Monday, May 25, 2020

শিল্প সাহিত্য ২৪

বৃহস্পতিবার ২৪শে বৈশাখ ১৪২৭, ৭ই মে ২০২০



কবিতা
রাকিবুল হায়দার
সমুদ্রজন্মের পর

লোকমারফত জানতে পারি, 
গতকাল ছিলো আমার বন্ধুর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী,
অনিবার্যকারণবশত আমি এই মৃত্যুকে বরাবরের মতোই প্রত্যাখ্যান করেছি!
তিনটে মোমের শিরদাঁড়ায় আগুন জ্বেলে আমি পালন করেছি-
বন্ধুর তৃতীয় জন্মবার্ষিকী!
বন্ধুকে তার প্রেমিকা বলেছিলো ডুবে মরতে,
বলেছিলো, বন্ধুকে আর ভালোবাসবেনা কোনোদিন!
মনখারাপের অজুহাতে বন্ধু যখন সমুদ্রের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো-
সমুদ্র তাকে একটা বারান্দা দিয়ে বলেছিলো-
এখানে বসে নিকোটিন আর মদের পেয়ালায় ডুবে মর,
আমার শরীরে নিজেকে ডোবালে মৃত্যু নয়, 
আরেক সমুদ্রজন্ম হবে!
প্রেম হারালে মানুষ নাছোড়বান্দা হয়, 
আমার গোবেচারা বন্ধুও ব্যতিক্রম ছিলোনা,
সে সমুদ্রে ডুববে বলে ঘর ছেড়েছিলো, 
তারপর সমুদ্রেই ডুবে গেলো!
এসব খবর যখন ডুবুরী মারফত লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়লো,
আমি চিৎকার করে হেসে উঠেছিলাম, বলেছিলাম-
যা শালা! এও দেখি আবার জন্মালো!
তারপর...
আমি আমার সমুদ্রজন্মের ঠিক আঠারোদিন পর বন্ধুর জন্মদিন পালন করি!

ডাঃ তারক মজুমদার
যদি 

ঘুমন্ত হায়না আসে 
কাচের পাত্রে। 
তার দাঁতে চোখে 
কুয়াশার প্রলেপ দিয়ে 
আমি ছুটতে থাকি ----
যে পথে কাল তুমি আসোনি। 
যদি আজ ভুল করে আসো
তুমি আর আমি 
মুখোমুখি মৃত্যু উপত্যকায়-----

মরিয়ম খাতুন মেরিনা
সমুদ্র

আমার একটা ছোট নদী ছিল বর্ষায় কানায় কানায় ভরা জল, তাতে পাল তোলা নৌকো চলত কিন্তু ভাঙ্গন মাসের নদী ভাঙ্গন আমাকে ব্যথিত করত নদীর সাথে মন খারাপ করে একসময় তাকে ত্যাগ করলাম। তবে দ্বীপ আমাকে কাছে টেনে নিল দ্বীপে বড় বড় পাথর আর তাতে আছড়ে পরা ঢেউ আমাকে মুগ্ধ করত। কিন্তু পর্যটকের কোলাহল আমাকে বিরক্ত করল তাই সেখানেও আমার স্বায়ীত্ব রইল না। এরপর চাইলাম সবুজ সমরোহে বাস করতে দ্বীপ ছাড়িয়ে দুই দিন পথ পাড়ি দিয়ে এক আকাশ ছোঁয়া সবুজ পাহাড় দেখতে পেলাম হারিয়ে ফেললাম নিজেকে সবুজ সমরোহে কিন্তু খুঁজে পেলাম এক নির্ঝুম ঝর্ণা কাছে। ঝর্ণা আমাকে আকৃষ্ট করল ছুটে চললাম ঝর্ণার পিছনে এক সমুদ্রে এসে থমকে গেলাম দিয়ে দিলাম আমার ভালোবাসার ডায়েরীটা যার প্রতিটি পাতায় ছিলে তুমি। কিন্তু আশ্চর্য, সমুদ্র তা নিল না ফেরত দিল একটা ঝিনুক সহ। বুঝতে পারলাম,ভালোবাসাটা সমুদ্রকেই বাসা যায়। বিনিময়ে ভালোবাসাটাই পাওয়া যায়।

আহমেদ মওদুদ
পাতা ছিঁড়ে লোকালয়ে

অরণ্যের আত্মীয় তুমি
পাতা ছিঁড়ে লোকালয়ে! লোকের আলোয়
ধ্বসে যাচ্ছে তোমার প্রণয়ের পাশা!

অতএব তুমি
ঘুমিয়ে পড়লেই
জেগে উঠবে হন্তারক সংঘ;
পরিবার, প্রতিবেশী, প্রচ্ছন্ন পুরুষ।

তারা আত্মীয় একে অন্যের, বন্যের বংশলতিকা তারা।

জাগরণ, তোমার
কেনইবা মেনে নেবে নিভে যাওয়া মশালের ছাই।

হন্তারক যারা 
জলের, জলরং ক্যানভাসের
সবুজ, আহ্ সবুজ ক্যানভাসের
নীলের, নীলরং ক্যানভাসের

ক্যানভাসার তারা, হন্তারক যুগল বৃক্ষের।

শামীম সৈকত
মানচিত্র

প্রথম দেখা মানচিত্র যখন আমাদের ভেঙ্গে গেল স্বপ্ন।
গোটা পৃথিবী ছোট হয়ে গেল, মা।
ভাগ হতে হতে আমরাও ভাগ হয়ে গেলাম ভাগশেষে।
মানুষের চোখগুলো আলাদা হলো দেখার দূরত্বে 
প্রকৃতির দৃশ্যকল্প থেকে সরে।

কাঁটাতার জেগে উঠে টেবিলে।
কলমের কালিতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব।
সংঘাতে সংলাপে!

পৃথিবী, তোমার বয়স হলো কতো? 
আমাদের প্রথম দেখা মানচিত্রে মেলেনি হিসেব।

তুমি ঘুমাও মা।
আমাদের আর পৃথিবী দেখা হলো না। দেখা হলো, মানচিত্র।

অণুগল্প
ঠোঙা
সোমনাথ বেনিয়া

প্রদীপের ঠোঙা পড়ার অভ্যাস আছে। হাতে ঠোঙা এলে উলটেপালটে পড়ে আর পড়া হয়ে গেলে ঠোঙাটিকে মুখ দিয়ে ফুলিয়ে হাতের চাপড়ে ফাটিয়ে ফেলে। এটা তার একটা নেশা বলা যেতে পারে।
       একদিন একটি ঠোঙা পড়তে গিয়ে দেখে তার গায়ে লেখা আছে- রেপড অ্যান্ড মার্ডারড! প্রদীপের মাথায় রক্ত উঠে যায়। সেই মুহূর্তে তার চোখে পড়ে রাস্তায় একটি কাক একটি নেংটি ইঁদুরের লেজ ধরে টানাটানি করছে। সে বিন্দুমাত্র দেরি না করে হাতের ঠোঙাটা ফুলিয়ে ফাটিয়ে দিলো। ঠোঙা ফাটার শব্দে ভয় পেয়ে কাক ইঁদুরটিকে ছেড়ে উড়ে যায়। শব্দের জোর আছে ভেবে প্রদীপ স্বস্তির শ্বাস ফেলে ছেঁড়া ঠোঙার দিকে পুনরায় তাকায় আর দেখতে পায় লেখা আছে- জনতার চিৎকারে দুষ্কৃতিদের পলায়ন ...

ভবিষ্যতে কোনো একদিন
আনিকা তামান্না

অনেকদিন পর বাবার বাড়ি এসেছি। আজ আকাশটা খুব মেঘলা হয়ে আছে। কতদিন হলো মেঘলা আকাশ দেখি না। আনমনে জানালা ধরে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ মনে পড়ল চিলেকোঠায় রাখা ট্রাংকটার কথা। দৃঢ় পায়ে গেলাম সেখানে।  ট্রাংকটা খুলতেই ডায়রিটা চোখে পড়ল। হাতে নিয়ে এক এক পাতা উল্টাতে  লাগলাম। আজ আর ডায়েরি পাতাগুলো সাদা ধবধবে নেই যেমনটা পঁচিশ বছর আগে ছিল! ফুলের পাপড়িগুলো শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। ডায়েরির সাথে একেবারে লেপ্টে আছে মনে হল এই ক’বছরে ডায়েরির পাতার সাথে পাপড়িগুলোর গভীর সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। অথচ চাইলেই এই লেখাগুলো দিয়ে শত শত বই ছাপানো যেত উৎসর্গ পত্রে কারোর নাম দেওয়া থাকত, কিন্তু না তা আর হয়ে উঠেনি কথাগুলো চিলেকোঠার ডায়েরিতেই বন্দী হয়ে রইল এতগুলো বছর ধরে। একটা দীর্ঘনিঃশ^াস ফেললাম এসব ভাবতে ভাবতে, আজকাল আগের মত চোখে দেখি না ডায়েরিটা  খুলতেই চশমাটা ঝাপসা হয়ে আসছিলো তাই খুলে ফেলেছি। ডায়েরির পাতাগুলো হাতে ছুঁয়ে দিতে পেরে একটু তৃপ্তি অনুভব করছি। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে সেই সাথে চোখের জলধারাও ছুটে চলল ওদের সাথে ভাব করতে। এমন সময় কাঁধে কারোর স্পর্শ অনুভব করলাম, ঘুরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কিছু বলবে? সে বলল- আজ কিছু বলব না, কিছু শুনবো। আমি বললাম- কি শুনতে চাও, বলো? সে বলল- এটাই যা দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে জানতে চাইনি। ডায়েরিটা তার হাতে তুলে দিয়ে বললাম এতে সব লেখা আছে পড়লেই বুঝতে পারবে, বলেই চলে যাচ্ছিলাম। এমন সময় সে হাতটা শক্ত করে ধরে বললো- ডায়েরিটা পড়তে চাই না, আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি। শুনো অপ্রাপ্তি আর অপূর্ণতা থেকেই কবিতার জন্ম। সবকিছু পেয়ে কেউ কবি হতে পারেনি। এভাবে কবিতার মাঝেই বেঁচে থাকুক  প্রতিটি ভালোবাসার মানুষ। আমি তার দিকে চেয়ে একটা ম্লান হাসি দিলাম।

চিঠি
রুমকি আনোয়ার

প্রিয়তম, এ চিঠি যখন লিখছি তখন তুমি গভীর ঘুমে অচেতন। মুখে মৃদু হাসি বুঝি লেগে আছে । ডীম লাইটের নীল আলো অদ্ভুত এক আভা ছড়িয়ে যাচ্ছে ঘরময়। খোলা জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে রাস্তার সোডিয়াম লাইটের ভ‚তুড়ে আলো। ক্রমাগত স্মৃতি হাতড়ে ফিরছি। কেন জানি নে মনে হয় জীবনটাই স্মৃতির প্রলেপ মাখা পলি মাটি। সেই যে ছোট্টটি, স্কুল ব্যাগ কাঁধে প্রায়ই পড়ে যেতুম। মুনমুন, শৈলী, মিথিলা মনে পড়ে আরো কত নাম। ঘুম থেকে উঠতে প্রায়ই দেরী হতো। আজও অনেক কিছুতেই দেরী হয়। দূরাগত ট্রেনের হুইসেল আর গীর্জার ঘণ্টা ধ্বনি জানিয়ে গেলো রাত্রির দ্বিপ্রহর পেরিয়ে এসেছি। আচ্ছা, মনে পড়ে প্রায়ই বলতে তুমি- জীবন একটা রেল গাড়ি যার ধাপে ধাপে কেবল স্টেশন কিন্তু গন্তব্য জানা নেই। রাবেয়া ম্যাডাম, রঞ্জিত স্যার, টিফিন পিরিয়ড, হৈ হুল্লুর। এক টাকার তেতুলের গোল্লা আচার। পাশের বাড়ির বিলাতি কুকুরের নিশুতি কান্না। রোজকার মত আজও আমার জ্বর। পারদ ১০৪ ছুঁয়ে গেছে। স্নান সেরে এলুম; তুমি জেগে থাকলে কি রাগটাই না করতে। মনে আছে কি তোমার প্রথম দেখায় বলেছিলে- বলত, কৃষ্ণচ‚ড়া লাল হয় কেন ? অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেম। তুমি রেগে গেলে গালে লাল টোল পড়ে তাই চুরি করে নিয়ে গেছে কৃষ্ণচ‚ড়া বুঝলে। এক দিন হাত ছুঁয়ে গেলে বলেছিলে- দেখো তো দীঘির জল ছুঁয়েছে কিনে । সত্যি বলছি, সেদিন জলই ছুঁয়েছিল। ব্যথার দান ফিরিয়ে দিতে তুমি দিয়েছিলে ছোট্ট একটা চিরকুট। পারলে আজকের চাঁদটা শরীরে মেখে নাও ভানভাসি জোৎস্না নেমেছে। সে দিন হাত বাড়িয়ে জোৎস্না ছোঁয়া হয় নি। জীবনের অনেক কিছুই হয়ে উঠে না। পাহাড় ছোঁব ছোঁব বলে আজও পাহাড় ছোঁয়া হয় নি। তোমার দেয়া খামিটা পড়ে আছি। মহুয়ার গন্ধ মাখা মাতাল রাত । মাথাটা ঘুরাচ্ছে। চরণটা কি ছিল জানি ‘নিশিথের অন্ধকারে মলয় সাগরে’ দূর সব ভুলে যাওয়া রোগটা আজকাল পেয়ে বসেছে। কবে না তোমাকে ভুলে যাই। কি গোস্বা করলে বুঝি, তবে একশো একটা নীল পদ্ম হাতে ধরিয়ে দিব। আলতা মাখছি পা'য়। চুলে বেনুনি। কি জানি আমিও হয়ত রেনুকা দিদির মত পাগল হয়ে যাচ্ছি। শুনেছি, পাবনা পাগলা গারদে আছে, বিয়ে হয় নি কিন্তু কপালে সিঁদুর। এতো রাতে গেট খুলবার আওয়াজ পেলুম। রুনুর বুঝি শুটিং শেষ হলো। ওর জীবনটা শুটিং শুটিং এই গেলো। ওর কষ্টটা বেশ বুঝতে পারি আমি। জীবন তার সূর্য দীঘল বাড়ি। পাশ ফিরলে বুঝি তুমি। মেয়ের লেপ টা সরে গেছে পায়ে পারলে টেনে দিও। পূবের আকাশটা লাল হয়ে এসেছে। কে জানে হয়ত শুরু হবে আরেকটি দুঃখী দিনের। তবুও জানি অনেকেই বলবে সুপ্রভাত। মৃতের শরীরের গন্ধ, লোবান নাকে এসে ভর করে। ঘুম কি আসবে একটা দীর্ঘ ঘুম। তুমি ঘুমোয় প্রিয়, ঘুমোয়। আমি চেয়ে থাকি বিষণ্ন বিদায়ী চাঁদ। আর শুনো ডিম দিয়ে বেগুনের ঝুরি করা আছে সাথে রুটি। আমি যদি ঘুমিয়ে পড়ি আমায় ডেকো না কিন্তু। চাঁদের গ্রহনকাল লেগেছে আমার বদনে। বিদায় প্রিয়তম বিদায়। তোমায় নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু পারলুম কই আর । সব ক্ষয়ে যায়, ক্ষয়ে যায়, ট্রেন যাচ্ছে যাচ্ছে যাচ্ছে------

No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক