তারা জানবেন-  
ঈশ্বর আছেন - 
ভালোভাবেই বিরাজ করেন- 
তা নাহলে 
বারোভাতারী বাংলাদেশ টিকে থাকে কি করে?

তন্ময় বিশ্বাস
অস্থায়ী

স্থায়ী বলে কিছু হয়না।
জোৎস্না নিভে এলে, ঘেড়ার খুড়ের মত-
অন্ধকার নামে বুকে! প্রেতপুরীর নারকীয় বেদনা-
বেদানার মত ঝরে গহ্বরে!
হাসতে হাসতে কয়েকটি রঙিন মাছ সঙ্গম ছেড়েঁ
নদীতীর খুঁজে নেয়! আর বলে যায়-
যা দেখি তা ক্ষণিকের!

সেদিনের কথা মনে পড়ল, ম্যাকলাস্কিগঞ্জে-
প্রেমিকার আঙুল-গন্ধ-স্বপ্ন বরাবর যেই হাঁটছি
অদ্ভুত এক পাথর পায়ে  টোকা মেরে হাসতে হাসতে বলল-
“আমি এগারো বছর পর ধূমপান ছেড়েছি”
ভাবলাম এতে আনন্দ বা বিষাদ কেন?
জীবনে যা করি তা ক্ষণিকের, আকাশে উড়ে যায় পাখী!

বক্রেশ্বর এই সকল তত্ত¡কথার অদ্ভুত ব্যাখ্যা দেয়-
জলের ধারা গাছ বরাবর হাঁটতে হাঁটতে মাটিতে মেশে,
আবার বৃষ্টি হয়ে ঝরে টিনে-ছাদে-পুকুরে-নদীতে-সমুদ্রে-মরুতে!
জটিল সব তত্ত¡! সোজা কথায় বুঝি-
প্রেমিকা ছেড়ে গেলে আবার প্রেম হয়, নদী হয়, নদীর গর্ভে বীর্য ভাসে!
অস্থিরতা পেয়ে বসে এসবে! মাথার ঘিলুর মধ্যে চেপে বসে বেদনা,
আসলে কিছুই স্থায়ী না!
মাঝেমাঝে রক্তের দোষেও ভেঙে যায় ভালোবাসা।

আর তখনি কার্লমার্কস'কে খুব মনে পড়ে।

আপন রহমান
উত্তাপ

পাথরকে আঁকড়ে ধরে
জীবনের দুঃখ ভুলতে চেয়েছিলাম
পাথরও মোমের মত গলতে শুরু করল।

অতঃপর সূর্যের কাছে গেলাম
দুঃখের উত্তাপগুলো রাখার জন্য,
সে জানাল নিজের উত্তাপে সে নিজেই জর্জরিত।

পরিশেষে কি আর করা
নিজের উত্তাপে-
নিজেই ভষ্ম হতে থাকলাম।

ক্রমশ ; সে উত্তাপকে আরও বেশি
আলগা করে দিতে থাকল
বেদনার বিষন্ন বাতাস।

ধারাবাহিক গল্প
পচন
স্বপঞ্জয় চৌধুরী

দুই
বাঁদিকের রাস্তা পেরিয়ে সামনে এগুলেই আরেকটি রাস্তা। রাত আটটা বাজলেই রাস্তাটি খানিকটা ভুতুড়ে হয়ে যায়। মাঝে মধ্যে দু’একটা প্রাইভেট কার এসে হর্ন বাজিয়ে কোনো বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে, নতুবা রাস্তা মাড়িয়ে অন্য কোনো রাস্তায় চলে যায়। অভিজাত বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে বাগানবিলাস। সমগ্র রাস্তাটিতে হাঁটলে ফুলমন বিবির স্বর্গসুখ অনুভ‚ত হয়। ঠিক তার বিপরীত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় রাস্তার মোড়ে ডাস্টবিনটার কাছে গেলে। পেটের নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে আসতে চায়। প্রতিদিনের মতো আজও নাকে কাপড়ের আঁচল টিপে ডাস্টবিনের সীমানা পেরুচ্ছে ফুলমন। হাত দশেক দূরে যেতেই ফুলমন বিবির কানে খানিকটা চেনা সুর ভেসে আসে। ফুলমন সুরের তোয়াক্কা না করে আরও দু কদম পা ফেলে। আবারও সেই সুর ফুলমন বিবির কান ও মস্তিষ্ককে আন্দোলিত করে। 
এবার পূর্বাপেক্ষা আরোও সচেতনভাবে ফুলমন বিবি সুরটিকে শ্রবণ করে। কান খাড়া করে শুনতে থাকে সুরটি বেড়ালের গর্জন নাকি কোনো নবজাতক শিশুর কান্না। ফুলমন বিবি আরো ভালোভাবে সুরটি শোনে আর বিড়বিড় করে বলেন “হ ঠিকইতো কুট্টু পোলাপানের কান্দনের আওয়াজ”। ফুলমন বিবি নিশ্চিত হয় সুরটি পিছন দিক থেকে আসছে। সে পশ্চাতে ফিরে আস্তে আস্তে এগুতে থাকে এবং ডাস্টবিনের কাছে আসতেই আওয়াজটি আরও ঘনিভ‚ত হয়। ফুলমন বিবির আর বুঝতে বাকি থাকে না “হায় আল্লা এই কাম কেডায় করলো, এই রহম এট্টা জ্যান্ত বাচ্চারে ময়লার মধ্যে ফালাইয়া গেলো” খানিকটা আতংকিত হয়ে বলে ফুলমন। বাচ্চাটার দিকে ফুলমনের দৃষ্টি আরোও প্রবলভাবে যায়। নবজাতকটি ছেলে শিশু এবং খুব বেশিক্ষণ হয়নি কেউ ফেলে গেছে। পনের বিশ মিনিট হবে এরকম অনুমান করে ফুলমন। যাউগগা তাতে আমার কী! বড়লোকের কুকামের ফসল ফালাইয়া থুইয়া গেছে। এই বলে হাঁটা ধরে ফুলমন। আবারও সেই কান্নার সুর ফুলমনকে অস্থির করে তোলে। ফুলমনের দ্বিতীয় সত্তা তাকে প্রশ্ন করে- কি পালাইয়া যাইতাছোস? এই বাচ্চাডাতো তরও হইতে পারতো। সে আবারও পিছন ফেরে এবং ভাবে বাচ্চাটাকে কি সে সাথে নেবে নাকি বস্তির লোকেদের ডেকে নিয়ে আসবে। বস্তির লোকেদের ডাকতে গেলে কেউ যদি বাচ্চাটাকে নিয়ে যায়।
“যাউগগা তাতে আমার কী?” ফুলমন বিবি আবারও সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে বাঁদিকের রাস্তায় চলে যায়। ফুলমনকে পাশ কাটিয়ে একটি কুকুর চলে যায় সেই ডাস্টবিনের দিকে। ফুলমন দুতিন কদম হাঁটে। হঠাৎ সে আঁতকে উঠে বলে-  “কুত্তাডা যদি বাচ্চাডারে মাইরা ফালায়। ফুলমন পিছন ফিরে দেখে কুকুরটা ডাস্টবিনের দিকেই এগুচ্ছে। লেমন বিবি এবার দৌড়াবার মতো করে হাঁটতে থাকে। কুকুরটা ডাস্টবিনের ময়লার কাছে যায়। বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে কুকুরটা জিহŸা বের করছে। ফুলমন বিবি হাতে একটা ইটের কণা নিয়ে হুংকার করতে করতে আসে ঐকুত্তা যা ভাগ এহেনতোন। কুকুরটি ফুলমন বিবিকে দৌড়ে আসতে দেখে ঘেউঘেউ করতে থাকে এবং গররর আওয়াজ করতে থাকে। ফুলমন বিবিও কম যায় না সেও কুড়ি বছরের তরুণীর মতো শক্তি নিয়ে বলে ওঠে যদি বাচ্চাডার গায়ে আঁচড় পড়ে খাইয়া ফালামু তোরে। হাতে নেয়া ইটের কণাটি সে কুকুরের দিকে ছুড়ে মারে। কুকুরটি এবার লেজ গুটিয়ে কেউ কেউ আওয়াজ করে পালিয়ে যায়। ফুলমন বিবি এবার দিশেহারা মায়ের মতো বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিয়ে চুমু খায়। বাচ্চাটির চোখে যেন চাঁদের আলোচ্ছটা পড়ে। ফুলমন বিবি বত্রিশ বছর আগে ফিরে যায়। যখন সে প্রথম মা হয়েছিল উনিশ বছর বয়সে। (চলবে...)

Sunday, July 26, 2020

শিল্প সাহিত্য ১০৪


রবিবার ১১ই শ্রাবণ ১৪২৭, ২৬ই জুলাই ২০২০




কবিতা
উপেক্ষিৎ শর্মা
কবিতা

কবিতা আমার কাছে ছিন্নভিন্ন প্রেমের অবশেষ
যেটুকু শব্দ থাকে জোড়া
অক্ষরে বিন্যাসে, সব
পতিতালয়ের মত স্নিগ্ধ ও রোজগেরে

কবিতা কি শব্দ চেনে?
বাক্য ও বিন্যাস?
জ্যোৎস্না মাড়িয়ে গেলে
মরা চাঁদ দৃশ্যমান হয়
কবিতার পিনকোডহীন অন্য ঠিকানায়

সুখের সেদিন
যেদিন ঢেউ আর নুন থাকে
সদাব্যস্ত গোধূলির মত
সেইদিন কবিতায় রাত্রি নামে
সাপের খোলসে
সেইদিন কবিতার স্পষ্ট হারাকিরি
কালি ও কলম ছুঁয়ে প্রেমের তাড়সে...

কবিতা আমার কাছে,
ছেঁড়া ফুল,
পাপড়িগুলো ছড়ানো ছেটানো,
কফিনের শ্বেতশুভ্র রঙীন অবকাশ...

দেবাশীষ চক্রবর্তী
প্রেম এখন

খোলা চাঁদে আজও ভাসে
অতৃপ্ত যৌবন
পুরুষের রমণী হতে চেয়ে আমারি শবদেহে রাত্রিযাপন
জলপদ্মের আবেশে সর্পবিষে গাঢ় প্রেম
শরীরী উষ্ণতায় ভরা উচ্ছ্বাস
পৌরুষ স্পর্শে ছুঁয়েছিল হাত
সেতো আমারি মৃতদেহ বোঝনি
বিভঙ্গীয় রেখার ঋজু বৈভবে
প্রেমিক হতে চেয়ে
পুরুষ হতে পারিনি
ভাঙ্গা চাঁদে আজও ভাসে অহংকারী যৌবন
পুরুষের রমণী হতে চেয়ে আমারি শবদেহে রাত্রিযাপন

অভ্র আরিফ
স্পর্শে তোমার শুদ্ধতা

যেখানে তোমার হাত পড়ে সেখানেই আশ্চর্য সুভাস
তোমার হাত কি তবে পদ্মফুল, আঙুলগুলো পদ্মপাপড়ি?
তোমার স্পর্শ পাওয়া শুকনো পাতা ঘিরে উড়ে বেড়ায় এক ঝাঁক ভ্রমর।

অমল ধবল হাতের ছোঁয়ায় তোমার,
প্রজাপতি হয়ে যায় ঝালমুড়ির ঠোঙা, পাখি হয়ে যায় লেখার কাগজ, কবিতার বই
পরশ পেয়ে হাতের-  মুমূর্ষু ফুল মুখ তুলে চায় নতুন করে, নুড়িও হয়ে যায় সোনা।

একদিন, বৈশাখী মেলা থেকে কিনে এক গোছা চুড়ি হাত গলিয়ে পড়লে তুমি,
রবিশংকরের সেতার হয়ে বাজলো টুড়িগুলো, গান শুনালো মাটির পাখি,
তোমার স্পর্শ পেয়ে নেড়ি কুকুর হিংস্রতা ভুলে টিএসসির মোড়ে প্রেমের গান গায়।

যেটুকু ছুঁও তুমি, সেটুকুতে আলোর রোশনাই, গুচ্ছ গুচ্ছ গোলাপফুল,
যেভাবে স্পর্শ করো তুমি, সেভাবে উম পায় পক্ষীছানা, পক্ষীর চোখে মুগ্ধতা
নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙ্গুলকে তাই আশ্রয় দিও নগ্ন করপুটে- স্পর্শে তোমার শুদ্ধতা।

বিপুল রায়
শেষ

কিসে যে কি হয়, মন জুড়ে ভয় ভয়, কত কথা শুনে যাই কানে।
রাত কেটে দিন আসে, কেউ থাকে না পাশে, কোন কথার ঠিক কি মানে?
হাঁটা পথে গাড়ি চড়ি, গলি থেকে গলি ধরি
রাজপথ ঠিক কতদূর?
যেতে যে হবেই হবে, চিরকাল কে কবে, ডাক দেয় কোন সে সুদূর!
আমি সে আমি নই, ফুটপাত জুড়ে বই, সেক্সপিয়র, কিটস, বায়রণ।
হাতে পুরোনো বই, পথে ছড়ানো খই, পিছনে পড়ে থাকা যে বারণ।
কেন এই ভয়ভাব, মনে কেন উত্তাপ, পথে থেকে ছুটি পথে পথে।
যেভাবে দিন কাটে, সে পথেই রাত হাঁটে, জীবন বাঁধা যেন গঁতে।

কিসে যে কি হয়, মন জুড়ে ভয় ভয়, কত কথা শুনে যাই কানে।
আকাশে আকাশ মেশে, কে দাঁড়ায় গা ঘেঁষে, কে জানে- কার শেষ ঠিক কোনখানে?

আল্পনা মিত্র 
যদি

আপন-ঘর, ভাবিস পর, তবে সে ঘর অন্ধকার,
মনের ঘড়ি! থামিয়ে তড়ি, টানিস দড়ি ভালবাসার।
নিজেই তবে, নিঃস্তব্ধে, হারাবি সবে মলিনতায়,
থাকবি বসে, একলা শেষে, মনপ্রকাশে অজ্ঞতায়।
হয়তো আমি, নয়ত দামী, শিখড়গামী উচ্চতায়,
চাতক হয়ে, জল না ছুঁয়ে, থাকবি চেয়ে জল-আশায়।
রোদ চশমা, করে ঝাপসা, বাষ্প আশা ভাবান্তর,
তাই বলে কি, দুখ বাহকি, হবে সাবেকি নিরন্তর!
সূর্যদয়ে, চন্দ্রোদয়ে, নামচা নিয়ে ভাবিনা রোজ,
নিজ খেয়ালে, ছন্দ তালে, উঠবো দুলে, যে রোজ রোজ।

ধারাবাহিক গল্প
পচন
স্বপঞ্জয় চৌধুরী
       
এক
সারাদিনের ভিক্ষাকর্ম সেরে ফুলমন বিবি তার বস্তিতে ফিরছে। যেমনটি আপনি আমি ফিরি অফিস কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। কারো উদ্দেশ্য অর্থ আবার কারোবা অর্থের জন্য বিদ্যা। ফুলমন বিবির উদ্দেশ্য বাঁচার জন্য ভিক্ষা করা। স্বামী গত হয়েছে প্রায় বিশ বছর আগে। ছেলেপুলে বিয়ে থা করে আলাদা সংসার পেতেছে। বৃদ্ধা মায়ের দিকে ফিরে তাকাবার সময় সময় ওদের নেই। তারপরও মানুষ বাঁচতে চায় একান্ত বাঁচার জন্যই। ফুলমন আজ ভিক্ষা করে পেয়েছে সাতান্ন টাকা পঁচিশ পয়সা আর সোয়া দুই কেজি চাল। শহুরে মানুষগুলো অনেক কৃপণ হয়ে গেছে। আর হবেইবা না কেন, ভিক্ষাবৃত্তির নব নব কৌশলের সূত্র ধরে  ফেলেছে শহরবাসী। আমার বৌ এর অসুখ, মেয়ের বিয়ে, পরীক্ষার ফিস, ছেলে হাসপাতালে এরকম আরো কত উপায়ে যে ভিক্ষা নেয়া হচ্ছে বাস, লঞ্চ, পথেঘাটে, দোকানপাটে সব জায়গাতে! সেখানে ফুলমন বিবিদের মতো অদক্ষ অভিনেত্রীদের সুযোগ কমই বৈকি।

বাজার থেকে তেল, নুন, তরিতরকারি কিনতেই সব ফুরিয়ে যায়। তার উপর আবার প্রতিমাসে বস্তির ঘর ভাড়া তিনশত টাকা দিতে হয়। ফুলমন বিবিরা সমুদ্র যাত্রায় হেঁটে চলা কচ্ছপের মতো প্রতিদিনের ভিক্ষাকর্ম সেরে রাজধানীর অভিজাত পথ মাড়িয়ে বস্তির কুঁড়েঘরে ঠাঁই নেয়।
                                                                                                                                                    (চলবে...)

গদ্য

কবিতা ও বাংলা কবিতা বিষয়ে 
সাজ্জাদ সাইফ

১.
কবিতা এক অনুভ‚তির নাম, সেন্স, যা ভাষার গায়ে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নেয়।
সেই বিশ্রাম অনন্য। সত্যিকারের হিভেনলি আরকি। শিল্প এই অনন্যতারই ধারণা। জীবন আর প্রকৃতি, মৃত্যু আর জন্ম, স্মৃতি আর স্বপ্ন, ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়া, সুখ আর অসুখ, সম্পদ আর দারিদ্র্য, বিলাস আর সগ্রাম কেউ কারো অনাত্মীয় নয় শিল্পে।
‘যেভাবে কবিতা হয়’ মানে নির্মিতিটাই শিল্প, অনুধ্যানের সন্ধান করে কবিতা আর কবি সেই অনুধ্যান সহযোগে পৌঁছায় কবিতা অব্দি অর্থাৎ সে-ই অনুভূতিটা ‘যে নিজে ভাষার গায়ে হেলে আরাম করছে বিশ্রামে’, কবি সেই সেন্সটার দেখা পায় ছোঁয়া পায় ঘ্রাণ পায় স্বাদ পায়।
এই অর্থে কবি একজন সাধক নিজ জগত সংসারে, নিজ ভাষাতে উপবিষ্ট। জীবনানন্দ বা রবীন্দ্রনাথ, হুইটম্যান বা জন মিল্টন, অডেন বা বোদলেয়ার, যে কবিকেই বিশ্লেষণ করুন দেখবেন সেখানে এক সন্ধানী সত্তা উপস্থিত। কিসের সন্ধান সেটি?
একই কথা এখানেও, সন্ধান সেই অনন্যসাধারণ অনুভ‚তির, আত্মতত্ত¡ যাকে বলে মোক্ষ আর এইখানে বাহনের নামটি হলো ভাষা, ধ্বনি-অক্ষর-চিহ্ন সহযোগে।
এই যেমন এইদিকে বৃষ্টি হইলো আজকে। দুপুরের বৃষ্টি। গ্রীষ্মের বৃষ্টি। ‘বৃষ্টি’ বা ‘দুপুর’ বা ‘গ্রীষ্ম’ এই যে একেকটা ধ্বনি-বর্ণ-অক্ষর-শব্দ, এরা নিজ নিজ গুণে একক সব অভিজ্ঞতার ভার বহন করে আর ব্যক্তিভেদে বিবিধ ইন্দ্রিয়কে প্রভাবিত করে, আর ভাষায় হেলান দিয়ে এই প্রভাবের চিত্রনাট্যটা লেখেন একজন কবি। মানে এই যে এই লেখার খেলাটা যিনি খেলেন তিনিই কবি, একটা বিশেষ মনস্তত্ত¡ বয়ে বেড়ান 
কবিরা। এইটা সংসারে থেকেই করেন কেউ কেউ, সংসারহীন কেউ-বা।
কবিতা আলো-অন্ধকার-দেখা-অদেখা-জানা-অজানা-চেনা-অচেনা যেকোনও আকার বা নিরাকারকে লেখ্যরূপে উপস্থাপন করে থাকে, জগতের অন্যান্য কাজের মতই এইটা একটা কাজের ফলাফল। সেই কাজ কবির। অন্যরা তা করে না তাই অন্যরা কবি নন।
এই লেখাটা হাইপোথেসিস বৈ বিশেষ কিছু নয়। সত্যিই ব্যপারগুলা এমন। বায়োলজিকাল।

২.
মালার্মে ইউরোপে যেই প্রতীকি আকার দিতে চাইছিলেন কবিতারে, আবার বোদলেয়ার, সেই কাজটা এইখানেও সমভাবেই হইছে, আগে আর পরে, এটাই ভিন্নতা। মধ্যযুগ মোটেও শূন্যতা নয় এই ব্যাসিসে। আর চর্যাপদ একটা ইউনিক সম্পদ বিশ্ব-সাহিত্যে। রামায়ন বা মনসামঙ্গল কোনটাই ফেলনা নয়। বাংলা কবিতা তার স্বরূপ নিয়া রাজনীতি করে নাই বিধায় প্রাতিষ্ঠানিক সারবত্তার প্রসঙ্গে বাংলা কবিতা পিছিয়ে। এই পশ্চাদপদতা উপনিবেশের শঠতা বৈ কিছু নয়। আর, প্রভাব সে যে কোনোভাবেই বিস্তৃত হতে পারে। আদি বাংলার চিত্রশিল্পের স্বত্ব নিয়ে যেমন মধ্য এশিয়ার গৌরব-রথ চালিত!
উপমহাদেশীয় শিল্পে বাংলা কবিতা সগৌরবে উজ্জ্বল আর বৈশ্বিক পটে সাংস্কৃতিক স্বীকৃতির বর্তমান সমস্ত মানদন্ড ইউরো শিল্পের আরোপিত সত্য, স্বয়ংক্রিয় নয়। হুইটম্যান যা নজরুল তার চেয়ে বামন নন, গোর্কী বা মানিক কেউই কারো চেয়ে হীন নন বরং উঁচু দেখানোর চেষ্টাটা আরোপিত সত্যই একইভাবে।
মাইকেলের কাজ কোনো অংশে শেক্সপিয়ার হতে নিচ নয়। আসলে মানদন্ডের ধারণাটাই কৃত্রিম, এতোটাই যে একে বর্ণবৈষম্যের দোষ দেয়া কোনো দূষণ বা নৈরাজ্য নয় একদম।

শিল্প ও কবিতা নিয়া সঠিক কথা কইতে পারা লোক সামান্যই আছে এই বঙ্গদেশে, যারা আছে তাদেরও অধিকাংশ মিডিয়ার কাছে সত্ত¡াকে বিক্রি করা লোক, যারা অবিক্রিত তাদের সম্মান করি ও ভালোবাসি। খালি কয়টা দেশি বিদেশী মুভির গল্প, কয়টা ইউরোপীয়-কলিকাতাইয়া শিল্পকবিতার গল্প আর কিছু ছন্দজ্ঞান লইয়া ফতোয়াবাজি করে বেড়ায় আর বাকিগুলা, কবিতা নিয়া আলাপের যোগ্যও নয় এরা তবে রেষারেষি ঠিকই করে, ফেসবুকের মতো ওপেন মিডিয়া পাইয়া এনারাই গোষ্ঠি গোষ্ঠি খেলে আর শিল্পে নৈরাজ্য ছড়ায়, এরা মেকী, এদের লেখাও জোড়াতালি মার্কা, এদের কথা ও কাজের কোনও মূল্যই নাই আর্টে, এদেরকে সম্বল করে মাঝারি ও নিম্নমানের লিখিয়েরা নিজেদের ঢোল জারি রাখে, এরা সেই জনতা যাদের চিহ্নিত করে গেছেন কবিদের কবি শার্ল বোদলেয়ার অথচ এরা নিজেদের মহান আর্টিস্ট ভাবিয়া মিডিয়া গরম রাখে-
‘যতই মানুষ শিল্পেরচর্চা করে-তার প্রবৃত্তি থেকে বর্বরতা কমে যেতে থাকে; কেবল স্থ‚লবুদ্ধির ও রুক্ষরাই যৌনক্রিয়ায় সফল; যে কারণে যৌনক্রিয়াই জনতার অন্যতম লক্ষ্য ...
জনতা একে অন্যের ভিতরে ঢোকে; অপরদিকে শিল্পী নিজের থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না!’’ - শার্ল বোদলেয়ার

Saturday, July 25, 2020

শিল্প সাহিত্য ১০৩


শনিবার ১০ই শ্রাবণ ১৪২৭, ২৫ই জুলাই ২০২০




কবিতা

এবাদুল হক
স্পর্শের গভীর থেকে

দিনশেষে যদি দেখ স্বপ্নের ভেতর রক্তপাত
চিলেকোঠায় সূর্য অস্ত গেল অথচ রাত্রির মুখ ঢাকা
তাহলে নিশ্চিত জেনো তোমাকে খুঁজছে কেউ
অথবা প্রতীক্ষারত তুমি, বসে আছো স্মৃতির জঙ্গলে
ক্রমশ তোমার মধ্যে জন্ম নিচ্ছে, ফিরে আসছে অনুভবে
স্পর্শের গভীর থেকে উঠে আসছে আরেক মানুষ।

যদিও অন্ধকারে পা রাখার জায়গা খুঁজে খুঁজে
পায়ের কথাই ভুলে গেছ, ভুলে গেছ ক্লান্তি ও হতাশা
রাত্রির সংগমরত নদী ঢেলে দিচ্ছে বিষজল
চতুর্দিকে সময়ের ভুক্তাবশেষ, মাকড়সার মত মৃত্যুসুখ।

দিনশেষে যদি দেখ করোটির ভেতর সূর্য ডুবছে
অদৃশ্য শিশির হিমে নিভে যাচ্ছে চিরব্রতী আগুন
প্রার্থনা করো, বুকে যে সামান্য তাপ ছিল
প্রলয় চিৎকারেও তার কোনো গান বন্ধ থাকেনি।

অশোক অধিকারী
অভিমানে রুমালের ঘাম আনতে যায়

ভিজে হাওয়ায় ঘুম খুঁজছে পিতৃপুরুষ
হিম বসন্তে নির্মিত অভ্যুত্থান তার নারী বাসনা
উভচর হৃদয় খুঁড়ে সে রেখেছে বিচ্ছেদ ফুল
একখণ্ড কাপড়ের মেঘ তার শাড়ির ঠোঁট
দিয়ে মুছে দেয় ইমন কল্যাণ

লম্বা চিঠির পাতায় কাটাকুটি নিবিড় সংবাদ
বর্গক্ষেত্র জুড়ে নৈঋত অস্বস্তিসূচক রমণীয়
জানালার রোদে সম্পর্ক শুকাতে দেয়
একদিন গাছের দেয়াল বেয়ে লালারস
শিকড়ের গম্ভীরতা ভাঙাবে বলে
রুমালের ঘাম আনতে যায় অভিমানে

সুজাউদ্দৌলা
পা এবং তুমি

জুতাবিক্রেতার মতো চেয়ে থাকি
মেয়েদের পায়ের দিকে
এতো সুন্দর পা ফেলে তারা হাঁটে বলেই
চারপাশ এতো সুন্দর হয়ে ওঠে
তাদের পদস্পর্শে ধন্য হয় ধূলো
এতো এতো পায়ের দিকে তাকিয়ে
দেবীর মতো তোমার চরণপদ্মের
                     কথা মনে পড়ে যায়
অমন পা ফেলে তুমি আজ কার পথে
                                                  হাঁটো?

মাহফুজুর রহমান লিংকন এর সাক্ষাৎকার
কবিতার ভাষাও মানুষের মুখের ভাষা হয়ে যেতে পারে।



মাহফুজুর রহমান লিংকন।
কবি ও প্রাবন্ধিক।
জন্ম: ১৭ মার্চ, ১৯৮০ এ বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায়।
প্রকাশিত কবিতার বই
 ‘অমীমাংসিত ফুলের  দেবতা’।
বিন্দু, জঙশন, ওয়াকিং ডিসট্যান্স সহ অপরাপর লিটলম্যাগে নিয়মিত লিখছেন।

কেমন আছেন?

সত্যি কথা বলতে কি বয়স বাড়ার সাথে-সাথে ভালো থাকার পরিধিটা মনে হয় বেড়ে যাচ্ছে... সব মিলিয়ে ভালোই আছি মনে হচ্ছে...

লেখার শুরুটা কীভাবে?

আমি ইনিয়ে বিনিয়ে, বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলতে পারি না। সত্য গল্পটা এই যে, আমি নিজেও জানি না লেখালেখি কীভাবে শুরু করেছি। তবে কুড়িগ্রামের মত সাজানো গোছানো, নদীর আনাগোনাময়, ছোট্ট শহরটা আমাকে কবিতার মানুষ করে তুলেছে। পাশাপাশি যার কথা বলতে হয়, তিনি আমার দাদা প্রয়াত মনির উদ্দিন ব্যাপারি। শৈশবে সম্ভবত তাঁকে দেখে উজ্জীবিত হয়েছিলাম। তিনি ছিলেন সূফী ঘরনার লোক, শৈশবে দেখতাম খাজা মইনুদ্দিন চিশতির জন্ম ও মৃত্যু দিবসে সারা রাত বাউল গান হতো... এখান থেকে সম্ভবত কবিতার প্রতি কিছুটা মমতা জন্মে, লিখতে উদ্বুদ্ধ হই...

আপনার কবিতায় তাই বারবার ‘কুড়িগ্রাম’ উঠে আসে। কিন্তু দীর্ঘদিন ঢাকা এবং দেশের বাইরে থাকার যে অভিজ্ঞতা, তা আপনার কবিতায় অনুপস্থিত কেন?

ঐ যে বললাম, কুড়িগ্রাম শহরটা আমাকে কবিতার মানুষ করে তুলেছে... হয়ত প্রথম প্রেম কুড়িগ্রাম... তাই ফিরে ফিরে প্রথম প্রেমের অনুভূতি আমাকে তাড়িত করে...
দীর্ঘদিন ঢাকায় থাকি, তবুও এই শহরটা আমার না... এমন ভাবনা আমাকে ভাবিত করেনা। আর আমার দু-একটি কবিতায় ঢাকার কথা উঠে এসেছে (যেমনঃ ‘বৃষ্টি এবং রিক্সা বন্দনা’)। তবে, দেশের বাহিরে যখন ছিলাম, তখন আমার আজন্ম প্রেমের সুতোয় আমি বাঁধা পরে ছিলাম। তার ফলে যা হয়েছে- আমি আসলে দৈহিকভাবে সেখানে থেকেও হয়ত সেখানে ছিলাম না... ওই সময়ের যে চোখ সে চোখ সত্যিকার অর্থে অন্ধ ছিল বলেই হয়ত আমাকে তাড়িত করতে পারে নাই... 

আপনার মতে কবিতা কী? কবিতা পাঠের প্রয়োজনীয়তা কী?

যে কোন কবিতা, তা কবির এক বিশেষ অভিজ্ঞতালব্ধ মুহূর্তের ফসল; অনুভ‚তি বা অনুভবের ভাষিক রূপায়ন। আমি মনে করি, কবিতা যতটা না বুদ্ধিবৃত্তিক আয়োজন তার চাইতে অনেক বেশি আবেগের অক্ষর, ভাষাবন্দীর খেলা। তবে শুধু আবেগিক প্রযোজনাই কবিতা নয়। কবিতাতে কবি প্রয়োজন অনুযায়ী সংযত আবেগের শৈল্পিক উপস্থাপন করেন। কবিতায় যদি এই নিয়ন্ত্রিত আবেগ সঞ্চালনের সাথে গঠনের সুষম প্রবাহ থাকে তখন তা উৎকৃষ্ট কবিতা হয়ে ওঠে। অর্থাৎ আবেগ ও অনুভবের সাথে চিন্তার যথার্থ শৈল্পিক সজ্জ্যায়নই কবিতা। এ অর্থে কবিতা ব্যক্তিনিষ্ঠ। কিন্তু যথার্থ শিল্পের শক্তি ও সৌন্দর্য এইখানেই যে তা ব্যক্তিগত ভাবের প্রকাশ হলেও হয়ে ওঠে সার্বজনীন। প্রকৃত কবিতার যাত্রা তাই ব্যক্তি থেকে বিশ্বের দিকে। পাঠক যখন কোন কবিতা পাঠ করে তখন সে নিজেও কবিতায় বর্ণিত অনুভ‚তি বা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায়। সাহিত্য মানুষের আবগেকে জাগিয়ে দেয়। কবিতা এই কাজটা সবচাইতে নিখুঁতরূপে করতে পারে। কবিতা পাঠের সময় পাঠকের সামনে তার নিজের ভেতর লুকানো জগতের প্রকাশ ঘটে যায়। সে নিজেকে আবিষ্কার করে বর্ণিল বিচিত্রতায়, বহুরূপী সময় আর নানামুখী অভিজ্ঞতার সদর দরজায়। নিজেকে এই যে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আবিষ্কার আর ভেতরের আবেগের জাগরণ- এটা পাঠককে সুখ দেয়। এই আবিষ্কার আসলে নিজেকে নতুনভাবে সৃষ্টি করা। সৃষ্টির ফলে স্রষ্টার (পাঠক এখানে স্রষ্টার ভূমিকায়) সুখ লাভ হয়।

কবিতায় ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে আপনার চিন্তা জানতে চাচ্ছি।

মানুষের মুখের ভাষা কবিতা নয়। কবিতা নয় সংবাদপত্রের ভাষাও। এগুলো কবিতা হলে কবিতাকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার প্রয়োজন বোধ জন্মাত না। কবিতার কিছু লাইন মুখের ভাষার মতোই লাগে। কিছু-কিছু কবিতার লাইন মানুষের  মুখের ভাষার সাথে, চেতনার ভাষার সাথে, বোধের সাথে, অভিজ্ঞতার সাথে, প্রত্যাশার সাথে এতোই মিলে যায় যে, কবিতার ওই লাইনটি প্রবাদে পরিণত হয়। তাহলে মুখের ভাষার সাথে কবিতার ভাষার দূরত্ব কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো? কিংবা ধরুন, রিকসাওয়ালার কণ্ঠে যখন কবি বলেন, ‘পেডেল মাইরা কি চান্দে যাওন যায়!’ তখনও দার্শনিকতার স্পর্শে সচেতন হয়ে ওঠে মন। সীমাবদ্ধতা ও প্রত্যাশার বিপরীতার্থকতাও ভেসে ওঠে। কিন্তু কথাটি তো নিছক মুখের ভাষা-ই। কিংবা বুদ্ধদেব বসু যখন বলেন, ‘সোনালী আপেল, তুমি কেমন আছ?’ অথবা শক্তি চট্টোপাধ্যায় যখন বলেন, ‘যেতে পারি- কিন্তু কেন যাবো?’ তখন?
তাহলে দেখা যাচ্ছে মুখের ভাষাও তার প্রচলিত অর্থকে ছাপিয়ে বিশেষ অর্থ বহন করতে পারে। তেমনি কবিতার ভাষাও মানুষের মুখের ভাষা হয়ে যেতে পারে। কবিতার বিশেষত্বও এখানেই। একটি শব্দকে সাধারণভাবে উপস্থাপন করলে সে সাধারণ অর্থই প্রকাশ করবে বা আভিধানিক অর্থই প্রকাশ করবে। কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ যদি আভিধানিক অর্থকে অতিক্রম না করতে পারে তাহলে বলতে হবে কবি তার ভাবকে শব্দের নদীর মাধ্যমে উপস্থাপন করতে পারেনি। আবার সাধারণ মুখের ভাষাকেও সাধারণ অর্থ থেকে উপরে তুলে তাকে বিশেষ অর্থে অর্থায়িত করা যায়। তখন মুখের ভাষাও হয়ে ওঠে কবিতা। 
এভাবে দেখা যায় চিঠির ভাষাও কবিতা পদবাচ্য হতে পারে। সাধারণ অর্থে কবিতার ভাষা তো সম্মোহনীয় ভাষা। তাই বলে সম্মোহনীয় স্বর সৃষ্টি করতে হলে শুধুমাত্র যে ঐন্দ্রজালিক পরিবেশ-পরিস্থিতি-ভাষার দ্বারস্থ হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সাধারণের ভেতর থেকেও তুলে আনা যায় বিবিধ গভীরতা।
কবিতার ভাষা এমন এক ভাষা-  ব্যকরণ দিয়ে যাকে সিদ্ধি করানো যায় না। প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধ বিদ্যা কবিতার ভাষার কাছে প্রায়ই মূর্খ। তাই বলা যায়, কবিতার ভাষা একধরনের অভিনব নিরীক্ষাধর্মী। সম্পূর্ণরূপে যা অন্যরকম, অন্যরকম এর অভ্যন্তর। ফলে কোনোভাবে একবার যে প্রবেশ করবে তার কাছে মনে হবে চলে এসেছি মনোরম মনোহর দিকশূন্যপুরে। ফলে ফিরে আসা যায় না... প্রেমিকার সঙ্গে বুক খোলা  মাঠে শতশত গল্প করার পর ফিরে যাওয়ার মতো নিষ্পলক বিস্ময় নিয়ে ফিরে ফিরে আসার অসীম অঙ্গীকার...

কবিতায় কি গল্প বলা যায় ?

কবিতা মানেই তো স্বল্প কথায় গল্প বলা... 

আগামী দিনে বই প্রকাশের বিষয়ে পরিকল্পনা কী?

আগামী ফেব্রুয়ারিতে আমার প্রথম এবং এখন অব্দি একমাত্র কবিতার বই ‘অমীমাংসিত ফুলের দেবতা’র পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের পরিকল্পনা আছে।

‘অমীমাংসিত ফুলের দেবতা’ পড়ার পর অনেক পাঠকের মন্তব্য ছিলো, এই কবিতাগুলোতে আমিত্বের প্রকাশ ঘটেছে তুমুলভাবে, বারবার। এ ব্যাপারে কিছু বলবেন?

আমি আমার নিজের মাঝে জগত সংসার দেখতে পাই। ফলে যেটা হয়েছে যে, সকলের কথা বলেও, আমি আমাকেই হয়ত ফুটিয়ে তুলেছি। আমি প্রায়ই একটি কথা বলি, পাঠক যদি কবিতার আয়নায় নিজেকে দেখতে না পায় তাহলে সে কবিতা সুখপাঠ্য হয়ে উঠে না। আমি চাই, কবিতার ভিতরে ঢুকে পাঠক নিজেকে আবিষ্কার করতে শিখুক। তাতে কবির সাথে কবিতার সাথে পাঠকের বন্ধন বেড়ে যাবে।

আপনি তো প্রবন্ধ লিখেন। প্রবন্ধের বই নিয়ে পরিকল্পনা কী? 

এখানে একটু গোপন কথা বলে ফেলি, লিটলম্যাগ বিন্দুর মুল কাণ্ডারী কবি সাম্য রাইয়ান আমার লেখালেখি জগতের দ্বিতীয় ঈশ্বর! ২০১২ সালের আগে আমি যা লিখেছি তা আমার নিজের ভিতরে বসে থাকা আর এক লিংকন আমাকে দিয়ে লিখিয়েছেন...। তবে ২০১২ সালে আমি প্রবাস জীবন শেষ করে দেশে আসার পর কবি সাম্য রাইয়ান’র সংস্পর্শে আসি এবং ওর উৎসাহে বলেন আর জোরেই বলেন, আমাকে অনেক কবিতা সহ প্রবন্ধের জন্ম দিতে হয়েছে...
বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ নিয়ে আপাতত কাজ করছি (ইতোমধ্যে তিনটি গদ্য বিন্দুতে ছাপা হয়েছে)... ভবিষ্যতে যদি তেমন লিখা হয়ে যায় তাহলে বই আকারে প্রকাশ করার ইচ্ছা আছে বৈকি... 

এই সময়ের তরুণ-তরুণী কবিরা প্রত্যেকে প্রত্যেককে আড়ালে ‘বোকাচোদা’ সম্বোধন করে। কবিদের মেরুদন্ড, স্বাভাবিক সৌজন্যবোধ হারিয়ে কি হারিয়ে যাচ্ছে?

কে, কারে কী কইলো, এই সব নিয়ে না ভেবে বরং এটা ভাবা উচিৎ “আমারে নিয়ে কেউ একজন ভাবতেছে... এই বা কম পাওনা কীসে! কবি সাম্য রাইয়ান প্রায়ই আমাকে একটা কথা বলে- ‘ভাই, কেউ যদি এক লাইনও কবিতা লিখে, তাহলে সে আমার ভাই।’ এর চেয়ে মহা সত্য বানী এই প্রসঙ্গে আর হয় বলে আমি মনে করি না। কবির চেয়ে সোজা মেরুদণ্ড জগতে আর কারো কি আছে! তবে আমি তরুণ লেখকদের উদ্দেশ্যে বলবো, সমস্ত পৃথিবী জ্ঞানের ভান্ডার, যেখান থেকে যা পাবেন, সেটাকে লুটে নিয়ে, আপনার মননে, সৃজনশীলতায়, সৃষ্টিতে ঢেলে দিয়ে আপনার সৃষ্টিকে তথা আপনার প্রেয়সীকে সাজান। সারা পৃথিবী আপনাকে স্যালুট করবে। এইসব দলাদলি- গলাগলি আপনাকে সাময়িক তুষ্টি দিতে পারে, কিন্তু তা আপনাকে ধ্বংস করে দিতে সময় নেবে না। অতএব, সাধু সাবধান!

পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তখন কী হতে চাইবেন?

কবিপত্নী!

আপনার জীবনে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা কী?

আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা আমি আমাকে ভালোবাসতে পারি নাই... 

সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ধন্যবাদ ‘শিল্প-সাহিত্য’ পত্রিকাকে। শুভকামনা।

Friday, July 24, 2020

শিল্প সাহিত্য ১০২


শুক্রবার ৯ই শ্রাবণ ১৪২৭, ২৪ই জুলাই ২০২০




কবিতা
তপনকুমার দত্ত
মেঘকে

মেঘ তোকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে।
কখনো তুই আগুন জ্বালা উনানের পাত্র
থেকে উপচে পড়া দুধ। কখনো দুই সিংহ সিংহির
মুখোমুখিতে। কখনো ঘোড়ার পিঠে চড়ে ধূসর এলোচুলে ছুটে চলার মুহূর্ত। কখনো তুই ক্লান্ত হয়ে পাহাড়ের বুকে শুয়ে। কী দারুণ রূপ তোর কী দারুণ সাজ। তুই ভালো থাক।

মেঘ শোন তোকে বলি-এযাবৎ যত লিখেছি সব পড়েছিস কখনো। কখনো না পড়া লেখাটি দেখতে চেয়েছিস। চাস নি। তোকে শোনালে বলেছিস-চমৎকার। সুন্দর অথবা জবাব নেই।
মেঘ তুই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকিস।
একার মতো একা থাকিস
উড়ে বেড়াস এদিক থেকে ওদিক।
তুইও সরে যাচ্ছিস এক্ষুণি।

মেঘ এতো লিখে কী পাবো বল
অর্থ যশ প্রতিপত্তি নাকি
অলীক ভালোবাসার কিছু ছায়া
যা শুধু ধেয়ে নিয়ে চলে পেছন পেছন

মেঘ বিশ্বাস কর
পরকীয়া হবে না আমার
আমি ভীষণ একান্ত ভালোবাসি।
আমার ভালোবাসা কষ্ট
আমার ন্যাকামী বোকামী সব
আমার স্ত্রী-ই বোঝে
বিবাহিত দিন থেকে।

মেঘ একটু দাঁড়া শুনে যা
অক্ষর বাঁধা অনেকেই
অক্ষরে অক্ষর রেখে
ভালোবাসার যাদুতে
ভ‚বন মাতাতে পারে
মন মাতাতে পারে না
পারে না ছুঁতে
বুড়িচ্ছু খেলা ছাড়া অন্য কিছুতে।

মেঘ ধূসর হয়ে গেলি
তবে কি তুই কাঁদবি এখন
অঝোর ধারায়।
মেঘ আমার কথা ভালো লাগলে
অন্য মেঘে বলিস।

বঙ্গ রাখাল
দূরে সরে যাচ্ছি

প্রতিদিন নিয়ম করে দূরে সরে যাচ্ছি
আরো দূরে যেতে চাই-তোমার থেকে
যতদূরে গেলে প্রিয়জন আরো প্রিয় হয়।

জীবনে অমূল্য ছিলে তুমি
আজ অনেক দূর অজানায়
প্রত্নশরীর খোঁজে প্রিয় মখমল-মন খোঁজে উষ্ণ আবেশ
তবু নিজের কাছে তুমি কত অচেনা।

চিরু
অপেক্ষারা অন্তহীন

রাতের পর রাত পেরিয়ে
অপেক্ষারা হাত বাড়িয়ে
গুনছে কেবল দিন
আসবে ফিরে
আসছো ফিরে
এই অপেক্ষা অন্তহীন...

ডাইরি খাতার
আবছা আলোয়
উড়ছে পাতা
জমছে ধূলো
শুকনো চাওয়া প্রতিদিন...

তোমার আমার
ঘর কুড়োনো
অশ্র্র নোনা
দিন ফুরোনো
চলছে প্রতিদিন...

পেছন ফিরে
হাত বাড়িয়ে
দ্যাখো আমি
সেই দাঁড়িয়ে
যেমন তোমার যাওয়ার দিন...

অপেক্ষারা হাত বাড়িয়ে
গুনছে কেবল দিন
আসবে ফিরে
আসছো ফিরে
এই অপেক্ষা অন্তহীন...

আশিক আকবর
হাঁসদের যৌন জীবন

হংস কুলও সমকামী। যৌথকামী তো বটেই। আজকে পুকুরে
জলের কিনারে
এক মাদিকে আরেক মাদি ইচ্ছে মতো...
আরো কতিপয় মাদি হংস পাশে তার।
যেনবা না, চলছে গ্রুপ সেকস্।
আর দ্যাখো হংস দলের সামনে, হংস এক। প্রিয় হংসিনী নিআ নির্বিকারে ঠুকরাচ্ছে ঘাস। কে কাকে কি করলো তাতে কি আসে যায়? সময় মতো সেকস্ টেকস্ পেলেই হলো।
এটাই পৃথিবীর চিরকালের নিয়ম। পুকুর ঘাটের পানি ভালো করে জানে।

গৌতম নাথ
জলছবি এই পথ

ফেরার পথ’টাকে এভাবে আগলে রেখে লাভ কি বলো?
সেই কবে থেকে ঝরো ঝরো বৃষ্টি গুলো পর্বত বেয়ে আজ বিস্তীর্ণ অতলান্তিক সমুদ্র হয়ে গেছে।
সাধে কি আর বলি হারাবার পথ’টাও এখন হারিয়ে গেছে।
পুরো তুমি’টাই এখন আড়ম্বর হীন, প্রচ্ছদ হীন ভিতর বারান্দা... আমার দখিন জানালা।
আমার আমি’তে বলো কয় দন্ড আর থাকতে পারি?
প্রতিটা বিরহই আমার ধ্রুপদী অমাবস্যা যাপন... শূণ্যতায় আলোছায়ার আলিঙ্গন।
ঘাটের কাছে সূর্য ডোবার সময় হলেই রুটিনমাফিক আনচান সন্ধ্যা।
তবুও দূরত্ব’টুকু মেখে নিতে হয়... দূরে যাওয়ার
জন্য নয়... পূর্ণ পথের সন্ধানে...
কোজাগরী আলোর বন্ধনে।
সব যাওয়া কি আর যাওয়া হয় বলো?
কিছু কিছু যাওয়ারও তো পিছুটান থেকে যায়...
কিছু কিছু যাওয়া সতত সবুজ জলছবি হয়ে থাকে।

গৌতম চট্টোপাধ্যায় 
এসো, পরাজয় দেখে যাও

যতই বর্ষা ঝরুক এ নোংরা সবুজ জলে
জীবন তো স্রোতে ভাসা শ্যাওলা,
যতই লক্ষ্য সিহ্র করে লক্ষ্য ভেদ করো না কেন
এ জলে ইন্দ্রধনু আঁকা হবে না কোন কালে!
মিথ্যে আশ্বাসের রণপা’য়ে আশ্বস্ত হয়ে
কত আর দৌঁড়াবে প্রগলভ জীবন! কতদূর?
ওই দেখো দিকচক্রবাল...
অপসৃয়মান মরীচিকা- বসন্ত দেখো!
এসো, হা-পিত্যেশ করা ফাঁকা মাঠে এসে দাঁড়াও-
হে মানব, তুমি কী দেখেছো ধীমান’এর পরাজয়
উড়ে যাওয়া কোন প্রজাপতি'র পাখায়!!!

অরিজিৎ রায় 
এ চোখ মানব জমিন 

মাথার ভিতরে এক শহর- উসখুস-ব্যস্ততা,
উদভ্রান্ত দিনলিপি খরস্রোতে বয়ে গেলে
যা কিছু ভাস্মর, ম্রিয়মাণ হয় সময়ের কাছে!
সম্পর্কেরা নিশ্চুপ, প্রদীপের সমঝোতায়
সারারাত জ্বলে যায়, নিভন্ত চুল্লির গনগনে
উত্তাপ বুকে নিয়ে!
এক্কাদোক্কায় দলছুট শৈশব- মোবাইল ভাবনায়
ইচ্ছে ফড়িং আঁকড়ে ঘাস মন জমি আঁকে
সাদা স্ক্রিনে। ভিতর ঘরে একাকীত্বের রং-মশালে
বিবর্ণ হয়ে পুড়তে থাকে মনের খাস-মহল।
দৈন্যতা ভেজা এ যাপন শুধু চোখ খোঁজে-
ভরসার নরম জমি! অনাহূত প্রেমিক অবয়ব
ভিতর উঠোন আমার- ছুঁয়ে যায় গাল মুখ ঠোঁটের
ইতিহাস ইলোরার স্থাপত্য ভেঙে বালিয়াড়ি
ধুয়ে যায়, গিরিখাত চিরে নেমে আসে একটি নদী-
ভালোবেসে যার নাম রেখেছি-“প্লাবন”

বঙ্কিমকুমার বর্মন
রাতগুলি

তাঁকে ফেরানো যায় না কিছুতেই, সে ফুটছে টলমল আশার মতো। দৌঁড় রাখছে চোখের বেদনায় - তাঁরও প্রাসঙ্গিক আগুনের উপমা চাই। সহজ সন্ন্যাস ছেড়ে এই প্রলুব্ধ যাত্রীস্নানে। এখানেই মাটির তাপমাত্রা ছিল অধিক প্রিয়। যেভাবে হলকর্ষণে লুপ্তপ্রায় যন্ত্রণা উঠে এলো তাকে সর্বদাই পোষাকের রঙে শিহরিত দেখি। নিয়মিত কান্নার পাশে একটা জানালার কচি বেদনা ছটফটে মাছ। ঘাড় গুঁজে হৃদয় রাখে দক্ষিণের ঘর। পত্রহীন বিজয়তন্ত্রের পালক ঢুকে পড়ে স্মৃতিস্তম্ভে, অসম্ভব জ্যোৎস্নার দাগ ফুলের নরম মাংসে লাগাম ছাড়া স্নেহের পুতুল। ভীষণ আলো করে আসে আমাদের শুভাশীষ পরিব্রাজিকা রাতগুলি।

ছোট গল্প

স্বৈরাচারের ডিনার টেবিল
আপন রহমান

শরীরটা আজ বেশি ভাল নেই। প্রচন্ড মাথায় যন্ত্রণা, জ্বরও আছে সাথে। ঘরে প্যারাসিটামল ছিলো খেয়ে; খাটের উপর শরীর এলিয়ে দিয়ে। মনে মনে ভাবছিলাম আজ নিশ্চয় ও আসবে। আমি অসুস্থ্য হলে একা থাকলে ও আসে। ও হচ্ছে আমার বন্ধু নীল পরী রিম্বা। ওর বাড়ি পরিস্থানের সেওগুণ রাজ্যে। ও প্রতিবার আমাকে এক একটি অদ্ভুত দেশে নিয়ে যায় বেড়াতে। তবে স্বপ্নের ঘোরে। এবারও হয়তো.....

ভাবতে -ভাবতে চোখটা কখন যে বুজে এলো টেরও পেলাম না। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ঘরটা আলোকিত হয়ে গেল বুঝতে পারলাম, ও এসে গেছে।

হ্যাঁ, ও এসেছে। আমার মাথার কাছে এসে বসলো। তারপর কোমল হাতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মুচকি হেসে বল্ল- শরীরটা কি খুবই খারাপ?
আমি বল্লাম- কৈ, না তো একটু...
- যাবে তবে নতুন দেশে?
আমি বল্লাম- হ্যাঁ।

ও আমার হাতটা ধরলো। মূহুর্তে আমরা পৌঁছে গেলাম সেই আজব দেশে। ও বল্ল এটা “সব খেয়েছির দেশ”। এদেশের সর্বোময় ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে সম্মানের সহিত বলা হয় স্বৈরাচার। এটা এদেশের একটি সম্মানজনক শব্দ। এদেশের ক্ষমতাধরেরা সর্বভ‚ক।

চলো এবার তোমাকে এদের বৈচিত্র্যময় ডাইনিং রুমে নিয়ে যাই।

কিছুটা ভয় কিছুটা সংকোচে আমি রিম্বার হাত ধরে এগিয়ে গেলাম ডাইনিং রুমে। ও বল্লÑ ভয় নেই বন্ধু যাদু বলে আমরা অদৃশ্য। ওরা আমাদেরকে দেখতেই পাবেনা।

রিম্বা একে একে ওদের খাবারগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল আর আমি অবাক হচ্ছিলাম।

সেখানকার অর্থাৎ স্বৈরাচারের ডিনার টেবিলের খাদ্য তালিকায় ছিলো।
- আধ সিদ্ধ গণতন্ত্র
- গরীবের চামড়ায় তৈরি মোঘলাই পরোটা।
- ধর্ষিতা রমনীর দেহ পেষা স্যুপ।
- বিপ্লবী কবির সুগঠিত রানের কাবাব।
- গণতন্ত্রকামী ছাত্রদের দেহের টুকরো টুকরো মাংস-ভ‚ণা আরও কত কি!

এবার গেলাম তাদের পানশালায়।
সেখানে গরীবের রক্তমদে নেশায় বুদ হয়ে আছে। কতিপয় ন-পুংশক মন্ত্রী, ফ্যাসিবাদীর দালাল, সেবা ব্যবসায়ী, ঘোড়েল আমলা, বাম-ডানের কিছু পল্টিবাজ নেতা ইত্যাদি।

আমি দেখছিলাম আর অবাক হয়ে ভাবছিলাম। বাহ্! কুকুর-শেয়াল-আর হায়েনার মাঝে কি অদ্ভুত মিল!

হঠাৎ পাশের বাড়ির নেড়ী কুত্তাটার ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেলো আমার। বাইরে কারা যেন চিৎকার করে বলছিলো; চোর - চোর - চোর...

লুঙ্গির খুট গুঁজতে -গুঁজতে মধ্যরাতের ঘুট ঘুটে অন্ধকারে ছুটে গেলাম বাইরে। দেখলাম হারিকেন আর লাঠি হাতে কিছু লোক ছুটছে চোর ধরতে। তাদের কিছুটা পেছনে অর্ধনগ্ন অবস্থায় খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে ছুটছে জহির পাগলা।
আমি বল্লাম- কি হে বাপু ছুটছো কেনো?
জহির একগাল হেসে বল্লো- আর বলোনা বাপু-চোরে দ্যাশটা খেয়ে নিলো রে...

বাড়ি ফিরে আসতে আসতে আমিও ভাবলাম সত্যিই তো! চোরে দেশটা খেয়েই নিলো...

এরপর আমার মনটা আরও খারাপ হয়ে গেলো যখন মনে পড়ল রাতের সেই অদ্ভুত স্বপ্নের কথা...

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক