Thursday, July 23, 2020

শিল্প সাহিত্য ১০১


বৃহস্পতিবার ৮ই শ্রাবণ ১৪২৭, ২৩ই জুলাই ২০২০




কবিতা
সমতোষ রায়
রুচিবৈচিত্র্য

যেমনই হোক জবা/ জুঁই বা ধুতুরা
সবারই আছে শখ-সাধ-আহলাদ
রং নেয় রং পরে...
তারপর---
কেউ কেউ পরি আর কেউ বা পেতনি...

আবার যে পরি সেও কিন্তু সবার নিকটে পরি নয়
তদ্রুপ পেতনিও...

রুচিবৈচিত্র্য আছে বলেই-না এ-জগত এত রূপসী...

সায়ন তরফদার
পূর্বাভাস

বিরহতে আজ জমেছে মেঘ
হারিয়ে গেছে ঘর-বাড়ি
হাওয়ার কেবল বাড়ছে বেগ
মন ভেঙেছে সারি-সারি।

ঝড় আসছে শহর জুড়ে
কেন যে তুই চলে যাস!
জানান দিচ্ছে চেনা সুরে
শুধু তারই পূর্বাভাস।

তোর ঠোঁটে ঠাঁই পায়নি
তাই, আমার ঠোঁট আগন্তুক
মেঘের গুড়ুম শোনা যায়নি
জানি, এটা বিচ্ছেদেরই অসুখ

এ শহরে আসবে না আর তোর মতন বসন্ত
আবহাওয়ায় বেড়ে চলেছে গ্রীষ্মের অসন্তোষ।

হরেকৃষ্ণ দে 
বন্দুক সরিয়ে হাতে তোলে আন্তরিক হৃদয়

একটি ঝিল সকাল আনন্দের গেটকিপার থেকে
বন্দুক সরিয়ে গোলাপ গুঁজে দিল,
গোলাপ হাসির মত পাপড়ি খুলে রং ছড়ালো,
বাগিচা পোশাক পাতার ক্লিপে রোদ আটকায়

লাল পিঁপড়ের বাসা বাঁধা মন জন্মদিন ছড়ায় বাতাসের নির্মল অক্সিজেন,

প্রিয় জন্মদিন
বিবেক মোমবাতি ঘেরা টেবিল
হাতে তোলে আন্তরিক হৃদয় কেকের অনবদ্য স্পর্শ।

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
হাতে হাত

গাছ নিয়ে যারা ভেবেছিল তাদের অনেকেরই
পায়ের নিচে থেকে সরে গিয়েছিল মাটি
জানলায় হাত রেখে তারা সোজা দাঁড়িয়েছিল
আকাশ ছুঁতে যাওয়া তাদের মাথা
শুধু গাছ দেখেছিল সারা দিনরাত

দিগন্তে নজর ছিল বলেই
পায়ের দৃষ্টি হারিয়েছিল পথ
পাখিদের সঙ্গে কোনো এক ভোরে ঘুম ভেঙেছিল
সবুজ জমি থেকে উঠে এসেছিল যে কণ্ঠস্বর
সকালের বন্ধু বলে কাছে গিয়েছিল তারা
বুঝেছিল হাতে হাতে লেগে গেলে জোড়া
ফিরে পাবে সব্বাই মাটি।

সমীর চট্টোপাধ্যায়
শপথের বানী

এত সুন্দর পৃথিবীর
সব কিছু ঘোলাটে বিবর্ণ রঙ!
তবুও, কবিতার পান্ডুলিপির ভাঁজে-
লেখনীর বর্ষা ফলকের মুখে একটুও পড়েনি জং!
জীবনের কুঁড়ি গুলো-সংকুচিত
ফুটবে কি ফুটবে না, ভয় ভয় চারিদিক,
স্বপ্নের নদী স্রোত পাশে মাথা তুলে,
বালি গুলো ধুসর রঙেতে চিক্ চিক্!
পার্কের বাগানে জলে ভেজা পাপড়ির পাতা,
কত দিন দেখেনি সে কচি কাচা দোলনায় ঝুলে!
সবুজ ঘাসের ডগায় জল ভরা অপেক্ষা,
আগামীর স্বপ্নদের কবে নেবে স্নেহ বুকে তুলে!
এগিয়ে যাবে সবাই পৃথিবীর আহ্নিক গতি-
সন্তান বুকে চেপে মায়ের শপথ
কত বড় মহামারী দেখে নেব
পারো যদি আটকাও জীবনের পথ।।

অনিন্দ্যকেতন গোস্বামী
নদী

গুড়ো হয় বুড়ো হয় ছাতু হয় নদী
বুকের ভেতরে তার কলতান।
খাবি খায় সাঁতরায় ঠিকানা টাঙিয়ে
নদীর জন্ম নদী সন্তান...

অভিমানে সাতখানে ঢেউ ভাঙি আমিও
হিসাব রেখেছে তার চরাচর।
চলে যাব গলে যাব মোহনার গন্ধে
মনেতে পুষেছি নদী দিনভর...   

দুলাল কাটারী 
সুবর্ণরেখার তীরে 

ব্যকুল দুটো প্রাণ সারা মাসের শেষে হাতে হাত রেখে, চোখে চোখ রাখলে ধীরে ধীরে
মৃদু মন্দ বাতাসের অচকিত জড়িয়ে জড়িয়ে ধরা
তুলতুলে নরম পড়ন্ত বিকেলে, সুবর্ণরেখার তীরে।
শরতের এক খন্ড নির্লজ্জ্য সাদা মেঘ তোমার আঁচলের ফাঁকে উঁকি মারবে, এমন এক লগ্ন।
লাজুক তোমার আবেগি কপালে ও গালে বিন্দু বিন্দু জলকণা
লীনতাপের ছোঁয়ায় বাষ্পায়নে মগ্ন।
একজোড়া শালিক সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরে আমাদের মাথার উপর গাছটিতে বসবে
কানাকানি শুরু করবে, তোমার রূপ বর্ণনায় ব্যস্ত।
স্থীর নয়নে ব্যকুল আশা গুলি মন থেকে ঠোঁটে আসবে।
অভিমানীর হৃদয় গলনাঙ্ক নামতে নামতে পৌঁছে যাবে শূন্য
সুবর্ণরেখা মন ভিজিয়ে, উপত্যকা কাঁপিয়ে, শিহরণ জাগিয়ে,
দুক‚ল ছাপিয়ে বইবে তখনও।

কবি ও কবিতা
রৌদ্রপ্রলাপ: বহুধারায় বিস্তৃত অনুভবের কথকতা
জারিফ এ আলম

কবিতা সবসময় মননশীল মানুষের মুখাপেক্ষী। এর ওপর কারো জোর খাটে না। আর অনুভ‚তি যে এখানে হৃদয়ের দিকে কেন্দ্রগামী তা বলাই বাহুল্য। কবি নাসিরুদ্দিন শাহ্ একদম প্রতিশ্রুতি নিয়ে লিখতে বসা কবি। তার কাছে কবিতা যে কমিটমেন্ট দাবি করে তিনি তাকে নিয়ে সাজিয়ে তোলেন ব্যক্তি সমাজ রাষ্ট্র অর্থাৎ কবিতার বিষয় এগিয়ে যায় আত্মকথাকে ছাপিয়ে বিস্তৃত বহির্বিশ্বের দিকে। আন্তর্জাতিকতা ঠাঁই করে নেয় কবিতার অবয়বে। এ কারণে তার কবিতার ভাষা পায় প্রেম, যাপিত জীবনের গ্লাণিকর সময়, নিঃসঙ্গতা, বিভিন্ন অসঙ্গতি আর মৃত্যুর মতো পরিচিত বিষয়। তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘অস্তগামী জংশন’(২০১৭)। এরপর খানিক বিরতি নিয়ে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থ ‘রৌদ্রপ্রলাপ’(২০২০)। প্রথম কবিতগ্রন্থের পর দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থ বোধের যে বিস্ময়কর পরিবর্তন তা বুঝতে মোটেও বেগ পেতে হয় না।‘রৌদ্রপ্রলাপ’ কবিতাগ্রন্থ এ কারণেই স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার কারণ, এখানে প্রতিটি কবিতার প্রারম্ভে বিদেশি কবি কিংবা শিল্পীদের কয়েকটি করে পঙক্তির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। মার্লো, লোরকা, বায়রন, নেরুদা, ভ্যান গগ কিটস এঁদের নাম করতে পারি। এরকম পঙক্তিনির্ভর কবিতা কখনো দেখা যায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় কখনো জয় গোস্বামীর কবিতায়ও। ব্যক্তিপ্রম কবি নাসিরুদ্দিন শাহ্ কবিতায় তুলে ধরেন সার্বজনীনরূপে। প্রেমের জন্যে যে হাহাকার, যে উদ্বিগ্নতা তার যেনো প্রতীকী রূপায়ন সবার মাঝেই ভাবাবেগ তৈরি করে। আর কবিতায় মূর্ত হয় এভাবে,

হৃদয় অরণ্যে ঝরো বাতাস আঘাত হানে
বিলোল জোয়ারের উচ্ছ¡াসে; যেখানে নেই কোন
প্রেমের প্রাইভেট কোম্পানি লিমিটেড; কেন এ
ঝড়! একি প্রেম নাকি অনবদ্য সীমাহীনতায়
গভীর নীল কোন অস্থিরতা!
(প্রেম কি)

যাপিত জীবনে নানা বোধ, স্নায়বিক অস্থিরতা কখনো কখনো তুমুল আলোড়ন তৈরি করে মনে। নিজের ছায়াও কখনো তার অস্তিত্ব জানান দেয় কিংবা বহু ছায়ার মাঝে সেও চলে মহাকালের দিকে। এ যেনো নার্সিসাসের সেই আত্মমগ্নতার ঘোর। এখানে সেটিই প্রতিভাত হয়,

মধ্যবিত্ত আতত ছায়াগণ নিয়মিত খোঁজ রাখে তাদের
একবমত্ত সম্ভাবনার বাস্তবতায়। আলো আর আঁধারিয়া
চোখ অবতল দৃশ্যের ব্যতিক্রমী প্রিজম পান করে যায়
অবসরের স্তব্ধতায়। একি এক চ‚ড়ান্ত নার্সিজম!
(আতত ছায়াগণ)

মৃত্যুচিন্তা মানুষের মনে সৃষ্টির শুরু থেকেই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। মিশরের ফারাও রাজাদের মৃত্যুর পর  তদের দেহ মমি করে রাখা হতো। এটা সেই মৃত্যুচিন্তা থেকেই উদ্ভূত। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে মানুষ কতো চেষ্টাই না করেছে! তবু একে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি কখনো। বর কবি নাসীরুদ্দিন শাহ্ তার অনুভ‚তির ছকে মৃত্যুর চিত্ররূপ এঁকেছেন এভাবে,

দুটি চোখ তাড়িয়ে বেড়ায়
স্পর্শের বেদিতে যাপন
কলাপাতা নড়ে গেলে বুঝবেন
মৃত্যু এগিয়ে আসছে ধীরে
জানালা খুলে দেবেন
একমাত্র মৃত্যুই দেবে শ্রেষ্ঠত্বের স্বাদ

মানুষের বাসযোগ্য পৃথিবীতে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি সংগ্রাম করে যেতে। জীবন বাঁচাতে, স্বপ্নকে টিকিয়ে রাখতে। যারা এই পথপরিক্রমায় পিছিয়ে যায় তারা মূলত ছিটকে পড়ে বর্তমান থেকে। শেক্সপীয়রের ভাষায়, রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করে যেতে হয়। আর মায়ার খেলা চালিয়েই যেতে হয়। কবির কবিতা আশাবাদী করে জীবনের পথে, 

থেমে যেতে নেই প্রমিত এই ক্ষণে
উতপ্ত উন্মাদ যাযাবর
অর্থহীন ফানুস কাচঘরে
পড়ে আছে নৈঃশব্দ্যের হিমঘরে
থেমে যেতে নেই প্রমিত এই ক্ষণে
মায়ার খেলা ভুলে থেমে যেতে নেই

‘রৌদ্রপ্রলাপ’ কবিতাগ্রন্থেও রৌদ্রপ্রলাপ কবিতাটি এখানে বিশেষত্বের দাবিদার। এই যে মানুষের জীবনে কতো চাওয়া-পাওয়ার হিশেব এসব কেবল বাড়তেই থাকে। কিন্তু জীবন থেমে থাকে না। সে চলে দুর্বার গতিতে। তবু কখনো সম্ভাবনার হাতছানি দিয়ে ডাকে এভাবে,

বেঁচে থাকার ট্রেন চলেছে নির্বাক প্রদোষে
রৌদ্র প্রলাপে বটপাতা ঝিরিঝিরি গান গায়
ঘুমঘোর মৃত্যু এসে কানাকানি করে যায়
যেন সমস্ত অচল মুদ্রায় প্রাণ ফিরে পাষাণে
(রৌদ্রপ্রলাপ)

কবি নাসিরুদ্দিন শাহ্ তার ‘রৌদ্রপ্রলাপ’ কবিতাগ্রন্থে কবিতার বিষয় বিন্যাসে অত্যন্ত সচেতন। যা নানা রং-রূপ-রস কবিতাগ্রন্থটিকে আলাদাভাবে চেনার সুযোগ করে দেয়।

No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক