Saturday, May 23, 2020

শিল্প সাহিত্য ১৩

রবিবার ১৩ই বৈশাখ ১৪২৭, ২৬ই এপ্রিল ২০২০




কবিতা
সুদেব চক্রবর্তী
আয়না

হাজার বছর আগেও তুমি জলের প্রতিবিম্বে চুল আঁচড়াতে; চুলের মায়ায় সরিসৃপ হয়ে ছুটে আসতো ঢেউ- নির্বোধ মাছের উত্তেজনায় পলি মাটির কণায় ঘোলাটে হতো উপরিভাগ,

আমরা তো কত শুক্লপক্ষে চলে গেছি সেই নদীর পাড়ে- চাঁদকে স্বাক্ষী করে জলের স্বচ্ছতায় ধরা পড়েছে আমাদের ওষ্ঠপ্রাশন,

এই যে জলের প্রতিবিম্বে দাগ পড়তো পলি মাটির- সর্পিল ঝির ঝির...
এই যে সেই জলজ আয়নায় মুখ দেখতাম গভীর রাতে...
একটুও কি পাপ জন্মেছিল আকাশের জার্নালে?

অথচ আজ রাতের বেলা আয়না দেখা বারণ- কলঙ্ক বাড়ে নাকি জীবনের ভাঁজপত্রে!
আয়না ভেঙে গেলেও নাকি ঝুলে থাকে অশনিসংকেত!

অনিন্দ্যকেতন গোস্বামী
সংক্রমণ

সংক্রমণ, অতীত নয়। সে তো ধমনীতে লেখা আছে।
ইতিহাস তোমার কাছে...

তুষার যুগেও জীবন কর্কটক্রান্তির রেখায়।
কিভাবে যেন বেঁচে যায় ?

কিভাবে নিয়েন্ডারথালদের ভাষা বহু যুদ্ধ করে
আজও সভ্যতার দোরে ?

সমস্ত গাছ-পাখি-গান জঙ্গলের দাবিদার
না তোমার না আমার...

একদিন তোমার দুর্বিনিত পদচিহ্নের ভিত
ফিরে পাবে সম্বিত।

অপার অরণ্য
জিয়ারত

সিঁথানের কিনারে সাতভাঁজ করে আনি ক্ষুদা ও খবিসের সুচতুর দাঁত
আফিমে আমিষে ওরা সাজায় ভোজ-টেবিল
এবং ঘরবন্দি বহুবিধ সজ্জা আরাম কেদারায়
ফেরেশতার চুরি করা চালডালতেল বোবা হয়ে দেখে কঙ্কালের ক্ষুদা
বিপরীত খুলেছে সাগরলতা ডলফিনের প্রাঞ্জল নাচ
শহরের কাকচিল কুকুরেও জেনে গেছে তা
অথচ সব অনলাইনে গজিয়েছে প্রসন্ন শস্যের দান
ঘুমঘড়ি শুয়েছে পাশে। কবর ও শ্মশানের ঘুম নেই তবু
কারা যেন ছুটছে অই শতাব্দির দশদিক- দ্যাখো
তেল নেই। নুন নেই। চুলায় জ্বলেনি লাল আগুন
জ্বলজ্বলন্ত আধাঁরেও স্বেচ্ছায় যারা করোনাকে ছোঁয়
তারপর, জীবিতের জিয়ারত সেরে দলে দলে ঘরে আসে আলখেল্লা পরা অবাস্তব পৃথিবীর আয়ু

ভাষান্তর: কায়েস সৈয়দ
মূল: জঁ ককতো
রাতে সজাগ রাখবে তোমায়

দানায় বাধা সাদাকালো ছবিগুলো
ঝাঁকুনি দেয় তোমায় বহুদিন পর
চোখ বন্ধ করে ভান করছো
যেনো পৌঁছে গেছো অন্য কোথাও
কর্কশ কণ্ঠস্বরটি মিলিত হয় ফরাসি সুগন্ধির সাথে
যতোটা তুমি বাধা দেও ঠিক ততোটা
পশুপ্রকৃতির জন্য তুমি যে অশ্রু ঝরিয়েছো তা বাস্তবিক
তার বুনোহৃদয় শান্ত, পীড়িত
ভালোবাসা দিয়ে বাঁচালে
চাঁদ ও তারার প্রতিকৃতি
তাকিয়ে থাকতে পারো আকাশের দিকে
কিঙবা অনুসরণ করতে পারো কলঙ্কিত প্লেট
হৈহুল্লোড় শব্দফিতা
নিচের দিকে তাকাতে সাহসী হলে
কবির রক্তকে আচ্ছন্ন করতে পারে না ক্লান্তি
প্রতিবিম্বে স্তম্ভিত
ডুবে গেছো স্বপ্নের দুনিয়ায়
ফ্রেমে লাগানো আয়নার
কবি, প্রকাশ করে যান
একজন শ্রমিক, একজন মধ্যস্ততাকারী
কাজ করে যান নির্জনে
কথা বলেন কালজয়ী ভাষায়
শেখা হয়নি যা এখনোও 
আকাশে পড়ার সাথে সাথে
অদৃশ্য হয়ে যান বাড়ির সাথে
একটি জাহাজ আর তার নিজের থাকে না
পুরাকথার মিথ্যা সত্য হয়ে ওঠার অপেক্ষায়

অণুগল্প
হ্যালো
সৌম্যজিৎ  আচার্য 

-হ্যালো! 
-হ্যালো!
-কে বলছেন?
-আমি।
-আমি কে?
-আপনি বলুন।
-আরে আপনিই তো ফোন করলেন! আপনি তো  বলবেন।
-না।
-না মানে?
-না মানে, না। আমি ফোন করিনি। আপনিই ফোন করেছেন।
-মানে? বললেই হল? আমার ফোনে রিং হল, আর আপনি বলছেন, আমি ফোন করেছি!
-মিথ্যে কথা। আমার ফোনে রিং হয়েছে।
-বললেই হল!
-সত্যি বলছি। আমার ফোনেও রিং হয়েছে।
-কেন বাজে বকছেন?
-আশ্চর্য! বিশ্বাস করুন সত্যি...
-কে আপনি? 
-সে আমি যেই হই, আপনি আগে বলুন।
-না। আপনি বলুন। তারপর আমি বলছি। আপনি ঠিক কে?
-আ-আমি শব্দ।
-হোয়াট? কে?
-শব্দ। মানুষের না বলা কথা। কোনও একটা গল্পের ডায়ালগ। যা এখনো বলা হয়নি। আর আপনি? 
-আমি চরিত্র। গল্পের জন্য জন্ম হয়েছে আমার। কিন্তু কিছুতেই এতদিন ঠিকঠাক কথা খুঁজে পাই নি...
-আমিও কিছুটা তাই জানেন। রোজ ভাবতাম, ঠিক কার মুখের কথা আমি? কার ডায়ালগ হতে হবে আমাকে? 
-হুম। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছিনা, দুজনের ফোনেই রিং হল কি করে? তবে কি এটা কনফারেন্স লাইন? মানে,আমাদের দুজনেরই কথপোকথন অন্য কেউ শুনছে? সে কে?
-গল্পকার?

প্রথম সংখ্যা

উত্তরের কবিতার স্বর ‘উত্তরা এক্সপ্রেস’
আবু জাফর সৈকত

দেবাচার্য দেবশর্মা ও কাজী শোয়েব শাবাব এর যৌথ সম্পাদনায় রাজশাহী থেকে প্রকাশিত হয় উত্তরের কবিতার স্বর ‘উত্তরা এক্সপ্রেস’। প্রথম সংখ্যা ফেব্রুয়ারি ২০১৮। ২০ টাকা মূল্যের এক ফর্মা এ কাগজটির মলাট করা হয়েছে বাঁশ পেপারে যা সংখ্যাটিতে ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করেছে। প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়েছে শেখ আব্দুস সাত্তার এর রূপান্তর ৩ সিরিজ এর স্কেচ। সম্পাদকীয় বদলে ব্যাক সাইডে ব্যবহার করা হয়েছে সিরাজুদ্দৌলা বাহার এর কবিতার উদ্ধৃতি এবং স্কেচ। তবে সম্পাদকীয় দিলে কাগজের গন্তব্য স্পষ্ট হতো। 

আশির দশকের অন্যতম কবি সিরাজুদ্দৌলা বাহার এর সাথে একান্ত আলাপচারিতায় ছিলেন শাহনেওয়াজ প্রামানিক সুমন, সমতোষ রায় ও কাজী শোয়েব শাবাব। এক প্রশ্নের জবাবে কবি বলেন- কে কবি কে কবি নয় এসব নিয়ে মাতামাতি করার চেয়ে স্ব স্ব কবিতা নিয়ে সততার সাথে কাজ করাটাই জরুরি। তিনি স্বীকার করেন- কবিতায় একটি ইনটেলেকচুয়াল ব্যাপার আছে তবে কবিতার মৌলিক জায়গাটা হল হৃদয়বৃত্তি। সেক্ষেত্রে মহৎ কবিতা রচনার একটা মোক্ষম সময় মনে করেন যখন কবি কোন ক্রাইসিসে পড়েন, নিজেকে নিঃসঙ্গ ভাবেন। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে কবি বলেন- কবির অবশ্যই কমিটমেন্ট আছে। কবির কাজ হলো ভালো কবিতা লেখা। ভালো কবিতার বৈশিষ্ট সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন- জীবন-জগৎ সম্পর্কে ভালো ধারনা থাকতে হবে, পঠন-পাঠন, অনুভূতি, দেখা, শব্দ প্রয়োগ, উপমা-উৎপ্রেক্ষা প্রভৃতি বিষয়ের উল্লেখ করেন।

সংখ্যাটির প্রথম কবিতা ‘আমোস টুটুওয়ালার বরেন্দ্র ভ্রমন’ কবি শামীম হোসেন। একটু অন্যরকম লেগেছে আমার-
...শহরের পিঠে চড়ে/ আমোস টুটুওয়ালা/ ঘুরে ঘুরে দেখছে/ তালগাছের চ‚ড়া, রসের নহর.../ ফাটা মাটিতে জল ঢেলে/ বুনছে সংগ্রামের বীজ/ আমাদের পোড় খাওয়া/ আদিবাসী তামাটে শরীর।/ এই যে সুনলি সরেন/ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো/ এবার উঠেন।

আরিফ রুবেদ এর কবিতায় নতুন স্বর খোঁজে পাওয়া যায়। পৃথিবী আর আমার সন্তানেরা, কাঠওয়ালা ঈশ্বর, গাড়ি মৃত্যুর মুখের ভেতর’ দ্রোহের কবিতা।-
মৃত্যুর মুখের ভেতর পা ঢুকিয়ে বসে আছি। আমার পা মৃত্যুর হৃদপিন্ড ছুঁয়ে গেছে আর দেখ মৃত্যুর আহাজারি আর দেখ তুমি আমার বুকের ভেতর ব্যথা হয়েছে। [মৃত্যুর মুখের ভেতর]

‘একটি পরিযায়ী পাখিকে ঘিরে’ শাহনেওয়াজ প্রামাণিক সুমন এর দীর্ঘ কবিতা। মূলত কবিতার ভিতরে নিজেকে আঁকার চেষ্টা করেছেন কবি, যাকে কেউ চিনতে পারে নি। দ্বিতীয় কবিতাটি উদ্ধৃতি করছি-
...কবি ভাবনায় ঘুরপাক খায়Ñ/ ছানাটি তার পূর্ব জন্মের কোনো এক পরমাত্মীয়/ হয়তো সহোদর কেউ!/ বেড়াল ছানাটি ভাবে/ কবিও তার মত এক বেড়াল’ [কবি ও এক বেড়াল ছানা]

কথাচ্ছলে কবিতা লিখেছেন সমতোষ রায়। নড়েচড়ে খোঁজেছেন কবি পনর্জন্মে কি ছিলেন।-
কেন ছিলাম, করতাম কার আরাধনা?/ মানুষই ছিলাম তো, নাকি ছিলামই না? [পুনর্জন্ম]

ছোট ছোট বাক্যে কয়েকটি ছোট কবিতা লিখেছেন কবি রফিকুল কাদির। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের হাতছানি আছে তার কবিতায়। মহেঞ্জোদারো, হরিদহের বিল কিংবা প্যারিস রোড আমাদের নিয়ে যায় আরো কিছু পথে। বুদ্ধের খোঁজে কবি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়েন অরণ্য গহনে। কবি কারো বাধা মানবেন না।-
বাধা দিও না, আজ যাই/ দেখা হবে [বৈধব মিথ]

সম্ভাবনাময় কবি কাজী শোয়েব শাবাব। কবিতায় পঠন-পাঠনের ছাপ পাওয়া যায়। ১৫ মার্চ ১৯৬৩ সালে এক হত্যাকান্ডে অভিযুক্ত ভিক্টর ফেগুইর শেষ ইচ্ছে নিয়ে লিখেন- ‘ফাসির দন্ডাদেশপ্রাপ্ত এক আসামির শেষ ইচ্ছে’।
আর জাগবো না/ জাগবে একটি গাছ/ বড় হবে/ ছায়া দেবে-/ জলপাই চোখে দেখবো রোজ
আরেকটি কবিতা-
রাস্তায় দাঁড়িয়ে দু’বন্ধু/ মুগ্ধতায় তাকিয়ে একজন-/ অন্যজন ভাবছে-/ একটা বন্দুক থাকতো যদি... [সহাবস্থান]

পুনর্পাঠ

শক্তি চট্টোপাধ্যায়
মনে মনে বহু দূর চলে

মনে মনে বহু দূর চলে গেছি- যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়
জন্মেই হাঁটতে হয়
হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে
একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি
পথতো একটা নয়-
তবু, সব গুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা
নদীর দু- প্রান্তের মূল
এপ্রান্তে জনপদ অন্য প্রান্ত জনশূণ্য
দু দিকেই কূল, দু দিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোরেন-
দুটো জন্মই লাগে
মনে মনে দুটো জন্মই লাগে

No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক