Monday, May 25, 2020

শিল্প সাহিত্য ৩৩

শনিবার ২রা জ্যৈষ্ঠ ১৪২৭, ১৬ই মে ২০২০




যদি এমন হতো
রোজী নাথ 

আকাশের বুকে তারাদের মিটিমিটি হাসি আর দরজা খোলা দখিনা বাতাসের বুক ছুঁয়ে সমস্ত সত্যগুলো অকপটে বলতে পারি, যেমনটা বারবার তোমায় বলতে পারি ‘ভালোবাসি’। ধারনাগুলোও কেমন যেন অক্ষরহীন পথিক , যারা অচেনা সুরের আবেশে অহরহ রং পালটায় আবহাওয়া আর সময়ের বিলাসী পায়ে পায়ে। দূরের পথিক কবেকার সেই সোনালী শৈশবকে যদি এখনও একটিবারের মতো কাছে পাওয়া যেতো। সেই ঝড়ের সাথী চঞ্চল উদ্যমী নির্ভীক সময়টাকে একটু কাছেপিঠে জড়িয়ে নিয়ে সব ভুলত্রুটি শেষবারের মতো গঙ্গাবিসর্জন দিতাম; নিঃসঙ্কোচে নিজেকে শুধরে নিয়ে নতুন এক সুন্দর সাতরঙা বর্তমান গড়ে তুলতাম আগামীর আনাম ছোঁয়া আমন্ত্রণে।

গদ্য জীবন
এম, এম বাহাউদ্দীন

তোমার বুকে এখন গদ্যের চাষ,
যে বুকের অনুর্বর পতিত জমি আবাদ করে,
শত কষ্টে বুনেছিলাম কবিতার বীজ!
সেখানে আজ ছন্দহীন গদ্যে ভরা।
তোমার বুকের সমস্ত আগাছা উপড়ে ফেলে
মরুর বুকে জল ঢেলে ঢেলে আমিই করেছি চাষ যোগ্য,
অথচ আজ কবিতার ক্ষেতে পঙ্গপালের বাস।
আমার আশ, নিশ্বাস, সব যেন হয়ে গেছে শেষ!
তোমার বুকের জমিন আজ গদ্যে ভরেছে বেশ।

যখন ছন্দ ছিলোনা বুকে, ছিলোনাকো চাষের জল।
যখন আগাছা ছিলো বুকে, ছিলোনাকো খাদ্য ফল!
তখন আমাদের মত কবিরা তোমাদের খাদ্য ছিলো!
তোমাদের মুখে তুলে দিয়েছে কবিতার জল খাবার।
অনামিকা-নিশিতা-হেলেনারা ভালো থাকে বেশ গদ্যে কোলে!
শুধু ছন্দ দিয়ে কবিতার বুকে,
ছন্দহীন পথ চলা এই কবিতা চাষাদের।

তোমার বুকের ফসল, পৌষে ওঠেনি আমার ঘরে,
তাই আমার আত্মা খাদ্য বিনে মরে।
আবার করবো চাষ, নেই কো সে আশ,
তাগিদ আসছে বেশ, আবার নতুন জমিন করো চাষ!
কি করে বলি মা-রে, সবটুকু শ্রম দিয়েছি যে বুকে,
এতটুকু ফসল আসেনি তার থেকে ঘরে।
কি আশায় আমি, বদ্ধ ভ‚মি, আবার করবো চাষ,
ছেড়েছি আশা, আমি এক চাষা, করি কুঁড়ে ঘরে বাস।
যে দেখে আমায়, সেই ছুড়ে দেয়!
তাই আশা ছেড়েছি সেই কবে!
এখন শুধু, বুকটা ধূ ধূ, সেই চাষের স্মৃতি বুকে নিয়ে,
কবিতা লিখি, কথার বুননে বেদনার ছন্দ দিয়ে।।

জাহাঙ্গীর জয়েস 
মানুষ

তুমি মানুষ !  মনে হয় না...

মানুষ হলে ঘর বলো আর ছাউনি কোথাও তুমি নির্যাতীত হতে না
মানুষ হলে তুমি ভূমিধ্বসে মারা পরতে না
মানুষ হলে তুমি জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হতে না
মানুষ হলে তুমি সাগরে ডুবে মারা যেতে না
মানুষ হলে তুমি ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিতে না
মানুষ হলে তুমি খুন হতে না
মানুষ হলে তোমার ঘরবাড়ি পুড়ে যেতো না
মানুষ হলে তোমাকে দেশ ছাড়তে হতো না

মানুষ হলে তোমার স্যুট কোর্ট থাকতো
ফিনফিনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী থাকতো
মানুষ হলে তুমি অট্টালিকায় থাকতে
তোমার দামি গাড়ি থাকতো
চোখ ধাঁধানো অফিস থাকতো
ব্যাংক অফিসার তোমার সাথে মিষ্টি করে কথা বলতো
পুলিশ তোমায় সালাম দিতো
বড় বড় নেতা তোমায় চায়ের দাওয়াত দিতো

আসলে তুমি মানুষ না...

গারো পাহাড়ের দিনলিপি
অনিন্দ্যকেতন গোস্বামী  

আমার যে হাত ধরে রাখে বই
কালো অক্ষর পড়ে থাকে মনের গাঁথুনিতে...
আমার পা খুলে রাখি লাল মাটির সরানে
অথচ গারোপাহাড় বসে থাকে আমাকে একদিন চুনামাটি মাখাবে বলে...
গাঢ় অমাবস্যার তমিস্রায় আত্মারা দ্রবীভ‚ত হলে
পৃষ্ঠা থেকে উলম্ব হয় উপন্যাস,
চরিত্ররা উঠে এসে বসে
বিড়ি চায়...
তারপর গল্পের সুতো দিয়ে হাত বেঁধে ফেলে
নাগাদের মত সাদা ছাই মেখে সাদা পৃষ্ঠা হয়ে যায় এক সময়ে তারা...
আমার পা দুটো খুলে এনে রাখি গারোদের চিহ্নিত পথে।
আমার পা ক্রমে আত্মা হয়ে ওঠে 
চুনামাটি মেখে পৃষ্ঠায় অক্ষর সাম্রাজ্যে...
মূল: কাহলীল জীবরান
অনুবাদ: মাজহার জীবন
ভালবাসা আর ঘৃণা

এক নারী এক পুরুষকে বলল,“ভালবাসি তোমাকে”। পুরুষ জবাব দিল,“আমার হৃদয় তোমার ভালবাসার যোগ্য"।
নারী এরপর বলল,” তুমি কি আমায় ভালবাস না?”। এ কথা শুনে পুরুষ তার দিকে তাকিয়ে থাকল কিন্তু কোন জবাব দিল না। এরপর নারী চিৎকার জুড়ে দিল, “ঘৃণা করি তোমায়।"
এর জবাবে পুরুষ বলল,” আমার হৃদয় তোমার ঘৃণা পাবার যোগ্য”

অণুগল্প
ভাই
সর্বানী রিঙ্কু গোস্বামী

হাড়জ্বালানে বিচ্ছু একখান ভাই বটে কঙ্কা ওরফে কাঁকনের.. জোচ্চোর পকেটমার মাতাল কি নয়! তবু মায়াও হয়, প্রাণে ধরে ফেলতেও পারেনা একেবারে। মা যখন চোখ বুঁজলো মানিক তখন এইটুকুনি পুঁচকে চামচিকে একটা। চুঁইচুঁই করে কাঁদে, মুখের ভেতরটা লাল টুকটুকে আর মুখে বোতল ধরলে চোঁ চোঁ করে টানে যেন ব্রহ্মতালু অবধি পৌঁছে দেবে দুধ। বাবা তো সারাদিন বাসে খালাসিগিরি করে ঘরে ফিরতো মদ আর রাগে টং হয়ে। তখন ঐ চ্যাঁ ভ্যাঁ শুনলে গলা টিপেই মেরে দেবে চামচিকেটাকে এমন হাবভাব। তো তখন কাঁকনই সাতবছুরে মা মানিকের। বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখত যেন বাঁদরের ছা একটা।
চামচিকে বাঁদর এসব থেকে মানিকের আর মানুষ হওয়া হয়ে উঠলো না কোনোদিন। গোটা কুড়ি হাতপাখা পিঠে ভেঙেও ইস্কুলমুখো করা গেলনা তাকে। বরং কাঁকনেরই এই ছিস্টির সংসার সামলাতে সামলাতে হাতে কড়া আর চুলে পাক। বাপ মরেছে বছর দশেক, এখন কাঁকনেরই সংসার। মানিককে তো বছরের মধ্যে ন মাসই সরকারি অতিথি, কোনো না কোনো কেসে জেলে!
তবু যখন দাঁত বের করে দিদি বলে এসে দাঁড়ায় , কাঁকনের বুকের ভেতর টা যে কেমন হু হু করে! একদম মায়ের মুখটা যেন ভাইয়ের মুখে কেটে বসানো। সেই হাসি, সেই চোখ অবিকল। কতো সাধ করে ভাইয়ের নাম রেখেছিলো “মানিক!” স্বপ্নও ছিলো নিশ্চয়ই অনেক, তা পূর্ণ আর করতে পারলো কই? বাপ রেগে গেলে চেঁচাতো, বলতো “হারামজাদা মা খেগো! গলা টিপে মেরে দিতে হয়।” কাঁকনের কিন্তু ভারি মায়া লাগে, আহা গো মায়ের দুধটুকু অবধি পেল না বেচারা। সে যথাসাধ্য করেছে, করেও তবু দিদি কি আর মা হয়?
কাঁকনের চোখে তার মায়ের চোখদুটি ভাসে, সেই নরম করে কাঁআআআকোন সোনা ডাক আর সেই টকটকে লাল টিপ পরা কোঁকড়ানো চুলে ঘেরা কপাল আর নরম তালু দিয়ে কপালে হাত বুলোনো। এমন অভাগা ভাইটা, এমন মায়ের কোলে শুতেও পেলনা, বাবার গালাগালই শুনলো খালি। সেই বাবাকে দেখতে পেলনা যে বাড়ি ফিরেই একগাল হেসে মা কে বলতো, “কি গো, খোকন মা বলছে?”
ভাইটা আজ ফিরবে জেল থেকে ছমাস পর, এইবার ছিনতাই। কম ডান্ডাপেটা কি আর খেয়েছে জেলে থাকতে? তবু কি লজ্জা আছে... ফিরে এসেই সেই একগাল হেসে বলবে, “পরোটা করিস নি দিদি?” শিরা ওঠা হাতে প্রাণপণে ময়দা ঠাসে কাঁকন, গরম গরম ছ’টা পরোটা আর আলুচচ্চড়ি করে ফেলতেই হবে ভাই আসার আগে। মা না হোক, সে দিদিই তো। এই ভাইটার কথা ভেবেই তো সে মা হতে চায়নি... কোনোদিন!

হস্তাক্ষর
সম্পাদক- আবু জাফর সৈকত ও কায়েস সৈয়দ।
বর্ষ ১৫ সংখ্যা ১১, ফেব্রæয়ারি ২০২০।
প্রচ্ছদ : ইউসুফ বান্না
প্রকাশনায় : ধীমান সংসদ, নবীগঞ্জ, বন্দর, নারায়ণগঞ্জ।

হস্তাক্ষর : প্রকৃত ছোটকাগজের প্রতিভ‚
আনোয়ার কামাল

বিবর্ণ এক সময় পাড়ি দিচ্ছি আমরা। যেখানে সকল ভালো সাংঘর্ষিক। অনুদান আর সাহায্যের পাঁয়তারায় রোহিঙ্গা ইস্যু মাদুলি হয়ে ঝুলে থাকে রাষ্ট্রের গলায়! গাছ যেখানে ফুসফুস, নদী যেখানে রক্ত, মাটি যেখানে মাংস সেখানে নগরায়ন এখনও অপরিকল্পিত। নিজেরাই বিলীন করা নিজেদের অস্তিত্ব, বাহ্যিক উন্নয়ন যেনো শাঁখা হয়ে ফোটে সৌন্দর্যে! গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মুক্তি শব্দঝুরি সবসময় ক্ষমতার পুজি! হতাশার নাটাই ঘুরায় সময়ের প্রহর, স্বপ্ন তবুও ঘুড়ি হয়ে জুড়ায় আমাদের আকাশ, আশায় প্রাপ্যতার অখÐ আকাশ। এভাবেই ‘হস্তাক্ষর’র সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে; যা থেকে এ পত্রিকাটির সম্বন্ধে একটা ধারণা পাওয়া যায়।

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক ছোটকাগজ ‘হস্তাক্ষর’ দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে বেরুচ্ছে। এবার বইমেলায় ২১তম সংখ্যা হিসেবে বের হয়েছে। এ সংখ্যায় গদ্য, কবিতা, অণুগল্প, ছোটগল্প, অনুবাদ কবিতা ও বই আলোচনা দিয়ে ৪৮ পৃষ্ঠার এ সংখ্যাটি সাজানো হয়েছে। বাঁশ কাগজে একরঙা কালো প্রচ্ছদে পত্রিকার আলাদা একটা ইমেজ তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছে।
ছোটকাগজের যে প্রচলিত ধারণা পত্রিকাটি পাঠকের সে আকাক্সক্ষা পূরণে সক্ষম হয়েছে।

এখানে ইউসুফ বান্না’র “হাউ টু রাইট এ শর্ট স্টোরি : এ লার্নিং কার্ভ অফ ইটস ওউন” শিরোনামে গল্প লেখার কলাকৌশল নিয়ে লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ, বনফুল, মার্কিন লেখক কার্ট ভনেগাট, এডগার এলেন পো’কে উদ্ধৃত করে ছোটগল্প লেখার কলাকৌশল নিয়ে একটা চমৎকার আলোকপাত করেছেন। যারা ছোটগল্প লিখতে চান কিংবা লিখছেন তাদের জন্য উপযোগী লেখাটি আমার বেশ ভালো লেগেছে। অনেক ধন্যবাদ লেখককে।

কায়েস সৈয়দের ‘মুক্তি’ নামের ছোটগল্প, মোহাম্মদ জসিমের ‘অতঃপর মহিমা একটি সন্দেহ ও দুইটি মার্বেল লইয়া ঘুমাইতে গেল’, কবির বিটু’র ‘আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়’ ও ইলিয়াস বাবর এর ‘বাম পা আগে দিন’ অণুগল্পগুলো ভালো চমৎকার প্লটে সাজানো হয়েছে। পাঠকের ভালো লাগবে বলেই আমার ধারণা। এধরনের ছোটকাগজে তরুণ লেখকদের জায়গা করে দেওয়ার জন্য পত্রিকার সম্পাদককে ধন্যবাদ দিতেই হবে। আগামী দিনের লেখক তৈরির জন্য ছোটকাগজগুলোর ভ‚মিকা অনস্বীকার্য। ‘হস্তাক্ষর’ তারই সহযাত্রী।
এ সংখ্যায় কবিতা লিখেছেন, অনিন্দ্য দ্বীপ, আদিত্য আনাম, বিনয় কর্মকার, রুদ্রাক্ষ রায়হান, জাবেদ ভ‚ঁইয়া, নাহিদ ধ্রæব, ডন শিকদার, রুদ্র সাহাদাৎ, বিষাদ আব্দুল্লাহ, ফরহাদ নাইয়া, দিপংকর মারডুক, ম্রিতোষ তত্রাচ, কাজী শোয়েব শাবাব, নাদিয়া জান্নাত, উবাইদুল্লাহ রাফী, বিবিকা দেব, পাÐব মনদেহী, রুকাইয়া পাখি, মাহমুদ হাসান আবির, মোকলেছুর রহমান, অর্পা হাসান, সাচি সানন্দ, শামীম আরেফীন, মুহাম্মদ ফরিদ হাসান ও সীমান্ত হেলাল।

No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক