Monday, May 25, 2020

শিল্প সাহিত্য ৩৪

রবিবার ৩রা জ্যৈষ্ঠ ১৪২৭, ১৭ই মে২০২০




আরণ্যক টিটো
চিয়ার্স

ফুলটুকু
যে ভাবে ভুল করে নিলেন,
সে ভাবে
ভুলটুকু ফুল করে নিলাম!
প্রজাপতি পাখনায়
ভুলে ভুলে ফুলে ফুলে উড়াউড়ি
ভুলের মুকুল মনে
ফুলেল শুভেচ্ছায়... বললাম, উদ্যান পুষ্পিত হোক!...
চিয়ার্স!... চিয়ার্স!... জলোচ্ছ¡াসে
গøাসে
উপচে পড়ছে
ভুলের সমুদ্র,
পাঠে
ভুলের খসড়া, একটি ফুলের সমাচার—
ভুল
হবো ফুল
ভুলে ভরা এ বাগানে 
ফুটবো আগামীকাল
আজিকার ভুল
তোমাদের
না দেখা ফাগুনে
ফুটেছিলাম একদা
ফুল
মন ও মননের ছোঁয়ায়
আবার ফিরবো সে জনমে
পাবো শোভা
সুরভী প্রিয়র হাতে হাতে
বলো না তখন
ভুল
নিও ফুল
জমবে আবার পৃথিবীতে
ফুল-উৎসব.......

আনিকা তামান্না
অন্তত একবার দেখা হোক

অন্তত একবার আমাদের দেখা হোক
আমি আপনাকে বসন্তের একটা গোধুলি বিকেল উপহার দিতে চাই,
যেখানে শহরের কোনো কোলাহল থাকবে না
রাস্তার দুপাশে থাকবে সারি সারি কৃষ্ণচ‚ড়া গাছ
আপনি খানিকটা ফুল নিয়ে আমার কানে গুজে দিবেন
দুজন মুগ্ধ হয়ে কোকিলের ডাক শুনবো।
অন্তত একবার আমাদের দেখা হোক
আপনি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমাকে একটা সন্ধ্যা উপহার দিবেন
তারপর কিছু কবিতা পড়ে শুনাবেন,
আমি বায়না ধরব আরো কিছুটা সময় থাকার জন্য।
অন্তত একবার আমাদের দেখা হোক
আপনার দেওয়া ভালোবাসা দিয়ে 
আমি তিল তিল করে একটা পাহাড় বানিয়েছি, তা দেখাতে চাই
আকাশ সমান ভালোবাসি আপনাকে
এই কথা শুনার পর আপনার অনুভ‚তি কেমন হয় তা বুঝতে চাই।
আচমকা একদিন হুট করেই বৃষ্টি নামল
আনমনে আমি বারান্দায় দাড়িয়ে আছি,
আপনার কথা মনে পড়ছে খুব
আপনার জন্য আমার মন খারাপ
অন্তত এই কথা বলার জন্য হলেও 
একবার আমাদের দেখা হোক!

কেয়া সরকার গুহ রায়
উপহার

তোমায় একটা আকাশ দেব ভেবেছিলাম। একটা ধ্রæব তারা ও। আর একপাত্র সুখ। উদারপ্রবণ, দিকশূন্য নিস্তারিণীর মতো নিশ্চুপ। পলাশের কাছে চেয়ে নেব আগুন রঙ, তেমনি কথা ছিল। চৈত্রের সন্ধ্যায় তোমার বুকে আকাশ বাতি জ্বালব বলে। পথ ছড়ানো রক্তলাল কৃষ্ণচ‚ড়া, শিমুল জাতিষ্মরের বায়না নিয়ে তুচ্ছ করছে মৃত্যুর অভিশাপ। প্রথম শাড়ি, প্রথম লুকোচুরি, সেই কবে গোলাপ ধোঁয়া গোলাপি শাড়ির জলরঙ লুকিয়ে রেখেছিলাম তরঙ্গের ভাঁজে। প্রথম প্রেমের অবুঝ ভাষা নিদারুণ যতেœ তোলা আছে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া দুধ সাদা কবিতার খাতায়। দোল তো প্রতিবার আসে, ফাগুন বুকে নিয়ে ফিরে যায় আগামীর আগামীতে। যদি কখনো দেখা হয়, কথা হয় মুখোমুখি বসে তবে মাছরাঙা ডানায় ধার নেওয়া আসমানী রঙ উপহার দেব তোমাকে।

ঘুমঘর
আবু জাফর সিকদার

আলো ছায়া অন্ধকার কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে সাপ বের করে আনে শতাব্দীর পরিক্রমা। যবনিকার অন্তরালেও চলে ভিন্ন ভিন্ন খেলা অবয়ব দৃষ্টিনন্দন ও তুচ্ছ হলেও উহানের ঝলমলে আলো ছায়ায় অন্ধকার ভেদ করে নামে এক গভীরতর অন্ধকার। পৃথিবী আপন কক্ষে পরিভ্রমের মতো কাঁটা গায়ে মৃত্যু পরোয়ানা ঝুলিয়ে ডুবে যাওয়া সূর্যের লাল ভেলায় জোনাকিপোকা নিয়ন আলো জ্বালায়। দূর নক্ষত্রলোকে মিটিমিটি স্বপ্ন বুনে কল্পলোকে দানা বাঁধে বারুদের ঝলকানি। কবে কোন মৃত সাগর তলায় আদ ও সামুদ- সামুদ্রিক জীবাশ্মের মতো পিরামিড ছাড়া টিকে যায়। জুলকার নাইনের তুলে দেয়া দেয়ালে ইয়াজুজ মাজুজ আটকে থাকে অযুত বছর মহাচীনের মহাপ্রাচীর দুর্ভেদ্য অচলায়তন ভেঙ্গে ফেলে অদৃশ্য শত্রু ছাউনি সাপ খেলায় হেরে যায় চৌকস সাপুড়ে...  
অণুগল্প
কিমত
প্রণবকুমার চক্রবর্তী 

     রবিবার ছুটির দিনটা বিতাংশু ওর মেয়ে আত্রেয়ীর জন্যই বরাদ্দ রাখে। সকাল থেকেই খেলাধুলো করে আর নানান ধরনের সব দেশি এবং বিদেশি নীতিমালার গল্প শুনিয়ে সময়টা কাটায়। 
     সেদিনও ও অন্যথায় করেনি । হঠাৎ, বাড়ির ফোনটা বেজে উঠলো। অফিসের ফোন। জানাচ্ছে- ইলেক্ট্রোপিউটেড হয়ে একটা বছর দশেকের মেয়ে মারা গেছে। এক্ষুণি যেতে হবে।
     গ্রামটার নাম শুনেই বিতাংশু চমকে উঠলো। লোকজন ভয়ঙ্কর বাজে। কোন কথাই শুনতে চায় না। মাস চারেক আগে ওই রকম একটা ঝামেলায় মেরে লাইনম্যনের মাথাটা তো ফাটিয়ে ছিলোই, কোম্পানীকে দু’লাখ টাকার উপরে নগদ জরিমানা দিতে হয়েছিলো। 
     এবারে যে কী হবে!
     বিতাংশু ঠিক করলো সঙ্গে পুলিশ না নিয়ে যাবে না। থানায় গিয়ে ব্যাপারটা বলতেই, ওকে বড়বাবু অভয় দিয়ে বললেন- ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ? আপনি যানতো। এবারে কোনও ঘটনাই ঘটবে না।
     বিতাংশু বলতে যাচ্ছিলো, কী বলছেন স্যার! ওটা ছিলো মোষ, এবারেরটা একটা জলজ্যান্ত বাচ্চা মেয়ে?
      বড়বাবু গম্ভীর হয়ে বলেন- সেই জন্যই তো বলছি।
      -তার মানে? বিতাংশু খানিকটা বিস্মিত হয়ে বড়বাবুর দিকে তাকাতেই, ভদ্রলোক ঠোঁটের কোনে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি তুলে বললেন- এটাই আমাদের দূর্ভাগ্য যে, এই দেশে মেয়েদের থেকে গরু-মোষের কিমত অনেক বেশি।

অণুগল্প
শহীদুল মিয়ার ঈমান বিষয়ক গল্প 
লোকমান হোসেন

শহীদুল মিয়ারা কয়েকদিন যাবত ঘরবন্দী। শহীদুল মিয়ারা বলতে শহীদুল মিয়ার মতন যারা গতর খাটে, দিন-মজুরি করে, তারা। যেমন পশ্চিম পাড়ার আউশ। পুবগাঁর মজিদ। কিন্তু তাদেরকে সবাই এত সুন্দর করে কেউ ডাকেনা। বয়স কম হওয়ার কারণেই হোক কিংবা তাচ্ছিল্যের কারণেই হোক গ্রামের মানুষের কাছে তারা যথাক্রমে আউইশ্যা এবং মইজ্জা। এই দু'জন বিশটিক্যা জিনিস ফেরি করে। তবে পঞ্চাশোর্ধ শহীদুল ভ্যান চালায়। ইট-পাথরের ট্রিপ থেকে শুরু করে গোবর টানা কোনোকিছুতেই আপত্তি নাই তার। কারণ দিনশেষে সত্তুর বছর বয়সী বুইড়া মা সহ কয়েকটা মুখের সামনে যে কয়েক লোকমা ভাত দিতে হয়। রুজি রোজগার খারাপ ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন বিপদটা বেড়ে গেল। সেদিন বিকেলবেলা মোহনবাবুর দোকানের দশ বান টিনের ট্রিপটা মেরেই সজলের দোকানের একটা বনরুটি আর দুধ চা খেতে খেতে টিভিতে খবরটা শুনতে পায় সে। চায়নাতে যে রোগটা ধরা পড়ছিল সেই রোগ নাকি এখন বাংলাদেশে চলে এসেছে। দিনদশেক পর একদিন মজিদ আর আউশ আসে। চাচা বেডা কুছতা কও তে। অহন কেম্নে চলনওলন। দুইজনের মুখেই প্রশ্নবোধক চিহ্ন। কিতা আর করবে ধৈর্য ধর। আল্লারে ডাক। একটা ব্যবস্থা অইবনানি? শহীদুল মিয়া পাল্টা সমর্থন চায়। নিজেও আসলে কোনো পথ খুঁজে পায়না। সরকার দেখলাম বিভিন্ন জাগার মাইঝে সাইঝ্য সঝোগীতা করতাছে। আম্রা দি কুছতা পাইনা। আউশ বলে। যেতা দেয় ইতা মেম্বার চেরমেনারই অয়না। যা, মেম্বার বাইত যা, দিব তরে। কিঞ্চিৎ খোঁচা দেয় মজিদ। ইডা অ ঠিকই মেম্বার চেরমেনের ভোডের খরচ আছেনা! বিড়বিড় করে আউশ। কিছুক্ষণ পর আবার হঠাৎ কোনকিছু মনে পড়ে গেলে যেভাবে লাফিয়ে উঠে সেভাবে লাফ দিয়ে আউশ আবার বলে, এমপি সাব অত্ত আয়েনা অহন! হালার... এমপি অহন মন্ত্রী বেডা। বেডার বালের লাগলনি পাইবে তুই! সাংসদের মন্ত্রীত্বে বিরক্ত হয় মজিদ। একসাথে চলাচলের কারণে অনেক সময় দু-চারটে অশ্রাব্য কথা বার্তা বলে ফেলে তারা। এতে কিছু মনে করেনা শহীদুল মিয়া। একমনে পাতার বিড়ি টানতে থাকে। মন্ডায় কয় এহট্টারে ধইরা চড়াই। ভোড দেই এরপরে খবর থাকেনা... এই কথা দুইজনের কোনো একজন কিংবা দুইজনেই বলে। শহীদুল মিয়া খেয়াল করেনাকে এই কথা বলেছে। তবে উত্তর দেয় ঠিকই। হুন ভাতিজা, চড় দিলে মন্ত্রীর গালো না, মেম্বার চেরমেনের গালো না, আমার গালো দে। ইডা কিতা কও বা চাচা? দুইজনেই প্রশ্ন করে। অয় আমার গালো দে, তরার গালো দে। ইলেকশনের আগে আম্রা যে দুইশো টেহার বদলা ভোটটা দিয়া আই, নাইলে যে বেঈমানী অইব; হেইডা মন নাই? আউশ, মজিদ তব্দা খেয়ে বসে থাকে আর শহীদুল একমনে বিড়ি টানে।

পুনর্পাঠ
দেবেশ রায়

বাংলা সাহিত্য তো বটেই, বাংলাদেশের সাহিত্যেও আরেকটি অনিষ্পন্ন বিষয় হলো ভাষা। বাংলাদেশের সাহিত্যের ভাষা আঞ্চলিক ভাষা হবে, নাকি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের মতো মান ভাষা হবে। আমি মনে করি, মান ভাষা হলো উপনিবেশবাদী ধারণা। উপনিবেশ বিস্তারের প্রয়োজনে পশ্চিমা শক্তি নিজেদের আয়ত্ত করায় সুবিধা হবে বলে বিচিত্র ও বিবিধ ভাষাকে একটা বাঁধা ছকে তৈরি করেছে। পশ্চিমবঙ্গের যে ভাষাকে আমরা মান বলে মেনে নিয়েছি, সেই মান ভাষা পশ্চিমবঙ্গের এখনকার সাহিত্যের জন্য সেটা এক বড় বাধা। কারণ সেই ভাষার পুষ্টি কমে গেছে।
ভাষার পুষ্টি আসে কৃষি থেকে, শ্রম থেকে। মানুষের শ্রমের সঙ্গে যুক্ত নয়, দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যুক্ত নয় যে ভাষা, সেই ভাষা রক্তাল্পতায় ভুগবেই। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার এটাই বড় সংকট। সে জন্য সেই ভাষা ক্রমাগত যান্ত্রিক কৃত্রিমতায় ভুগছে।
বাংলাদেশের বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় জোর এ জায়গায়: অজস্র জেলার অজস্র ভাষা এই ভাষাকে পুষ্ট করছে। আমার এই কথার বিরোধিতার মনোভাব বাংলাদেশের অনেক লেখকের মনে আছে। সেটা মেনে নিয়েই বলছি, বাংলাদেশ যদি কৃত্রিমভাবে কোনো মান ভাষা ব্যবহার করে সেটা বাংলাদেশের সাহিত্যের বেলায় বিরাট ক্ষতির কারণ হবে।
গল্প-উপন্যাসের ভাষা প্রশ্নে আঞ্চলিক, আঞ্চলিকতর আঞ্চলিকতম ভাষা ব্যবহারের যে সুযোগ বাংলাদেশে আছে সেই সুযোগ কোনোমতে বন্ধ করা উচিত নয়। লেখার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ভাষার বিভিন্ন স্তর। একটা ভাষায় যখন উপন্যাস লিখছি, তখন সেই ভাষার মধ্যে স্তরান্তর আনায় কথ্য ভাষা যে রকম সাহায্য করে, এ রকম আর কোনো কিছু করে না। আমার যদি ঘরের মধ্যে সেই সম্পদ থাকে, আমার কি উচিত তাকে অবহেলা করা?

No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক