রবিবার ২৭শে বৈশাখ ১৪২৭, ১০ই মে ২০২০
কবিতা
সুদেব চক্রবর্তী
বোধ
বোধের মূল্য না দেয়া বোধজীবিরা
প্র্রশ্ন তুলছে মূল্যবোধ নিয়ে!
উচ্চ মূল্যহারের শতকে প্রেমের বাজার সস্তা, তবু মিডিয়ায় ভাসে মুদ্রাস্ফীতির খবর।
বোধের শাখায় বসে গান গায় বিরহী পাখি;
চোখে জল আসে না বলে মেঘও জমে না,
ধেয়ে আসে মেঘতাড়–য়ার দল।
সুবোধরা পালায়- নির্বোধরা ঘুমায়;
মূল্যের অভাবে হারিয়ে যায়
আমাদের সব বোধ।
আনিকা তামান্না
ফাল্গুনের দিনে
বর্ষা, শরৎ তারপর শীত পেরিয়ে বসন্ত
এভাবে কেটে গেলো এক যুগ
হঠাৎ এক ফাল্গুনে তোমার সাথে দেখা!
তুমি পরেছিলে আকাশ রঙা পাঞ্জাবী আর গায়ে জড়ানো ধূসর রঙের চাদর,
চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, চুলে হালকা পাক ধরেছে তোমার আর হাতে একটা সুটকেস।
মনে হলো পরের ট্রেনেই শহর ছাড়বে তুমি!
আমি বসেছিলাম দূরে এক বেঞ্চিতে
কাছে গিয়ে কেমন আছো বলে সম্বোধন করার সাহস পেলাম না
দূর থেকেই দেখছি তোমাকে আর ভাবছি
এই ক’বছরে কতো বদলে গেছো তুমি।
তুমি কেবল ঘড়ি দেখাতেই ব্যস্ত ছিলে
আশ পাশ ঘুরে তাকানোর সুযোগই মেলেনি,
হঠাৎ ফিরে গেলাম অতীতের সময়টাতে
সাইরেনের শব্দে ঘোর কাটল
তুমি আর দশজনের মতোই তাড়াহুড়ো করে প্লাটফর্ম ছাড়লে
ঠিক কোন কামড়ায় উঠেছিলে জানি না।
এক এক করে সবাই চলে গেল,
আমি প্লাটফর্মে দাড়িয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম!
তারপর প্রতিবছরই ফাল্গুন আসে আর এই দিনটাতে আমি অধীর আগ্রহে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকি এই আশায়,
যদি শেষবারের মতো তোমার দেখা পেতাম তবে জিজ্ঞাসা করতাম
“আজো কি তুমি আমায় ভালোবাসো”
সেই আগের মতো?
মাহমুদ হাসান আবির
হাতঘড়ি
মৌসুমী ভালোবাসা প্রেমিকার কানে গুঁজে দিয়ে ঈশ্বর বলেন, ‘শুভ সকাল’। প্রেমিকার সকাল নিরীহ ড্রইং খাতায় এঁকে দেয় একটি আঁতর শিশি। যার মধ্যে রাখা থাকে এক ফোটা হাত ঘড়ি। খুব যত্ন করেঘড়িতে যখন রাত দশটা বাজে, একটি কচুরিফুল ঈশ্বরকে প্রেম নিবেদন করে। প্রেমিকা তাকে গুছিয়ে রাখে হাত ঘড়িতে। এমন ঘড়িতেই আমরা চাতকের মতো তাকিয়ে থাকি, আঁতর ঘ্রাণের ভাঁজ গুনি সারা সকাল।
রেডিওতে ঈশ্বর সম্পর্কিত যেসকল ঘোষণা আসে, তার মধ্যে ‘শুভসকাল’ সব থেকে উপাদেয়। এমনই একটা উপদেশ ঝালমুড়ির ঠোঙায় পেয়েছিলাম।
অনিন্দ্যকেতন গোস্বামী
রত্নাদি
রত্নাদি রে, তোর কথা মনে এলেই শুয়ে পড়ি নরম অক্ষরের উপর
অক্ষর মুড়ি দিয়ে ভাবি তুই রত্নাদি রে, তোর কথা মনে এলেই শুয়ে পড়ি নরম অক্ষরের উপর
অক্ষর মুড়ি দিয়ে ভাবি তুই এসে টুপ্পুস করে চোখ চেপে ধরবি
ধরিস না.... ছায়ারাও কঠিন হয়ে গেছে আজ
বাতাসে লন্ঠন নেই
লন্ঠনে প্রাণভোমোরা বাতি নেই আর
সেই সব মোহবিল থেকে শাপলাকে কে তুলে এনে দেবে ?
সেই সব তালের ডোঙাভরে তুই আছিস
আর তোর তরলিত ছায়া
টুপ্পুস করে চোখ ধরবি, আয়....
আমি ভূতাবিষ্টের মত অক্ষর হয়ে যাই
এই সব পথ এই সব পৃথিবীর ধুলোবালি কনা
তোর হয়ে রইলো না জেনে আমি আর শাপলা তুলি না বিলে,
বিল ডাকে আয়
ধুলোবালি ডাকে আয়
শাপলারা ডাকে আয়
তুই আর ডাকতে পারিস নারে দিদি
হেমলকের মত সেই ব্যথা শিরা বেয়ে লতিয়ে ওঠে মনে
শুধু তুই অক্ষর দিয়েছিলি তাই অক্ষর নরম আজো
মোহ হয়ে শীত হয়ে রাত হয়ে গল্পের বুনিয়াদে চলে আয় তুই
আমি একটা নরম তমসুকে একশো আটবার তোর নাম লিখে রেখে আসবো নীলকুঠীর পেছনে
আর ভুলে যাবো পৃথিবীটা আজো বিষে ডুবে আছে তোকে জাগাবে বলে
আমি সেইসব শ্রুতিগুলোকে ঘুম পাড়াই নরম অক্ষরে টুপ্পুস করে চোখ চেপে ধরবি
ধরিস না.... ছায়ারাও কঠিন হয়ে গেছে আজ
বাতাসে লন্ঠন নেই
লন্ঠনে প্রাণভোমোরা বাতি নেই আর
সেই সব মোহবিল থেকে শাপলাকে কে তুলে এনে দেবে ?
সেই সব তালের ডোঙাভরে তুই আছিস
আর তোর তরলিত ছায়া
টুপ্পুস করে চোখ ধরবি, আয়....
আমি ভ‚তাবিষ্টের মত অক্ষর হয়ে যাই
এই সব পথ এই সব পৃথিবীর ধুলোবালি কনা
তোর হয়ে রইলো না জেনে আমি আর শাপলা তুলি না বিলে,
বিল ডাকে আয়
ধুলোবালি ডাকে আয়
শাপলারা ডাকে আয়
তুই আর ডাকতে পারিস নারে দিদি
হেমলকের মত সেই ব্যথা শিরা বেয়ে লতিয়ে ওঠে মনে
শুধু তুই অক্ষর দিয়েছিলি তাই অক্ষর নরম আজো
মোহ হয়ে শীত হয়ে রাত হয়ে গল্পের বুনিয়াদে চলে আয় তুই
আমি একটা নরম তমসুকে একশো আটবার তোর নাম লিখে রেখে আসবো নীলকুঠীর পেছনে
আর ভুলে যাবো পৃথিবীটা আজো বিষে ডুবে আছে তোকে জাগাবে বলে
আমি সেইসব শ্রুতিগুলোকে ঘুম পাড়াই নরম অক্ষরে
ভাষান্তর: কায়েস সৈয়দ
মূল: জঁ ককতো
সংযুক্তি
দুটি বাড়ি
একে অপরের দিকে মুখোমুখি অভিগমন
ফুলের গালিচা লাগানো ছিলো তাদের জানালায়
একটি বড় স্ট্রিটল্যাম্প তাদের মুকুট হয়
আর উজ্জ্বল ঝাড়বাতি
তাদের বিষণ্ন পথের মুখ থেকে
চলার পদচিহ্ন
অণুগল্প
বজ্রপাত
নুসরাত রীপা
বজ্রপাতকে ভীষণ ভয় পায় সুমি।
আকাশে মেঘ ডাকলে, বৃষ্টি এলে অন্য মেয়েরা যখন উচ্ছ¡সিত হয়ে পড়ে, ভিজতে নেমে যায়, গ্রীষ্মে আম আর বর্ষায় ঝরা বকুল ককুড়ায় সুমি তখন মনে মনে স্রষ্টাকে ডাকতে থাকে ঝড়-বৃষ্টি না হওয়ার জন্য।
আকাশের ভয়ংকর গর্জন শুনলেই ওর ইচ্ছে করে মায়ের কোলের নিরাপদ আশ্রয়ে সেঁধিয়ে যেতে!
মা নেই, সুমি ওর ছোট্ট দুহাতে কান চেপে চোখ বুঁজে বসে পড়ে আকাশে সোনালি রূপোলী বিজলী ঝলকাতে দেখলেই!
এতিমখানায় ও নতুন হলেও বিল্ডিং এর সবাই এটা জেনে গেছে। ওরা হাসাহাসি করে।
সুপার আন্টি গম্ভীর আর রাগী। সেদিন তিনি সুমিকে দুটো টিফিন ক্যারিয়ার ফিরিয়ে আনতে পাশে ছেলেদের বিল্ডিং এ যখন পাঠালেন তখন প্রবল ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। সুমি কয়েকবার আন্টিকে বলতে গিয়েও ভয়ে ফিরে এসে বৃষ্টিতেই নেমে পড়ল। বেশ খানিকটা খোলা জায়গা পেরিয়ে যতে হয় পাশের বিল্ডিংয়ে।
শোঁ শোঁ বাতাস আর অঝোর বৃষ্টি, ভিজতে সুমির সমস্যা নেই, সমস্যা হচ্ছে যখন বিজলী চমকে আকাশ গর্জন করে উঠে। সুমির মনে হয় সমস্ত আকাশ বুঝি এক্ষুণি ভেঙে পড়বে মাথার ওপর। ও ভয়ে চিৎকার করে ওঠে, দুহাতে কান ধরে বিল্ডিং এর দিকে ছুটতে থাকে।
দ্বিতীয় বিল্ডিংটা এতিম ছেলেদের।
বৃষ্টি ভিজে সে বারান্দায় উঠে হাফ ছাড়ে সুমি। জামার জল চিপে ঝরায়। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ির কোণে গিয়ে দাড়ায়।
কে ওখানে? বয়স্ক এক লোক এগিয়ে আসে। ইনাকে সুমি চেনে, সুপার আজিজ মুন্সী স্যার। সুমি নিজের নাম বলে, কেন এসেছে জানায়।
আজিজ মুন্সী সুমিকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে আসে। গা মুছতে গামছা দেয়। বজ্রপাতে সুমির চমকে ওঠা লক্ষ্য করে বলে, মেঘ ডাকলে তুমি ভয় পাও? সুমি মাথা নাড়ে।
আজিজ মুন্সী সুমির কাছে এগিয়ে আসে। ওর মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, তাহলে মেঘ থামলেই যাইও। এখন বস। ভয়ের কিছু নাই সোনা! মেঘ-বাদল আল্লার দান- বলতে বলতে সুমির মাথাটা নিজের পেটের কাছে টেনে নিলে সুমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে, আমার কাজ আছে। সুপার আন্টি তাড়াতাড়ি যাইতে বলছে।
আজিজ মুন্সী হাতের স্পর্শ বজ্রপাতের চেয়ে বেশি ভয়ংকর লাগে সুমির।
পুনর্পাঠ
কেন লিখি
মানিক বন্ধোপাধ্যায়
লেখা ছাড়া অন্য কোন উপায়ে যে-সব কথা জানানো যায় না সেই কথাগুলি জানাবার জন্যই লিখি । জীবনকে আমি যেভাবে ও যতভাবে উপলব্ধি করেছি অন্যকে তার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ভাগ দেয়ার তাগিদে আমি লিখি বা আমার লেখাকে আশ্রয় করে সে কতগুলি মানসিক অভিজ্ঞতা লাভ করে- আমি লিখে পাইয়ে না দিলে বেচারী যা কোনদিন পেতো না।
আগেই বলেছি সাময়িকপত্রের দক্ষিণা সমান্য। টাকার জন্য তাই অনেকগুলি কাগজে তাকে লিখতে হবে। বই বিক্রি হয় কম সুতরাং বেশি বইও তাকে লিখতে হবে।
নাম আছে সুতরাং কাগজের মালিকের কথা না ভাবলেও চলে- কিন্তু ওই যে পাঁচখানা কাগজের পাঁচরকম রুচির পাঠক পাঠিকা, তাদের রুচির কথা না ভাবলে তো চলবে না! পাঁচ রকমের পাঁচমিশেলী লেখার খিচুড়ি সাহিত্যে বোঝাই পত্রিকাটির বিক্রির মধ্যে যে বাস্তব সত্যের প্রকাশ তাতে খাতির না করলে অর্থাৎ বেশি সংখ্যক লোকের কাছে রুচিকর হয়, খানিকটা এই ধরণের বই না লিখলে তো চলবে না! ব্যস, খতম হয়ে গেল লেখকের স্বাধীন সৃষ্টির স্বাধীনতা!
এই গেল ক্রেতা বাড়াবার জন্য নিজের চেতনা ও প্রতিভার যোগ্য ব্যবহার ছাঁটাই করার দিক! অন্য দিকটা হলো বেশি বেশি লিখতে বাধ্য হওয়ার দিক। হলেন বা নাম-করা লেখক, নতুন চিন্তা আর অভিজ্ঞতার কতই বা তার পুঁজি! পুঁজি খরচ করে বই লিখে তবেই তো নাম-করা লেখক হয়েছেন! পুঁজি ফুরিয়ে গেলে উপায়? পুঁজি বাড়াবার উপায় নেই, বেশি লিখে নতুন চিন্তা ও অভিজ্ঞতার পুঁজি সঞ্চয় করার সময় কই! অগত্যা বলা কথাই আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নতুনভাবে বলার চেষ্টা।
No comments:
Post a Comment