Wednesday, July 8, 2020

শিল্প সাহিত্য ৮৬

মঙ্গলবার  ২৪শে আষাঢ় ১৪২৭, ৮ই জুলাই ২০২০




কবিতা
শান্তম 
তুই

ভাগ করে নিই এই পাওয়া । তুইও 
তুলে দিস তোর দু’মুঠোর একমুঠো

মৃত্যু এলে কীভাবে তোকে দেব 

কিম্বা আমাকে তুই ! এই ভেবে 
না-ঘুমোনো তোকে জাগাতে জাগাতে 

একেকবার নিজের ভেতরে পৌঁছে যাই 

দেখতে পাই আমি আর আমি নই 
অন্য কেউ। যেন সত্যি এক তুই

অনিমেষ সিংহ
গোলাকার

চাকায়, চাকায় গড়িয়ে যাচ্ছে ছেলেটা।
পুঁথির ভাঁজে ভাঁজে, কতো যে আঙুল!
আঙুলে আমার, তৃষ্ণা,
আমার, ক্ষুধার পিং পং বল-
লাফাতে লাফাতে, নদীর দিকে চলে যাচ্ছে!

নদীটা দূর্গের চারিদিকে পাক খায়;
পাক, খেতে খেতে-
উঠে যায় ওপরে

মুক্তি তুমি চাকার মতো দেখতে?
গড়িয়ে যাওয়ার মতো দেখতে!

মুক্তির পিছনে ছেলেটি, সকাল থেকে হেঁটে যাচ্ছে।

হরেকৃষ্ণ দে 
ম্যানিয়া

ফাই ধরে সময় এগিয়ে চলে 
বিরক্তি পথ আগলায়
চোখের সাথে নাকের ১৮০ ডিগ্রি এঙ্গেল

বিকৃত থুতুনিতে আকুপংচার করতে করতে
নিজেই ম্যানিয়া কবলে ভেসে চলেছ

ঘুমের ঘোরে বগল বাজিয়ে
বিড়বিড় করে বলে চলেছ
“ক্ষ্যাপেও শান্তি নেই”

জাহাঙ্গীর জয়েস 
মুখোশ

সিনেমার নায়ক বা নায়িকার মতো দাঁড়িয়ে থাকো পথের পাশে কেউ একজন আসবে
বিলবোর্ড এখন হাতে হাতে, প্রতিদিন অথবা প্রতি সপ্তাহে বদলে যায় চেহারা!

এখন উৎসবে, অনুষ্ঠানে চেনা যায় না তোমাদের
এখন নিজেকে কুৎসিতভাবে তুলে ধরার দিন
এখন বড় আড়াল হওয়ার দিন!

মমতাজ মম
কাজলা খোয়াব

হাওরের ধলা পানিতে কালা মাইয়্যাও রঙিলা শাপলা তুলে,
সাদা আর গোলাপি'র অদেহা সুতায় মালা গাঁথুনের গিট্টু তুলে।
কালা মাইয়্যা গতরের রঙ খুইল্যা দুই চক্ষে কাজল টানে,
রাইতের আন্ধারে হেই কালা কাজল খোয়াব দেহে গোপনে। 
কালা মাইয়্যার কালা চুলে মেঘ নামে আসমান ভাইঙা,
গতরে আষাঢ়ের লাহান বান উছলায় পিরিতের লাইগ্যা।
কালা মাইয়্যার গালের গর্তে বেডা মাইনষের শরীল লালচায়,
হাওরের জলে পাও ডুবাইলে পোনা মাছেরাও ঠুকরায়। 
আসমানের ডাহে যেমুন কই মাছ উজাইয়্যা উঠে হাওরের পাড়ে,
বয়সের ডাহে কালা মাইয়্যার গোপন তল্লাট গুলানও উজাইয়্যা উঠে নজরে। 
হাওরের ভাসান মাঝির লাইগ্যা সে পরান বান্ধে অগোচরে।

গোপেশ রায়
হেরিটেজ বিল্ডিং 

হেরিটেজ বিল্ডিং থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম আমাকে এগিয়ে যেতে হবে- তুমি কুয়াশার চাদর দিয়ে অঙ্গ ঢাকছ
এখন দুচোখ ঘুমানো অতীত স্বপ্ন দেখাছে আমার ভবিষ্যত-
ছেড়ে দাও মায়াকাটা প্রহরগুলি, কেটে যাক ধোঁয়াশা!
আমাকে ছেড়ে দাও যেতে হবে অনেকটা পথ -
কারা যেন ফিসফস কথা বলে, বলুক। তাদের কথায় কান দেবনা আর আমাকে যেতে হবে। পথ থেকে সরাও ব্যরিকেড!
ভাঙা ইঁটের স্তূপ ঘেঁটে কী খুঁজছো নিশাচর! পিছুটান দিওনা ছেড়ে দাও-
আমাকে যেতে হবে সামনে, অসীমে ...

নাদিম সিদ্দিকী
প্রথম যৌবনে

ভালোবেসে সবাই পায় কোমল গোলাপ
আমি পেয়েছি আগুনের নদী।
হাজারও মিথ্যে গোলাগের ভীড়ে
এক মানবী সুভাষ না দিক
পোড়াতে তো পারবে
দুঃসময়ের এই মিছিলে
আমি তাকেই পেতে চাই প্রথম যৌবনে।

ছোটগল্প
বাবা
আপন রহমান

আজ দুইদিন যাবত বাবা কিছুই খাচ্ছেন না। কোন কথাও বলছেন না। বিছানায় শুয়ে শুধুই কাতরাচ্ছেন।
- বাবা গো, মাগো মরে গেলাম’।

মরে গেলাম শব্দটা শুনলেই কেমন যেন একটা ধাক্কা লাগে চয়নের মনে। কেননা বাবা ছাড়া যে এ পৃথিবীতে তার আপন বলতে আর কেউ নেই। সেই বাবা যদি মারা যায়, তবে সে কার কাছে থাকবে। দু:খ-সুখে কার বুকে মাথা রাখবে? বাবা ছাড়াও অবশ্য আপন বলতে তার আরও একজন আছে। তবে তাকে ঠিক আপন ভাবতে ঘৃণা হয় চয়নের। তার কথা মনে পড়লে ক্ষোভে ঘৃণায় তার মুখ দিয়ে থু-থু বেরিয়ে আসে। সে আর কেউ নয়, চয়নের মা।

সে অনেক ঘটনা ...

চয়নের বাবার এক সময় অনেক টাকা-কড়ি ছিল। পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান সবই ছিল। ছিল পাটের বড় কারবার। আর ছিল পয়সার মত সাদা একটি হৃদয়। বিপদে-আপদে অভাবে-অনটনে সব সময় সে মানুষের পাশে দাড়াতেন তিনি।
সেদিন আড়ৎ থেকে সাইকেলে করে বাড়ী ফিরছিলেন তমাল মিয়া অর্থাৎ চয়নের বাবা। হঠাৎ রাস্তার পার্শ্ববর্তী একটি বাগানে একটি মেয়ের গোঙানীর আওয়াজ শুনতে পেলেন। সাইকেল ফেলে তিনি ছুটে গেলেন বাগানে দেখলেন, একটি মেয়ে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। অনেক কষ্টে সে মেয়েটিকে রক্ষা করে এবং মেয়েটির কাছে জানতে চায় তার আত্মহুতির কারণ। জবাবে মেয়েটি তাকে জানায়-
“আমি অনেক গরীব ঘরের একটি মেয়ে। অনেক কষ্টে এবার এস.এস.সি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছি, তা প্রায় নয় মাস হল। কলেজে রফিক নামের একটি ছেলের সঙ্গে আমার খুব গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রফিক আমাকে নানাভাবে প্রলোভীত করতে থাকে এবং আমার সঙ্গে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে। প্রথম দিকে আমি নানা অজুহাতে তার কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করি। কিন্তু একসময় কিভাবে যেন নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি এবং তার লালসার শিকার হই। এভাবে চলতে থাকে বেশ কিছুদিন। এক সময় আমি অন্তসত্ত¡া হয়ে পড়ি। আমি বুঝতে পারি না আমি কী করব। চারপাশের পৃথিবীকে কেমন যেন অন্ধকার মনে হতে থাকে। লজ্জায় কাউকে কিছুই বলতে পারছিনা। এমনকি রফিককেও না। এভাবে কেটে যায় দুই-দুই মাস। আমি একদিন রফিককে সব খুলে বলি। ও আমাকে তখন বলে এটা নিয়ে কোন চিন্তা করো না। এবং কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। আমরা খুব শীঘ্রই বিয়ে করবো। এভাবে আরো ৩ মাস কেটে যায়। হঠাৎ করে আমাকে কিছু না বলে গতকাল রফিক বিদেশ চলে গেছে। এখন আপনিই বলুন আত্মহত্যা ছাড়া আমার আর কোন পথ কি খোলা আছে?

জবাবে তমাল মিয়া বলে, হ্যাঁ, আছে।
- কি সেই পথ!
- আমি তোমাকে বিবাহ করবো। তুমি আমাকে তোমার বাবা মায়ের কাছে নিয়ে চলো।

এভাবেই তমাল মিয়া তাকে বিবাহ করেন। কিছুদিনের মধ্যে ঘর আলোকিত করে চয়নের জন্ম হয়। কিন্তু কিভাবে যেন গ্রামে এই ঘটনা জানাজানি হয়ে পড়ে। কথায় বলে “সত্য কখনও চাপা থাকে না, সত্য তার নিজ যোগ্যতায় প্রকাশ হয়ে পড়ে”। কত লোকে কত কিছু বলে।  কিন্তু তমাল মিয়া কারও কথায় কান দেয় না। তিনি আদর-স্নেহে নিজের সন্তানের মত চয়নকে লালন-পালন করতে থাকে। সেই চয়ন এখন ৮ বছরের বালক।

বেশ কিছুদিন হল গ্রামে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেছে। সকাল-সন্ধ্যা লোক মুখে আলোচিত হচ্ছে ঘটনাটি। সবাই আফসোসের সঙ্গে বলছে আহ্ তমাল মিয়ার মত একটা ভাল মানুষের  সাথে এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতা টা কিভাবে করল সে। শালী একটা আস্ত নিমুক হারামী! হ্যাঁ, এই নিমুক হারামীটা আর কেউ না, চয়নের মা। যাকে তমাল মিয়া বিশ্বাস করে ভালবেসে নিজের সর্বস্ব তুলে দিয়েছিল যার হাতে সেই। নতুন ব্যবসায় হাত দেবে বলে সেদিন তমাল মিয়া তার পুরানো ব্যবসার সমস্ত মূলধন আড়ৎ থেকে বাড়ি এনেছিল। কিন্তু কোন এক ফাঁকে চয়নের মা সমস্ত টাকা নিয়ে নিরুদ্দেশ! কিছু দিন পর অবশ্য বিষয়টা সকলের কাছে পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল। রফিক দেশে ফিরে ঢাকায় নতুন বাড়ি করেছে। সে তমাল মিয়ার সর্বস্ব নিয়ে রফিকের কাছে চলে গেছে। নিষ্ঠুর পৃথিবীতে হয়তো এটাই তমাল মিয়ার উপকারের প্রতিদান। মা চলে গেলেও চয়ন কিন্তু একদিনও মায়ের জন্য কাঁদেনি। বরং তার নাম শুনলে সে প্রচন্ড রকম রেগে যায়। কেননা নিষ্ঠুর পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা বোঝার মত যথেষ্ট বয়স তার হয়েছে। তার যত চিন্তা বাবাকে নিয়ে। সে এখন বুঝতে শিখছে এবং বোঝে। তমাল মিয়া তার আপন বাবা নয়। গ্রামের নানান মানুষের নানান আলোচনায় সে এখন প্রায় সব ঘটনায় জেনে গেছে। তবুও জন্মের পর যাকে সে বাবা হিসেবে জেনে এসেছে। যে তাকে আপন বাবার চেয়ে অনেক বেশি স্নেহ-মমতায় মানুষ করেছে। তার জন্য শরীরের শেষ রক্ত বিন্দু দিতেও প্রস্তুত সে। যেদিন সর্বস্ব নিয়ে রাক্ষসীটা চলে গিয়ে ছিল।
তার কিছুদিন পর থেকে তমাল মিয়া বিছানা ধরা ডাক্তার কবিরাজ অনেক দেখানো হলে, কিন্তু কোন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। শহরে নেওয়ার মত যথেষ্ট টাকা তার অবশিষ্ট নেই। শুকোতে-শুকোতে শরীরটা হাড্ডিসার হয়ে গেছে তার। তারমধ্যে আজ দুদিন খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুই খাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরপর -মরে গেলাম, মরে গেলাম বলে চিৎকার করছে। গ্রামের লোকজন পাড়া-প্রতিবেশী প্রথম দু-একদিন তাকে দেখতে এসেছিল। কিন্তু এখন আর কেউ ফিরেও তাকায় না। যে যার কাজে ব্যস্ত । অথচ; বিপদে-আপদে এই লোকটাই এক সময় সকলের আগে ছুটে যেত তাদের পাশে। আজ তার পাশে সেই কুড়িয়ে পাওয়া ধন-চয়ন ছাড়া কেউ নেই।

তখন দিনের সূর্যটা প্রায় ডুবু-ডুবু করেছে। তমাল মিয়া চিৎকার করে ডাকছে।
- চয়ন; বাবা চয়ন-তুই কোথায়?
- আমি এখানে বাবা; ভাত রাধছি।
- ভাত আর রাধা লাগবে না, বাবা; তুই-তুই একটু আমার পাশে আয়।
- আমি আসছি বাবা...

চয়ন দৌঁড়ে বাবার কাছে আসে। বাবার মুখে হাত দিয়ে বলে,
-বাবা, ও বাবা; কি হয়েছে? ডাকছো কেন?

তার বাবার মুখ থেকে আর কোন কথা বের হয় না। সমস্ত শরীর নিথর হয়ে গেছে। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন তমাল মিয়া। তিনি আর কোন দিন ডাক শুনবেন না। ছোট্ট বালক চয়ন সেটা বুঝতে পারে না। সে ডেকেই যায়, বাবা ও বাবা; কথা বলছো না কেন? বাবা-বাবা ...

No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক