মঙ্গলবার ৮ই বৈশাখ ১৪২৭, ২১ই এপ্রিল ২০২০
ক বি তা
নাহিদ ধ্রুব
মনোলোভা
উত্তুরে হাওয়ার পাশে তুমিও হিজল
গেয়ে ওঠো কী এক সিন্দুকী স্বরেÑ
হয়তো বনস্পতি ছায়ার অনুকূলে
ঘুমায়ে পড়িতেছে সব মৌসুমি ঝড়ে
বনের ভেতর হেঁটে যাইতেছি একা
শিকারিপাখি তুমি কার কথা বলো
কোন ইশারায় মন ব্যাকুল ভ্রমেÑ
জেগে উঠিয়া বুঝি ঘুমায়ে গেলো!
এমন অনবদ্য মনোলোভার টানে
ফেলে এসে হিয়া কাঁদে ইশারায়Ñ
আড়ালে তুমি,
তবু অনুগ্রহ করো
পাতা নয় এই বুঝি প্রাণ ঝরে যায়!
সৈয়দ সাখাওয়াৎ
মড়ক সংবাদ-৪
যেনবা ভ্রƒণের মাঝে,
শুনি পাতায় পাতায় শব্দ
গাঢ় কোন অন্ধকারে ডুবে যাওয়া এ’চরাচরে
একাÑশব্দের চেয়েও বেশি কোন এক নীরবতা
ভাঙছে,
উল্কার মতো,
দূর থেকে খসে পড়া তারা।
কোন পরিণতি নেই,
নেই কোনো স্বপ্নের আহ্লাদ
আছে ক্রমাগত ক্ষয়Ñ
জন্ম থেকে মৃত্যু-নিরবধি।
এসময় মনে পড়ে,
মেহেরুন সন্ধ্যাবেলা তুমিÑ
আমার সাথে উড়ছো,
পেছনে চলে যাচ্ছে শহর
আমরা ক্রমশ ঢুকে পড়ি,
জল ও জঙ্গলে,
শূন্যে
সহসা স্মৃতির মাঝে,
বিবিধ মাইলেজ ফলকে।
আমাদের বন্দীদিনে,
বেঁচে থাকার তীব্র সাহসে
এ’শহরে বাঘবন্দী,
পরস্পরের মুখের দিকে ।
বিনয় কর্মকার
বিষামৃত
আলো হতে গেলে দাহ্যও হতে হয়!
আবার শীতলতাও মৃত্যুর আরেক নাম!!
দহন ভয়ে আঁতকে ওঠা প্রাণী কি বোঝে;
উষ্ণতায়ও লুকিয়ে থাকে আগুন?
দুধের বাটিতে মাছিটি ডুবে যেতে-যেতে বলে গেলো;
শুধু বিষেই মরণ হবে;
এমন কোনো কথা নেই!
সুদেব চক্রবর্তী
বাস ভাবনা
শহুরে লোকাল বাস দাঁতে দাঁত চেপে হাঁটে-
তার চোখে মুখে পালংকীর উঠোনে মাথায় প্যানোয়া বাঁধা তরুণীর হামবড়া ভাব-
যে আড়চোখে ঢেকে রাখে অফিসযাত্রীর বিরক্তিপত্র।
আর মফস্বলের এক্সপ্রেস শার্ট খুলে দৌঁড়ায়-হাইওয়ের পরিবহন অমন নয়-
হা করে ছোটে নেটিজন বালককে ঘুম পাড়িয়ে...
বাসেরা যৌবন হারালে
ঠাঁই নেয় মফস্বলের রাস্তায়,
একদিন যার অহংকার ছিল
এখন তার সাই সাই শরীরে
নিরক্ষর হেল্পার পাঁচ আঙুলের চাবুক মারে।
মাহিরা রুবি
একটি বাউলগাছ
চন্দ্রনাথ যখন সময় থেকে হারিয়ে যায় তখন একরাশ আঁকিবুকি ঢুকে পড়ে স্নানের ঘরে। মুখোশে তখনো রোদের ঝিলিক।
সংসারে প্রতিটি মানুষ কোথাও না কোথাও পাথর অথবা ত্রিভুজ নদী।
চন্দ্রনাথ আজ একটি বাউলগাছ―যার ডালে শিশুরা রোজ ঝুলিয়ে দেয় লাল রঙের বেলুন,
অভিমান আর বিপুল বড়দিন।
এইসব ঋষিলিপি পড়তে পড়তে শরীরও জমিয়ে রাখে নিমফলের মতো ঘড়ি।
আজ ঘুমকে ভালোবেসে বারবার জেগে ওঠে চন্দ্রনাথ।
ইকতিজা আহসান
গাজিপুর
-১
গাজিপুর,
এক রহস্যপুর
দূরের দেশ
পরিণতিহীন মায়াবীজ!
গাজিপুর হতে গাজিপুর কতদূর?
ক্লান্ত হয়ে ওঠা রোদের চিহ্ন ধরে
এই মাড়ি,
এই ধেয়ে আসা মন্বন্তর একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে
তবু,
গাজীপুর
অনতিক্রম প্রতিবেশীর বাড়ি,
কুয়াশা-কণ্টকিত
অনেক দূর....
বিভ্রমপুর!
ভাষান্তর: কায়েস সৈয়দ
মূল:
জঁ ককতো
শৈশব স্মৃতি
রাতে একটি গোলাপ
সামনে এগিয়ে যায়,
সমস্ত আলো বন্ধ
যদি কিছু ঘটতো তবে
অপেক্ষা করা হতো ভোর পর্যন্ত
তোমার মা বাদামকে সোনালী রঙে এঁকেছেন
তোমার ক্রিসমাস গাছের জন্য
নিচের প্রান্তে জুতোরা
নিয়ন্ত্রণ করে আকাশ
সামনে,
মূল্যবান শৈশব ভ্রমণ
করেছে প্রজ্জ্বলিত
পরীদের লিভারপুল
দেখতে চমৎকার
একটি মশারি
তুষারের মতো,
তুমি সেখানে মরো
বিশেষত তারাটি জ্বলে উঠলে
চিমনির ডানাগুলি ঝাপটাতে থাকে
গল্প
পরিচয়ের খোঁজ
ইসরাত জাহান আঁখি
বাংলাদেশে বর্তমানে সাড়ে ষোল কোটি জনসংখ্যার মধ্যে তিন কোটি আঠাশ লাখ মানুষ দারিদ্র্যতায় ভুগছে। তারই মধ্যে সুজন একজন। একদিন সম্ভবত দুই থেকে আড়াই বছর পূর্বে নতুল্লাবাজ এর রাস্তা পেরিয়ে বাসা এর দিক আসছি। হঠাৎ এক বিচ্ছু বাহিনীর দল রিকশার সামনে এসে রিকশা থামাল। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম
'তোমরা কী কিছু চাও?'
তারা ক্ষাণিক সময় চুপ থাকার পর তাদেরই মধ্যকার এক বালক আমার দিকে আগালো। মনে হলো সে-ই বুঝি এ দলের দলনেতা। পার্স ব্যাগ দিয়ে বলল
'আফা এই ন্যান ওহানে পইড়া গ্যাছেলো। দ্যাহেন সব আছে কিনা। আমাগো ঘরে আইজগো খাওনের লইগা টাহা আছে। জানেন তো অভাবে স্বভাব নষ্ট।'
'দেখা লাগবে না। তোমার নাম কী?'
সঙ্গে সঙ্গে হাসির যেন তোড় পরে গেল। হতভম্বি হয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলাম
'তোমার পরিচয়টা কী?'
কিছু না বলেই মন খেয়ালে চলে যেতে লাগল। ওদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম যেন কোন কিছুর সন্ধান করছি। দলের কে যেন বলে উঠল
'সুজন,
দ্যাখ দ্যাখ,
মেমসাহেব এদিকে তাকাইয়া আছে।'
অতঃপর সুজন অদ্ভুত হাসিতে মুখ ফিরিয়ে বলল
'মেমসাহেব দুই বছর পর কমু...'
আমি যেন সেই হাসিতে রহস্য খুঁজে পেলাম।
আমি বরাবরই বেশ কৌতুহলি। তাই ওদের দলকে অনুসরণ করলাম। নতুল্লাবাজের একটা বস্তিতে ঢুকলাম অনুসরণ করতে করতে। এতটা গোলমেলে স্থান বসতের জন্য হতে পারে আগে কখনো ভাবিনি। হারিয়ে ফেললাম ওদের দলকে। তবে একজনকে বলতেই সামনের দিকে ইশারা করল। হঠাৎ কিছু লোক ছুটে আসছে এইদিকে। কিছুটা হতচকিত। তবুও ঐ দিকেই আগাচ্ছি। কয়েকজন বাসিন্দা ডাক দিয়ে বলল
'ওদিকে যাইয়েন না ঝামেলায় পরবেন।'
তবুও যে আমার মাথার সেই কৌতুহলের ভ‚ত সে তো দমে থাকতে নারাজ। কয়েক পা এগোতেই এক বয়স্ক বৃদ্ধা ডেকে বলে
'ওদিকে যাও কই মা?
তুমুল কান্ড হইতেছে সামনে।'
বৃদ্ধার কথা ফেলতে না পারায় কৌতুহলকে দমিয়ে রাখলাম। এরপর অবশ্য একবার খোঁজ নিয়েছিলাম বটে। শুনেছি সেদিনের দাঙ্গায় ছেলেটা মারামারি থামাতে গিয়ে আহত হয়েছে। একবার দেখতে যাব ভেবেছিলাম তবে তা হাজারো ব্যস্ততার মাঝে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
এবার যখন করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে তখন আমরা কয়েকজন একটা সংগঠন দিয়ে দরিদ্রদের সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। ঐ বস্তিতেও গেলাম। সেখানে যেতেই সেদিনের কথা স্মরণ হলো। বোধ হয় কোন এক সুপ্ত আকাক্সক্ষা ছিল ঐ রহস্যের কিনারা করার। রিমি,
সুইটি,
রুপম ওদেরকে বলে আমি একাই সামনের দিক আগালাম। একটা শিশুকে বলতেই সে সুজনের বাড়ির দিক নিয়ে যেতে রাজি হলো। শিশুটি সাথে ঐ ক্ষুদ্র সময় এর ভিতর ভারি ভাব জমলো। সে বয়সে ছোট তবে বেশ চালাক। সুজনের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই এক প্রশংসার ঝুলি ধরিয়ে দিল। আমারও অবশ্য মনে হয়েছিল ছেলেটি ভদ্র। সুজন যে এই বস্তিবাসিদের কাছে খুব প্রিয় তা বুঝতে আর অন্ত রইল না। তবে ওকে দেখার পর ভারি দুঃখ হলো। সেদিনের হাঙ্গামায় ওর এক পা পঙ্গু হয়ে গেছে। এ হৃদয় বিদারক কাহিনীর কাছে আমার কৌতুহল বড্ড ফিকে ছিল।
ভাবিনি সুজন আমায় দেখে চিনতে পারবে। দেখেই বলে উঠল,
'আফা পরিচয়ের খোঁজে ঠিক আইছেন। আমনে তো ঐ টিভিতে যারা মাইক হাতে লইয়া কথা কয় হ্যাগো মতোন। আমি দেখছি যে আমনের মতৌ এইরম কইরাই খবর নেয়।'
'ওস্তাদ,
ঐ যে মতিন মিয়ার খুনের সময় আইছেলে?'
'হ তুই এহন যা আফার লইগগা চা লইয়া আয়।'
'তোমার আমার কথা মনে আছে?'
'মনে থাকবে না আবার!
ঐ দিনের কোন কথা ভুলা যায় মেমসাহেব!'
মনে হচ্ছিল ওর হাসিতে আমি কান্না খুঁজে পাচ্ছি। ঐদিনের সকল ঘটনা শুনে ভাবলাম হয়তো বা ওকে না খুঁজে পেলেই ভালো হতো। সমাজকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল,
গরিবরা কী মানুষ নয়?
এতো চিকিৎসা সেবা সবই ওই টাকাওয়ালা ক্ষমতাওয়ালাদের জন্য তৈরি?
তা না হলে কেন সুজনকে চিকিৎসার অবহেলায় আজ পঙ্গু থাকতে হবে?'
আফা,
শোনলাম আমনেরা নাকি আমাগো দান করতে আইছেন?
আগে ঐ এমপি মন্ত্রী চেয়ারম্যান-মেম্বারগো দিয়া আন্। কত গরিবই তো মরতেছে আমরা না হয় আরো কজন করোনা আর খিদার জ্বালায় মরমু। এই কথার উপর ঠিক কী বলে শান্তনা দেয়া যায় বুঝে উঠতে পারছি না। তাই কিছু না বলেই সুজনের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম। সুজন তার ঐ যন্ত্রণাকৃত পা নিয়ে বাইরে এসে ডাক দিয়ে বলল
'আফামনি,
আমার জানতে আইয়া না জাইনাই চইলা যাইতেছেন। শোনেন,
আমার মতো মানুষদের পরিচয় একটাই,
আমি গরিব।
পুনর্পাঠ
শক্তি চট্টোপাধ্যায়
ভিতর-বাইরে বিষম যুদ্ধ
এই আমি যে পাথরে
ইচ্ছে ছিলো তোমার কাছে ঘুরতে-ঘুরতে যাবোই
আমার পুবের হাওয়া।
কিন্তু এখন যাবার কথায়
কলম খোঁজে অস্ত্র কোথায়
এবং এখন তোমার পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা কুঞ্জলতায়
রক্তমাখা চাঁদ ঢেকেছে
আকুল চোখ ও মুখের মলিন
আজকে তোমার ভিতর-বাইরে বিষম যুদ্ধ পুবের হাওয়া।।
No comments:
Post a Comment