Saturday, May 23, 2020

শিল্প সাহিত্য ১৫

মঙ্গলবার ১৫ই বৈশাখ ১৪২৭, ২৮ই এপ্রিল ২০২০



কবিতা
রুদ্র সাহাদাৎ 
আমিও তালিকাভুক্ত

চৌদিক এতো এতো মৃত্যুর সংবাদ শুনছি
ক্ষণে ক্ষণে থামকে যাই চলতি পথে 
কখনো সখনো নিজেকেই চিনতে কষ্ট হয়

গল্পে গল্পে শুনতাম পৃথিবীর অসুখ হলে
 মানুষও রেহায় পায় না তেমন

উচ্চবিত্তের সুখের অসুখ
নিম্নবিত্তের ক্ষুধার অসুখ
আর মধ্যবিত্তের নৈঃশব্দ্যে কিছু বলতে না পারা 
 চাপা কষ্টের অসুখ।

মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে, শুনছি আর দেখছি
কখনো রেড়িও, কখনো টেলিভিশনের পর্দায় 
মনে হচ্ছে আমিও তালিকাভুক্ত.....

হাসানুজ্জামিল মেহেদী
নিঃসঙ্গতার অতল জল

খুঁজে ফিরি সেই হলুদ বিকেল,
শাদা মেঘের ঘুনবৃষ্টি,
যেখানে জম্পেস নগরীর হৈ হুল্লোরে
ব্যস্ত সড়কে দেখা হয়েছিলো তোমার
এবং আমার নিঃসঙ্গতার।

বিকেলের রোদ জমে নির্জন বারান্দায়,
চিলতে বাগানে প্রেমে মজে ভ্রমর মধুকরী,
উদ্দাম শিশুর মতো আনন্দে মজে পরিযায়ী প্রজাপতি,
যেন বৃহস্পতির খয়েরি পরী।
প্রেমে প্রেমে সূর্যটা অস্তগামী, 
আমার সন্ধ্যার আড্ডায় কেবলই আমি।
অথচ আজও খুঁজে ফিরি তোমাকে।
সেই হলুদ বিকেল,
সেই শাদা মেঘ,
সেই ঘুনবৃষ্টি কেবলই হারাতে থাকে।

একটি শহর হয়ে ওঠে অজস্র শহর,
আদিগন্ত ছুটতে থাকে আমার নিঃসঙ্গতার বহর।
তুমি হয়ে উঠো জনক,
আমার চোখে জন্ম দাও দু'ফোঁটা
অতল জল।

ভাষান্তর: কায়েস সৈয়দ
মূল: জঁ ককতো
কাঁকড়াগুলি পায়ের আঙুলের উপর বাইরে চলে যায়

কাঁকড়াগুলি হাতকে বৃত্তাকার করে
পায়ের আঙুলের উপর বাইরে চলে যায়
কানে কানে হাসে তারা

একজন অপেরা নর্তকী
ঠিক যেনো কাঁকড়ার মতো
অঙ্কিত ডানাগুলি বাইরে ছড়িয়ে পরে
বৃত্তাকার করে হাত

গল্প
আমরা কেউ ভালো নেই
খালিদা খানম

কারো কারো কথা মনে খুব ইফেক্ট ফ্যালে। তেমনই একটা কথা বলেছিল
বায়োলজির টীচার ছিলো সাগর দত্ত । মোটা ফ্রেমের চশমা, অগোছালো চুল । সারা দিন বই পড়েন। কত কিছুতে যে তার নলেজ তার ইয়াত্তা নেই। আমার মনে হত কবি হতে হতে ভুল করে বায়োলজি টীচার হয়ে গেছেন। প্রতিদিন ক্লাসে এসে বলতেন- কেমন আছিস ?
আমরা বলতাম- ভালো আছি স্যার।
স্যার বলতেন- বলবি খুব ভালো আছি। কারণ তোর থেকে কেউ না কেউ খারাপ আছে।
কথাটা আমার মনে কিভাবে গেঁথে গিয়েছিল জানিনা কিন্তু গেঁথেছিল।

তারপর বড় হয়েছি বিস্তর । আকারে আর কিছুটা অভিজ্ঞতায়। দেঁতো হাসি হেসে ভালো আছি বলতে শিখে গেছি আরো ভালো ভাবে।

দমদম স্টেশনের সাবওয়ের কাছে হঠাৎ চোখ আটকে গেলো, সাগর দত্ত স্যার না ? হ্যাঁ, স্যারই মোটা ফ্রেমের চশমা। তবে আগোছালো চুল আর নেই। প্রায় ন্যাড়া। কাছে গিয়ে অভ্যাস বশে জিজ্ঞাসা করলাম- ভালো আছেন স্যার ?
মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- কে তুমি ?
-আমি ১৯৮৫ এর ব্যাচ স্যার। আপনি বায়োলজি পড়াতেন। ভালো আছেন ? আপনি এখানে ?
-আমি দমদমেই থাকি এখন । তুমি এখানেই থাকো ?
আমি এতোদিন দমদম এলাকায় আছি কখনোই মুখোমুখি হয়নি স্যারের। আমি বললাম- আপনি কোন দিকে যাবেন এখন ?
-তুমি যাও। আমি এখানেই দাঁড়াবো এখন ।

বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি সবাই দৌড়াচ্ছে সাবওয়ের দিকে। কি হলো ! এমন ভাবে দৌড়াচ্ছে কেন। কে একজন বলল, ছেলেধরা ধরা পড়েছে । খুব মারছে সবাই । অনেকদিন পর ধরা পড়েছে।

বেশ ভালো একটা ভীড় জমে গেছে। এমন নয় যে সবাই খুব রাগান্বিত । কেউ ফোনে কথা বলছে,  কেউ কচি শশা বেগুন কিনছে ফুটপাথের দোকান থেকে। লাল হলুদ ক্যাপসিকাম কচি ভুট্টার দামাদামি করছে কিনতে পারবেনা জেনেও। আমি মোমোওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম - কি হয়েছে দাদা।
সে অনাগ্রহের সুরে বলল- জানিনা দাদা। ছেলেধরা ফরা মনে হয়। একটা বস্তির বাচ্চার সাথে কি কথা বলছিল যেন। কোথায় নিয়ে যাবে । পড়াশোনা করাবে। জনতা শুনে ফেলে ক্যালাচ্ছে। গরম মোমো আছে চিকেন ভেজ।

ভীড় ঠেলে কাছে গিয়ে দেখি- সাগর স্যার। মুখটা রক্তাক্ত ।
স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বলে- আমি ভালো আছি। কিন্তু আমরা কেউ ভালো নেই ।

সাক্ষাৎকার


ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত (জন্ম ১৯৫৩) অসংখ্য কবিতা গল্প প্রবন্ধও ফিচার লিখেছেন। স্মৃতিচারণামূলক একটি গ্রন্থ (টুকরোগুলো) ছাড়াও চারটি কাব্যগ্রন্থ (বিকেলে হ্রদের ধারে, জিরাফের বাগান, মৎস্যকন্য ও জ্বলন্ত গিটার) এবং একটি গল্পগ্রন্থ (মিসেস মালহোত্রা ও অন্যান্য গল্প) আছে তাঁর লেখা। ভারত, বাংলাদেশ ও বিদেশের নানা পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে দেশ, কৃত্তিবাস, শারদীয়া আনন্দবাজার, শারদীয়া বর্তমান, সন্দেশ, সুখী গৃহকোণ, অনুষ্টুপ, দুকূল, ভাষানগর, কবিতা পাক্ষিক, কবিকল্প, কবি সম্মেলন, যুগসাগ্নিক, দৃষ্টি (বাংলাদেশ), দৈনিক সংবাদ (বাংলাদেশ) ইত্যাদি। সুদীর্ঘ সরকারী চাকরি জীবনের নানা ঘটনা ও বিদেশভ্রমণ তাঁর লেখায় এক অন্য মাত্রা যোগ করে।

লেখার শুরুটা কিভাবে ?
স্কুল পত্রিকায়। শিশু সাহিত্য পত্রিকায়। তখন টিন এজার। চল্লিশ বছর দীর্ঘ বিরতির পর আবার পত্র পত্রিকায় প্রকাশ । সব খ্যাত পত্রিকায়, গল্প, কবিতা, ফিচার, ভ্রমণ।

কোনটাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ অনুভব করেন?
কবিতা।

আপনার মতে শিল্প সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা কি ?
সঠিক শিল্প সাহিত্য মানুষকে উত্তরণে নিয়ে যায়। অনুভ‚তিতে জারিত করে, যা একান্ত প্রয়োজন।

লিটিল ম্যাগাজিন না ফেসবুক কোনটা শ্রেষ্ঠ মাধ্যম,আপনার মতে ? কেন ?
কোন বিরোধ নেই। দুটোই জরুরী। লিটল ম্যাগাজিনে প্রিয় লেখা খুঁজে দেখা যায়। ফেসবুক চলমান, পুরনো লেখা চাপা পড়ে যায়। 

কবিতায় কি গল্প বলা যায় ?
হ্যাঁ। 

এই সময়ের তরুণ-তরুণী প্রত্যেকে প্রত্যেককে আড়ালে 'বোকাচোদা' সম্বোধন করে। কবিদের  মেরুদন্ড , স্বাভাবিক সৌজন্যবোধ হারিয়ে কি হারিয়ে যাচ্ছে?
ওগুলো ব্যতিক্রম। নজর কাড়ার চেষ্টা। অবজ্ঞা করাই ভালো। 

আপনি কি তরুণদেও লেখা পড়েন, আপনার পরে যারা লিখছেন?
অবশ্যই পড়ি। 

আপনার প্রিয় কবি, প্রিয় ঔপন্যাসিক ও প্রিয় গল্পকার কে এবং কেন?
একাধিক। আল মাহমুদ, রহমান হেনরী, বিভাস রায় চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জীবনানন্দ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, রমানাথ রায়। কে নয়? ওবীন্দ্রনাথ, নজরুলই বা বাদ যাবেন কেন? বিস্তৃত আলোচনা করা যায় না। প্রতিনিয়তই নতুন নতুন নাম জুড়ে যায় আমার তালিকায়।

পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তখন কি করতে চান?
মানুষের কাজে লাগতে চাই।

লেখকের স্বাধীনতা বলতে আপনি কী মনে করেন?
লেখকের স্বাধীনতা সোনার পাথরবাটি। সবাই বন্ধনে থাকেন। নিজের বিশ্বাসের বন্ধনে। সেও তো এক রকমের পরাধীনতা। আসলে নৈর্বক্তিক হওয়াটা প্রায় অসম্ভব।

এপার বাংলার লেখার ভাষা এবং ওপার বাংলার লেখার ভাষার মধ্যে পার্থক্য কতটুকু?
ততটা পার্থক্য নেই। তবে কিছু শব্দের প্রয়োগ আঞ্চলিক বৈশিষ্টের পরিচয় বহন করে।

সাহিত্যের বিশ্বাস আর ধর্মের বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য বা দ্ব›দ্ব কোথায়?
নির্ভর করে ব্যক্তির মনোজগতের ওপর। পার্থক্য তেমন কিছু নেই। সাহিত্যের বিশ্বাসও অনেক সময় তীব্র হতে পাওে যেমন ধর্মের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই। 

কিভাবে একজন তরুণ লেখক তার জীবন-দর্শনকে সমৃদ্ধ করতে পারেন?
পড়তে হবে, কেবল সাহিত্য নয়। দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, লোকাচার, বিজ্ঞান- সবকিছুই অধ্যয়ন করতে হবে। নয়ত জীবন দর্শন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।


পুনর্পাঠ

সৈয়দ শামসুল হক
এখন মধ্যরাত

এখন মধ্যরাত।
তখন দুপুরে রাজপথে ছিলো মানুষের পদপাত।
মিছিলে মিছিলে টলমল ছিলো সারাদিন রাজধানী।
এখন কেবল জননক‚ল ছল বুড়িগঙ্গার পানি
শান্ত নীরব
নিদ্রিত সব।
ওই একজন জানালায় রাখে তার বিনিদ্র হাত
ছিলো একদিন তার
উজ্জ্বল দিন, ছিলো যৌবন ছিলো বহু চাইবার।
সারা রাত চষে ফিরেছে শহর খুঁজেছে সে ভালোবাসা।
পেতেছে সে হাত জীবনের কাছে ছিলো তারও প্রত্যাশা পাওয়া না পাওয়ার
প্রশ্নে হাওয়ার
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে এখন সারারাত হাহাকার।

পথে ওড়ে ধুলো, ছাই ওড়ে শুধু পথে যে আগুন ছিলো
একদা সে জ্বেলে ছিলো।
হৃদয়ে এখন সৌধের ভাঙা টুকরো আছাড় খায়।
আলো নিভে যায়, নিভে যায় আলো একে একে জানালায়।
থেমে যায় গান
তারপরও প্রাণ
বাঁশিটির মতো বেজে চলে যেন সবই আছে সবই ছিলো।

No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক