বৃহস্পতিবার ১৭ই বৈশাখ ১৪২৭, ৩০ই এপ্রিল ২০২০
কবিতা
সঞ্জয় আচার্য
এক আমেরিকান পাগলার আত্মবিলাপ
আমি আমাকে সরাইখানার টেবিলে তুলে
চিৎকার করে বলছি ' নাচরে প্রেসিডেন্ট নাচ'
আমি আমার গায়ে ছুঁড়ে মারছি
কখনো চেয়ার,কখনো ল্যাপটপ
মাঝে মাঝে ঘোষণা করছি আমার মাথার দাম।
আমি নিজের হাত পিছমোড়া বেঁধে
নাকের সামনে ধরছি বুল কুকুরের বমি-
শানিত আঙুল চোখের মনিতে ফুঁটিয়ে দিয়ে বলছি
ভ‚তে পেয়েছে আমায়,ডাইনিতে,
আমি অন্ধকারে শেওড়া তলায়
চিৎকার করে-পাখিকে বলছি মাছ,
মাছকে বলছি গাছ।
লোকালয় জুড়ে মৃতের ছায়া,আমি
লঙ্গরখানা খুলছি-
আমি নিজের কলজে, মেটুলি,কলম
বাড়িয়ে ধরে বলছি-দাও, দাও যতটা পারো
তেলা মাথায় তেল,ওষুধে ওষুধ
আমি স্ট্যাচু অফ লিবার্টির মাথায় চড়ে
ডলার ছুঁড়ে বলছি- দেখ, দেখ তোরা
পৃথিবীর ইশ্বর কে।
যে ইশ্বর আজ মৃত।
কাজী জুবেরী মোস্তাক
লাশঘর
এই পৃথিবীটা যেন আজ এক লাশঘর
মরছে মানুষ হোকনা সে আপন কিম্বা পর;
পৃথিবীর উঠোন জুড়ে আজ কারফিউ
এমন দৃশ্য এ ব্রহ্মাণ্ডে দেখেনি আগে কেউ ।
জমজমাট এই মহাবিশ্ব আজকে স্তব্ধ
কাঁটাতারের এপার ওপার নেই কোন যুদ্ধ ;
জাত কিম্বা ধর্মে আজ নেই ভেদাভেদ
মানুষ মরছে মহাবিশ্বে তাইতো আজ খেদ ।
চেনা পৃথিবীর যেন অচেনা এক রূপ
জমজমাট এই মহাবিশ্ব এক নিমিষেই চুপ ;
ঐার ভেতরে ছিল প্রতিশোধের নেশা
সেও আজ করছে মানুষ বাঁচানোর আশা ।
আনন্দ উল্লাসে মেতে থাকা এ নগরী
আজকে যেন হয়ে গেছে একটা মৃত্যুপুরী ;
মানুষ তুমিও মানুষের পাশে দাঁড়াও
পৃথিবী জুড়ে ভালোবাসার সৌরভ ছড়াও ।
অনিন্দ্য দ্বীপ
মুখস্ত শ্লোক
ধরো, রাতই একমাত্র উর্বর জমি।
আমরা বীজ বুনে যাচ্ছি স্বপ্নের-
যেখানে গাঢ় সবুজ হয়ে ফুটছে প্রেম
আর মুগ্ধতার রূপকথায় তুমি রাজকন্যে
আলোর মায়াবি ঘোর তোমাকে কুর্ণিশ করছে
তোমার স্তুতি বর্ণনায় স্বয়ং জিউস
অথচ তুমি বৃক্ষের নীচে ঘুমিয়ে পড়েছো
স্বপ্নের ভেতর একটা কাটাঘুড়ি
অস্তিত্বের এন্টিনারে ঝুলে আছে..,
তুমি তোমার অস্তিত্বের নামে চুমু খাও
বুকের খামে লিখে রাখো গোপন প্রেমপত্র-
ঘোড়ার খুড়ের শব্দে ঘুমভেঙে গেলে
রাজপুত্তের বুকে বসিয়ে দিও খঞ্জনী
প্রবাহিত রক্তে যদি লিখে তোমার নাম
তাকে জীবনের প্রতিশ্রুতি দিও
তাঁর নামেই পড়ো গোপন জিকির...
রফিকুল নাজিম
আড়াল
চোখের ভিতর চোখ যে থাকে
মনের আড়ালে আরেক মন,
ভিতর বাহির এক কারো না
মিথ্যে হাসির সব আয়োজন।
দাঁত কেলিয়ে মুখোশ হাসে
গোপনে ঝুলে ফাঁসির দড়ি,
সবাই আসে সুখ কুড়াতে
বোকা আমি আড়ালেই মরি।
রোদ্দুর রিফাত
মৃত্যু
জীবন লুটিয়ে পরবে,
ছটফট করবে করোনায়
পাবে না কাছে কোনো প্রিয়জনকে
দু'চোখ ভিজে যাবে
ব্যকুলতা বেড়ে যাবে
আকুল আকাক্সক্ষা বেঁচে থাকার
জপবে মুখে মুখে স্রষ্ঠার নাম
আতঙ্ককের পাখি করবে উড়াউড়ি
শোকাহত পাখি পালক ফেলে-
হঠাৎ হয়তো বা
শিকারির শীসার গুলির আঘাতে
লুটিয়ে পরবে মাটিতে,
কেউ ছুঁবে না।
আধুনিক প্রযুক্তির লম্বা হাতে-
বৃহৎ গর্তে অজস্র মৃতে ভিড়ে
হয়তো বা আমিও রবো।
ভাষান্তর: কায়েস সৈয়দ
মূল: জঁ ককতো
নরম মিঠাই
একটি যুবতী মেয়ে নেও
পূরণ করো তাকে বরফ এবং জিন দিয়ে
ঝাঁকুনি দাও সর্বসমেত উভলিঙ্গ বানাতে
এবং ফিরিয়ে দাও তাকে পরিবারের কাছে
হ্যালো, হ্যালো, অপারেটর কলটি কাটবেন না
আহ! পশুদের রাজা হওয়া কতো কষ্টের,
-কেউ কোনো কথা বলে না
ওহ! প্রেম খারাপের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ
একটি যুবতী মেয়ে নেও
পূরণ করো তাকে বরফ এবং জিন দিয়ে
মুখে দাও একফোঁটাঅ্যাঙ্গোসতুরা
একজনকে চিনতাম যে ছিলো অসুখী প্রেমে
যে তার ড্রামে বাজিয়েছিলো চপিনের স্বপ্নীল সঙ্গীতাংশ
হ্যালো, হ্যালো, অপারেটর কলটি কাটবেন না
আমি বলছিলাম... বলছিলাম...হ্যালো, হ্যালো?
-কেউ কোনো কথা বলে না
তুমি কি অনুসন্ধান করে পাও না যে শিল্প হলো কামড়...
আমরা বাচ্চাদের বলি- হাত ধোও
কিন্তু বলি না দাঁত ধোও...
নরম মিঠাই-
অণুগল্প
চুল
সোমনাথ বেনিয়া
মেয়েদের মাথার চুল খুব লম্বা হলে সাধারণ লোকেরা যেমন বলে, দেখ মেয়েটার চুল পাছা পর্যন্ত ছাপিয়ে গেছে, সেরকম মিনতির চুলও পাছা ছাপিয়ে আরও অনেকটা নিচে চলে গেছে। এই ঘন লম্বা চুলের গোছ তার বিয়ের পিছনে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিল।
বিয়ের পর মিনতির শাশুড়ি তাকে বসিয়ে মাথার চুলে ভালো করে তেল মাখিয়ে আঁচড়ে দিতো প্রতিদিন। কীভাবে চুলের যত্ন নিতে হয় তাকে পাখি-পড়া করে বোঝাতো। মিনতির এই চুলের গোছ সব থেকে বেশি পছন্দ করেছিল তার হবু শাশুড়ি। এখন তো সবাইকে তিনি বলে বেড়ান যে চুল যদি হতে হয় তাহলে যেন তার বৌমার মতো হয়। এই বলার মধ্যে তিনি কোথায় একটা গর্ব অনুভব করতেন। এই চুল যেন সংসারকে একটু অন্যরকম ভাবে বেঁধে রেখেছিল।
যাই হোক সময়। প্রথমে শাশুড়ি মারা গেল। মিনতির ছেলেটা তখন সাবালক হওয়ার মুখে, এমন সময় তার বরটাও মারা গেল। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বাস্তুভিটে আঁকড়ে কোনোভাবে ছেলেটিকে বড়ো করলো। বিয়ে দিল। এখন তার ঝাড়া হাত পা। সে নতুন করে আবার ওই চুলের গোছের যত্ন নিতে শুরু করলো যা সময়ের আঘাতে অনেকটাই তার জৌলুস হারিয়েছে। না তেমন তা লম্বা আছে, না তেমন ঘন গোছ আছে। তারপর উপর হালকা পাকও ধরেছে।
এটা তার কাছে একটা বেঁচে থাকার স্মৃতি। তবে একদিন ছেলে-বৌমার অনুপস্থিতে পাড়ার নন্দ নাপিতকে ডেকে তার সমস্ত চুল কাটিয়ে ন্যাড়া হয়ে গেল। নন্দের কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পুকুর ঘাটে গিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে সেই কেটে ফেলা চুল জলে ফেলে দিলো।
আসলে যে চুলের গোছ তার শাশুড়ির গর্বের কারণ ছিলো কিংবা হাওয়ায় উড়ে মুখে উপর ফুরফুর করলে বরের চুল সরানোর অছিলায় আদরের স্পর্শ পেতো, সেই চুলের গোছ বৌমার প্ররোচনায় তার ছেলের হাতের মুঠোয় মানাচ্ছে না ...
প্রবন্ধ
বাংলা ছোটগল্পের বর্তমান সংকট ও অতীত
আবু জাফর সৈকত
ছোটগল্প সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী মাধ্যম। আকৃতির দিক থেকে ছোট গল্প যতই ছোট হোক প্রকৃতির দিক থেকে ঐশ্বর্যশালী। বর্ণনার আরম্বর নাই, এক্ষেত্রে পরিমিতি বোধ গুরুত্ব বহন করে অনেক। মোট কথা নিজের কথাটি নিজের মন মতো করে বলতে পারা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলা হয় ছোটগল্পের পথিকৃত। আধুনিক ছোটগল্পের একপ্রকার নতুন রূপ সৃষ্টি করেছেন তিনিই। তবে শুরুটা ঘটেছে পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বর্ণকুমারী দেবী, নগেনন্দ্রনাথ গুপ্ত প্রমুখ সাহিত্যিকদের হাতে। ত্রিশ ও চল্লিশের দশক ছোটগল্পের স্বর্ণযুগ। দুইটি মহাযুদ্ধে মানুষের বিচিত্র অভিজ্ঞতা গল্পে নতুনত্ব সৃষ্টি করে। অনেকের নাম করা যায় তবে সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ, আবু ইসহাক, শওকত ওসমানকে রাখতে হয় সর্বাগ্রে। ৪৭ এর দেশ ভাগের পর দুই বাংলা আলাদা হল। দ্বিখন্ডিতকরণ, দাঙ্গা, উদ্বাস্তু সমস্যা গল্পে নতুন পথ রচনা করর। এর সাথে যুক্ত হলো ভাষা আন্দোলন, খাদ্য সংকট, আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব। উঠে এলেন- আলাউদ্দিন আল আজাদ, জহির রায়হান, আবুল খায়ের মুসলেউদ্দিন প্রমুখ। ষাটের দশকে পেলাম হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ ছফা, সেলিনা হোসেন, আবুল হাসনাত প্রমুখ। তারপর যে প্রেক্ষাপট: মুক্তিযুদ্ধ এবং নব্বই এর গণ-আন্দোলন। এসময়ের কয়েকজন গল্পকার হলেন- হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, শহীদুল জহির, জাকির তালুকদার প্রমুখ। পশ্চিমবঙ্গে কিংবা অন্যান্য বাংলা ভাষী অঞ্চলেও প্রচুর ভালো গল্প হচ্ছে। হাসান বা ইলিয়াস বা আবু বকর সিদ্দিক দুই বাংলাতেই পরিচিত মুখ। সুনীল-শীর্ষেন্দুর জনপ্রিয়তার বিষয়টি না বললেও চলে।
এখন একুশ শতক; বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তির যুগ। পুঁজির যুগ। অর্থ দিয়ে সবকিছু ক্রয় করার চেষ্টা চলছে সবখানে। যদিও বিতর্ক চলছে অনেক, উদ্বেগ বেড়েছে, রাষ্ট্রক্ষমতার ভিত আলগা হয়ে গেছে মহামারিতে। জাতীয় অর্থনীতি অনিশ্চয়তার খাদে হুবুডাবু খাচ্ছে। ক্ষুধা ও পিপাসা প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে। হৃদয়হীন মানুষের মিছিল বাড়ছে। ব্যস্ত হয়ে পড়ছে মানুষ তাই বিনোদনের সময় অল্পই। বর্তমান গল্পে তাই হতাশা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের বৈচিত্র্যই ভেসে উঠে। ছোট ছোট যে কোন বিষয় নিয়ে তৈরি হয় গল্প, অনুগল্প। অনুগল্পের পরিসর কম হওয়ায় গল্পকারের সংখ্যা বেড়েছে অসংখ্য যদিও গল্প কতটুকু হয়ে উঠে তা ভাববার বিষয়। সম্পাদনার সাথে যুক্ত হওয়ার ফলে অনেকের লেখা আমাকে পড়তে হয়। অনেক গল্প বাদ দিতে হয় কখনো সঠিক বিন্যাস না হওয়ায় আবার কখনো গল্পের মজা না থাকলে। গল্প পড়ে যদি কোনো আকর্ষণ বোধ না হয় তাহলে সে গল্প গল্পই না। গল্পের সমাপ্তিতে থাকতে হবে ক্লাইমেক্স অর্থাৎ ছোটগল্পের আরম্ব ও সমাপ্তি নাটকীয় হওয়া চাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়-
‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’।
রহস্য থাকবে কিন্তু রহস্য ভেদ করার চেষ্টা থাকবে না। থাকবে একটি স্থির দৃষ্টি নিরীক্ষণ। পাঠক স্ব-উদ্যেগেই যুক্ত হন যেন শিল্পীর সাথে, ঢুকে পড়েন বিষয়ের গভীরে। এডগার এলান পো এ বিষয়ে বলেন-
‘ভাল গল্প যা এক সিটিংএ পড়ে শেষ করা যায়’।
বর্তমান লেখকদের বড় সমস্যা- নিজের সৃষ্টির প্রতি প্রেমে পড়া। বিশেষ রচনার প্রতি দূর্বলতা লেখকের লেখার বৈচিত্র্যকে নষ্ট করে দেয়। ভালো লেখার একমাত্র কৌশল-নিরন্তর অধ্যয়ন, নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং নিরলস চর্চা। এক্ষেত্রে ছোট কাগজ কর্মীদের অবদান রাখার জায়গা সবচেয়ে বেশি। ছোটকাগজের দুর্দান্ত গল্পকারদের গল্প আদান-প্রদানের অভাবে কোথায় যেন ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। পারস্পরিক গভীর বিশ্লেষণ, সমালোচনা তাদের লেখাকে উত্তীর্ণ করতে পারে কালের খেয়ায়।
No comments:
Post a Comment