Sunday, July 26, 2020

শিল্প সাহিত্য ১০৪


রবিবার ১১ই শ্রাবণ ১৪২৭, ২৬ই জুলাই ২০২০




কবিতা
উপেক্ষিৎ শর্মা
কবিতা

কবিতা আমার কাছে ছিন্নভিন্ন প্রেমের অবশেষ
যেটুকু শব্দ থাকে জোড়া
অক্ষরে বিন্যাসে, সব
পতিতালয়ের মত স্নিগ্ধ ও রোজগেরে

কবিতা কি শব্দ চেনে?
বাক্য ও বিন্যাস?
জ্যোৎস্না মাড়িয়ে গেলে
মরা চাঁদ দৃশ্যমান হয়
কবিতার পিনকোডহীন অন্য ঠিকানায়

সুখের সেদিন
যেদিন ঢেউ আর নুন থাকে
সদাব্যস্ত গোধূলির মত
সেইদিন কবিতায় রাত্রি নামে
সাপের খোলসে
সেইদিন কবিতার স্পষ্ট হারাকিরি
কালি ও কলম ছুঁয়ে প্রেমের তাড়সে...

কবিতা আমার কাছে,
ছেঁড়া ফুল,
পাপড়িগুলো ছড়ানো ছেটানো,
কফিনের শ্বেতশুভ্র রঙীন অবকাশ...

দেবাশীষ চক্রবর্তী
প্রেম এখন

খোলা চাঁদে আজও ভাসে
অতৃপ্ত যৌবন
পুরুষের রমণী হতে চেয়ে আমারি শবদেহে রাত্রিযাপন
জলপদ্মের আবেশে সর্পবিষে গাঢ় প্রেম
শরীরী উষ্ণতায় ভরা উচ্ছ্বাস
পৌরুষ স্পর্শে ছুঁয়েছিল হাত
সেতো আমারি মৃতদেহ বোঝনি
বিভঙ্গীয় রেখার ঋজু বৈভবে
প্রেমিক হতে চেয়ে
পুরুষ হতে পারিনি
ভাঙ্গা চাঁদে আজও ভাসে অহংকারী যৌবন
পুরুষের রমণী হতে চেয়ে আমারি শবদেহে রাত্রিযাপন

অভ্র আরিফ
স্পর্শে তোমার শুদ্ধতা

যেখানে তোমার হাত পড়ে সেখানেই আশ্চর্য সুভাস
তোমার হাত কি তবে পদ্মফুল, আঙুলগুলো পদ্মপাপড়ি?
তোমার স্পর্শ পাওয়া শুকনো পাতা ঘিরে উড়ে বেড়ায় এক ঝাঁক ভ্রমর।

অমল ধবল হাতের ছোঁয়ায় তোমার,
প্রজাপতি হয়ে যায় ঝালমুড়ির ঠোঙা, পাখি হয়ে যায় লেখার কাগজ, কবিতার বই
পরশ পেয়ে হাতের-  মুমূর্ষু ফুল মুখ তুলে চায় নতুন করে, নুড়িও হয়ে যায় সোনা।

একদিন, বৈশাখী মেলা থেকে কিনে এক গোছা চুড়ি হাত গলিয়ে পড়লে তুমি,
রবিশংকরের সেতার হয়ে বাজলো টুড়িগুলো, গান শুনালো মাটির পাখি,
তোমার স্পর্শ পেয়ে নেড়ি কুকুর হিংস্রতা ভুলে টিএসসির মোড়ে প্রেমের গান গায়।

যেটুকু ছুঁও তুমি, সেটুকুতে আলোর রোশনাই, গুচ্ছ গুচ্ছ গোলাপফুল,
যেভাবে স্পর্শ করো তুমি, সেভাবে উম পায় পক্ষীছানা, পক্ষীর চোখে মুগ্ধতা
নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙ্গুলকে তাই আশ্রয় দিও নগ্ন করপুটে- স্পর্শে তোমার শুদ্ধতা।

বিপুল রায়
শেষ

কিসে যে কি হয়, মন জুড়ে ভয় ভয়, কত কথা শুনে যাই কানে।
রাত কেটে দিন আসে, কেউ থাকে না পাশে, কোন কথার ঠিক কি মানে?
হাঁটা পথে গাড়ি চড়ি, গলি থেকে গলি ধরি
রাজপথ ঠিক কতদূর?
যেতে যে হবেই হবে, চিরকাল কে কবে, ডাক দেয় কোন সে সুদূর!
আমি সে আমি নই, ফুটপাত জুড়ে বই, সেক্সপিয়র, কিটস, বায়রণ।
হাতে পুরোনো বই, পথে ছড়ানো খই, পিছনে পড়ে থাকা যে বারণ।
কেন এই ভয়ভাব, মনে কেন উত্তাপ, পথে থেকে ছুটি পথে পথে।
যেভাবে দিন কাটে, সে পথেই রাত হাঁটে, জীবন বাঁধা যেন গঁতে।

কিসে যে কি হয়, মন জুড়ে ভয় ভয়, কত কথা শুনে যাই কানে।
আকাশে আকাশ মেশে, কে দাঁড়ায় গা ঘেঁষে, কে জানে- কার শেষ ঠিক কোনখানে?

আল্পনা মিত্র 
যদি

আপন-ঘর, ভাবিস পর, তবে সে ঘর অন্ধকার,
মনের ঘড়ি! থামিয়ে তড়ি, টানিস দড়ি ভালবাসার।
নিজেই তবে, নিঃস্তব্ধে, হারাবি সবে মলিনতায়,
থাকবি বসে, একলা শেষে, মনপ্রকাশে অজ্ঞতায়।
হয়তো আমি, নয়ত দামী, শিখড়গামী উচ্চতায়,
চাতক হয়ে, জল না ছুঁয়ে, থাকবি চেয়ে জল-আশায়।
রোদ চশমা, করে ঝাপসা, বাষ্প আশা ভাবান্তর,
তাই বলে কি, দুখ বাহকি, হবে সাবেকি নিরন্তর!
সূর্যদয়ে, চন্দ্রোদয়ে, নামচা নিয়ে ভাবিনা রোজ,
নিজ খেয়ালে, ছন্দ তালে, উঠবো দুলে, যে রোজ রোজ।

ধারাবাহিক গল্প
পচন
স্বপঞ্জয় চৌধুরী
       
এক
সারাদিনের ভিক্ষাকর্ম সেরে ফুলমন বিবি তার বস্তিতে ফিরছে। যেমনটি আপনি আমি ফিরি অফিস কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। কারো উদ্দেশ্য অর্থ আবার কারোবা অর্থের জন্য বিদ্যা। ফুলমন বিবির উদ্দেশ্য বাঁচার জন্য ভিক্ষা করা। স্বামী গত হয়েছে প্রায় বিশ বছর আগে। ছেলেপুলে বিয়ে থা করে আলাদা সংসার পেতেছে। বৃদ্ধা মায়ের দিকে ফিরে তাকাবার সময় সময় ওদের নেই। তারপরও মানুষ বাঁচতে চায় একান্ত বাঁচার জন্যই। ফুলমন আজ ভিক্ষা করে পেয়েছে সাতান্ন টাকা পঁচিশ পয়সা আর সোয়া দুই কেজি চাল। শহুরে মানুষগুলো অনেক কৃপণ হয়ে গেছে। আর হবেইবা না কেন, ভিক্ষাবৃত্তির নব নব কৌশলের সূত্র ধরে  ফেলেছে শহরবাসী। আমার বৌ এর অসুখ, মেয়ের বিয়ে, পরীক্ষার ফিস, ছেলে হাসপাতালে এরকম আরো কত উপায়ে যে ভিক্ষা নেয়া হচ্ছে বাস, লঞ্চ, পথেঘাটে, দোকানপাটে সব জায়গাতে! সেখানে ফুলমন বিবিদের মতো অদক্ষ অভিনেত্রীদের সুযোগ কমই বৈকি।

বাজার থেকে তেল, নুন, তরিতরকারি কিনতেই সব ফুরিয়ে যায়। তার উপর আবার প্রতিমাসে বস্তির ঘর ভাড়া তিনশত টাকা দিতে হয়। ফুলমন বিবিরা সমুদ্র যাত্রায় হেঁটে চলা কচ্ছপের মতো প্রতিদিনের ভিক্ষাকর্ম সেরে রাজধানীর অভিজাত পথ মাড়িয়ে বস্তির কুঁড়েঘরে ঠাঁই নেয়।
                                                                                                                                                    (চলবে...)

গদ্য

কবিতা ও বাংলা কবিতা বিষয়ে 
সাজ্জাদ সাইফ

১.
কবিতা এক অনুভ‚তির নাম, সেন্স, যা ভাষার গায়ে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নেয়।
সেই বিশ্রাম অনন্য। সত্যিকারের হিভেনলি আরকি। শিল্প এই অনন্যতারই ধারণা। জীবন আর প্রকৃতি, মৃত্যু আর জন্ম, স্মৃতি আর স্বপ্ন, ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়া, সুখ আর অসুখ, সম্পদ আর দারিদ্র্য, বিলাস আর সগ্রাম কেউ কারো অনাত্মীয় নয় শিল্পে।
‘যেভাবে কবিতা হয়’ মানে নির্মিতিটাই শিল্প, অনুধ্যানের সন্ধান করে কবিতা আর কবি সেই অনুধ্যান সহযোগে পৌঁছায় কবিতা অব্দি অর্থাৎ সে-ই অনুভূতিটা ‘যে নিজে ভাষার গায়ে হেলে আরাম করছে বিশ্রামে’, কবি সেই সেন্সটার দেখা পায় ছোঁয়া পায় ঘ্রাণ পায় স্বাদ পায়।
এই অর্থে কবি একজন সাধক নিজ জগত সংসারে, নিজ ভাষাতে উপবিষ্ট। জীবনানন্দ বা রবীন্দ্রনাথ, হুইটম্যান বা জন মিল্টন, অডেন বা বোদলেয়ার, যে কবিকেই বিশ্লেষণ করুন দেখবেন সেখানে এক সন্ধানী সত্তা উপস্থিত। কিসের সন্ধান সেটি?
একই কথা এখানেও, সন্ধান সেই অনন্যসাধারণ অনুভ‚তির, আত্মতত্ত¡ যাকে বলে মোক্ষ আর এইখানে বাহনের নামটি হলো ভাষা, ধ্বনি-অক্ষর-চিহ্ন সহযোগে।
এই যেমন এইদিকে বৃষ্টি হইলো আজকে। দুপুরের বৃষ্টি। গ্রীষ্মের বৃষ্টি। ‘বৃষ্টি’ বা ‘দুপুর’ বা ‘গ্রীষ্ম’ এই যে একেকটা ধ্বনি-বর্ণ-অক্ষর-শব্দ, এরা নিজ নিজ গুণে একক সব অভিজ্ঞতার ভার বহন করে আর ব্যক্তিভেদে বিবিধ ইন্দ্রিয়কে প্রভাবিত করে, আর ভাষায় হেলান দিয়ে এই প্রভাবের চিত্রনাট্যটা লেখেন একজন কবি। মানে এই যে এই লেখার খেলাটা যিনি খেলেন তিনিই কবি, একটা বিশেষ মনস্তত্ত¡ বয়ে বেড়ান 
কবিরা। এইটা সংসারে থেকেই করেন কেউ কেউ, সংসারহীন কেউ-বা।
কবিতা আলো-অন্ধকার-দেখা-অদেখা-জানা-অজানা-চেনা-অচেনা যেকোনও আকার বা নিরাকারকে লেখ্যরূপে উপস্থাপন করে থাকে, জগতের অন্যান্য কাজের মতই এইটা একটা কাজের ফলাফল। সেই কাজ কবির। অন্যরা তা করে না তাই অন্যরা কবি নন।
এই লেখাটা হাইপোথেসিস বৈ বিশেষ কিছু নয়। সত্যিই ব্যপারগুলা এমন। বায়োলজিকাল।

২.
মালার্মে ইউরোপে যেই প্রতীকি আকার দিতে চাইছিলেন কবিতারে, আবার বোদলেয়ার, সেই কাজটা এইখানেও সমভাবেই হইছে, আগে আর পরে, এটাই ভিন্নতা। মধ্যযুগ মোটেও শূন্যতা নয় এই ব্যাসিসে। আর চর্যাপদ একটা ইউনিক সম্পদ বিশ্ব-সাহিত্যে। রামায়ন বা মনসামঙ্গল কোনটাই ফেলনা নয়। বাংলা কবিতা তার স্বরূপ নিয়া রাজনীতি করে নাই বিধায় প্রাতিষ্ঠানিক সারবত্তার প্রসঙ্গে বাংলা কবিতা পিছিয়ে। এই পশ্চাদপদতা উপনিবেশের শঠতা বৈ কিছু নয়। আর, প্রভাব সে যে কোনোভাবেই বিস্তৃত হতে পারে। আদি বাংলার চিত্রশিল্পের স্বত্ব নিয়ে যেমন মধ্য এশিয়ার গৌরব-রথ চালিত!
উপমহাদেশীয় শিল্পে বাংলা কবিতা সগৌরবে উজ্জ্বল আর বৈশ্বিক পটে সাংস্কৃতিক স্বীকৃতির বর্তমান সমস্ত মানদন্ড ইউরো শিল্পের আরোপিত সত্য, স্বয়ংক্রিয় নয়। হুইটম্যান যা নজরুল তার চেয়ে বামন নন, গোর্কী বা মানিক কেউই কারো চেয়ে হীন নন বরং উঁচু দেখানোর চেষ্টাটা আরোপিত সত্যই একইভাবে।
মাইকেলের কাজ কোনো অংশে শেক্সপিয়ার হতে নিচ নয়। আসলে মানদন্ডের ধারণাটাই কৃত্রিম, এতোটাই যে একে বর্ণবৈষম্যের দোষ দেয়া কোনো দূষণ বা নৈরাজ্য নয় একদম।

শিল্প ও কবিতা নিয়া সঠিক কথা কইতে পারা লোক সামান্যই আছে এই বঙ্গদেশে, যারা আছে তাদেরও অধিকাংশ মিডিয়ার কাছে সত্ত¡াকে বিক্রি করা লোক, যারা অবিক্রিত তাদের সম্মান করি ও ভালোবাসি। খালি কয়টা দেশি বিদেশী মুভির গল্প, কয়টা ইউরোপীয়-কলিকাতাইয়া শিল্পকবিতার গল্প আর কিছু ছন্দজ্ঞান লইয়া ফতোয়াবাজি করে বেড়ায় আর বাকিগুলা, কবিতা নিয়া আলাপের যোগ্যও নয় এরা তবে রেষারেষি ঠিকই করে, ফেসবুকের মতো ওপেন মিডিয়া পাইয়া এনারাই গোষ্ঠি গোষ্ঠি খেলে আর শিল্পে নৈরাজ্য ছড়ায়, এরা মেকী, এদের লেখাও জোড়াতালি মার্কা, এদের কথা ও কাজের কোনও মূল্যই নাই আর্টে, এদেরকে সম্বল করে মাঝারি ও নিম্নমানের লিখিয়েরা নিজেদের ঢোল জারি রাখে, এরা সেই জনতা যাদের চিহ্নিত করে গেছেন কবিদের কবি শার্ল বোদলেয়ার অথচ এরা নিজেদের মহান আর্টিস্ট ভাবিয়া মিডিয়া গরম রাখে-
‘যতই মানুষ শিল্পেরচর্চা করে-তার প্রবৃত্তি থেকে বর্বরতা কমে যেতে থাকে; কেবল স্থ‚লবুদ্ধির ও রুক্ষরাই যৌনক্রিয়ায় সফল; যে কারণে যৌনক্রিয়াই জনতার অন্যতম লক্ষ্য ...
জনতা একে অন্যের ভিতরে ঢোকে; অপরদিকে শিল্পী নিজের থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না!’’ - শার্ল বোদলেয়ার

No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক