মঙ্গলবার
৬ই শ্রাবণ ১৪২৭, ২১ই জুলাই ২০২০
কবিতা
হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়
উপহার
প্রতিটি গাছের পাতায় প্রেমের আগুন ছড়িয়ে গেছে, ঝড়ের পর চাঁদ উঠল
ঝড়ের সঙ্গে সে কি বৃষ্টি!
উপক‚লে আসমুদ্রহিমাচলে
সবাই বলল বসন্ত জাগ্রত দ্বারে
ঘোড়ার খুরে নিষ্পেষিত হল মাটি
নদী উপকূল থেকে উপক‚লে ফোন বেজে উঠল
পথ ভুল করে হাওয়া এল হরির লুটের বাতাসা
নিয়ে তার দুটো হাত একটা পরম, আরেকটা চরম, পরম বলল
তোমাকে দেখলে সমস্ত শব্দের মাত্রা, ছন্দ হারিয়ে যায় চরম বলল পরমকে
মৃদু, নরম অথচ অসম্ভব কঠিন
অনুশাসন আমি জীবনে মানিনি
বৃষ্টি ধারার ভিতর দিয়ে বেরিয়ে এল তাদের এক একজনের সত্যি
এখন ভোর হয়ে এল, চোখে মুখে জল দিচ্ছে
শিশির ধানশীষ বেলপাতা
ঝড়ের পর চাঁদ ওঠার মতো সোদা গন্ধময় ঘাস ছড়িয়ে রইল চরাচরে, উপকূলে আসমুদ্রহিমাচলে এ জন্মের শেষ উপহার...
সৌম্যজিৎ আচার্য
তোমাকে বলা হয়নি
তোমাকে বলা হয়নি, শেষ ট্রেনটা পেয়ে গেছি। ট্রেন একটা অচেনা প্ল্যাটফর্মে এসে থেমেছে। এ প্ল্যাটফর্মে নদী আছে। তাই নেমে যাচ্ছি। নদীতে পা ডুবিয়ে গোটা শীতকাল এবার এখানেই কাটাব আর আমার পা শ্যাওলা হয়ে ভেসে যাবে মোহনায়...
তোমাকে বলা হয়নি, চিড়িয়াখানা আর জেলখানার পাঁচিল দুটোই সমান উঁচু। আমি তাই ওদের নেমপ্লেট বদলে দিয়েছি। দুটোর পাহাড়াদারই আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। ওদের বোলো না, আজ রাতে আমি অ্যাসাইলামের দেয়ালে হিসি করতে যাচ্ছি। ও দেয়ালেও বৃষ্টি হয়নি বহুদিন...
তোমাকে বলা হয়নি, শব্দরা চায়নি, তবু লেখা ছেড়ে চলে যাচ্ছি দূরে। কবিতা আমায় ফ্যাকাসে করে দিয়েছে। আমার প্রতিটা কবিতাই ও-পজিটিভ। আমি এত রক্তাক্ত লেখা লিখতে চাইনি কোনোদিন... কাউকে বোলো না, আজকাল সারা গায়ে জ্যোৎস্না গাছ বেড়ে উঠছে... আলো ভরে উঠেছে... আমার আর চাঁদ ভাল লাগছে না। আমি জলের নীচে সাঁতার কেটে চলে যাচ্ছি মোহনায়...
সাঈদুর রহমান লিটন
অচেনা গন্তব্য
শাহেদরা আসে যায় নিয়মিত
আদরে আহ্লাদে
ছবি তোলে
ফোকাস দেয়
ক্ষমতা আর দাপটে
নির্যাতিত হই-
যারা মিলাতে পারিনা জীবনের হিসাব,
এক শখ মিটাতে গিয়ে অন্য কষ নিভৃতে কাঁদে।
শাহেদরা বুক উঁচিয়ে চলে
অন্য কারো বুকের পর-
দামি পারফিউমের ঘ্রাণে ঠিকই আকৃষ্ট হয়
উপরিওয়ালা
পারফিউমের দাম তোলে অন্য কারো বুক চষে।
শাহেদরা বুদ্ধিজীবী-
বুদ্ধি রপ্তানি করে
কেনাবেচা করে
যা দেখায়- দেখি, যা শোনায়- শুনি
সর্বস্ব খুইয়ে বোকা বনে যাই,
তবু শাহেদরাই শাসন করে,
পরামর্শ দেয়।
তবু অচেনা গন্তব্যে হেঁটে যাই নিরন্তর...
অনিন্দ্য বড়ুয়া
হরণ
ছেঁকে যাচ্ছি সমুদ্রের অনিশেষ ঢেউ
মৈনাকে জড়িয়ে আছে বাসুকির বিষমাখা দেহ,
বিষমবাহুর নিচে শঙ্খিনী অস্থির হলে
ভদ্রচোখও বারবার চরিত্র হারায়
না- বোঝার ভান করা শিখেছো তো বেশ
ব্যস্ত হয়ে আছো তাই ফুটে যাওয়া মুগ-মন্থনে
এই ফাঁকে
পোড়-খাওয়া রসুনেরা বিদ্রোহে ফেটে পড়ে
টগবগে বলকের মুখে-
নিঃশেষ হওয়ার আগে হয়তো বা
নিস্তারের দুর্লভ অধিকারই চায়
রন্ধনের কলা জান- ঘ্রাণে তা জেনেছি
না-বলার শিল্প বালা শিখেছো কোথায়?
মিলন ইমদাদুল
কবি
একজন কবি যে পথে হেঁটে চলেন একান্তে-
গভীর চিন্তায় ভারাক্রান্ত হৃদয়ে,
অসুরেরা সে পথে থুথু ছিটায় বারংবার!
তবুও কবির মনে এতোটুকু লাগে না দাগ
থাকে না কোনো ঘৃণা -কিংবা অভিশাপ!
কবি নিঃসন্দেহে হেঁটে চলেন প্রতিবার,
কেননা কবিই একজন মানুষ- যিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন,
আঘাতের প্রতিঘাত অস্ত্র দিয়ে নয়
ফুল দিয়েই দিতে হয়...
গৌতম চট্টোপাধ্যায়
মুমূর্ষু আঙুল
পোকার মত কিলবিল করে উঠে আসছে
হাজার হাজার আঙুল...
নালা- নর্দমা'র ভেতর থেকে,
ঘিঞ্জি গলি বেয়ে
ধ্বসে যাওয়া ম্যাকাডেমাইজড্ রাস্তায়, কালচে...
সরীসৃপের মতো হেঁটে বেড়াচ্ছে...
একটি আঙুল আরও কত আঙুলকে
আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে...
কৃষ্ণ গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসা এ আঙুলের
কোনও নখ নেই, কোণায় রক্ত জমাট,
চুষে চুষে খেয়েছে জোঁক, বিবর্ণ, পরিত্যক্ত...
এ আঙুল জিভ ছুঁতে পারে, টানতে শেখেনি
এর খিদে লাগে না, আগুন জ্বলে না,
ঘাম ঝরে ঝরে আগুন স্তিমিত!
এ আঙুল তবলীগি ভাইরাস নয়
এ আঙুল পাথর ছুঁড়তে শেখেনি
এ আঙুল একলব্য’দের...
বয়ে বেড়ায় পঞ্চবর্ষীয় যোজনার কালি!
অর্জুন, কর্ণ এর মতো নেই এদের বীরত্ব
এরা চিরকাল বিস্মৃত, উপেক্ষিত,
ছোট; সামান্য দৃশ্য!
আত্ম- রক্ষা আর নির্ভরতার ধনুষ্টংকার
শুনতে না চাওয়া কত শত দ্রোণাচার্য
এদের কাছে দক্ষিণা নেয় রোজ!
আর ছড়ানো ছিটানো রাস্তায়
মুমূর্ষু এ আঙুলের প্রতিক্ষণ চলে
শ্রাদ্ধ নিমিত্ত ভোজ!!!
ছোটগল্প
এ কেমন আতঙ্ক
রানা জামান
কথাটা মনে হলেই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় নওরিনের। কাঁপতে থাকে শরীর-মাঝে মাঝে শ্বাস-প্রশ্বাসও যায় বেড়ে। ব্যাপারটা নিয়ে কারো সাথে আলোচনাও করতে পারছে না-সবাই সদ্য জ্বালানো বাতিতে দিচ্ছে অক্সিজেন। পাশে শুয়ে আবীর নাক ডাকে আর ও দীর্ঘশ্বাসগুলো হজম করে। অবশ্য সে সারারাত জাগে না-ঘুমের ঔষধ খাওয়ায় এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। এই বিষয়টা আবীরকে জানায় নি।
সকালে ঘুম থেকে জেগে আতঙ্কিত হয়ে উঠে। যত দিন যাচ্ছে ততই আতঙ্ক বাড়ছে ওর।
একদিন দ্বিধা ঝেরে মাকে ফোন করলো নওরিন। মাকে কিছু বলার আগেই মা ওকে শরীরের যত্ন নেবার পরামর্শ দিতে লাগলেন। নওরিন মার প্রতি বিরক্ত হয়ে কলটা দিলো কেটে। মা সাথে সাথে কল দিলো মোবাইল ফোনে। নওরিন আর ফোন ধরলো না। বাসায় কাজের মেয়েটা ছাড়া আর কেউ না থাকায় মা আর কাউকে ফোন করতে পারলো না।
কিন্তু একটু পর ফোন এলো আবীরের। আবীরের ফোন না ধরার মতো কোন কারণ ঘটে নি তখনো। কলটা গ্রহণ করতেই আবীর মায়ের কথা বললো। ও ফোন গ্রহণ করছে না কেনো? কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি? ইত্যাদি। মা খুবই উদ্বিগ্ন। আবীর নওরিনকে বললো মার সাথে ফোনে কথা বলতে।
নওরিন অনিচ্ছাসত্তে¡ও ফোন করলো মাকে। ও ফোনে বললো, এভাবে বারবার ফোন করার চাইতে তুমি আমার এখানে চলে আসো আম্মু। আমার একা একা ভালো লাগছে না।
মা বললেন, বললেই কী আর আসতে পারি রে মা! এখানে আমারও সংসার আছে। আমি আগামী সপ্তাহে আসতে চেষ্টা করবো। মন খারাপ করিস না। এ সময় শরীরের যত্ন নিতে হয়।
মার কথাগুলো পছন্দ হলো না নওরিনের। সে মোবাইল ফোনের লাইন কেটে দিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে হেঁটে চলে এলো ড্রয়িংরুমে। ফুল্লরা টিভিতে কার্টুন দেখছিলো। নওরিন ওর হাত থেকে রিমোট কন্ট্রোলটা নিয়ে চ্যানেল পরিবর্তন করতে করতে সোফায় বসলো। ডিসকভারি চ্যানেলে গর্ভবতী নারীদের পরিচর্যা বিষয়ক অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে। শেষে দেখালো অস্ত্রোপচার সন্তান প্রসব। তখন ওর রাইমা ভাবীর চেহারাটা ভেসে উঠলো-পরপর দুবার অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসব হওয়ায় পেটে চর্বি জমে হয়ে গেছে ইয়া ধুমসি। কী বিচ্ছিরি দেখতে হয়েছে এখন।
টিভির রিমোট কন্ট্রোলটা রাইমার হাতে দিয়ে নওরিন চলে গেলো নিজ কক্ষে। একটু পর বাসায় তালা আটকে বেরিয়ে এলো বাইরে।
ওদিকে আবীরের মোবাইল ফোন বিষয়টি মনে করিয়ে দেয়ায় চমকে উঠলো আবীর। সে কল দিলো রাইমাকে। রাইমার ফোন বন্ধ। বন্ধ কেনো? কোন খারাপ কিছু? সে ফের শ্বাশুড়িকে ফোন করলো। শ্বাশুড়িও কিছুক্ষণ পর বললেন যে রাইমাকে ফোনে পাচ্ছেন না-আবীরের এখনই বাসায় যাওয়া দরকার।
আবীর বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়। বাসায় এসে দেখে তালা। ওর কাছে চাবি নেই। রাইমা কোথায় গেছে কখন আসবে, ফুল্লরা কিছুই বলতে পারলো না। নিরুপায় আবীর এপার্টমেন্টের নিচে দোকানের সামনে বসলো। অস্বস্তিকর অপেক্ষা।
পৌণে তিন ঘন্টা পর রাইমা একটা উবারের কার থেকে নামলো। বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওকে। আবীর এগিয়ে গেলে রাইমা ম্লান হাসলো। দু’জনে উঠে এলো উপরে।
শয্যাকক্ষে ঢুকে আবীর উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো, কোথায় গিয়েছিলে তুমি? তোমাকে এমন ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেনো? আজ তোমার চেকাপের ডেট। অফিস থেকে তোমার ফোন বন্ধ পেয়ে চলে এসেছি। তোমার ফোন বন্ধ কেনো?
রাইমা পাণ্ডুর হেসে বললো, একসঙ্গে এতোগুলো প্রশ্ন করলে জবাব দেবো কিভাবে?
সরি রাইমা! আমি খুব টেনশনে ছিলাম।
আর আমি ছিলাম আতঙ্কে। সেই আতঙ্কই শেষ করতে গিয়েছিলাম।
বুঝলাম না।
প্রেগনেন্ট হবার পর আতঙ্ক আমাকে ঘিরে ধরলো। পেটের ভেতর একটা শিশু আস্তে আস্তে বড় হতে থাকবে। এই পেট নিয়ে কিভাবে আমি চলাফেরা করবো? সিজার করার যন্ত্রণা কেমন হবে? আমি কি তা সইতে পারবো? যদি সিজার করার সময় মারা যাই? এতসব আতঙ্কে রাতে ঘুমাতে পারছিলাম না। তাই এমআর করিয়ে এসেছি। না বাবা! আমি আর কনসিভ করবো না!
No comments:
Post a Comment