শিল্প সাহিত্য ৪৬ শুক্রবার ১৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪২৭, ২৯ই মে২০২০
ধানরঙের ঘ্রাণ: ব্যক্তিচেতনার সারৎসার
জারিফ এ আলম
কবিতা আটপৌরে জীবন থেকে বিশ্বমানবের কথা বলে। কবিতা
কখনো মানুষকে ভাবায়, কখনো জাগ্রত করে সুপ্ত চেতনা, কখনো প্রতিবাদী করে তোলে। কখনো মগজে
গেঁথে থাকে কারুকার্যময় পঙক্তিমালা। ‘ধানরঙের ঘ্রাণ’ অনু ইসলামের
নানা বোধের সমন্বয়ে রচিত তেমনি একটি কবিতাগ্রন্থ। এখানে সমন্বয় ঘটেছে, ব্যক্তিগত চিন্তা,
বিশ্বাস, স্মৃতিকাতরতা আর আছে নানা রকম টানাপোড়েনের কথা। কবিরা সাধারণত সৌন্দর্য পিপাসু।
তার সেই প্রমাণ কবি অনু ইসলামের ‘ধানরঙের ঘ্রাণ’ কবিতাগ্রন্থেও
পাই। বইটির প্রথম কবিতা সেই সৌন্দর্যবিষয়ক। তিনি কবিতাটিতে পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য সংরক্ষণের
কথা বলেছেন এভাবে,
সমুদ্রগর্ভের উচ্ছ্বাস ছুটে আসছে-
বীজমন্ত্র ভেঙে; ঝিনুক হওয়ার লোভে
দেহ-স্নানঘরে রক্তচিহ্নের সৌন্দর্য, জেগে-
উঠলে; ফুটফুটে ঝিনুক খেলবে স্বপ্নদৌড়।
ভাঙনপ্রিয় সময়ের; হাতে হাত রেখে চর্চিত হোক
সৌন্দর্যবোধ
চলো, সংরক্ষণ করি; পৃথিবীর তাবৎ
সৌন্দর্যজ্ঞান।
ভালোবাসা বিষয়টিকে কবি পুণ্যের সহযোগ করে নিজস্ব
চিন্তা তুলে ধরেছেন। এতে করে কবির ভালোবাসা সার্বজনীনতা লাভ করেছে। আর তিনি এই ভালোবাসাকে
অনাগত আগামীর জন্য রেখে যাবার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তার ‘পরিব্রাজক’ কবিতায়।
তিনি বলেছেন,
জানি, ভালোবাসা-শুধু পুণ্যযোগে বিশ্বাসী
হয়ে ওঠে। তাই পরিভ্রমণ শেষে- পূতগন্ধ
রেখে যেতে চাই আগামী ভালোবাসার জন্য।
এসব পরিব্রাজক দিন গ্রন্থিত হোক জীবন-
সংগ্রহশালায়। ইতিহাস, পৃষ্ঠা খুলে দেখবে
আমরাও পরিব্রাজক ছিলাম; পৃথিবীমঞ্চে।
মানুষের স্বল্পায়ুর জীবনে নানা রকম চড়াই-উতরাই পার
হতে হয়। আর সবাইকে নিজের চরিত্র নিয়ে যাপন করতে হয় গোটা জীবন। এখানে শেক্সপিয়ার মানুষকে
পৃথিবী নামক রঙ্গমঞ্চের অভিনেতা-অভিনেত্রী হিশেবে আখ্যায়িত করেছেন এভাবে, All the world's a stage, and all the men and women merely
players. কবি অনু ইসলাম তার ভাবানাকে চিত্রায়িত করেছেন তার
মতো করে। তিনি ‘প্রেক্ষাগৃহ’ নামক কবিতায় বলেছেন,
রূপালি পর্দার বিচিত্র দৃশ্যেও কোণে
আমিও নগন্য এক কীট-চরিত্রের ভ‚মিকায়-
জেগে আছি; স্বল্পায়ু দৃশ্য নিয়ে।
কবি যাপিত জীবন, ক্রমাগত ছুটে চলা, সর্বোপরি এই
বেঁচে থাকাকে প্রহসহ হিশেবে দেখেছেন। কেননা বেঁচে থাকাটাই যেখানে চ্যালেঞ্জ হিশেবে
দেখা হয়, সেখানে জীবনের অন্যান্য কার্যপ্রণালী লক্ষ্যহীন, ক্রমাগত অদৃশ্যের পানে ছুটে
চলা। তাই কবি প্রহসন কবিতায় বলেছেন এভাবে,
জোছনার আড়ালে রক্তছোপ দেখে কেটে যাচ্ছে ক্ষণ
নৈঃশব্দ্যের হাতে হাত রেখে-
একটি বাক্য উচ্চারিত হতে থাকে ‘বেঁচে আছি এইতো’।
আহা- এই প্রাসঙ্গিক প্রহসন।
‘ধানরঙের ঘ্রাণ' নামক কবিতাগ্রন্থের একই নামের নামের কবিতায় কবির
ব্যক্তিগত হতাশা ফুটে উঠলেও শেষপর্যন্ত আশাবাদ
ব্যক্ত করেছেন। এ যেনো জীবনের বেঁচে থাকার আরেক আহ্বান সেখানে তিনি বলেছেন,
জঠরযন্ত্রণা বোঝে প্রসূতিমন; প্রেম বোঝে না
ঠুনকো জীবন- মন্দ কী ছুঁড়ে ফেলে দিলে
হেমন্তকন্যার দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠছে ধানরঙের
ঘ্রাণ।
জয়ধ্বজা উড়িয়ে মনোকাশে কী অদ্ভুত এক আনন্দযাপন...
জীবনকে কবি বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করেছেন।
আর কবিতায় তুলে এনেছেন তার দেখা ও চেনা জগৎ।
আর তার দার্শনিক মনোভাবসুলভ চিন্তাও লক্ষ্য
করি ‘এসো পাঠ নেই একটি জীবন’ নামক কবিতায়। তিনি বলেছেন,
সন্ধ্যা; দেখো- গোলাপের ডাল অসংখ্য কাঁটাযুক্ত
কাঁটার আঘাত সযতনে আগলে রাখতে হয়!
একটা জীবন; আরপকটা জীবনের দিকে তাকিয়ে থাকে-
পর্যটনপ্রিয় দৃষ্টি নিয়ে সামগ্রিক এই খেলায়
জীবন গল্পগুলো ইঙ্গিতে রেখে যায়-
মানুষ নিজেই নিজের কাছে ফিরে আসে আপন ব্যঞ্জনায়।
মৃত্যুবিষয়ক ব্যক্তিগত ভাবনা নিয়ে কয়েকটি কবিতা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যেমন,
আগুনরঙ, মৃত্যুরপূর্ব-রাত, তাসের ঘর, প্রস্থান প্রভৃতি। ‘আগুনরঙ, কবিতায় কবি বলেছেন-
মৃত্যু; ঢেউনৃত্যের খেলায় মত্ত এক অভিশাপ!
উঠা-নামা নিয়ে ব্যস্ত-
কাঙ্ক্ষিত অন্ধকার খোঁজে; নিজস্ব উপত্যকা।
‘কোন পাসপোর্ট হাতে নেই’ কবিতায়
কবি সমগ্র পৃথিবীকে একটি মানচিত্র হিশেবে কল্পনা
করেছেন। অর্থাৎ, কবিমানসের বিশ্বজনীন রূপ আমার এখানে দেখতে পাই। কবিতাটি বিশ্বনাগরিক
হবার লক্ষণ প্রকট। তাই তিনি বলেছেন,
চলো- খুলে দেই অসহ্য কাঁটা-তার
পাসপোর্ট, পাসপোর্ট খেলা মুছে যাক ম্যাজিক দৃশ্যের
মতো
অ আ ক খ প্রমুখ বর্ণমালার কসম লাগে
সমগ্র পৃথিবী একটাই মানচিত্র হয়ে উঠুক
পাখিসব নিজ নিজ স্বাচ্ছন্দ্যে উড়াবে মনের ডানা
যদিও পৃথিবী প্রবেশের কোন পাসপোর্ট, কারো হাতে নেই;
সত্য।
‘ধানরঙের ঘ্রাণ’ কবিতাগ্রন্থ
কবি অনু ইসলাম নানা ভাব ও ভাবনার কবিতা সন্নিবেশিত করেছেন। যা আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে সজাগ ও সচেষ্ট করে তোলে। ব্যক্তিগত
চিন্তার কথা বলতে গিয়ে কবি ‘গভীর আত্মপোলব্ধির নাম কবিতা’ শিরোনামে
ভ‚মিকায় বলেছেন, ‘কবিতা; জীবনের এক একটি ধারণকৃত ছবি। যেখানে পরিবার,
রাষ্ট্র, বহির্বিশ্ব, প্রেম, প্রকৃতি এবং সমকালীন ভাবনা এমনকি ব্যক্তিগত নৈঃশব্দ্য
প্রতিটি বিষয় আলাদাভাবে কবিতা পৃথিবী নামক ক্যানভাসে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।’ কবির এই
কথামালা কবির কবিতা বুঝতে সহায়ক হিশেবে কাজ করবে।
কবি অনু ইসলামের ‘ধানরঙের ঘ্রাণ’ কবিতাগন্থে
নানা স্বাদের ৬৮টি কবিতা ঠাঁই পেয়েছে। পাঠক কবিতাগুলো পড়ে নানা ভাবনাচিন্তার মধ্যে
পরিভ্রমণ করতে পারবে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
শিল্প সাহিত্য ৪৪ বুধবার ১৩ই জ্যৈষ্ঠ ১৪২৭, ২৭ই মে২০২০
সাজ্জাদ সাঈফের কবিতা প্রসারিত করে অন্তর্দৃষ্টিকে
তানহীম
আহমেদ
কবিতা কি? ধারণা করি বাংলা তথা বিশ্বকবিতা ভাষার একটা স্বতন্ত্র খরস্রোতা নদী। যার পরতে পরতে পাথর। সে পাথর আটকে দিতে চায় কবিতার গতিপথ। পাল্টে দিতে চায় ভাষার জীর্ণ পুরোনো আঙ্গিককে। কবি সেই নদীতে ভাসমান এক নৌকোমাত্র। যাঁর উদ্দেশ্য মহাকাল কিংবা কিছুই না। একটা অর্থহীন জার্নির ভিতর। ধরা যাক, একটা দীর্ঘ বাক্যবন্ধের ভিতর দিয়ে নিজের বৈচিত্র্যময় জীবনটা কাটিয়ে দিতে জানেন একজন কবি। কিংবা ধরা যেতেই পারে কবি সেই নদীপাড়ের একজন আশ্চর্য জাদুকর, দুপুরের রৌদ্রমাখা অস্তরেখায় যিনি পলে পলে তুলে আনেন প্রাণচঞ্চল শব্দরাশি। সাধনার ফসল। ফসিল।
কবি সাজ্জাদ সাঈফের কবিতা আমাদের এভাবেই ভাবতে শেখায়। প্রসারিত করে আমাদের অন্তর্দৃষ্টিকে। যেন একফালি রোদ শুষে নিচ্ছে সমস্ত বিকেলটাকে আর জার্সির মাঠে মেষ চড়াচ্ছেন আশ্চর্য সেই কবিবর। হাওয়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যিঁনি তার কবিতার খসড়া এঁকে যাচ্ছেন। আলোচ্য কবি তাঁর কবিতার এক পর্যায় এসে বলেন-
“পুরাতন গানের ভঙিমাসহ, অন্তর টাচ করে করে
হেঁটে যাওয়াতে আমার আনন্দ যতো, আততায়ী শীত জানে...”
আমরা জানি যেই কবিতা মানুষের অন্তর ও মস্তিষ্কে একইসঙ্গে আঘাত করে তাকেই সফল কবিতা হিসেবে ধরা হয়। কবিতার এই দিকটা কবির দীর্ঘ পাঠাভ্যাস এবং নির্মোহ সাধনার ফল হিসেবেই কবিতায় ফুটে ওঠে, এই কবির কবিতায় আনন্দের সাথে যার স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই। সেই আনন্দের স্পর্শ আমরাও পাই তাঁর কবিতাপাঠে।
“... নিঃশ্বাসে ত্রিভুজ আঁকে প্রেমপত্র!
সাধু বা সন্ত নই, তুমি জানো, বুকে আছে কাঁটার পত্রালি”
“...হয়তো ভালোবাসে তাই প্রেমভাব নিয়ে ছাতা
মেলে ধরে, বৃষ্টি এলে...”
কবি সাজ্জাদ সাঈফের কবিতায় নতুন এক আঙ্গিকে আমরা উঠে আসতে দেখি প্রেমের সেই চিরায়ত ভঙিমাকে, আবেদনকে।কবিতায় প্রেম একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও এই বিচিত্র ন্যারেটিভে গতানুগতিকভাবে আমরা কোথাও’ই উঠে আসতে দেখি না তাঁকে। সে’ই কাঁটার পত্রালির আঘাত প্রেমিক বৈ আর কে জানে! কবির ভাষায় কিছুটা ভিন্ন ইমেজারির ভিতর দিয়েই উঠে এসেছে সেই যন্ত্রণা। প্রেমিকের বুকের ভেতরের অন্ধকার কবরের দীর্ঘশ্বাস...
“পিতার কফিন সয়নি যে কাঁধ
কোনো বাক্যই তাকে দিতে পারে না গন্তব্যের খোঁজ...”
সদ্য পিতৃবিয়োগে দগ্ধ কবি নাঈম ফিরোজকে উৎসর্গ করা এই কবিতায় কবি তাঁর করুণ ভাষার তুলিতে টেনে ধরছেন পিতৃ বিয়োগের ব্যথাকে। তার কবিতায় এভাবেই উঠে এসেছে জীবনের নানা রং ও দিক।
“লিখে দিলাম অর্ধ-সকাল তোমায়;
লিখে দিলাম গোলাপবর্ণ গান।”
র্যাবো/পাররা কবিতার প্রচল অস্বীকার করে দেখিয়েছেন, প্রথাগত সমাজকে বিনির্মাণের কথাও বলে গেছেন যুগে যুগে হুইটম্যান-নজরুল-সুভাষ-নবারুণ প্রমুখ, সাজ্জাদ সাঈফ নিজস্ব আঙ্গিকে সমাজকে দেখেন এবং কবিতায় নতুন আমেজ তৈরি করতে প্রয়াসী হন, Art for art shake এবং জীবনের জন্যেও এই কবির কলম ব্যতিক্রমী রকমের একাত্ম-
‘হাত এঁকেছি, হাতের মুঠোয় তোড়া
ফুল এঁকেছি, ফুলের নামটি গাঁদা;
মৃত্যু কেমন, ছুটছে তাহার তাড়া?
পাঁজরটি আজ শিশিরচোয়া, ধাঁধা!’
আবার
‘আমাদের সময় নগণ্য, মিথ্যারা প্রসাধনী আজ;
যার বুকে জেগে থাকে গানের তাড়না, মঙ্গল-স্বর
তার দিকে অজস্র তির, ছুটে যায় সমাজ-ধারণা হতে’
নতুন শব্দ-ইমেজারি-বাক্যধরণ ব্যতীত মানুষকে দেয়ার জন্য কবির আর কাছে অবশিষ্ট থাকে না কিছু। এই কবিতাগুলো যা আমরা নতুন ও ভিন্ন স্বরে খুঁজে পাই বারবার। এর প্রতিটি পঙক্তিতে কবি যেই চিত্রকল্প তার তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন তা আমাদের সবারই খুব চেনা অথবা অচেনা। যা আমাদের শুনিয়ে যায় নতুন সুরে বাঁধা গান। এঁকে দিয়ে যায় তার স্বেদ এই বিষণ্ণ মার্চের বৃষ্টিস্নাত রাত্রির এপিটাফে।
“সমস্ত গানের ভেতর এক এক করে ঢুকে যাচ্ছে রাস্তার হর্ন”
“এই জন্ম ও জন্মবিজারক রাত্রি
টেনে ধরে আছে শেষতম তারাটিকে”
“এই ত্রিদিক মেঘের ভিতর মা’কে
দেখি নাই হাস্যোজ্জ্বল, দেখি নাই কতকাল”
“শীতে কতোভাবে কাঁপতেছে চাঁদ একা
ভাঁজ-ভেঙে নামে মহাকাশ বলাকা”
এমন অজস্র চিত্রকল্প, ভিন্নস্বর, বাক্যভঙি আমরা খুঁজে পাই কবির কবিতায়। যা তাঁকে অন্যদের থেকে করেছে আলাদা সুস্পষ্টভাবে। এক্ষেত্রে জীবনদাশের একটা কবিতার পঙক্তি উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক-
“অনেক লোকের মাঝে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা”
সাজ্জাদ সাঈফের কবিতা পাঠেও আমরা দেখতে পাই একটা ভিন্ন কিছুকে তুলে ধরবার প্রয়াস, সম্পূর্ণ নিজের স্বরে। চিত্রকল্পই কবিতাএই অনুসিদ্ধান্তে অনুগমন করলে বলা যায় সাজ্জাদ সাঈফ ধীমান কবি, বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখক।
বহুদিন ব্যাকফুটে এসে কবির তৃতীয় কবিতার বই। আগের দুটি বইকবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা ও মায়ার মলাট’র ছায়া থেকে অনেকটা দূরে সরে এসে কবিতাগুলো জন্মলাভ করেছে। কবির এইসব নিবেদিত জার্নিকে আরও আরও পাঠের আশা ব্যক্ত করে শেষ করছি অনুভূতির বয়ান...
শিল্প সাহিত্য ৩৭ মঙ্গলবার ৬ই জ্যৈষ্ঠ
১৪২৭, ১৯ই মে ২০২০
দাউদ হায়দারের কবিতা ও তার কাল
জারিফ এ আলম
বাংলা কবিতা তার বয়সের দিক থেকে হাজার বছর অতিক্রম করেছে। আর এই অতিক্রমণের মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতার একটি উজ্জ্বলতম দিক পরিদৃষ্ট হয়। ১৯৪৭ সালের বিভাগত্তোর সময়ে পূর্ব-বাংলায় সাহিত্যচর্চার বিষয়, চিন্তা, প্রকরণ নতুন রূপ লাভ করে। এ সময় আমরা অনেক কবি-সাহিত্যিককে নতুন ভাবনাচিন্তা নিয়ে সাহিত্যচর্চা করতে দেখি। সেই সময়ে আহসান হাবীবের(১৯১৭-১৯৮৫) ‘রাত্রিশেষ’(১৯৪৭) কবিতাগ্রন্থের মধ্য দিয়ে নতুন সম্ভাবনার বীজ বপন হতে দেখি। এছাড়া আবুল হোসেন এবং ফররুখ আহমদও তাদের স্বকীয়তা নিয়ে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করেন। তাই ১৯৪৭ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সাহিত্যের স্বরূপ বিবেচনা করে বাংলাদেশের সাহিত্যের কাল গণনা করা হয়। ৫০ এবং ৬০ দশকে বাংলা সাহিত্যে এক ঝাঁক কবি-সাহিত্যিকের আবির্ভাব লক্ষ্য করা যায়। শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬), আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯), হাসান হাফিজুর রহমান ( ১৯৩২-১৯৮৩), সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬), রফিক আজাদ (১৯৪৩-২০১৬), সানাউল হক (১৯২৪-১৯৯৩) আরো উল্লেখযোগ্য কবিবৃন্দ বাংলা সাহিত্যকে অনেক সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। এরপর পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ বছর। গল্প উপন্যাসেও হয়েছে অনেক বাঁক বদল।
২.
দাউদ হায়দার (১৯৫২) বাংলাদেশের একজন সমাজ সচেতন এবং প্রতিবাদী কবি। তাঁর কবিতার বিষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলে বিভিন্ন বৈচিত্র্য চোখে পড়ে। ব্যক্তিগত চিন্তা, প্রেম, নৈরাশ্যবোধ, মিথ-পুরাণের ব্যবহার ইত্যাদিকে প্রধান বিষয় হিশেবে তার কবিতায় দেখতে পাওয়া যায়। তার কবিতায় ক্ষয়ে যাওয়া সমাজ কাঠামোর নানা রকম অসঙ্গতি থাকলেও তা তাঁর উপস্থপনার শৈলীতে নিজস্বতা অক্ষুণœ থেকেছে। এখানে কবির শ্রম ও মেধার সমন্বয় ঘটেছে সে-কথা বলাই যায়। বাংলা সাহিত্যে কবি দাউদ হায়দারের আবির্ভাব ‘জন্ম আমার আজন্ম পাপ (১৯৭৩)’ কবিতাগ্রন্থটির মধ্য দিয়ে। তিনি মূলত সত্তরের দশকের কবি হিশেবে পরিচিত। ১৯৭৪ সালের ২৪ ফেব্রæয়ারি; সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার কবিতা ‘কালো সূর্যের কলো জ্যোৎস্নার কালো বন্যায়’। এই কবিতাটি তার জীবনের জন্য দুর্নিবার ঝড় আর কালো অমাবস্যা হয়ে দাঁড়ায়। যার কারণে তৎকালীন সময়ে মৌলবাদীদের রোষানলে পড়েন। আর এরই রেশ ধরে অবধারিতভাবে নির্বাসিত হন। দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। তখন তার বয়স মাত্র বাইশ।
দাউদ হায়দার তার দেখা সমাজ আর যাপন করা সময়কে কবিতায় তুলে ধরেছেন নির্মোহভাবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে তিনি দেশের ভঙ্গুর অবস্থা, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির বেহাল দশা ইত্যাদিকে তুলে ধরেছেন তার কবিতায়। আর সময়কে তুলে ধরাই যে প্রকৃত কবি-সাহিত্যেকের প্রধান লক্ষ্য সেটা অত্যন্ত যতেœর সঙ্গে করেছেন কবি দাউদ হায়দার। তিনি তার নির্বাসন-পূর্ববর্তী সময়ে লিখেছেন একটিমাত্র কবিতাগ্রন্থ ‘জন্ম আমার আজন্ম পাপ’। এই কবিতাগ্রন্থটিতে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের সমাজচিত্র দৃশ্যমান; যখন কিছু সুবিধাবাদী এবং স্বার্থান্বেষী মানুষ স্বাধীন বাংলাদেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে সচেষ্ট ছিলো। আর সেই সময়ে অনেক ভীতি আর বিরূপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয় এদেশের মানুষকে। যার কারণে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি হয়েছিলো। আর এতে করে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ হয়ে পড়েছিল অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিক‚ল। সে বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন কবি দাউদ হায়দার। আর তাই তিনি বলেন,
হে দিন, হে রাত্রি
আমাদের দিনগুলি ঘোর ঘূর্ণি-লাগা চৈত্রের মতো কঠিন;
আর, রাত্রি
উদ্ধত বাঘের মত ভয়াল হিংস্র,
রাত্রির জঠর জুড়ে প্রেতের সঞ্চরণ।
(জন্মই আমার আজন্ম পাপ: আমাদের দিনগুলি)
শত্রুর দেখা নেই; অথচ আমারি শত্রু আমি-
জ্বলন্ত যৌবনে ছুটি ফ্যামিলি প্ল্যানিং কোথায়
কোথায় ডাক্তার কমপাউন্ডার?
যারা আমার অপারেশ করবে?
পুরুষত্ব বিলিয়ে ভাবি কুড়ি টাকায় একসের চাল ও একদিনের অন্যান্য
সামান্য দ্রব্যাদি মিলবে তো?
(জন্মই আমার আজন্ম পাপ: জন্মই আমার আজন্ম পাপ)
কবিতা দুটিতে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি লেখকের সচেতনমূলক মানসিকতার। যা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থার অধোগতির কথাই মনে করিয়ে দেয়। কবি নির্বাসন-পূর্ববর্তী সেই সময়ের স্বাধীন বাংলাদেশকে যেভাবে দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন সে-সব দৃশ্যেরই বয়ান করেছেন তার কবিতায়। যার মাধ্যমে তিনি আমাদের সেই সময় সম্পর্কে একটি টোটাল ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছেন।
৩.
দাউদ হায়দারের কবিজীবনকে মোটামুটি দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হলো তার নিজদেশে থাকাকালীন জীবন; অপরটি হলো, নির্বাসিত জীবন(প্রবাস জীবন)। যখন তিনি নিজদেশে অবস্থান করেছেন তখন তার দেখা সমাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে কবিতা লিখেছেন। আর কবিতাও হয়ে উঠেছে বাস্তবানুগ। তার নির্বাসিত জীবনের (১৯৭৪) পর থেকে কবিতার অনেক পরিবর্তন লক্ষণীয়, সেটা বিষয় কিংবা কবিতার কাঠামো যার কথাই বলি না কেনো। নির্বাসনকালীন সময়ে কবির দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থ ‘সম্পন্ন মানুষ নই (১৯৭৫)’। এই কবিতাপ্রন্থে স্বদেশের প্রতি যে হাহাকার তা খুব স্পষ্ট। স্বদেশকে ছেড়ে যাওয়া মানে তো পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র আর প্রিয় নানা বিষয়ের সঙ্গে বাহ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাওয়া। কিন্তু আত্মিক বন্ধন দৃঢ় করে আগের তুলনায় অনেক বেশি। সে-সব বিষয়-আশয় কবির কবিতায় প্রতিভাত হয়েছে। বর্তমানে ফরধংঢ়ড়ৎধ (ডায়াসপোরা) সাহিত্য নিয়ে আলোচনার বিষয়টি লক্ষ্য করার মতো। ডায়াসপোরা অর্থ করলে দাঁড়ায়, বীজের ছড়িয়ে পড়া। স্বদেশ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে কিংবা স্বেচ্ছায় যদি কেউ স্থায়ীভাবে অন্যদেশে বসবাস করে তাকে ডায়াসপোরিক মানুষ বলে আর তার রচিত সাহিত্যকে ডায়াসপোরা সাহিত্য বলে। এক্ষেত্রে, আইজাক সিঙ্গার, সালনান রুশদি, ভি এস নাইপল এদের নাম করতে পারি। আবার যাদের জন্ম এ বাংলাতে কিন্তু জীবন কাটান অন্য দেশে গিয়ে তাদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শহীদ কাদরী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত উল্লেখযোগ্য।
কবি দাউদ হায়দারও একজন ডায়াসপোরিক সাহিত্যিক। এ কারণে তার কবিতা সে-রকম উপলব্ধি দেখতে পাওয়া যায়। তার চিন্তায় চেতনায় স্বদেশের কথাই বারবার উঠে এসেছে। তিনি শেকড় সন্ধানী তাই তার কবিতাও হয়েছে মূলানুগ। আর এ কারণেই বলেন,
আমি যাই, নৌকো ভর্তি যাত্রীর সঙ্গে আজ আমার রাত্রী যাপন
খোলা আকাশের নিচে গঞ্জে গঞ্জে-
আমি যাই, যাবার আগে শুধু দেখে যাই
এদেশের মানুষের মুখে কতখানি হাসির মহিমা লেগে আছে!
(সম্পন্ন মানুষ নই: যাই)
রাখিতে মহৎ আশা সুন্দর ভালোবাসা
জ্যোৎস্নায় শুদ্ধ পবনে গান ধরি-
সুবর্ণ পাহাড়ে যাই-
জননীর হাতছানি বড় মায়ার
তবু নৈসঙ্গবোধ কোথাও পারি না যেতে
-বিচ্ছিন্ন সবকিছু আমার থেকে!
(সম্পন্ন মানুষ নই: এ নয় রক্তস্নাত বিজয় বৈজয়ন্তী সখী)
সম্পন্ন মানুষ নই কবিতাগ্রন্থটি যেহেতু নির্বাসন পরবর্তী সময়ে রচনা আর সঙ্গত কারণে লেখকের মনে বিচ্ছিন্নতাবোধের বিষয়ই সর্বোপরি পরিলক্ষিত। আমি ভালো আছি, তুমি? (১৯৭৬)’ এই কবিতাগ্রন্থটিও দেশের প্রতি মমত্ববোধেরই বহিঃপ্রকাশ যা কবির একই বোধ আর ভাবনাচিন্তার রিপিটিশন বলা যেতে পারে। যেখানে বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে আর নস্টালজিয়া কাজ করেছে দেশের প্রতি আর সেখানকার মানুষের প্রতি। এখানে তার নিজদেশে ফেরার প্রবল আকুতিও লক্ষ্য করার মতো। আর সেসব তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে এভাবে,
হয়তো আবার বাড়ি ফিরে আসব, ভেবেছিলে। কিন্তু আমার
ফেরা হয় না। যখন রাত্রি অতিক্রান্ত, তুমি হয়তো
“এই আসবে আসবে করে” দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলে!
তোমার অস্থির চিত্তে তখন নানা ঘটনা ও দুর্ঘটনার সম্ভার!
কবি দাউদ হায়দারের কবিতার বিষয় আর প্রকরণের প্রতি যেমন সজাগ তেমনি কবিতায় ছন্দের সার্থক ব্যবহারও করেছেন। তার কবিতায় প্রেম ঈর্ষার বিষয় নয়, নিজের দুঃখকে জয় করবার মাধ্যমে বরং প্রিয় মানুষটির সুখের কথাই ভেবেছেন। এবং তা কবিতায় আলাদা ব্যঞ্জনাও তৈরি করেছে। তিনি বলেন,
যে আমাকে দুঃখ দিল সে যেন আজ সুখেই থাকে’-
আমার বাঁধন-ছেঁড়া ভালোবাসা বেঁধেছিল দুর্বিপাকে
আমি ছিলাম স্বেচ্ছাচারী, আউল বাউল তীক্ষèধার
এক নিমিষে বাঁধলো আমায় কী জানি কী দুঃখ তার।
যে আমাকে দুঃখ দিলো সে যেন আজ সুখেই থাকে।
(এই শাওনে পরবাসে: যে আমাকে)
কিংবা
সমস্ত দুঃখের মধ্যে সমস্ত শিল্পের মধ্যে পুনরায় যখন প্লাবিত হও
বৈতরণী পার হয়ে চলে যাও অনন্তের দিকে; সমস্ত নীলিমা জুড়ে
সমস্ত পৃথিবী ও বনাঞ্চল জুড়ে
তোমার শুভ্রতা তোমার শিল্প তোমার বিন্যাস
অনন্ত অরুন্ধতি, বহুদিন পড়ে আছি অন্ধকারে।
(আমি পুড়ছি জলে ও আগুনে: অনন্ত অরুন্ধতী তুমি, অন্ধকারে)
কবিতা দুটি যে কবির পুষে রাখা দুঃখের ক্যানভাস তা স্পষ্ট। আর এই স্পষ্টতা নিয়ে কখনো তিনি প্রতিবাদী, কখনো দুঃখে কাতর, কখনো প্রেমে আকুল। এই সাবলীলতাই মূলত কবি দাউদ হায়দারকে অন্য অনেকের থেকে পৃথক করে তুলেছে। তার কবিতা মানুষকে স্বপ্ন দেখায়। তার কবিতা সংঘাতহীন, বৈষম্যহীন এক সুন্দর পৃথিবীর কথা বলে। মানসলোকে সত্য ও সুন্দরের দৃশ্যপট আঁকতে প্রেরণা জোগায়। কবির মতো আমাদের মনে নানা রকম প্রশ্ন উঁকি দেয়। প্রাসঙ্গিক নানা কথা, ভাবায় প্রতিদিন। যার কারণে কবির সচকিত উচ্চারণ,
রক্তাপ্লুত দেশ, বারবার স্বাধীনতা চাই-
মানুষের স্বাধীনতা চাইÑ
কেন এত রাবণের ভিড়
কেন এত অসুরের ভিড়
কেন দেশব্যাপী পলাশীর উত্থান?
(ধূসর গোধূলি ধূলিময়: ঝরাবে নবীন রক্ত আ-মরি বাংলাদেশের?)
কবি দাউদ হায়দার যিনি অন্যায়ের সঙ্গে আপোষকামী নন। সকল প্রকার নৈরাজ্যের বিপক্ষে যার অবস্থান। এ কারণে তার লেখা হয়ে ওঠে জাগ্রত মনের কথকতা। তিনি তার কবিতায় সত্য আর প্রতিবাদী চেতনার দিক থেকে মেরুদণ্ড সোজা রাখার কথাই বলেছেন বারবার। এ কারণেই তার কবিতা বর্তমান সময়ে এসেও অনেক প্রাসঙ্গিক।
No comments:
Post a Comment