Monday, July 27, 2020

শিল্প সাহিত্য ১০৫

সোমবার ১২ই শ্রাবণ ১৪২৭, ২৭ই জুলাই ২০২০



কবিতা
আনোয়ার হোসেন বাদল
ক্ষয়ে যাওয়া চোখ

বিমূঢ়তা কাটিয়ে যখন দিঘির জলের দিকে তাকাই
দেখি তার কাজল চোখের টলটলে জলে
গ্রীক দেবী সাইকি’র প্রেম খেলা করে
আমার তখন ক্ষয়ে যাওয়া চোখ
আমার তখন ডুকরে ওঠা বিকেল
কেন যে সেইসব দিন-রাত্রি পালক ঝরা ডানার সাথে জড়িয়ে ছিলো!
আমিতো এরোস নই
ওহে সাইকি, আমিতো চাইনি হতে প্রেমের দেবতা
প্রকৃতির খেয়ালী এক সৃষ্টি আমি
কোনদিন শিখিনি এতটুকু ছল
যে চোখে পাথর ছিলো, ভালোবাসা ছিলোনা সেখানে 
যে চোখে প্রেম ছিলো সেতো এক বিবর নয়ন
ছিলোনা জলের নদী অথবা আকাশ
তাকে আমি রেখেছিলাম খুব গোপনে একাকী তার সাথে কে করেছে দেখা!
বিমূঢ়তা কাটাতে চলে গেছে রৌদ্রের কাল
চলে গছে শীতল বৃক্ষ আর বনানীর সুনিবির ছায়া
এখন আমার পাশে কাঁদে কোনজন
মাটিতে পড়েনা কেন তাহার ছায়া!
সেকী তবে মৃত কেউ?
শতাব্দীর প্রেতাত্মা, অথবা কায়া?
ছায়া-কায়া দুই-ই ছিলো চির অচেনা
ভালোবাসা-প্রেম সব সুদূর অতীত
তবু কেন সে এসে দেখা দিয়ে যায়!
আমিতো কিউপিড নই; প্রেমের দেবতা!
সাইকি’র প্রেমে পড়ে ছুঁড়ে দেবো
মধুময় তীড়!
আমার জীবন কই? সেতো এক বেদনা গভীর!

তন্ময় পালধী
যে বৃত্তে ভাসতে ভাসতে

আসক্তির মাত্রা ভরপুর হলে
তাকে যে যতই মোহ বলে ভাবুক
আমি বলি প্রেম।
যে বৃত্তে ভাসতে ভাসতে উত্তোরণ ঘটে
বিবর্ণ পৃথিবী থেকে
রঙিন অমানুষতা থেকে
এক সোনালি সকাল।

আসক্তি যদি নাই থাকে
মায়া প্রেম ভালবাসায় সন্দেহই জাগে।

সোয়েব মাহমুদ
মন্ত্রীসভা এবং বাজে কবিতা

একদিন ছেনাল বেশ্যার উরুতেও জায়গা হবে না নগরপিতার।
একদিন শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকবে দশ-দশটা শুয়োর,
ওরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে করুণা করে ঘুমাতে বলবে।  
একদিন শহরের আনাচে কানাচে 
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মশাগুলো-
কালো কোটের দালালকে চ্যাঙদোলা মশারী টানিয়ে 
ফুটো করে ঘোরাবে নগরময়- শেখাবে 
উত্তর- দক্ষিণ উত্তর- দক্ষিণ।
একদিন সব কিছু-
সব কিছু ছাপিয়ে সব শেয়ারবাজারের 
কারসাজিকারীদের স্থান হবে হাইকোর্ট মাজারে,
ওদের সাথে তখন শুধুই কথা বলবে কাগজের মুখ -টাকা।
একদিন ওয়াসার প্রধানের মেয়ের বিয়ে হবে-  
বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ ঠিক মতন পাওয়া যায়নি 
বিধায় কবুল বলবার ৫ মিনিট পর নিকাহবিচ্ছেদ ঘটে যাবে।
একদিন দুর্নীতি দমন কমিশনার দেখবেন তার জিপারে
সরল বিশ্বাসে ঝরে গেছে তার দন্ড, 
উইপোকা কিলবিল করছে  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পা’দুকায়।
একদিন বন্যার পানি নেমে গেলে- 
একদিন বাংলাদেশ ব্যাংক শুন্য হয়ে গেলে 
তামিম ইকবাল আর দরবেশবাবা জানবেন আবেগে 
আমরা হিসেব কষতে ভুলে যাই- 
একটা সময় এলে ভাবি 
আমাকে কোথাও জবাবদিহিতার কিছু নাই।
একদিন এইসব বাজে কবিতা লিখতে লিখতে - 
প্রধানমন্ত্রীর হাসিতে হাসি মিলিয়ে 
হাসতে হাসতে আমিও 
বসে যাবো হয়ে একাডেমি প্রধান - 
অথবা বিকলাঙ্গ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র- 
নিয়োগ দিতে থাকবো অথর্ব গো-বেষক, অনুবাদক।
সোনার বাংলায় ঝলমল ঝলমল করবে 
ষাট বছর আগেকার ক্লাসিক অথচ 
বাংলা যাবে না কোথাও,
বাংলা থাকবে না কোথাও!
একদিন সারা পৃথিবীর মানুষ - 
আস্তিক হয়ে উঠবেন- 
ঈশ্বরভীতি সৃষ্টি হবে- 
কারণ তারা জানবেন-  
ঈশ্বর আছেন - 
ভালোভাবেই বিরাজ করেন- 
তা নাহলে 
বারোভাতারী বাংলাদেশ টিকে থাকে কি করে?

তন্ময় বিশ্বাস
অস্থায়ী

স্থায়ী বলে কিছু হয়না।
জোৎস্না নিভে এলে, ঘেড়ার খুড়ের মত-
অন্ধকার নামে বুকে! প্রেতপুরীর নারকীয় বেদনা-
বেদানার মত ঝরে গহ্বরে!
হাসতে হাসতে কয়েকটি রঙিন মাছ সঙ্গম ছেড়েঁ
নদীতীর খুঁজে নেয়! আর বলে যায়-
যা দেখি তা ক্ষণিকের!

সেদিনের কথা মনে পড়ল, ম্যাকলাস্কিগঞ্জে-
প্রেমিকার আঙুল-গন্ধ-স্বপ্ন বরাবর যেই হাঁটছি
অদ্ভুত এক পাথর পায়ে  টোকা মেরে হাসতে হাসতে বলল-
“আমি এগারো বছর পর ধূমপান ছেড়েছি”
ভাবলাম এতে আনন্দ বা বিষাদ কেন?
জীবনে যা করি তা ক্ষণিকের, আকাশে উড়ে যায় পাখী!

বক্রেশ্বর এই সকল তত্ত¡কথার অদ্ভুত ব্যাখ্যা দেয়-
জলের ধারা গাছ বরাবর হাঁটতে হাঁটতে মাটিতে মেশে,
আবার বৃষ্টি হয়ে ঝরে টিনে-ছাদে-পুকুরে-নদীতে-সমুদ্রে-মরুতে!
জটিল সব তত্ত¡! সোজা কথায় বুঝি-
প্রেমিকা ছেড়ে গেলে আবার প্রেম হয়, নদী হয়, নদীর গর্ভে বীর্য ভাসে!
অস্থিরতা পেয়ে বসে এসবে! মাথার ঘিলুর মধ্যে চেপে বসে বেদনা,
আসলে কিছুই স্থায়ী না!
মাঝেমাঝে রক্তের দোষেও ভেঙে যায় ভালোবাসা।

আর তখনি কার্লমার্কস'কে খুব মনে পড়ে।

আপন রহমান
উত্তাপ

পাথরকে আঁকড়ে ধরে
জীবনের দুঃখ ভুলতে চেয়েছিলাম
পাথরও মোমের মত গলতে শুরু করল।

অতঃপর সূর্যের কাছে গেলাম
দুঃখের উত্তাপগুলো রাখার জন্য,
সে জানাল নিজের উত্তাপে সে নিজেই জর্জরিত।

পরিশেষে কি আর করা
নিজের উত্তাপে-
নিজেই ভষ্ম হতে থাকলাম।

ক্রমশ ; সে উত্তাপকে আরও বেশি
আলগা করে দিতে থাকল
বেদনার বিষন্ন বাতাস।

ধারাবাহিক গল্প
পচন
স্বপঞ্জয় চৌধুরী

দুই
বাঁদিকের রাস্তা পেরিয়ে সামনে এগুলেই আরেকটি রাস্তা। রাত আটটা বাজলেই রাস্তাটি খানিকটা ভুতুড়ে হয়ে যায়। মাঝে মধ্যে দু’একটা প্রাইভেট কার এসে হর্ন বাজিয়ে কোনো বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে, নতুবা রাস্তা মাড়িয়ে অন্য কোনো রাস্তায় চলে যায়। অভিজাত বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে বাগানবিলাস। সমগ্র রাস্তাটিতে হাঁটলে ফুলমন বিবির স্বর্গসুখ অনুভ‚ত হয়। ঠিক তার বিপরীত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় রাস্তার মোড়ে ডাস্টবিনটার কাছে গেলে। পেটের নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে আসতে চায়। প্রতিদিনের মতো আজও নাকে কাপড়ের আঁচল টিপে ডাস্টবিনের সীমানা পেরুচ্ছে ফুলমন। হাত দশেক দূরে যেতেই ফুলমন বিবির কানে খানিকটা চেনা সুর ভেসে আসে। ফুলমন সুরের তোয়াক্কা না করে আরও দু কদম পা ফেলে। আবারও সেই সুর ফুলমন বিবির কান ও মস্তিষ্ককে আন্দোলিত করে। 
এবার পূর্বাপেক্ষা আরোও সচেতনভাবে ফুলমন বিবি সুরটিকে শ্রবণ করে। কান খাড়া করে শুনতে থাকে সুরটি বেড়ালের গর্জন নাকি কোনো নবজাতক শিশুর কান্না। ফুলমন বিবি আরো ভালোভাবে সুরটি শোনে আর বিড়বিড় করে বলেন “হ ঠিকইতো কুট্টু পোলাপানের কান্দনের আওয়াজ”। ফুলমন বিবি নিশ্চিত হয় সুরটি পিছন দিক থেকে আসছে। সে পশ্চাতে ফিরে আস্তে আস্তে এগুতে থাকে এবং ডাস্টবিনের কাছে আসতেই আওয়াজটি আরও ঘনিভ‚ত হয়। ফুলমন বিবির আর বুঝতে বাকি থাকে না “হায় আল্লা এই কাম কেডায় করলো, এই রহম এট্টা জ্যান্ত বাচ্চারে ময়লার মধ্যে ফালাইয়া গেলো” খানিকটা আতংকিত হয়ে বলে ফুলমন। বাচ্চাটার দিকে ফুলমনের দৃষ্টি আরোও প্রবলভাবে যায়। নবজাতকটি ছেলে শিশু এবং খুব বেশিক্ষণ হয়নি কেউ ফেলে গেছে। পনের বিশ মিনিট হবে এরকম অনুমান করে ফুলমন। যাউগগা তাতে আমার কী! বড়লোকের কুকামের ফসল ফালাইয়া থুইয়া গেছে। এই বলে হাঁটা ধরে ফুলমন। আবারও সেই কান্নার সুর ফুলমনকে অস্থির করে তোলে। ফুলমনের দ্বিতীয় সত্তা তাকে প্রশ্ন করে- কি পালাইয়া যাইতাছোস? এই বাচ্চাডাতো তরও হইতে পারতো। সে আবারও পিছন ফেরে এবং ভাবে বাচ্চাটাকে কি সে সাথে নেবে নাকি বস্তির লোকেদের ডেকে নিয়ে আসবে। বস্তির লোকেদের ডাকতে গেলে কেউ যদি বাচ্চাটাকে নিয়ে যায়।
“যাউগগা তাতে আমার কী?” ফুলমন বিবি আবারও সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে বাঁদিকের রাস্তায় চলে যায়। ফুলমনকে পাশ কাটিয়ে একটি কুকুর চলে যায় সেই ডাস্টবিনের দিকে। ফুলমন দুতিন কদম হাঁটে। হঠাৎ সে আঁতকে উঠে বলে-  “কুত্তাডা যদি বাচ্চাডারে মাইরা ফালায়। ফুলমন পিছন ফিরে দেখে কুকুরটা ডাস্টবিনের দিকেই এগুচ্ছে। লেমন বিবি এবার দৌড়াবার মতো করে হাঁটতে থাকে। কুকুরটা ডাস্টবিনের ময়লার কাছে যায়। বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে কুকুরটা জিহŸা বের করছে। ফুলমন বিবি হাতে একটা ইটের কণা নিয়ে হুংকার করতে করতে আসে ঐকুত্তা যা ভাগ এহেনতোন। কুকুরটি ফুলমন বিবিকে দৌড়ে আসতে দেখে ঘেউঘেউ করতে থাকে এবং গররর আওয়াজ করতে থাকে। ফুলমন বিবিও কম যায় না সেও কুড়ি বছরের তরুণীর মতো শক্তি নিয়ে বলে ওঠে যদি বাচ্চাডার গায়ে আঁচড় পড়ে খাইয়া ফালামু তোরে। হাতে নেয়া ইটের কণাটি সে কুকুরের দিকে ছুড়ে মারে। কুকুরটি এবার লেজ গুটিয়ে কেউ কেউ আওয়াজ করে পালিয়ে যায়। ফুলমন বিবি এবার দিশেহারা মায়ের মতো বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিয়ে চুমু খায়। বাচ্চাটির চোখে যেন চাঁদের আলোচ্ছটা পড়ে। ফুলমন বিবি বত্রিশ বছর আগে ফিরে যায়। যখন সে প্রথম মা হয়েছিল উনিশ বছর বয়সে। (চলবে...)

No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক