Saturday, July 11, 2020

শিল্প সাহিত্য ৮৯

শনিবার  ২৭শে আষাঢ় ১৪২৭, ১১ই জুলাই ২০২০



কবিতা
মীর সাহাবুদ্দীন
প্রতিশ্রুতি

ইচ্ছে থাকলে বাস ট্রাক গাড়ি ছাড়া আসা যায়
এখানে স্বপ্নের কথা বলছিনা
তোমার চলে যাবার আবাস পেয়ে বলেছিলাম
শুধু দশ দিক নয় দশটা পুরুষ দেখে এসো...

পায়ের পা দিলে তোমার শূন্যতা বেড়ে যায়
অথচ পৃথিবীও জেনে গেছে একদিন পুরুষের আকাল হবে।

আভাবের দিনে তুমি থাকলেও আমি থাকছিনা
ক্ষুদ্র সময় পর তোমাকে আসতেই হবে
সেসব প্রতিশ্রুতির কথা সাজিয়ে রোপণ করছি

আপন রহমান
আজন্ম অন্ধকার

হৃদয়টা এখন শূণ্যতার চিলেকোঠা
বেদনার রুমালে মুছে নিয়েছি
সোনালী অতীত।

হারাতে হারাতে হারিয়েছি সব, সবকিছুই; কিছুই নেই বাকি...
-না প্রেম
-না ভালবাসা
-না স্মৃতি ।

শূণ্য হৃদয়ের খোলা উঠানে আজ বিলি কাটে দুখী বাতাস
না কিছুই নেই-কেউ নেই!

সব কিছু গিলে খেয়ে গেছে
কালের দানব-
আমার সোনালী স্বপ্নগুলো
স্নায়ুর ইচ্ছে গুলো
পুষ্পিত বসন্ত গুলো
-হারিয়ে গেছে;
হারিয়ে গেছে আজন্ম অন্ধকারের বুকে...

আমার হারিয়ে যাওয়া;
প্রথম ভোরের সূর্যটাও
আজ আলো দেয় অন্যের আকাশে...
তাই আজ আমার সঙ্গী
সোনালী স্বপ্ন নয়, পুষ্পিত বসন্ত নয়
চৈতালি সন্ধ্যাও নয়
আজন্ম অন্ধকার...!

ছেঁড়াকাব্য-৭ 
বিনয় কর্মকার

[ সাঁইত্রিশ ] 
আমি ফুল ছেঁড়ার বিপক্ষে, 
তুমি; আমাকেই উপড়ে ফেললে!

[ আটত্রিশ ]  
এইযে ওঠানামা;
অজস্র আয়ুষ্কালের ছেদ, সিঁড় ডিঙানোর ইতিহাস। 
সিঁড়ির একটা ধাপকেও  কোনদিন ওপর নিচ হতে দেখিনি! 
তাই বলে ভেবো-না পৃথিবী স্থির।

[ ঊনচল্লিশ ]
মৃত্যু দেখতে কি প্রেমিকার মতো?
নইলে কেনো সামনে ভাসে তোমার মুখ!
প্রেমের সংজ্ঞা জানা থাকলে বিষয়টা ভাবনার খোরাক। 

[ চল্লিশ ]
ইচ্ছে করেই জীবন থেকে দূরে থাকি,
পাছে জীবনের প্রেমে-না, পড়ে যাই! 

[ একচল্লিশ ]
জানাশোনা বলেই সাধারণ; অজানায় বিস্ময় থাকে।
তাচ্ছিল্যে কতো-কী হাওয়ায় ওড়াই;
অথচ;
এক টাকার কোটি কয়েনে; এক কোটি টাকাই হয়! 

[ বিয়াল্লিশ ]
হারিয়ে যেতেও, পেরোতে হয় অনেকটা পথ।
চেনা মানুষ, চেনা শহর-বন্দর, চেনা নদী, চেনা অরণ্য...
নিখোঁজ হতে গেলে পেরিয়ে যেতে হয় পড়শি বাড়ির সীমানা!

দ্বীপ সরকার
বিরান হওয়ার রাত

একটা বিরান হওয়ার রাত-
জামদানি কুয়াশার ভেতরে, চারপাশে জ্বালাময়ী ঝোপঝার
লুণ্ঠণের আওয়াজ থেকে আসছে রাতের ডাক
কবরের পাশে বসে বসে রাতকে করছি আয়ত্ব
অদ্ভুত অপেক্ষা সব!   

সেদিনের সেই ভৌতিক রাতের কথা ভুলিনি-
ক্ষণে ক্ষণে বিরান হচ্ছি, বিরান হচ্ছে পাশে বসা রাত
ভয়ার্ত শিয়ালের ডাকে নেচে উঠছে শরীর
হাতের কবজি জুরে পেতনিদেও ছায়া পড়ে আছে যেনো
বৃক্ষের মর্মরও বেশ ঢুকে পড়ছে, শিউরে উঠি
কাঁপে গলার ভেতরকার অনুগত আওয়াজ!

তবুও নিজেকে দাঁড়িয়ে রেখেছি, বসে রেখেছি-
আরেকটু পরেই ঢুকে যাবো কাঙ্খিতের গতরে
অপেক্ষার ভেতরে আরো কতোনা ব্যাপার থাকে বাপু!

ছোটগল্প
টিন এজ লাভ
জাহিদুল মাসুদ

ওটা কে? রুবিনা না! হ্যাঁ, রুবিনাই তো।
কি আশ্চর্য! এই নির্জন মাঠে একাকী রুবিনা! মাঠের দক্ষিণ দিক থেকে নির্জন মেঠোপথ ধরে একাকি হেঁটে আসছে। ওর পিছনের পটভূমিতে এই নির্জন মাঠ, আরও পিছনে ধূ ধূ করছে রসূলপুর গ্রাম। পরনে সালোয়ার কামিজ, বাতাসে মৃদু উড়ছে ওড়না।

ইনছানের বুকের মধ্যে হৃদকম্পন শুরু হয়ে গেলো। গত তিন চার বছর ধরে সে রুবিনাকে তার মনের কথা বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই পারছে না। কখনো রুবিনাদের স্কুল মাঠে দেখা হয়ে গেলে বলার চেষ্টা করে, কখনো ওদের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে কোথাও যাবার সময় দেখা হয়ে গেলে বলার চেষ্টা করে। কিন্তু বলতে পারে না। কখনো ওর সাথে কেউ না কেউ থাকে। কখনো কেউ ওর সাথে না থাকলেও এতই হৃদকম্পন বেড়ে যায় যে ও কিছু বলতেই পারে না। তাই সে কখনো অন্য উপায় খোঁজে। কখনো ওকে লেখা চিঠি বুক পকেটে রাখে, সুযোগ পেলে ওর হস্তগত করবে বলে। কিন্তু সুযোগ কখনো এলেও সে সুযোগ সে কাজে লাগাতে পারে না। বাড়িতে এসে চিঠিটা লুকিয়ে রেখে দেয়। সকালে বের হওয়ার সময় আবার পকেটে ভরে। চিঠিটা আবার ফেরত আসে, কোনদিন কোন সুযোগ তেরী হয়না, কোনদিন সুযোগ তৈরী হলেও কাজে লাগাতে পারেনা। তবে কিছুদিন পরপর চিঠিটা নতুন হয়। নতুন ভাবনা এলে সে আবার নতুন একটা চিঠি লিখে আগেরটা পুড়িয়ে ফেলে। তারপর নতুন চিঠিটা সে বারবার পড়ে আর কল্পনা করে রুবিনা তার চিঠি পড়ছে। পড়তে পড়তে রুবিনার মন ও মুখমন্ডলে কেমন শিহরণ হচ্ছে-তা সে অনুভব করে। সেই অনুভব নিজের শরীর ও মনে মেখে নেয়। এভাবে দিন যায়, মাস ও বছর পার হয়, তার চিঠির সংখ্যা বাড়ে, চিঠির ভাষা পরিপক্ব হয়। লিখতে লিখতে কিছু কথা কবিতা হয়ে যায়। ইনছান কবি হয়ে ওঠে। কিন্তু রুবিনা এসবের কিছুই জানতে পারে না। হয়তোবা জানতে পারে। পারে কি? ইনছান যখন ওর সামনে দাঁড়ায়, নার্ভাস ফিল করে, চোখ তুলে ঠিকমতো তাকাতে পারেনা, কথা বলতে গিয়ে জবান আটকে যায়- কেন যায়? রুবিনা কি এসব বোঝে না? বোঝে হয়তো। কিন্তু ইনছানের মনের সাথে সে যোগাযোগ হয় না। আজ ইনছানের ভালোবাসার কথা বলার জন্য আবার একটা সুযোগ এসেছে,  সুবর্ণ সুযোগ। এই নির্জন মাঠের নির্জন মেঠোপথ ধরে প্রায় বিশ মিনিট সে পাশাপাশি হাঁটার সুযোগ পাবে। এর মধ্যেই তাকে কথাটা বলে ফেলতে হবে।

শেষ বিকেল। মাঝ মাঠ। চারদিকের গ্রামগুলো দুরে সরে গিয়ে ধূ ধূ করছে। কৃষকরা ইরি ধান আবাদ করার জন্য মাঠে নামতে শুরু করেছে। মটর পাম্প থেকে তারা পানি সেচ করে এই শুকনো মাটি ভিজাবে, পাওয়ার টিলার দিয়ে কাদা মাটি চাষ করে ধান রোপন করবে। রুবিনার বাবা হয়তো তাঁর মটর পাম্প নিয়ে মাঠে নেমে পানি সেচ করতে শুরু করেছে। রুবিনা হয়তো ওর বাবাকে রাতের খাবার দিতে গিয়েছিল। এই সময়টা কৃষকরা এত ব্যস্ত থাকে যে খাবার জন্য তারা বাড়ি যাওয়ার সময় পায় না।
ইনছানরা এখনো মাঠে নামেনি। তার বাবা তাকে জমি দেখতে পাঠিয়েছিল। দুই একদিনের মধ্যে তারাও আবাদ করার জন্য মাঠে নামবে।
মাঠের মাঝখান দিয়ে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা। রাস্তাটি গ্রাম থেকে নামতে নামতে মাঠের মধ্যে নেমে এসেছে। মাঠের মধ্যে নেমে রাস্তাটির উচ্চতা কমতে কমতে মাঠের জমির সাথে মিশে গেছে।
এই রাস্তা ধরে দক্ষিণ দিক থেকে হেঁটে আসছে রুবিনা। ইনছানদের জমির পূব ঘেঁষে এই রাস্তা। ইনছান তাদের জমির আল ধরে এমনভাবে হেঁটে রাস্তার দিকে আসছে যাতে তারা দুজন একসাথে মিলিত হয়।
হলোও তাই। ইনছান রুবিনার সাথী হলো। কাছাকাছি হতে ইনছানের হৃদকম্পন আরও বেড়ে গেলো। কিন্তু রুবিনার কি তাই হলো? রুবিনা নতমুখে হাঁটছে, যেন সে ইনছানকে চেনে না। কি সুন্দর মেয়ে রুবিনা! এত সুন্দর মেয়ে সে জীবনে দেখেনি। তার গায়ের রঙ ফর্সা, ছিপছিপে শরীর। নাকটা সরু, ফর্সা থুতনিতে একটি কালো তিল। এই তিলটাই রুবিনার সৌন্দর্য শতগুণে বৃদ্ধি করেছে।
ইনছান কাপা বুকে অন্য কথা বললো, ‘কোথায় গিয়েছিলে?’

রুবিনা নতমুখে বললো, ‘জমিতে’।
প্রশ্নটা করেই তার অস্বস্তি হলো। প্রশ্নটা করা কি অর্থহীন হয়ে গেলো! ও যে জমিতে গিয়েছিল এটাতো জানা কথা। সে বললো, ‘তোমাদের আবাদের কাজ শুরু হয়েছে? ' ইনছানের গলা কাঁপছে?
রুবিনা নতমুখে বললো, ‘হ্যাঁ’। 
‘তোমার বাবাকে খাবার দিতে গিয়েছিলে?' রুবিনা বললো, ‘হ্যাঁ’। রুবিনার স্বরও খুব নিচু। ওর বুকের মধ্যেও কি ইনছানের মতো হৃদকম্পন হচ্ছে?  কি জানি, ইনছান বুঝতে পারছে না। আর কিছু বলার মতো কথাও সে খুঁজে পাচ্ছে না। কেবল নিরবে পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। মাঠ জুড়ে হিমেল হাওয়া বইছে। ইনছানের বুকের মধ্যে মাত্র একটি বাক্য ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘রুবিনা, আমি তোমাকে ভালবাসি।’ বাক্যটা বুক থেকে গলা পর্যন্ত উঠে আসছে; কিন্তু মুখ থেকে কথাটি বের হচ্ছে না। সে বারবার চেষ্টা করছে। এইতো, কথাটা সে বলে ফেললো প্রায়, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি রুবিনা।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর কথাটা গলা বেয়ে বের হচ্ছে না। আজ তার পকেটে কোন চিঠিও নেই। ইস! তার পকেটে প্রায় প্রতিদিন চিঠি থাকে। কিন্তু আজ কেন যে সে চিঠিটা পকেটে তুললো না! বড়ই আফসোসের কথা। আজ সে চিঠিটা অনায়াসেই দিতে পারতো। আর শেষ চিঠিটার ভাষা বেশ পরিপক্ক আর কাব্যিক হয়েছিল। এই চিঠিটা পড়লে রুবিনা ইনছানের কাব্যিক মনের সন্ধানও পেত। কিন্তু তা আর হলো না। আফসোস! দুটি মানুষ এভাবে নির্বাক হাঁটাও অস্বস্তিকর। কেবল এই মাঠ, শেষ বিকেলের হিমেল হাওয়া অনেক কথাই বলছে যেন। রুবিনা যেন এই হিমেল হাওয়া হয়ে সারা মাঠে ছড়িয়ে পড়েছে ।

সামনে একটি পুকুর। মাঠের মাঝখানের এই পুকুরটার ইতিহাস ইনছান জানে না। সে ছোটবেলা থেকেই  দেখে আসছে। পুকুরের চারপাশে কয়েকটা তালগাছ, ঝোপঝাড়। বর্ষা কালে যখন সারামাঠ পানিতে ডুবে যায় তখন তাদের বাড়ি থেকে এই তালগাছ দেখা যায়। পুকুর পাড়ের ধার দিয়ে রাস্তা। এই নির্জন রাস্তায় উঠেও ইনছান কথাটি বলতে চায় কিন্তু পারে না। এভাবে হাঁটতেও তার অস্বস্তি লাগছে। নিজের শরীরটাকে যেন খাপছাড়া কিছু মনে হচ্ছে। কিছু না বলে এভাবে হাঁটার কোন মানে হয়? ওর পিছনে পড়াটাও বিব্রতকর। এই পৌষ মাসেও যেন ঘামছে ইনছান। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

পুকুরটাকে তারা পিছনে ফেললো। সামনে তাদের গ্রামটা এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বিকেলটাও শেষ হয়ে এসেছে। চরাচরে সন্ধ্যার অন্ধকার ঝিরঝির করে ঝরে পড়ছে।
গ্রামটা শুরু হয়েছে যে বাড়ি দিয়ে সে বাড়ির সামনে একটি খড়ের পালা। বর্ষার পানির সাথে লড়াই করে টিকে আছে এই পালাটা। এই পর্যন্ত এসে কিছু বলতে না পারার উত্তেজনায় ইনছানের মনের চাপ প্রচন্ড বেড়ে গেলো। সে কোন মতো বলে ফেললো, ‘শোন’।
রুবিনা দাঁড়িয়ে গেলো, ‘কিছু বলবেন?’
রুবিনার বলা এই শব্দ দুটি তার হৃদকম্পন আরও বাড়িয়ে দিল। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে ইনছান; কিছু বলতে পারছে না।
রুবিনা এই প্রথম চোখ তুলে ইনছানের দিকে তাকালো। সন্ধ্যার নরম আলোয় রুবিনার সুন্দর মুখটা দেখা যাচ্ছে। আহা! কি সুন্দর মুখটা রুবিনার! সে মুখে আবার হাসি। বুকটা ভরে গেল ইনছানের। রুবিনা মৃদু হেসে চোখ নামালো। ইনছান হঠাৎ বলে ফেললো, ‘হাসছো যে!’
রুবিনা মৃদু হেসে বললো, ‘আপনার অবস্থা দেখে হাসছি। একটি কথা বলার জন্য সারা মাঠ হেঁটে হেঁটে চেষ্টা করলেন; তবু কথাটি বলতে পারলেন না। ‘রুবিনার এই মৃদু হাসি থেকে কি মিষ্টি তাচ্ছিল্য ঝরে পড়ছে?
ইনছান এবার বলতে পারলো, ‘আমি যে তোমাকে একটি কথা বলতে চাই, তা তুমি কি করে বুঝলে?’
‘মেয়েরা এসব কথা বুঝতে পারে।’
ইনছান উত্তেজিত, ‘তাই নাকি! আমি কি বলতে চাই, তুমি তা জানো?’
রুবিনা কেবল মৃদু হাসলো, কিছু বললো না।
‘আচ্ছা, বলোতো দেখি, আমি কি বলতে চাই?'
রুবিনা আবার চোখ তুলে তাকালো,‘আপনার কথা আমি কেন বলবো? আপনার কথা আপনাকেই বলতে হবে।’
রুবিনার মুখে সন্ধ্যার আলো আধারী। কিন্তু সে আধার থেকেও ওর চোখ দুটো জ্বলছে, ভালোবাসার আলোয়।

No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক