শুক্রবার
১৬ই শ্রাবণ ১৪২৭, ৩১ই জুলাই ২০২০
কবিতা
অপার অরণ্য
ঋতুশূন্য মা’র শৈশব
লাঙ্গল-শুশ্রুষায় কৃষক যেমন রক্ষা করে জমি
তামাম নির্জনতা গিলে সুঁইয়ের পরে সমুদ্র তুলে মা
সেলাই করেন আমাদের যাপন।
পান থেকে খসলেই চুন বাবার লিকলিকে চোখ
ফোঁসফোঁস করে-
কেমন নির্বান্ধব আর সঙ্গীতশূন্যতায়
বাবা বুঝতেই পারেনা মা আসলে ফোঁড় কাটেন
ঋতুচক্রের ফাঁপা হাঁড়পাজর।
কাঁথার অন্দরে আশৈশব লুকিয়ে রাখার সন্দেহে
এক বর্ষায় চুরি করে সুঁই হই
দেখতে যাই কড়ুই রোদে সইয়ের সঙ্গে মা পুতুল
খেলত কিনা
উঠতি বয়সের দস্যিপনা কি ঋতুস্রাব এলে মা’ও ঠোঁটে
অযত্নে বসত কিনা কাঠফড়িংয়ের লাল
এসব খোঁজ তল্লাসির ফাঁকফোকরে বসন্ত লেগে যায়
কোন হঠাৎ গাওয়া কোকিলে মা কণ্ঠ দিল কিনা
তন্নতন্ন করেও এই ঋতুটি উদ্ধার করা গেলো না!
পাড়াত মেয়েরা খোঁপায় গল্প গুজে
কোঁচর ভরে চালভাজা খায়
মা তখন যত্ন করে গোয়ালঘরে গরু তোলেন
ডালিমতলার শুকনো পাতা নরম হাতে সরিয়ে রাখেন
মা’র আকাশে মেঘ নেই- গান নেই পাখিদের উড়বার
শরৎ এর বুক চিঁড়ে ফুটে থাকে যুগলযুঁথী
একজন গ্রীষ্মের তাপতড়িৎ ছুঁয়ে ছুঁয়ে কেটে যায় অন্যান্য ঋতু
কোথাও কোন পুকুরঝাপে নেই
সন্ধ্যা নামলে চোখপলান্তি— তাও
তালগাছে পাকে তুখড় ভাদ্রমাস
শীতকাটা সুখে কুয়াশায় পাখিদের আহ্লাদী নাচ
সব ঠিকঠাক সবখানে, হায়!
সমস্ত শৈশব জুড়ে মা হয়েছেন উনুনের পেটে
জ্বলজ্বলন্ত কাঠ!
সুঁই-জীবন থেকে বেরিয়েই
গলা টিপে দেই মা’ও বোবা থাকার ব্যামো
এখন সুনসুনিয়ে কাঁথা সেলাই কালে
মা’র নিশ্চুপ ঠোঁটে নামে অলৌকিক ভোর,
ঋতুমঙ্গল গান।
অ। জ। য় রা। য়
নববর্ষে শতবর্ষের মৃত্যুদূত
তুমি আর এসো না ফিরে অশুভ ছায়া রূপে এমন সুন্দর অবনী পরে
প্রতি শতবর্ষের মৃত্যুদূত হয়ে প্রাণ কেড়োনা যাও চলে দূর বহুদূরে
শ্যামল প্রকৃতি আজ হাসে না হারিয়েছে রূপ দখিনা সমিরণে দোলেনা মুকুল
পুষ্প কাননে সুগন্ধি ফুলের সৌরভ ছড়ায় না নিস্তেজ জুঁই মালতি বকুল
কোকিলের কুহু ছন্দ মন ভরে না তার আনন্দ চারিদিকে বিমূর্ত করুণ সুর
নবান্নের উঠোনে কাকেরা হাহাকার ধ্বনি তুলে ধবলীর গলায় স্বর ভঙ্গুর!
নীল অম্বর ক্ষণে ক্ষণে কাল মেঘে ঢাকা পড়ে বিস্তর পাকা ফসলের মাঠ
কালবৈশাখীর ভয় কৃষকের বুক কেঁপে ওঠে যতদূর চোখ রুদ্ধ পথঘাট।
নতুন দিনে নতুন পার্বণ স্বস্তিহীন মানুষের প্রাণ দিগন্তে নেই রবির প্রদ্যোত
ঘোর অমানিশার আঁধার চারিদিক ছেয়ে গেছে নববর্ষেও তুমি শতবর্ষের মৃত্যুদূত।
সৌম্যজিৎ আচার্য
তোমাকে বলা হয়নি
তোমাকে বলা হয়নি, শেষ ট্রেনটা পেয়ে গেছি। ট্রেন একটা অচেনা প্ল্যাটফর্মে এসে থেমেছে। এ প্ল্যাটফর্মে নদী আছে। তাই নেমে যাচ্ছি। নদীতে পা ডুবিয়ে গোটা শীতকাল এবার এখানেই কাটাব আর আমার পা শ্যাওলা হয়ে ভেসে যাবে মোহনায়...
তোমাকে বলা হয়নি, চিড়িয়াখানা আর জেলখানার পাঁচিল দুটোই সমান উঁচু। আমি তাই ওদের নেমপ্লেট বদলে দিয়েছি। দুটোর পাহাড়াদারই আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। ওদের বোলো না, আজ রাতে আমি অ্যাসাইলামের দেয়ালে হিসি করতে যাচ্ছি। ও দেয়ালেও বৃষ্টি হয়নি বহুদিন...
তোমাকে বলা হয়নি, শব্দরা চায়নি, তবু লেখা ছেড়ে চলে যাচ্ছি দূরে। কবিতা আমায় ফ্যাকাসে করে দিয়েছে। আমার প্রতিটা কবিতাই ও-পজিটিভ। আমি এত রক্তাক্ত লেখা লিখতে চাইনি কোনোদিন... কাউকে বোলো না, আজকাল আমার সারা গায়ে জ্যোৎস্না গাছ বেড়ে উঠছে...আলো ভরে উঠেছে... আমার আর চাঁদ ভাল লাগছে না। আমি জলের নীচে সাঁতার কেটে চলে যাচ্ছি মোহনায়...
রুদ্র সাহাদাৎ
প্রথম মৃত্যুর পূর্বে আমাকে কেউই চিনতো না
প্রথম মৃত্যুর পূর্বে আমাকে কেউই চিনতো না
তখোন গহিন অরন্যে আমি একাই ছিলেম তা- কিন্তু না
কতো ধর্মের কতো বর্ণের কতো জাতি ছিলো
জাতিসংঘ সব জানে, শুধু মানুষের মন বোঝে না।
বেরসিক মানুষ সমাজের জঞ্জাল,
ডাস্টবিনে পড়ে থাকা আবর্জনার মতন।
কি আশ্চর্য, এখনও অনেকেই আমাকে চিনে না...
চন্দনা রায় চক্রবর্তী
লক্ষণ রেখা
প্রসবের রক্ত জল সাঁতরে উঠে আসা
কিছু অন্তর্জলি ছবি, ভাষা, কল্পনা...
অনায়াস শারীরিক পরিক্রমা পার করে
মনের কুণ্ঠার দরজায় অবিরাম কড়া নাড়ে।
শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটে,
আগ্রাসী চুম্বনের জ্বরতপ্ত উষ্ণতা,
কপট রাগের অজুহাতে
ছায়া বিস্তারের চতুভৌতিক সীমা বজায় রাখে।
দু’বাহুর দুরত্বে শারীরিক সংশ্লেষেও দোটানায়।
বারোমেসে ধুলো পড়া সংস্কার,
কুন্ডলী পাকিয়ে পড়ে থাকে,
আশ্বিনের অশ্বগন্ধার রূপকল্পে।
চারিদিকে অবগাহনের মন্ত্রে ভেসে যায়
অন্তর্লীন আমিত্বের জোলো ইঁদারার জল।
ধ্রুব তারার আলোয় নতুন করে পথ চেনা
গন্ডীর লক্ষণ রেখা পার করে অচেতন মন
পৃথিবীর যাবতীয় ঋদ্ধিই এপিটাফ হয় তখন।
অণুগল্প
এবং কুমুদ
শুভা গাঙ্গুলি
কুমুদিনী ছাদে তাঁহার মেঘসদৃশ কেশদাম শুকাইতেছিলেন, তিনি প্রত্যহ দুপুর দুইটা হইতে চার ঘটিকা ছাদে ঘুরিয়া ঘুরিয়া গান করিতে করিতে তাঁহার চুল শুকান। কুমুদিনী ঊনত্রিশ বৎসর বয়স্কা বাল্যবিধবা, বাল্যে ছয় বৎসর বয়সে কুলীন প্রথায় বিবাহ নয় বৎসরে বৈধব্য যোগ, কুমুদ স্বামীকে চিনিত না, মরিলে বিন্দুমাত্র দুঃখিত হয় নাই, পিতৃদেবের স্বচ্ছল অবস্থা তাই তাহার জীবন সুখেই কাটিত, কিন্তু তাহাকে তখনকার নিয়ম কানুন অনুযায়ী গৃহবন্দী হইয়া থাকিতে হইতো।
গল্প এই পর্যন্ত ঠিক ছিলো, কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো কুমুদের দাদা বিলাত হইতে তিনটা পাশ করিয়া ফিরিয়া আসিলে, সে আসিয়া কহিলো কুমুদ লেখাপড়া শিখিবে, কেবলমাত্র নির্জলা উপবাস করিয়া জীবন কাটাইবে না।
বিদ্যাসাগর মহাশয় মেয়েদের শিক্ষা নিয়া অনেক ব্যবস্থা করিয়াছেন, কুমুদ বিদ্যালয়ে যাইবে আর পড়াশোনার পাশাপাশি শিল্পকর্মও শিখিবে, খেলাধুলাও করিবে। রায় বাড়ীতে বড় ছেলের কথা মান্য করা হইতো, তাই কুমুদের বন্দীদশা ঘুচিলো কিন্তু অন্য অশান্তি দেখা দিলো। তাহার বয়সী মেয়েদের অভিভাবকরা এই রীতিকে প্রশ্রয় দিলো না ফলে কুমুদ সখীহীন হইলো, কিন্তু কুমুদ দমিবার পাত্রী নয়। সে সকলকে বুঝাইয়া গুটি কতক ছাত্রী জোগাড় করিলো, পড়াশোনায় মোটামুটি ভালোই ছিলো, ইস্কুল পাস করিলে দাদা পুনরায় বিবাহের চেষ্টা করিতে লাগিলো, ততদিনে। বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবা বিবাহ আইন পাশ করিযাছেন, সেই হেতু দাদা বোনের বিবাহের জন্য ব্যস্ত হইলো।
কুমুদ ছোটবয়সে বিবাহ নামক প্রণালী সম্পর্কে কোনো ধারণা করিতে পারে নাই, এখন দেখিলো এবং বুঝিলো আইন পাশ হইলেও বাল্য বিধবার বিবাহ সহজ নহে, নারী ঘরে পচিয়া মরিবে কিন্তু বাহিরের জগতে যাইতে পারিবে না।
কুমুদ দুই একবার দাদার কথা মানিয়া পাত্রপক্ষের সামনে বসিলো, কিন্তু তাহাদের প্রথা শুনিয়া নিজেই নাকচ করিলো।
কুমুদ নিজেই গ্রামের মেয়েদের লেখাপড়ার পাঠ দিয়া তাহাদের মানসিক শক্তি বাড়াইতে লাগিলো, নানারূপ কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোবৃত্তির বাহিরে যে একটা সুস্থ জগত আছে সে তাহাদের শিখাইলো, এ কাজে তাহাকে প্রচুর অসুবিধার সামনে পড়িতে হইলেও সে পশ্চাদপদ হয় নাই।
এত অবধি গল্প মোটামুটি ঠিক চলিতেছিলো, এইবার ঘটনায় নয়া মোড় আসিয়াছে, কুমুদিনীর পাশের বাড়ীতে কোলকাতা হইতে এক মাষ্টার আসিয়া ছেলেদের স্কুলে জয়েন করিয়াছে, বিশ বছরে গ্রামে প্রচুর উন্নতি হইয়াছে, মেয়েদের ইস্কুল ছেলেদের ইস্কুল সব কিছুই কুমুদ আর ওর দাদার আন্তরিক প্রচেষ্টায় গঠিত হইয়াছে, মেয়েরা এখন চারদেয়ালের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অশিক্ষিত গৃহবন্দী অবস্থায় দিনযাপন করে না, জ্ঞানের আলো গ্রামে প্রবেশ করিয়াছে।
খোঁজ লইয়া জানা গেছে নতুন মাষ্টার এখনও বিবাহ করে নাই সাংসারিক কারণে, এক্ষণে সে ছাদে বিচরণরত কুমুদকে দেখিয়া কিঞ্চিত বিচলিত হইয়াছে, সম্ভবত: সমাজসংস্কারক কুমুদ এবং সংসারসুদারক মাষ্টার কুমুদের দাদার পরামর্শে একত্র থাকিবে।
কুমুদ দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্না সুন্দরী এবং স্বাধীনচেতা, সাধারণ জনতার ভাষায় দজ্জাল কিন্তু মানুষটির কাজে সারা গ্রাম উৎসাহিত। অলিখিত লকডাউন হইতে নারী জাতিকে মুক্তি দিয়াছে।।
ধারাবাহিক গল্প
পচন
স্বপঞ্জয় চৌধুরী
ছয়
এরপর আরো দুইবছর কেটে গেলো। পচনের শরীরে কুষ্ঠরোগীদের মতো ফোস্কা দাগ উঠতে লাগলো। মাঝে মাঝেই জ্বর আসে। ডাক্তার বলেছে সুচিকিৎসার প্রয়োজন। কুষ্ঠ ছোঁয়াচে রোগ এই আতঙ্কে ওর সাথে কেউ মিশতে চায় না। এমনকি ওর মা কুসুমও ওর থেকে যেন খানিকটা দূরে সরে যাচ্ছে। মানুষের বাড়ি কাজ করে ওর চিকিৎসা খরচ মেটানো সম্ভব নয়। তাই ওকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে শুয়ে বসে ভিক্ষা করতে হয়। কেউ হয়তো দু’চার আনা দেয় কেউ আবার আতঙ্কে সরে যায়। দিন শেষে যা কামাই হয় তা দিয়ে ওষুধ পথ্য কেনা হয় না। অবশ্য একটি এনজিও ওর চিকিৎসা খরচ বহনের আশ্বাস দিয়েছে। বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও নাকি চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় এ খবরও জানে পচন। কিন্তু তবুও সেসব চিকিৎসা সেবা নেয় না। কারণ কুষ্ঠ রোগকে পুঁজি করে ভিক্ষার মাধ্যমে কিছু পয়সা কামাই করে যদি দুগ্ধদাত্রী মাকে একটু আর্থিক সহয়তা করা যায়। রোগ ভালো হয়ে গেলে সুস্থ্য মানুষকে কেউ ভিক্ষা দেবে না। ( চলবে...)
No comments:
Post a Comment