সোমবার
৫ই শ্রাবণ ১৪২৭, ২০ই জুলাই ২০২০
কবিতা
রফিকুল কাদিরআমরা যারা বেয়াদব হয়েছি
সময়কে সাক্ষী করে
সত্য বলার অধিকার
আমাদের আজন্ম
তোমাদের সময়ের সন্তান ভেবে
নিজেদের বোধ, ভালবাসা
অঙ্গীকার, বিশ্বাস অর্পণ করে
চেয়েছি সময়ের সুবাতাস বয়ে যাক
জাতীয়, আন্তর্জাতিকতার সীমানা পেরিয়ে
মহাবিশ্বের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে
হতে চেয়েছি বিশ্বমানবতার অংশীদার
সত্ সৃষ্টি, সুসময়ের আশায়
সাতরঙা ঝান্ডা ললাটে লটকে
ঘোষণা করেছি-
তোমরাই অগ্রগামী, মানবতার ধারক-বাহক
আমাদের আশা ভরসার অনির্বাণ প্রজ্জ্বলিকা
সমস্ত আশা-আকাক্সক্ষার নিকুচি করে, নির্ভরতার প্রশ্রয়ে-
কামুকতাই লালন করেছ তোমরা
ভালবাসার বিন্দু-বিসর্গ অবশিষ্ট রাখনি
রাখনি নির্ভেদ নিয়নের শেষ বিন্দুটুকু
ভালবাসার আশ্রয় হতে গিয়ে
কেবলই জন্ম দিয়েছ
অজস্র, অসংখ্য জারজ
দুর্গন্ধি বির্যে
জননী গর্ভে সন্তান দানেও
পিছপা নয়
তোমাদের জারজ শরীর
তোমাদের দায়িত্বহীনতা, ভোগবাদীতা
আমাদের নিরাশ করেছে;
করেছে ক্ষ্যাপা, দলছুট
আমরা বেয়াদব; বেয়াদব হয়েছি
উদয় সাহা
সুশান্ত
মনের মত করে মেঘের পিঠে রঙ মাখতে মাখতে
চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে
অথচ দেখ আমাদের অনেকেই
রোজ রাতে তারা গুনি
তারা গুনতে গুনতে ভোর হয়ে যায়
উঠোন জুড়ে শ্রাবণের ধারাবিবরণী
স্কেচবুকে ঘষটে ওঠে শীতকাল
সংলাপহীন
রুদ্র সাহাদাৎ
ভালোবাসা ভেঙে পড়ে মনের গহিন থেকে
ভালোবাসা ভেঙে পড়ে মনের গহিন থেকে
সবাই তো আর ভালোবাসা বুঝে না
সুখ খোঁজে, সুখী মানুষের ভিড়ে।
স্বার্থহীন নেই সময়, স্বার্থহীন নেই কোনোকথা
চব্বিশঘণ্টা স্বার্থ খোঁজা ক্লান্ত মুখ।
বুকের পাঁজর ভেঙে যায়, চোখে দেখা বাস্তবতায়
বিরহী সঙ্গীত বাজে ইউটিউব চ্যানেলে চ্যানেলে...
নাদিম সিদ্দিকী
শঙ্খধ্বনি
আজ সম্মুখ সমরে দাঁড়িয়ে যদি বলতে না পারি
কলমের লৌহ দৃঢ়তায় যদি লিখতে না পারি,
যদি না পারি রঙিন আভাষ ছড়াতে তোমার বুকে
তবে জন্মভ‚মির গর্ভে শাশ্বত ইতিহাস বলে দেবে
আত্মকেন্দ্রিক পৃথিবীতে আমি কতোটা অপরাধী
কতোটা জীর্ণ-শীর্ণ মনস্তত্তে¡ ভরপুর আমাদের সভ্যতা।
হে আধুনিক পৃথিবীর ডিনামাইট সভ্যতা
আমি তোমার কাছে জানতে চাই?
প্রাত্যহিক জীবনে ক্ষমতার এই নগ্ন লালসায়
এভাবে আর কতোকাল, আরও কতোদিন
বুলেটের নিষ্প্রাণ শব্দ চিৎকার করবে
আরো লাশ চাই, আরো লাশ চাই।
আর কতো লাশ চাই তোমার
আর কতো রক্তে ভিজলে মাটি
মুক্ত হবে জন্মভ‚মি, মুক্ত হবে ইতিহাস
আমি জানতে চাই?
এবং
জানাতে চাই অনাগত ভবিষ্যৎকে
এভাবে আর কতোকাল, আর কতোদিন
প্রভাতেই ঝড়ে যাবে রক্তিম ভাস্কর!
গোবিন্দ সরকার
শব্দের শক্তিশেল
অব্যর্থ অস্ত্র
ছুড়ে মারো পাখি মরবেই
আবার কোমল স্থানের নির্ভুল জড়িবুটি।
তূণীরের এই বাণ রহস্যঘন।
শব্দ, তুমি এত ধাতব কেন?
পাথর করতেও পারো আবার গলাতেও পারো।
বিষাদ আব্দুল্লাহ
তাড়া
বারান্দার হলজুড়ে নেশা ধরা আকাশ
মেঘের ওড়না খুলে জোৎস্না নিভু নিভু হাসে
ঘ্রাণেও বুদ হওয়া যায়, ঘ্রাণেও তুমি থাকো ভেসে
এমন-রাতে- ঠাণ্ডা বাতাসে বাতাসে
নিশ্চয় এখন লেগে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা
দোল খায় বারান্দার কার্নিশে
রাতের মফস্বল শহর
দালানগুলোয় আলোর কারুকাজ
পুকুর জলের ওপর ঝিঁ ঝিঁর কণ্ঠভরা মিউজিক
আর কদমের ঘ্রাণে মাতাল হতে হতে হতে
এমন সুন্দর রাত্রির বৈঠকে নিঃশব্দে বসে রই!
ঘুম নেই, আছে তাড়া, ক্ষুধাও আছে,
চারদিকে অদৃশ্য খুনির হাত ধরে মৃত্যু নাচে!
তামান্না মেহেরুন
মহাকালের যাত্রীরা
রাত্রির স্টিমার থেমে গেলো বুনো ঝোপে
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম
ভয় নেই হে মহাকালের যাত্রীরা
এই বুনো ঝোপ আমার পোষা
এই থৈ থৈ জল আমার
এই নষ্ট ইঞ্জিন আমার
এই ত্যক্ত স্টিমার আমার
নীল দিগন্তের ফাঁকিবাজি মেঘ
আসমান চেড়া ফরমালিনের গন্ধ
পাখিদের ডানায় ঘুণে ধরা পালক
নদীর বুকে ভেসে উঠা লাশ
আমি আবারো চেঁচিয়ে উঠলাম
ভয় নেই হে মহাকালের যাত্রীরা
এই মেঘেরা আমার
এই ফরমালিনের গন্ধ আমার
এই ঘুণে ধরা পালক আমার
এই লাশ গুলাও আমার
জলন্ত নদী সাগরের সঙ্গম
চোখ পোড়ানো কালশিটে সমাজ
জীবন থেকে হারিয়া যাওয়া মানুষ
তোমার জিহ্বার বেপর্দা
অতঃপর কয়েক ফোঁটা দেশাত্মবোধ
আবার চেঁচিয়ে উঠলাম
ভয় নেই হে মহাকালের যাত্রীরা
এসব আমার কিচ্ছু না কিচ্ছু না।
ধারাবাহিক গল্প
অন্ধকারাচ্ছন্নপ্রণব কুমার চক্রবর্তী
ছয়
ঢুকতে বাধা পেয়ে আমি বাধ্য হয়ে গেটের সামনে থেকে সরে আসলাম। রংমহল এর বাইরে দাঁড়িয়ে ওই মহিলাটির কথাই শুধু ভাবতে লাগলাম। ভাবনার ভিতরেই মনে হল- মহিলাটির নাম খুব সম্ভবত শরীফুন্নেসা বেগম কিম্বা নাদিরা বেগম!
তুরস্কের রাজা সম্রাট আকবরকে খুশি করার জন্য শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে একে আগ্রায় পাঠিয়েছিলেন।
সম্রাটাট আকবর খুশি মনে সেটা গ্রহণ করেছিলেন। ভালোবেসে সর্বসমক্ষে ওর নাম দিয়েছিলেন- আনারকলি। ও ও হয়ে উঠেছিল সম্রাটের অন্যতম প্রিয় রক্ষিতা। কিন্তু শাহজাদা সেলিমও ওকে ভালোবেসে ফেলেছিল। চেয়েছিল নিজের বেগম করে সংসার পাতবে। কিন্তু সেটা হতে পারেনি।
আকবর জান্নাত মহলেরই গোয়েন্দা মারফত ছেলের ওই প্রেমের খবরটা জানতে পেরে এতটাই কুপিত হয়েছিলেন যে, আনারকলিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। লাহোরের দুর্গে ওকে জ্যান্ত কবর দিয়ে মারা হয়েছিল। সেই শরীফুন্নেসা এখানে কেন এসেছে? কেন সে হত্যাকারী আকবরের সাথে আবার মেহেফিল মানাতে এসেছে? তবে কি, আনারকলি কে লাহোরের দুর্গে জ্যান্ত কবর দেওয়া টা একটা লোক দেখানো ব্যাপার! তার প্রিয় রক্ষিতা আনারকলিকে জাহাঙ্গীরের প্রেম থেকে থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার জন্য- এটা আকবরের একটা বানানো ইতিহাস!
তবে কি এটা আনারকলির অশরীরী আত্মা! সুন্দরলালের ভাষায় আনসেটিসফাই আত্মা!
আমি যখন এইসব চিন্তায় ব্যস্ত তখনই আবার কানে ভেসে এলো ঘুঙুরের আওয়াজ, তবলার বোল এবং বাইজীর গানের কলি! সাইয়া, তু মেরি পাস আনা / মুঝে তুমহে জরুরাত হ্যায় / মুঝে তুমহে কুছ বাতানা...
তার মানে, ও আমাকে চিনতে পেরেছে! আমাকে ডাকছে! বলছে আমার সাথে ওর কথা আছে!
তাহলে, আমার ধারণাটাই ঠিক যে, একসময় আমি ছিলাম এই কেল্লার জান্নাত মহলেই সুন্দরী নর্তকী আনারকলির খোজা প্রহরী কাসেম আলী হয়ে। আমিই ওকে মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার পরে এই আগ্রা কেল্লা থেকে সুরঙ্গপথে নদীতে স্নান করতে যাওয়ার নাম করে- গোপনে লাহোরে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলাম। বলেছিলাম, আমি ওখানে গিয়ে ওর সাথে দেখা করব। কিন্তু সম্রাটের রোষানলে পড়ে আমাকে প্রাণ হারাতে হয়েছিল।
কাসেম আলী নামটা কানে যেতেই আমার সারা শরীরে একটা অদ্ভুত শিহরণ শুরু হয়েছে।
খুব সম্ভবত আনারকলি আত্মা আমাকে এখানে দেখতে পেয়ে এসে হাজির হয়েছে- কিছু গোপন কথা বলার জন্য।
মহলের ভেতরের আলো-আঁধারিতে গোটা ব্যাপারটা কেমন যেন একটা কুয়াশা ঢাকা অদ্ভুত ঘটনা বলে মনে হতে লাগলো। ঘুঙুরের আওয়াজ আর গানের ঝংকার ক্রমশই বাড়ছিল! মনে হচ্ছিল ঘটনাটা সত্যি। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। এগিয়ে গিয়ে বাইরের থেকে রংমহল’ এর জাফরী লাগানো জানালা দিয়ে উঁকি মেরে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। জাফরির বাইরে থেকে ঘরের ভেতরের কিছুই দেখা যায়না। সবটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন- আকবর, আনারকলি এবং সেলিমের ত্রিকোণ প্রেমের আখ্যানের মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন।
- দাঁড়াও আনারকলি!
আমি চিৎকার করে উঠতেই, পাশে বসে থাকা
সত্যজিৎ আর সুদীপ্ত আমাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলে বলে- কিরে! কি হলো? চিৎকার করে উঠলি কেন ওই ভাবে? নেশাটা তো দারুন চাগিয়েছে দেখছি? চল, আর এখানে বসে থাকতে হবে না। (সমাপ্ত)
No comments:
Post a Comment