বুধবার ১৩ই জ্যৈষ্ঠ ১৪২৭, ২৭ই মে২০২০
কবিতা
কায়েস সৈয়দ
দুঃস্বপ্ন
১
কারো কারো চোখে রাত্তিরে বাসা বাঁধে মেঘ। যে আঁধারে জ্বলে জোনাকি সে আঁধার হয়ে যায় চোখের কাজল। আমাদের পাঁচ ভাইবোনকে একটু একটু করে আলো বিলাতে বিলাতে মা হয়ে যান আলোকশূন্য। উলিরা দখল করতে চায় চোখের কোটর। মা তবু মেঘকে বানান স্বপ্ন। একটা আশ্রয়স্থল সামনে সবজি বাগান। এই স্বপ্ন দেখতে দেখতেই বড় হয়ে যাই আমরা। স্বপ্নও সাথে সাথে বড়ো হয় মার। একটা দোচালা ঘর,
সামনে গেট,
ফলের বাগান। আমাদের সন্তানরাও বড় হতে থাকে। সমান্তরালে ছোট হয়ে যায় মায়ের স্বপ্নের দৈর্ঘ্য!
২
ঘুমের মধ্যে আপনি হাঁটছেন। ফুটপাতের সমতলে হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ পেছন থেকে বাসের কষিয়ে ধাক্কা। আপনার খুলি বাসের চাকায় কটমট করে ভেঙে গেলো। রক্তাক্ত মগজ থেৎলিয়ে ছিটকে পরলো পাশের সরকারি দেয়ালে। অযথা দেয়ালটা নষ্ট হলো। আপনার ঘুম ভাঙলো না।
আপনার ঘুম যেহেতু ভাঙলো না সেহেতু আপনি বেঁচে আছেন। আপনি আবার উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। জামা-জুতা কিনতে গেলেন মার্কেটে আর চাল-মাছ কিনতে ফুটপাতে। কোনো ফরমালিটি ছাড়াই দোকানী আপনাকে দিলো ফরমালিন উপহার। আপনি আয়েস করে খেতে থাকলেন। এভাবে খেতে খেতে হঠাৎ একদিন পেটের ব্যাথায় ধাক্কা খেলেন হাসপাতালের সঙ্গে। ডাক্তার মারফত জানতে পারলেন আপনার দুটো কিডনিই ড্যামেজ। আপনার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আপনার ঘুম ভাঙলো না।
যেহেতু আপনার ঘুম ভাঙলো না সেহেতু আপনি এখনোও বেঁচে আছেন। আবার উঠে দাঁড়ালেন। হাঁটতে শুরু করলেন এবার সাবধানে। নাক কান চোখ মুখ খোলা রেখে। নাক কান চোখ মুখ খোলা রেখেও আপনি আবার ধাক্কা খেলেন। জ্ঞান ফিরলে দেখলেন হাসপাতালের নিবির পর্যবেক্ষণ কক্ষে আপনি। ডাক্তারের পুরো শরীর সাদা এপ্রোনে আবৃত। ডাক্তার আতঙকের চোখে আপনাকে জানালো আপনি মারাত্মক ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত। এবার আপনি খুব শান্ত থাকলেন কেননা আপনি আগে থেকেই জানতেন এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। যেহেতু কোনো চিকিৎসা নেই তাই একমুহূর্তের জন্যও আপনি আর হাসপাতালে রইলেন না। একদীর্ঘ লাফে চলে গেলেন বাসায়। বাসায় গিয়ে বসতে না বসতেই টিভিতে জানতে পারলেন আপনার ভাইরাসজনিত রোগটির এন্টিভাইরাস আবিষ্কারের তথ্য। সমস্ত টাকাপয়সা নিয়ে একমুহূর্তও দেরি না করে চলে গেলেন আবার হাসপাতালে। হাসপাতালে গিয়ে দেখতে পেলেন পুঁজিবাদের দুইভাগ করা পশ্চাৎদেশ। আপনার সামর্থ্যের কাছে সমস্ত আশা উবে গেলো। ধীরে ধীরে নিথর হয়ে গেলো আপনার শরীর। মুচকি হাসি দিলেন। এবার সত্যিই আপনার ঘুম ভাঙলো।
৩
শেষ আশ্রয়স্থল ভেবে আঁকড়ে ধরেছি যে স্থল পুঁজির জাতাকল তাকে বানিয়ে ফেলে পরিকল্পিত প্লট। প্লটগুলো উচ্চতায় বড় হয়। বড় হতে হতে সুউচ্চ ইমারত। আমাদের কান্না স্পর্শ করে সুবর্ণরেখা।
৪
অ্যালেন গিন্সবার্গ এর প্রতি
একটা বাস্তবিক ওয়াশিং মেশিন দরকার। নদীগুলো করতাম বিধৌত,
খালগুলো পরিচ্ছন্ন,
নালাগুলো পরিশুদ্ধ। পৃথিবীর বুকে শিরা-উপশিরা হয়ে বয়ে যেতো বিশুদ্ধ জলরক্ত। সড়কগুলো ধুয়ে ঝেঁটে দিতাম অবাঞ্চিত সব ধূলো। ধুয়ে ফেলতাম নিজেকে,
ভেতরের সব অমানবিক সত্ত¡াকে। ধুয়ে ফেলতাম ইরাক,
আমেরিকার সব সৈন্যকে। ধুয়ে ফেলতাম আমেরিকা,
ভারত, চীন, রাশিয়া, পৃথিবীর দখলদারিত্ব ও খবরদারির মানসিকতা। ধুয়ে দিতাম আকাশ,
ড্রাইওয়াশ করে উড়িয়ে দিতাম সব এসিড-জল। ড্রাইওয়াশ করতাম জাতিসংঘ নোবেল কমিটি ও অন্যান্য। ড্রাইওয়াশ করতাম গণতন্ত্র স্বাধীনতা শান্তি আরও অনেক শব্দ। ধুয়ে নিতাম সমাজতন্ত্র,
মৌলভী লোকটাকে ধর্ম ছেড়েই আসতে হবে কট্টর এই অন্ধত্ব।
মিজান মজুমদার
করোনার আত্মকথা
প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হও যদি
লালসার লকলকে জিহ্বা
গুটিয়ে নেবে তুমি
আমি চলে যাবো।
যদি অঙ্গীকারাবদ্ধ হও
আধিপত্যের আগুনে আর পুড়বেনা
কোনো ভ‚মি
চলে যাবো আমি।
যদি শপথ লও
ক্ষমতার দম্ভে আর কোনো
রক্ত খাবেনা তুমি
চলে যাবো আমি।
যদি প্রতিশ্রুতি দাও
পাপ ও পতন চ‚ড়ায় দাঁড়িয়ে
আর কোনোকালে প্রতিপক্ষ ঘায়েল করতে
খুন ধর্ষন ও লুন্ঠনের আয়োজন করবেনা
চলে যাবো আমি।
যদি অন্তরীক্ষে একটি বীজ লাগাও;
জীবন প্রেমের
পরমতসহিষ্ণুতার
পরম্পরা ভালোবাসার
চলে যাবো আমি।
যদি দম্ভ আর ক্রোধের বিষবাষ্প থেকে
বেড়িয়ে আসো তুমি
যদি রত হও ক্ষমা প্রার্থনায়
চলে যাবো আমি।
যদি প্রতিশ্রুতি দাও
পৃথিবী নির্মাণে পাপের গুহা থেকে
বেড়িয়ে এসে পূন্যের জোয়ারে ভাসবে তুমি
চলে যাবো আমি।
সুমন মন্ডল
প্রকৃত রাজা
আকাশ আজ স্বচ্ছ
বাতাস আজ নয় বিষাক্ত
পাখির ক‚জন আজ আনাচেকানাচে
দূষণ আজ পরিত্যক্ত
আমরাই আজ দূষণের ভাগীদার
পাচ্ছি তাই সাজা
চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে
প্রকৃতি তুমিই রাজা।
কবি ও কবিতা
সাজ্জাদ সাঈফের কবিতা প্রসারিত করে অন্তর্দৃষ্টিকে
তানহীম
আহমেদ
--
কবিতা কি? ধারণা করি বাংলা তথা বিশ্বকবিতা ভাষার একটা স্বতন্ত্র খরস্রোতা নদী। যার পরতে পরতে পাথর। সে পাথর আটকে দিতে চায় কবিতার গতিপথ। পাল্টে দিতে চায় ভাষার জীর্ণ পুরোনো আঙ্গিককে। কবি সেই নদীতে ভাসমান এক নৌকোমাত্র। যাঁর উদ্দেশ্য মহাকাল কিংবা কিছুই না। একটা অর্থহীন জার্নির ভিতর। ধরা যাক, একটা দীর্ঘ বাক্যবন্ধের ভিতর দিয়ে নিজের বৈচিত্র্যময় জীবনটা কাটিয়ে দিতে জানেন একজন কবি। কিংবা ধরা যেতেই পারে কবি সেই নদীপাড়ের একজন আশ্চর্য জাদুকর, দুপুরের রৌদ্রমাখা অস্তরেখায় যিনি পলে পলে তুলে আনেন প্রাণচঞ্চল শব্দরাশি। সাধনার ফসল। ফসিল।
কবি সাজ্জাদ সাঈফের কবিতা আমাদের এভাবেই ভাবতে শেখায়। প্রসারিত করে আমাদের অন্তর্দৃষ্টিকে। যেন একফালি রোদ শুষে নিচ্ছে সমস্ত বিকেলটাকে আর জার্সির মাঠে মেষ চড়াচ্ছেন আশ্চর্য সেই কবিবর। হাওয়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যিঁনি তার কবিতার খসড়া এঁকে যাচ্ছেন। আলোচ্য কবি তাঁর কবিতার এক পর্যায় এসে বলেন-
“পুরাতন গানের ভঙিমাসহ, অন্তর টাচ করে করে
হেঁটে যাওয়াতে আমার আনন্দ যতো, আততায়ী শীত জানে...”
আমরা জানি যেই কবিতা মানুষের অন্তর ও মস্তিষ্কে একইসঙ্গে আঘাত করে তাকেই সফল কবিতা হিসেবে ধরা হয়। কবিতার এই দিকটা কবির দীর্ঘ পাঠাভ্যাস এবং নির্মোহ সাধনার ফল হিসেবেই কবিতায় ফুটে ওঠে, এই কবির কবিতায় আনন্দের সাথে যার স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই। সেই আনন্দের স্পর্শ আমরাও পাই তাঁর কবিতাপাঠে।
“... নিঃশ্বাসে ত্রিভুজ আঁকে প্রেমপত্র!
সাধু বা সন্ত নই, তুমি জানো, বুকে আছে কাঁটার পত্রালি”
“...হয়তো ভালোবাসে তাই প্রেমভাব নিয়ে ছাতা
মেলে ধরে, বৃষ্টি এলে...”
কবি সাজ্জাদ সাঈফের কবিতায় নতুন এক আঙ্গিকে আমরা উঠে আসতে দেখি প্রেমের সেই চিরায়ত ভঙিমাকে, আবেদনকে।কবিতায় প্রেম একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও এই বিচিত্র ন্যারেটিভে গতানুগতিকভাবে আমরা কোথাও’ই উঠে আসতে দেখি না তাঁকে। সে’ই কাঁটার পত্রালির আঘাত প্রেমিক বৈ আর কে জানে! কবির ভাষায় কিছুটা ভিন্ন ইমেজারির ভিতর দিয়েই উঠে এসেছে সেই যন্ত্রণা। প্রেমিকের বুকের ভেতরের অন্ধকার কবরের দীর্ঘশ্বাস...
“পিতার কফিন সয়নি যে কাঁধ
কোনো বাক্যই তাকে দিতে পারে না গন্তব্যের খোঁজ...”
সদ্য পিতৃবিয়োগে দগ্ধ কবি নাঈম ফিরোজকে উৎসর্গ করা এই কবিতায় কবি তাঁর করুণ ভাষার তুলিতে টেনে ধরছেন পিতৃ বিয়োগের ব্যথাকে। তার কবিতায় এভাবেই উঠে এসেছে জীবনের নানা রং ও দিক।
“লিখে দিলাম অর্ধ-সকাল তোমায়;
লিখে দিলাম গোলাপবর্ণ গান।”
র্যাবো/পাররা কবিতার প্রচল অস্বীকার করে দেখিয়েছেন, প্রথাগত সমাজকে বিনির্মাণের কথাও বলে গেছেন যুগে যুগে হুইটম্যান-নজরুল-সুভাষ-নবারুণ প্রমুখ, সাজ্জাদ সাঈফ নিজস্ব আঙ্গিকে সমাজকে দেখেন এবং কবিতায় নতুন আমেজ তৈরি করতে প্রয়াসী হন, Art for art shake এবং জীবনের জন্যেও এই কবির কলম ব্যতিক্রমী রকমের একাত্ম-
‘হাত এঁকেছি, হাতের মুঠোয় তোড়া
ফুল এঁকেছি, ফুলের নামটি গাঁদা;
মৃত্যু কেমন, ছুটছে তাহার তাড়া?
পাঁজরটি আজ শিশিরচোয়া, ধাঁধা!’
আবার
‘আমাদের সময় নগণ্য, মিথ্যারা প্রসাধনী আজ;
যার বুকে জেগে থাকে গানের তাড়না, মঙ্গল-স্বর
তার দিকে অজস্র তির, ছুটে যায় সমাজ-ধারণা হতে’
নতুন শব্দ-ইমেজারি-বাক্যধরণ ব্যতীত মানুষকে দেয়ার জন্য কবির আর কাছে অবশিষ্ট থাকে না কিছু। এই কবিতাগুলো যা আমরা নতুন ও ভিন্ন স্বরে খুঁজে পাই বারবার। এর প্রতিটি পঙক্তিতে কবি যেই চিত্রকল্প তার তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন তা আমাদের সবারই খুব চেনা অথবা অচেনা। যা আমাদের শুনিয়ে যায় নতুন সুরে বাঁধা গান। এঁকে দিয়ে যায় তার স্বেদ এই বিষণ্ণ মার্চের বৃষ্টিস্নাত রাত্রির এপিটাফে।
“সমস্ত গানের ভেতর এক এক করে ঢুকে যাচ্ছে রাস্তার হর্ন”
“এই জন্ম ও জন্মবিজারক রাত্রি
টেনে ধরে আছে শেষতম তারাটিকে”
“এই ত্রিদিক মেঘের ভিতর মা’কে
দেখি নাই হাস্যোজ্জ্বল, দেখি নাই কতকাল”
“শীতে কতোভাবে কাঁপতেছে চাঁদ একা
ভাঁজ-ভেঙে নামে মহাকাশ বলাকা”
এমন অজস্র চিত্রকল্প, ভিন্নস্বর, বাক্যভঙি আমরা খুঁজে পাই কবির কবিতায়। যা তাঁকে অন্যদের থেকে করেছে আলাদা সুস্পষ্টভাবে। এক্ষেত্রে জীবনদাশের একটা কবিতার পঙক্তি উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক-
“অনেক লোকের মাঝে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা”
সাজ্জাদ সাঈফের কবিতা পাঠেও আমরা দেখতে পাই একটা ভিন্ন কিছুকে তুলে ধরবার প্রয়াস, সম্পূর্ণ নিজের স্বরে। চিত্রকল্পই কবিতাএই অনুসিদ্ধান্তে অনুগমন করলে বলা যায় সাজ্জাদ সাঈফ ধীমান কবি, বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখক।
বহুদিন ব্যাকফুটে এসে কবির তৃতীয় কবিতার বই। আগের দুটি বইকবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা ও মায়ার মলাট’র ছায়া থেকে অনেকটা দূরে সরে এসে কবিতাগুলো জন্মলাভ করেছে। কবির এইসব নিবেদিত জার্নিকে আরও আরও পাঠের আশা ব্যক্ত করে শেষ করছি অনুভূতির বয়ান...
সুন্দর...
ReplyDeleteভালো কাজ হচ্ছে
ReplyDelete