Wednesday, July 29, 2020

শিল্প সাহিত্য ১০৭


বুধবার ১৪ই শ্রাবণ ১৪২৭, ২৯ই জুলাই ২০২০




কবিতা
মৃনাল কান্তি বিশ্বাস
ক্ষুধার বিপ্লব

আমি সাত-রাস্তা মোড়ের রিক্সা চালক শামসের আলী
লকডাউনের জনশুন্য শহরের রাস্তায় কর্মহীন একজন
কয়েকদিন হলো কোনো রোজগার নেই
মাথার  উপর সাত সাতটা মানুষের ভার ।

আমি ক্লান্ত নই তবু
যদিও, অনাহাওে আছি আজ!
বউটা আমার ফিরবার পথ চেয়ে-
তিন বছরের লতুটা না খেয়ে আছে সকাল থেকে।
বৃদ্ধা মা অসুস্থ্য, অন্ধ বাবা  অপেক্ষায়---
সাত বছরের অবুঝ ছেলেটা খাবারের লোভে তাকিয়ে থাকে, ওর বাবা কখন ফিরবে  ?
এগারো বছরের মায়ের মত মেয়েটা, কিছুই বলেনা---
ওর বাবার অক্ষমতার কথা ভেবে।

আমি রিক্সা চালক শামসের আলী ভিক্ষাবৃত্তি বুঝিনা।
এ হাসপাতাল থেকে ঐ ক্লিনিকে ছুটে গেছি রক্ত বেঁচবো বলে
কেউ- তাও কিনলো না!

এবার শুধু একটা ধারালো অস্ত্র চাই
হয় নিজেকে মারবো, না হয় জবাই দেব পুঁজিবাদ।

আমি অতশত বুঝিনা
কিসে কত অপরাধ! কেনই বা হব বিপদগামী?
ক্ষুধার  যন্ত্রণায়---
সমস্ত শহরের পুঁজিবাদ বিক্রি দেব নিলামে।
কচু কাটা করব সব মজুদদার, কসাইখানার চাতালে।
কেউ অভুক্ত থাকলে ক্ষুধার পরিমাণে রক্ত নেব
ছোট্ট লতুটা অনাহারে থাকলে শান্তিধাম মোড় থেকে জ্বালবো আগুন!
তাতে কে পুড়লো?  আর কে হল দগ্ধ! বুঝিনা,
আমার শুধু-
এক কেজি চাল আর দু-মুঠো ডাল চাই।

কেউ খাবে---
কেউ খাবেনা---
কেউ ঘাম ঝরাবে? কেউ থাকবে আরামে---
তা হবেনা---

সামুয়েল মল্লিক 
ফরমালিন ভোর

সবুজ বাতাস চুরি করেছে দলবদ্ধ কর্পোরেট চোর।
সাথে নিয়ে গেছে চড়ুই-এর কিচিরমিচির,
মধুক‚পী ঘাস আর খয়েরি শালিকের পালক।
একদিন ভোরে ঘুম ভেঙে দেখি চারপাশে ধোঁয়ার আসর
বিস্বাদ কমলার মতো ঝুলে আছে ফরমালিন ভোর
সবুজ বৃক্ষরাজির মাথা নেই শুধু পড়ে আছে খন্ডিত ধর।

কমল কুজুর 
কাক ডাকা ভোর

তারপর,
কচুরিপানার আড়ালে আড়ালে লুকিয়ে বেড়ানো
ডাহুকের বিরহী ডাক
তুমি শুনতে পাও এখনো?
নাকি তোমার কর্ণযুগলে শুধুই করে প্রবেশ
কোকিলের বসন্ত রাগ?

মাছরাঙ্গার ঠোঁটের ফাঁকে আটকে থাকা
পুঁটি তোমায় কাঁদায় হররোজ
এসব বিলাসিতা তোমায় মানিয়ে যায় বেশ,
মাছরাঙ্গা নৃশংস নয়
সে শুধু বাঁচতে চায়।

তার চেয়ে বরং অনেক বেশি দায়ী এই আকাশ
বেলা অবেলায় সাদা নীল হলুদের খেলা খেলে
অভাগাদের স্বপ্ন দেখিয়ে যায়,
তারাও সমুদ্রস্রোতের মতোন
স্বপ্ন দেখে
বাসা বাঁধে বালুচরে
থরে থরে
সাজানো স্বপ্নসাধ তাই অল্পেই
ভেঙে ভেঙে লুটিয়ে পড়ে।

তোমার কাক চোখের গভীরতা তবু
আমাকে ডেকে নিয়ে যায়
বারবার
সেই বিষণ্ন নদীটির ধারে
অল্প একটু হাঁটুজল যেখানে
কাপলা ফোটায় মিষ্টি হাসি মেলে।

শম্পা পাল 
যে নদী জন্মের আগেই কবিতা হয় 

গনগনে রুপকথা হয়েছি
লিখতে চাইলে লিখতে পারো
তবে অণু কবিতা নয়
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কবিতা লিখতে হবে
শিরোনাম দিতে হবে যে নদী জন্মের আগেই কবিতা হয়
তারপর সিন্ধু, ব্যাবলিন, মিশর
আমি সব গুছিয়ে নেবো
শুধু নদী ভাঙনের আগে
বেহালাটা আমার হাতে দিও ----

অণুগল্প

অভাবনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা
রানা জামান

তৃণভোজী প্রাণীদের সারিটা বেশ লম্বা। সবাই চারপেয়ে। সবাইকে বিষণ্ন দেখাচ্ছে। ওদের কাউকে না কাউকে বাঘ ধরে নিয়ে এসেছে। এতক্ষণে খেয়ে ফেলেছে কিনা বুঝতে পারছে না। ওরা এ-ও ভাবছে যে খেয়ে ফেললে ওদেরকে দেখা করার জন্য খবর দেবে কেনো?

সারির প্রথমে আছে একটা জেব্রা। শেয়ালের ইশারা পেয়ে গুহার ভেতরে ঢুকলো জেব্রাটা। গুহার ভেতরটায় আলো-আঁধারের মিশ্রণ। ঐ আলো-আঁধারে একটা নেকড়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুকটা কাঁপছে ওর। ইতিপূর্বে ও কখনো কোন নেকড়ের এতো কাছে আসে নি এবং কোন নেকড়ে ওদের কাউকে এতো কাছে পেয়ে হামলে না পড়ে ছেড়ে দেয়নি। সে এ-ও ভাবছে: ভয় পেয়ে এখান থেকে পালিয়ে গেলে ভাইটাকে তো খাবেই, ওকেও খুঁজে পেয়ে ওখানেই খেয়ে ফেলবে। সৃষ্টিকর্তা কী দেহ দিয়েছে ওদের-এরা দেখলেই হামলে পড়ে ওদের উপর ছিড়ে-ফেড়ে খাওয়ার জন্য। এসব ভাবতে ভাবতেই জেব্রাটা গুহার আরো গভীরে ঢুকলো।

ওখানে একটা বাঘকে বসে থাকতে দেখে জেব্রার হৃৎস্পন্দন বাড়তে শুরু করলো। মনে মনে বললো: সব রাক্ষস এক জায়গায় কেনো? ভাইকে ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে ভাগবে নাকি? আপনি বাঁচলে বাপের নাম?
তখন বাঘটা বললো, ভয় নেই জেব্রা, তোমাকে খাবো না। তোমার ভাইকেও খাই নি।
জেব্রা বিনয়ের সাথে বললো, আশ্বস্থ করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ব্যাঘ্র মহাশয়।
-কী ব্যাপার? প্রাগৈতিহাসিক কালের সম্বোধন কেনো? বাঘ স্যার বলো, শার্দুল স্যারও বলতে পারো। যাকগে।
যেজন্য তোমাদের ডেকেছি।
-বলুন শার্দুল স্যার!
বাঘ মুচকি হেসে বললো, আদিপিতা থেকে শুরু হয়েছে আমাদের শিকার ধরার জন্য ছুটাছুটি। আমরা কখনো কোন খাবার পাতে পাই না। প্রচণ্ড ছুটাছুটি আর দৌড়াদৌড়ির পর একটা শিকার ধরে ওটাকে মারার পর খেতে শুরু করবো না শ্বাসপ্রশ্বাস সামলাবো! কী একটা অবস্থা তখন! পৃথিবী এখন অনেক এগিয়েছে। খাবারের পেছনে ছুটাছুটির দিন শেষ করতে হবে। তাই সিংহ মহারাজের সাথে আলোচনা করে আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেটাই তোমাদের জানাবো। তখন তোমরাও আমাদের দেখে ভয়ে ছুটাছুটি করবে না।
জেব্রা অত্যন্ত খুশি হয়ে বললো, তাহলে সিদ্ধান্তটা তাড়াতাড়ি বলুন শার্দুল স্যার!
তুমি প্রতি মাসে দশটা দু’পেয়ে প্রাণী দেবে। খবরদার! বক দেবে না কখনো! বকের গায়ে শুধু হাড্ডি! তুমি তোমার গোত্রের সবাইকে এই ম্যাসেজটা জানিয়ে দেবে।
আমার ভাই শার্দুল স্যার?
পাঁচটা মুরগি দিয়ে নিয়ে যাবে। যাও এখন। পরেরটাকে পাঠাও।
জেব্রা গুহা থেকে বের হয়ে কারো কথার জবাব না দিয়ে ঢুকে গেলো জঙ্গলে।

চিত্রা হরিণটা শেয়ালের ইশারা পেয়ে ভেতরে ঢুকে নেকড়ে দেখে কাঁপতে লাগলো থরথর করে। মনে মনে বললো: যেহেতু জেব্রা বেরিয়ে গেছে অক্ষত দেহে, সেহেতু ওর-ও কিছু হবে না।
নেকড়ে নরোম গলায় বললো, আরেকটু ভেতরে যাও চিত্রা। ওখানে মহামন্ত্রী বাঘ বসে আছে।
বাঘের নাম শুনে কাঁপুনি বেড়ে গেলো চিত্রা হরিণের। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলো সেখানেই।
পতনের শব্দে বাঘ এগিয়ে এসে নেকড়েকে বললো, নাকেমুখে পানি ছিটিয়ে ওর জ্ঞান ফেরাও নেকড়ে।

এভাবে একের পর এক তৃণভোজি প্রাণী গুহায় ঢুকে বাঘের নির্দেশ নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে জঙ্গলে।

এক সময় খরগোশ ঢুকলে বাঘ ক্ষেপে গিয়ে বললো, তুইও লাইনে এসেছিস? তুই তো আমার কাচ্চি বিরিয়ানি!
তোকে তো রেহাই দিতে পারি না! বলেই বাঘটা খরগোশকে খপ করে ধরে দুই কামড়ে খেয়ে ফেললো চিবিয়ে। একটা পায়ের কিছু অংশ থাবা ফসকে মাটিতে পড়ে গেলে নেকড়েটা দ্রুত তুলে পুড়ে নিলো মুখে।

তখন গুহা কাঁপিয়ে একটা হাতি ভেতরে ঢুকে বললো, আমিও ঘাস খাই। আমাকে ডাকলে না কেনো বাঘ। তুমি তো এখন মহামন্ত্রী!
তখন মহারাজা সিংহ এসে বললো, আপনি আমার মন্ত্রীপরিষদের সম্মানিত সদস্য। আপনি কল্যাণ মন্ত্রী ঐরাবত।
ঐরাবত বললো, বাহ! তাহলে আমার খাবার এনে দেবে কে?

ধারাবাহিক গল্প
পচন
স্বপঞ্জয় চৌধুরী

চার
বস্তিতে হৈ চৈ পড়ে গেছে। ফুলমন বিবির ঘরে কুড়িয়ে পাওয়া নবজাতক শিশু। সবাই এক নজর দেখতে ভিড় জমালো ফুলমন বিবির ঘরে। হৈ চৈ ঠেলে বস্তির মাতবর ঘরে ঢুকলো। কোন পাপের বীজ ঘরে আনছো ফুলমন? যেইখান থিকা নিয়া আসছো সেইখানে রাইখা আসো। বুড়া বয়সে ঝামেলা করার দরকার কী? অন্য একজন জোয়ান বললো এইডাতো মানুষের মতো কথা হইলোনা মাতবর সাব। শত হইলেও এইডা মানুষের বাচ্চা, কুত্তা বিলাইয়ের বাচ্চা না। সকলেই মাথা নেড়ে বলে, হ ঠিকই কইছো। অন্য একজন বৃদ্ধা মহিলা বললো- তোমরা কি খালি প্যাঁচালই পারবা? বাচ্চাডারেতো আগে বাঁচানো লাগবো নাকি? ওর দুধ খাওনের ব্যবস্থা করো। অন্য এক মহিলা বললো- এইমুহূর্তে ওরে মায়ের দুধ দেওন লাগবো। কিন্তু দুধ দিব কেডায়? বলে ওঠে অন্য এক মহিলা। ঘরের ভিড় আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এক বৃদ্ধা বলে উঠলো, আচ্ছা কুসুমেরতো দুধের বাচ্চাডা মইরা গেলো। ওর কাছে নিলেতো মনে হয় কাম হইতো। অন্য এক বৃদ্ধা হাহুতাশ করে বলে- আরে, পর পর দুই বাচ্চা মরলো তারপর গত হপ্তায় গাড়ির তলে পইড়া ভাতার মরলো, ওর কি এহন মাতা ঠিক আছে? ওতো একটা পাগলি! একথা বলতে না বলতেই কেউ একজন ভিড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। কেউ একজন ঠাট্টা করে বলেছিল, তোর ছেলে ফিরে এসেছে। একথা শুনেই ও ছুটে আসে। দে আমার পোলারে, দে বুড়ি। এই বলেই ফুলমনের কাছ থেকে নবজাতকটিকে চিলের মতো ছোঁ মেরে কোলে নেয় কুসুম। সকলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে যার যার ঘরে ফিরে যায়।
(চলবে...)

2 comments:

  1. বাংলা কবিতা ভালবাসার গল্প পেতে আমাদের ওয়েবসাইটি ভিজিট করুন
    চিরকুটবিডি.কম

    ReplyDelete

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক