Thursday, July 9, 2020

শিল্প সাহিত্য ৮৭


বৃহস্পতিবার ২৫শে আষাঢ় ১৪২৭, ৯ই জুলাই ২০২০




কবিতা
জারিফ এ আলম
উৎসের দিকে ফেরা

অনেক দিনের ঘরে ফেরবার তাড়া নিয়ে
ঘাম আর কামের কাহিনিপাঠ ছেড়ে
মগ্ন হয়ে জেগে থাকে বিনিদ্র দুটি চোখ,
আর সুরেলা ঠোঁটের মোহনীয় আহ্বান।
মৌমাছি প্রলোভিত হয়; প্রতিদিন দরদামে কেনাবেচা হয়,
অযুত নিযুত মানুষের জীবন-স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা।

গীতিকার মহুয়া তাই ডুকরে কেঁদে ওঠে বারবার
কী যে আকুতি খেলে গেছে মনে তার!
ভুলের বিভ্রমে সেও খুঁজেছিলো সুখের সঙ্গম;
সে’বছর ঘরভাঙা ঝড়ের পূর্বাভাসে সের কেঁদেছিল।
নিখোঁজ কতো সংবাদে কতো বছর ভরে গেছে
তবু শোকের পোশাক-আশাক খুলে ফেলে
গায়ে এখন শোভা পায় দুঃখ ভোলানো সঙ্গীত।
নিষিদ্ধগ্রন্থে লেগে থাকে চকচকে চোখের প্রলুদ্ধ চাহনি
একান্তপাঠে মনোযোগী ছাত্রের মতো জেগে থাকে চোখ
লাল টেনিস বল হয়ে ঘুরে বেড়ালো তোমার বক্ষযুগল।
তোমাদের নিবিড় পাঠে জেনেছি মহুয়া-মলুয়া গীতিকায়
সকল আশ্রয় খুঁজে নেয়, হৃদয় নামক দুর্ভেদ্য নগরী!

মনিরা রহমান
বিচ্ছিন্ন কিছু বোধ

যখন কোনো অন্যায়ে মূক হয়ে থাকি
তখন মনে হয় সত্যিকারের
মূক হওয়া ছিল ভাল

যখন অন্যায় কোনো দৃশ্য দেখে
বন্ধ করি চোখ
তখন মনে হয়
অন্ধ হওয়াই ছিলো ভাল

যখন প্রতিবাদে হাত উপরে না তুলে
গুটিয়ে নেই নিজেরই দিকে
তখন হাতহীনতাকেই শ্রেয় মনেহয়

যখন প্রতিবাদী মিছিলে গুটিকতক পা দেখে
অবশ হয়ে যায় পা, শেকড় গাড়ে মাটিতে
তখন মনে হয় গাছ হওয়া ছিলো ভালো

প্রতিনিয়ত ন্যুব্জ হতে হতে
   ন্যুব্জ হতে হতে
    মানুষের অবয়বে হই অন্যকিছু
প্রকৃতির শক্তির রূপান্তরে
কত ক্রিয়া কত বিক্রিয়া
অতঃপর পাথর হও ...

রুদ্র সাহাদাৎ
সংসার মানে মরিচীকা

চলতি পথে যেনো আটকে যাই ফাঁদে
পেছনে তীর ধনুক তলোয়ার আর বন্দুক তাক করা সৈনিক
ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ - সজাগ কান।

মানুষ যে যার মতোন সরে যাচ্ছে, আত্মরক্ষায় ছোটাছুটি
আদিগুহায় থেকেও শান্তি নেই, মাঝেমধ্যেই আপনেই মারে মরণটান
ক্রুশবিদ্ধ জীবন, পেরেকে পেরেকে রক্তাক্ত
অসহায় কিছু চোখ তাকিয়ে তাকিয়ে কাঁদে
নিঃস্তব্ধে আমৃত্যু

বোকা কিছুমুখ স্বার্থ খুঁজে জানে না
সংসার মানে মরিচীকা...

সাঈদুর রহমান লিটন
এখন আর কান্না নয়

কান্নার শক্তি নাই আর
কেঁদেছি অনেক- সকাল বিকেল সন্ধ্যায়
অফিসে, আদালতে, রাস্তায়।

কেঁদে কেঁদে হয়রাণ, বিবেক দেখেনি
চোখ নেই কানা সব, কালা
আমার অস্তিত্ব জুড়ে খোদার তাড়ণা
দেখেও না দেখে হেঁটেছে পথ।

হাঁটতে শিখেছি এখন। আজও অফিসে আদালতে রাস্তায়
হাটে-বাজারে-গঞ্জে হাঁটি ভিন্ন রকম পথে।
আর এখন কাঁদিনা
অনেকে কাঁদে আমার জন্য, ভয়ে, লজ্জায়
ঘৃণায়---

রহিম উদ্দিন
বিনিময়

তুমি ভালোবাসলেই নবরূপে গড়তে পারি-
ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান
মিশরের খুফুর পিরামিড
শিখে নিতে পারি-
হায়ারোগ্লিফিক্স, আর;
আমি ভালোবাসলেই মুখোমুখি দাড়াতে পারি-
র‌্যাডক্লিপ লাইনে ...
পাখির ভঙ্গিমায় বলতে পারি-
দ্যা মোর ইউ লাভ মি; দ্যা মোর আই লাভ ইউ।

অণুগল্প
একটা ঝুরঝুরে আঙুল
অনিন্দ্যকেতন গোস্বামী

আঙুলেই গেঁথে আছে সেইসব দিন। ঝুরঝুরে আঙুল এখন লাঠি হয়ে গেছে। পা এখন গাছ। প্রকৃত স্বাদুফল এখন আর নেই। তবু একবুক মাঠ প্রশস্ত হয়ে আছে বিল-কান্দায়। বিঘে বিঘে খন্দের কথা কণ্ঠ বেয়ে গরুর গাড়ি চড়ে আসে। চোখের মণি বেয়ে উঠে আসে মাছ খেপলার ঘের বেয়ে। চৌধুরী মিঞা আর আসে না জ্যাঠাদের বাঁশতলায় নলি-সুতো হাতে। চকচকে নাইলনের সুতো দেখিয়ে বলত এগুলো জাপানী-কট। আমরা জাল বোনার পাশেই খেলতাম একবিদ্যা চীনা কাঁচের গুলি। চৌধুরী চেয়ে থাকত জাল বোনা ফেলে। তার চোখ হয়ে গুলি, আর আমাদের ছিটানো গুলি হয়ে যেত জাল...

বিকেলের আকাশ হয়ে যেত নবার কামারশালা। লাল লোহা দেগে পিটিয়ে চ্যাপ্টা করে দিত মেঘের মিনার।

গরু নিয়ে ফিরে যেত সুরজের ভাই। বজ্রের মতন পাচন ছুঁয়ে যেত লেজ।

এখন স্মৃতিরা শুধু মনের মধ্যে ট্রাংক গড়ে তোলে। দস্তাবেজ বেঁধে রাখি পিঠমোড়া।

তবুও হাটখোলা ঝুরি নামায়। প্রোথিত করে মহাকাল... সেখানে মদের মহড়া দিতে উঠে পড়ে জটা। হাতের তালুতে চুমু দিয়ে অদ্ভুত বাঁশি বাজায়। ডান হাতে হেঁসো ঘুরিয়ে উঠে যায় তালগাছে তাড়ির বাজারে। চিল্লিয়ে যেন হাট মেলে দিত ডগায় ডগায়। অশ্লীল ভাষা দিয়ে ঘোষণা করে যেত- বিকেলে বিক্রি হবে তাড়ি, ভবের বাজারে। চৌধুরী নুরানিতে হাত রেখে বলত-তওবা তওবা!

তবুও কি পথে পড়ত না ধুলো ? তবুও কি এঁদো সরণী বেয়ে নেমে আসতো না তেলচোঁয়া ফুলকো চাঁদ সন্ধানী গ্রাম্য বালকের মত? তবুও কি শুক্লপক্ষে পনেরোদিন উজ্জ্বল কাস্তে ঝুলে থাকতো না আকাশের ফসলী মাঁচায়?

মদনা থেকে গরীব সনাতন মন্ডল কাপড়ের সাদা আকশির ঝোলায় পেড়ে নিত নালশের ডিম।  কোলকাতার ঝিলে অফুরন্ত বাবুরা মাছ ধরবেন মদ মাখিয়ে।

সব স্মৃতিই কি ভাঁপা বাক্স হয়ে যায় ? বাক্স-পেটরা? 

কোনও একদিন মধ্য-জ্যোৎস্না তরল হয়ে এলে চৌধুরী মিঞা ঘোলা কাঁচের চসমা পরে চুপিচুপি মাকে এসে বলত- ভাবিসাব চা করেন। কাল আপনার পুকুওে খেপলা ফেলবো...

আমরা বারান্দায় ঝুঁকেঝুঁকে পড়তাম পিদ্দুমের আলো... পড়তাম গঙ্গাফড়িংয়ের ঠ্যাং ছিঁড়ে কতবার চাপ দিয়ে ওঠানো নামানো করা যায়... পড়তাম কয় ফাঁসের খেপলা জাল শুরু করে শেষে কয় ‘মালি’ নামাতে হবে নীচে? পড়তে পড়তে একদিন পৃষ্ঠা থেকে সব কালো অক্ষর উবে গেল। হাতে রইলো সাদা বই।

এইসব কথা আঙুলে লেখা আছে...
আঙুল এখন ঝুরঝুরে...
আঙুল এখন লাঠি...

ঘড়ি
সোমনাথ বেনিয়া

বিয়ের পর সাজন্তর এই প্রথম পুজো। দোকানে কেনাকাটি করতে গেছে। তার বউ সোনালির একটি শাড়ি পছন্দ হয়েছে। কিন্তু দাম! এই দামে শাড়িটি কেনা সাজন্তর আর্থিক সামর্থ্যরে বাইরে। কিন্তু সদ্য বিয়ে করা বউ চেয়েছে। সাজন্তর হাবভাব দেখে সোনালিও কিছু বুঝতে পারে। তাই সে বলে - জানোতো শাড়িটির সব ভালো, কিন্তু রঙটা যেন কেমন একটু ম্যাড়মেড়ে। জরির কাজগুলি কেমন আলগা। ভালো হবে না বুঝলে!
সাজন্তও সবটা বোঝে! কিন্তু তার মন মেনে নিতে পারে না। বিয়ের পর এই প্রথম পুজো। সব কিছুর মধ্যে একটা নতুন গন্ধ আছে। তার কাছে সোনালির এই চাওয়াটিও প্রথম। অথচ সে ব্যর্থ! সে কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারছিল না। ঠিক করলো মোবাইল আসার পর যেহেতু ঘড়ির আর তেমন কোনো কদর নেই তাই সে তার আশীর্বাদের ঘড়িটি বিক্রি করে দেবে বলে মনস্থ করলো। ব্রান্ডেড প্রোডাক্ট। দাম পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। তার চেনা একটি ঘড়ির দোকানে গিয়ে সে ঘড়িটিকে বিক্রি করলো। আশানুরূপ দাম পেল। সেই দামের সঙ্গে তার আগে ধরা শাড়ির বাজেটের টাকা নিয়ে, দোকান থেকে সোনালির সেই পছন্দ করা শাড়িটি কিনে এনে, তাকে সারপ্রাইজ দিল। সোনালি খুব খুশি।

পুজো এলো। অষ্টমীর রাতে দু-জনে বেরোবে। সোনালি তৈরি। সে আগেই ঠিক করে রেখেছিল যে অষ্টমীর দিন সাজন্ত আশীর্বাদের ঘড়িটি পড়ে তার সঙ্গে বেরোবে। ঘড়িটি পড়লে সাজন্তকে বেশ দেখায়। আশীর্বাদের ঘড়ি বলে তার আবার একটি বাড়তি গুরুত্ব আছে। আলমারি খুলে ঘড়িটি দেখতে না পেয়ে সোনালি, সাজন্তকে জিজ্ঞাসা করে - কী গো, তোমার ঘড়ি কোথায়?
কোন ঘড়ি!
কোন ঘড়ি আবার! আশীর্বাদের ঘড়ি!

সাজন্ত দেখল এই সুযোগ। সে বলে - দেখ, কোথায় রেখেছো। জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখার মেয়ে কী তুমি। কার তলায় কাকে চাপা দিয়ে রেখেছ। এখন খুঁজে পাচ্ছ না।

ইচ্ছে কোরে সাজন্ত সোনালির উপর এই দোষ চাপিয়ে দিল, যাতে সোনালি এটাকে নিয়ে আর বেশি দূর না এগোয়। তাহলে ধরা পড়ে যাওয়ার চান্স আছে।

সোনালি ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে আছে। সাজন্ত কিন্তু খুব খুশি। সে পেরেছে! চোখ মুছিয়ে দেওয়ার ছলনায় সে সোনালিকে জড়িয়ে ধরে বুঝতে পারে, ঘড়িটি কিন্তু তার হৃদয়ে টিক্ টিক্ কোরে অনবরত ঘুরেই চলেছে ...

No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক