Saturday, May 16, 2020

শিল্প সাহিত্য ০৩

বৃহস্পতিবার ৩রা বৈশাখ ১৪২৭, ১৬ই এপ্রিল ২০২০



কবিতা

উবাইদুল্লাহ রাফী

গ্রাসিত

 

কোনো স্থান ক্যানো ভাবা গেলো না আর? যারে ভালোবাসি, এতো পর্দার পরও, তার চেহারাই শুধু উজ্জ্বল হয়ে আসে।

নিচ থেকে উঠতে উঠতে অনেকবার যদিও গিয়েছি পড়ে, আমি প্রতিবার উঠতে চেয়েছি, চূড়াদৃষ্টে আমি দাঁড়ানোর প্রেরণা পেয়েছি।

তাপ বিশ্রামবিনা এই শীতে, খাঁজহীন পাহাড়ের উপর উঠেছি, ক্রমশ স্ফীত শীতে, সেইখানে থাকা শুধু মোমে হাত দিতে পারি নি; শিখার বাহু আর উচ্চতা আমার চামড়াকে ছিটকে দিয়েছে দূরে। তবু সেই শিখা মনে রেখেছি, বারবার ধরতে চেয়েছি।

শিখার সেই ড়া ছাড়া কি হেতু আর ভাবতে পারি নাই কিছু; প্রচুর পাহাড় পেরিয়ে সেই মোমের টিলাই আজো ভাবি;

শুধু তারে গ্রাস করার দিকে, এই শীতে ক্যানো নিজেই গ্রাসিত থাকি?

 

ফরহাদ নাইয়া কবিতা

বিকেল কি নারিকেল

কদবেল আমড়া

বিকেলের গায়ে থাকে

সকালের চামড়া।

দুপুর কি নুপুরের

টুপুরের তোয়ালে

দুপুরকে টানে রোজ

তিনমুখো বোয়ালে।

সকাল কি মহাকাল

অকালে পাকে রোজ

সকালের পিছু লেগে

দুপুরের ভুরিভোজ।

রজনী কি সজনীর

গজনীর মহারাজ

রজনীর বাম বুকে

লুকানো সে কারুকাজ।।

 

আসমা বেগম

নির্বোধ

 

এতো সব বাণী বার্তার

অনেকেই ডেম কেয়ার

দাড়িয়ে মুখোমুখি মৃত্যুর

 

আমরা যখন মুর্খ-নির্বোধ

তখন গুনতে হতে পারে-

অকল্পনীয় খেসারত

 

চারদিকে মৃত্যুপুরী

কাল নিশি দিচ্ছে ডাক

ঘুম কাতুরে এবার জাগ!!!

 

আবু জাফর সৈকত

দলদাস

 

আজকাল

ভবানি সাহারা

পদ নিয়ে বসে থাকেন

ভাবে-অভাবে।

বিশ বছরেও-

সাহিত্যের কর্মী চিনেন না

কেননা-

বলয়ের বাইরে চোখগুলো অন্ধকার দেখে।

তাই-

নব্বই পার্সেন্ট দলদাসে তাকে ফেলতে আমার দ্বিধা হয় না।

আর আমরাও-

জোট-মহাজোটে

যেতে পারি না।

 

অরবিন্দ চক্রবর্তী

অবান্তর

 

নিজের শার্টটা একদিন গাছকে পরিয়ে বললাম

তুই, মানে আপনি কি অরবিন্দ?

গাছ চুপচাপ

কোনো উত্তর পেতে না পেতেই

দেখি কাঁটার প্রাচীরে জোনাক জ্বলে।

 

একদিন নিজগৃহ থেকে আলোর প্রতি ছুড়লাম প্রশ্ন

সকল জোনাক কি অরবিন্দের ঘরের বাল্ব?

সেই থেকে তোমাদের বাড়ি চিত্রল উৎসব।

 

ঘটনার হইরই থেকে এখন বুঝি

রহস্যের অন্তরালে চলচ্চিত্র থাকে

আরও থাকে চুড়ির টুংটাং, বাসনের ঝনঝন।

 

যার বিষাদ নিয়ে কেউ কেউ হাসি বাজায়,

অন্ধকারে আয়নার ব্যক্তিসজ্জা নিয়ে অলৌকিক ভাবে।

 

নাদিয়া জান্নাত

আমার মা এবং রবীন্দ্রনাথ

----------------------------------------------------------------------

আমার ছোট বেলায় মা স্লো ভলিউমে গান বাজাতো সারাদিন। আমি তখনো রবীন্দ্রনাথের মানে জানতাম না। রবীন্দ্রনাথ মানে

চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি - এই বোধটাও হয়নি তখনো। আমার তখন ছেলেবেলার বয়স। আমি মুখস্ত করতাম-

"চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাঁদা,

একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।

কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,

রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।"

তখন বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠতো। মনে হতো,

আমাদের গ্রামে কেন কোন  ছোট নদী নেই! অথচ বৈশাখ ভাবলেই

"গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে" অনুভতিটা সারা মন ছুঁয়ে যেতো।

আমি আমার মায়ের বাজানো গান শুনতাম। ভালো লাগতো না। আমি তখনো জানতাম না এই ভালো লাগছে না এবং ভালো লাগছে সমস্ত কিছু দুয়ের মাঝেই আছে রবীন্দ্রনাথ।

হলো না, হলো না, হলো না বলেই চমকি চমকি উঠি, বয়সটা আমার একটু আগেই এসেছে। পুরোনো চৌকাঠ, পুরোনো বাড়ি এবং চোখ বন্ধ  করলে একটি ইছামতি নদী। আমি সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে নদী খুঁজতাম। বৃষ্টি চাইতাম। বৃষ্টি নামলে ছোপ ছোপ দাগ বসতো মাটিতে। আমি কারো পায়ের ছাপ খুঁজলাম।

আচ্ছা সেসময় কি বুড়ো রবীন্দ্রনাথ আমাদের বাড়ি আসতো?

কিন্তু আমি তো সমস্ত দিন যা কিছু তরুণ তাকে ভালোবেসেছি।

আমি জেনেছি ভালোবাসা মানে বুকের ভেতর হুটহাট আসা জলোচ্ছ্বাস।

ভালোবাসা মানে খোলা গহনার বাক্স। শাড়ি এলোমেলো পরে আছে বিছানার পাশে। ভালোবাসা মানে এক্ষুণি আসতে পারে একটা দূর্যোগ।

আমি যখন প্রথম রবীন্দ্রনাথ শুনি তখনো ভালোবাসা বুঝতাম না। শুধু বুঝতাম মা রোজ অপেক্ষা করছে বাবার জন্য। বাবার অফিস পাঁটচায় ছুটি।

বাবা বাড়ি ফিরতো রাত নটায়।

মা সন্ধ্যা বাতি জ্বালাতো। হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখতো বাবার সাদা পাঞ্জাবি।

বাবা বাড়ি ফিরলে আমরা দু ভাই বোন দৌঁড়ে যেতাম বাবার কাছে। মা ঘরেই থাকতো। চুপচাপ হাতে নিতো বাবার বাজারের ব্যাগ। মা কি বাবাকে ভালোবাসতো?

ভালোবাসলে চুপচাপ থাকতে হয় এটা কি রবীন্দ্রনাথ মাকে শিখিয়েছিলো?

 

অণুগল্প

পাঁচিল

সোমনাথ বেনিয়া

 

ননী সাহার বাড়িতে পাড়ার -দল এসে বললো, কাকু বাড়ির বাইরের পাঁচিল চুনকাম করাবেন না। শুনে ননীবাবু আমতা-আমতা করে বললেন, কেন বলতো! মানে, ঠিক বুঝতে পারলাম না।

- খুবই সহজ কাকু। আপনি না করলে আমরা করে দেবো। শর্ত শুধু একটাই। ওই চুনকামের উপর আমাদের পার্টির প্রতিনিধির নাম থাকবে। সামনে নির্বাচন, বুঝতেই পারছেন। ননীবাবু দেখলেন এই সুযোগ। বললেন, ঠিক আছে। তবে শর্ত হলো ভোট মিটে যাওয়ার পর আবার চুনকাম করে প্রতিনিধির নাম মুছে দিতে হবে। -দল শর্তে রাজি হয়ে গেল।

       রাতে পাড়ার বি-দল এসে একই প্রস্তাব রাখলো এবং ননীবাবু -দলকে যা বলেছিলেন, বি-দলকে একই কথা বললেন। বি-দলও শর্তে রাজি হয়ে গেল।

       -দল যথারীতি পাঁচিল চুনকাম করে পরের দিন নাম লিখবে বলে চলে গেল। বি-দল বিষয়টি জানতে পেরে -দলের সঙ্গে ঝামেলা বাঁধিয়ে দিল এবং সমাধানের জন্য ননীবাবুর কাছে আসলো। ননীবাবু দুই দলের দিকে হাতজোড় করে বললেন,

- তোমরা সবাই পাড়ার ছেলে। তোমাদের সবাইকে আমি স্নেহ করি। তাই কাউকে ফেরাতে পারবো না বলে ওই কথা বলেছিলাম। এখন বলছি পাঁচিলটা নিজেদের মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করে দলের প্রচার চালাতে পারো।

ননীবাবু ভদ্র লোক বলেই পাড়ায় পরিচিত। বেশ গুণি মানুষ। একবার বলাতেই পাঁচিল ব্যবহার করতে দিচ্ছেন এটাই বিশাল ব্যাপার।

       দুদলই ননীবাবুর কথায় সায় দিয়ে পাঁচিলটি অর্ধেক করে পার্টির প্রচারের কাজে ব্যাবহার করলো। ভোটপর্ব মিটে গেল। দু-দলই পুনরায় এসে পাঁচিলের নিজেদের ব্যবহৃত অংশ পুনরায় সাদা চুনকাম করে দিয়ে গেল।

   এখন ননীবাবু রং মিস্ত্রি ডেকে পাঁচিলটিকে নিজের মনের মতো করে রং করাতে-করাতে ভাবছেন আসলে পাঁচিলটি কার ...

 

ভাষান্তরকায়েস সৈয়দ

মূল: মাও সে তুঙ

হলুদ ক্রেন টাওয়ার

 

(পু সা ম্যান এর সুরের প্রতি)

প্রশস্ত, নয়টি প্রশস্ত ধারা মিতে প্রবাহিত

অন্ধকার, রেখার সাথে যোগসূত্র করে অন্ধকার-

দক্ষিণ থেকে উত্তর

আবছায়া বৃষ্টির জলীয় বাষ্পে অস্পষ্ট

কচ্ছপ সাপ ধরে রাখে মহান নদীটিকে গাঢ় আলিঙ্গনে

হলুদ ক্রেন চলে গেলো, কোথায় কে জানে?

শুধুমাত্র এই টাওয়ারটি পরিণত হয়েছে দর্শনার্থীদের আড্ডায়

আমার ওয়াইন বন্ধক রাখি উত্তাল খরস্রোতে

আমার হৃদয়ের জোয়ার ফুলে ওঠে ঢেউয়ে

 

পুনর্পাঠ

শামসুর রাহমান

তিনি এসেছেন ফিরে

 

লতাগুল্ম, বাঁশঝাড়, বাবুই পাখির বাসা আর

মধুমতি নদীটির বুক থেকে বেদনাবিহ্ব

ধ্বনি উঠে মেঘমালা ছুঁয়ে

ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়।

এখন তো তিনি নেই, তবু সেই ধ্বনি আজ শুধু

তাঁরই কথা বলে;

মেঘনা নদীর মাঝি যখন নদীতে

ভাটিয়ালী সুর তোলে, তার

পালে লাগে দীর্ঘদেহী সেই পুরুষের দীর্ঘশ্বাস,

যখন কৃষক কাস্তে হাতে

ফসলের যৌবনের উদ্ভিন্ন উল্লাস দেখে মাতে,

তখন মহান সেই পুরুষের বিপুল আনন্দধ্বনি ঝরে

ফসলের মাঠে,

যখন কুমোর গড়ে মাটির কলস, ঘটিবাটি,

নানান পুতুল চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে,

তখন সৃজনশিল্পে তার

জেগে ওঠে মহান নেতার স্বপ্নগুলি,

উচ্ছ¡সিত লাউডগা, কচুপাতা, কুয়োতলা, পোয়াতি

কুমোর বউ।

ওরা তাঁকে হত্যা রে ভেবেছিল তিনি

সহজে হবেন লুপ্ত উর্ণাজাল আর ধোঁয়াশায়,

মাটি তাঁকে দেবে চাপা বিস্মৃতির জন্মান্ধ পাতালে-

কিন্তু তিনি আজ সগৌরবে

এসেছেন ফিরে দেশপ্রেমিকের দীপ্র উচ্চারণে,

সাধারণ মানুষের প্রখর চৈতন্যে,

শিল্পীর তুলিতে, গায়কের গানে, কবির ছন্দের

আন্দোলনে,

রোদ্রঝলসিত পথে মহামিছিলের পুরোভাগে।


No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক