বৃহস্পতিবার ৫ই ভাদ্র ১৪২৭, ২০ই আগষ্ট ২০২০
কবিতা
আজাদ হোসেন
না গল্প না কবিতা
মুঠোফোনটা হতে নিয়ে, পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে টিপ টিপ করে হাঁটছি।
এই পথটা আমার খুব চেনা।
রাস্তার দু’পাশে বুনের ঝাড়, ফির ফির করে বাতাস বইছে।
বাতাস লেগে কাঁচা ধানের পাতায় যেন সাগরের ঢেউ উঠেছে।
ভাবছি দু’লাইন লিখি,
হঠাৎ চোখ পড়লো সামনের দিকে।
মনে হচ্ছে আকাশ থেকে এক নীল পরী নেমে এসেছে।
কপালে লাল টিপ, কানে ঝুমকো, দুটি ঠোঁট গোলাপি রঙে আঁকা।
এক গুচ্ছ চুল এসে বারে বারে তার গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে।
আরো একটু সামনে এগিয়ে যেতেই আমি থমকে দাঁড়ালাম,
কে ওটা?
চোখে চোখ পড়তেই আমার বুকের ভেতরটা হু হু করে কেঁদে উঠে।
নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করে বসলাম।
কেমন আছো মিথিলা?
কেমন কাটছে তোমার নতুন ভুবন?
আমায় কি ভুলে গেছো?
থমকে গেলাম, এতো দিন পরে দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারছি না।
উত্তর দেয়ার সময় দিচ্ছি না।
চুপ করে আছো কেনো কিছু বলবে না?
কথা বলার ইচ্ছে নেই এমন করে উত্তর দিলো ভালো আছি।
তার উত্তর শুনে মনের ভেতর যেন আর ঝড় বইছে। তবে কি মিথিলা ভালো নেই?
কোথা থেকে আসছো?
শশুর বাড়ি।
মিথিলা : তুমি কেমন আছো?
এই আছি।
বিয়ে করেছো?
মুখ ঘুরিয়ে চোখ মুছে ফিরে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম বিয়ে?
না সেটা আর হবে না।
মিথিলা : কেনো?
তুমি এ কথা আমায় বলছো?
কেনো তুমি সব ভুলে গেছো?
তুমি যে দিন আমার জীবন থেকে চলে গেছো দিন থেকেই আমার সব ইচ্ছে মরে গেছে।
আর যেনো কথা বলার ইচ্ছে নেই
থাকো আমি যায় বলেই পাশ কাটিয়ে এক ধাপ দু’ধাপ করে এগিয়ে গেলো।
মিথিলা আমাদের কি আর দেখা হবে না?
সামনে হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিলো না।
উত্তর শুনে আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। ধীরে ধীরে আড়ালে চলে গেল। আমি আমার মনটাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না মিথিলা আর কোনো দিন ফিরবে না।
সাঈদুর রহমান লিটন
সময় বড়ই নিষ্ঠুর মুসাফির
কার কথায় কি আসে যায়?
সময় থেমে নেই, সময় এক ভয়ংকর মুসাফির,
কারো আদর, ভালবাসায় কিংবা রক্তচক্ষু
থামাতে পারেনা।
মাঝে মাঝে দুই একটা ঘটনা ঘটায়,
বিবেক নাড়িয়ে দিয়ে, চোখের নোনা জলে প্লাবন ঘটিয়ে দেয় দৌড়।
সময় সত্যি এক নিষ্ঠুর মুসাফির,
ভাষার জন্য রক্ত নিল, স্বাধীনতার জন্য
রক্ত গঙ্গায় ভাসলাম, আজ স্বাধীনতা রক্ষায় রক্ত নিচ্ছে,
আজ সিনহারা মরছে, সাধারণ মানুষ তো
দুধে ভাত।
সময় ঠিকই চলে যাচ্ছে, থামবার প্রয়োজন বোধ করছে না।
রাহুল বর্মন
মায়ার বাঁধন...
রাত একটু গভীর হলে,
আমার সূক্ষ্ম সত্ত্বাটা স্থূল দেহ ছেড়ে
বাইরে বেরিয়ে আসে।
এক ঝলক ঘুমন্ত আমি’টাকে দেখে,
তারপর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়,
জীবন-মৃত্যুর চরম অনিশ্চয়তায় ভাসে।।
চারিদিকে কি সুন্দর ঠাণ্ডা হাওয়া,
কখনও বা পূর্ণিমার স্নিগ্ধ চাদর,
কখনও বা মেঘলা আকাশ, ভীষণ বৃষ্টি।
সূ² সত্ত¡াটাকে মৃত্যু টানতে থাকে,
জীবনের সুতো আলগা হতে থাকে,
সেই সময়ই কুয়াশার মতো এক ঝাঁক মায়ার সৃষ্টি।।
কতগুলো দায়িত্ববোধ, কত কত স্বপ্ন...
কয়েকটা প্রিয় মানুষ.. মায়ার বাঁধন দৃঢ় হতে থাকে।
ওই পাড়ের আকর্ষণ আলগা হয়, জীবন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে।
সূক্ষ্ম সত্ত্বাটা স্থূল দেহটার কাছে ফিরে আসে,
মা-বাবার ঘুমন্ত, ক্লান্ত মুখটা দেখি,
আমি ছেড়ে যেতে পারি না, ফিরে যাই জীবন প্রান্তরে।।
অণুগল্প
নিয়াজ মাহমুদ
একজন রিদম
এক নাগাড়ে তৃতীয়বারের মতো ঝাঁঝালো প্রকম্পনে পরিচিত রিংটোন শুনতে পেয়ে শিশিরাচ্ছন্ন দূর্বা ঘাসের মতো অনিয়মিত ভেজা শরীর নিয়েই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এল রিদম। বেলা দ্বিপ্রহরের। অসময়ের এই ক্লান্তি লগ্নে ঝিম ধরা শরীরে হঠাৎ তাজা শকুনের নবাগত প্রাণ চাঞ্চল্য গোত্তা খেতেই মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠল বন্ধু আরিফের নাম। পাড়ায় আয়োজিত বাৎসরিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আজ বিকেলে, এটা নিয়ে কথা বলতেই ফোন দিয়েছিল আরিফ। দীর্ঘ এক মাস কঠোর অনুশীলন আর ধারাবাহিক সফলতায় সেমি-ফাইনাল জিতে ফাইনালে উঠে রিদমের দল। রিদম তার দলের দলনেতা। কে জানতো, ভিনদেশী এক আণুবীক্ষণিক আগন্তুকের কাছে পরাস্ত হয়ে এভাবে নির্মল ব্যাধি জর্জরিত ভঙ্গিমায় আত্মগোপন করবে সবাই নিজেকে! রিদম স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয় আরিফকে, ফাইনাল ম্যাচটা আপাতত হচ্ছে না এবার। ঠিক যেমন গতকাল এক দাপ্তরিক ঘোষণায় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গুলো অনির্দিষ্টকাল বিবেচনায় বন্ধের প্রজ্ঞাপন মিলেছিল খানিকটা অপ্রস্তুত মেজাজে। শুধু কি তাই? কয়েকদিন হলো পারভিন খালাকে বাসায় কাজ করতে আসাও বারণ করে দিয়েছে রিদমের বাবা। রহমান চাচার ভোরে সাইকেলের টুং-টাং শব্দে দুধ দিতে আসাও বন্ধ। হয়তো দুদিন পরে খবরের কাগজ দিতে আসা ছেলেটাও মলিন চেহারায় বিদায় নিবে রিদমের বাবার কড়া বাক্যে। বিশ্বজুড়ে মহামারির এই জাঁহাবাজ পরিস্থিতিতে অদূর ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্ভ‚ত দুশ্চিন্তা গ্রাহ্য করাও শক্ত ব্যাপার এখন রিদমের।
পড়াশোনার চলমান নিথর যুদ্ধেও অবহেলার ছোপ পড়েছে প্রকৃতির অদ্ভুত নিয়মে। চাইলেও ইচ্ছেঘুড়ি যে হাওয়ার টানে গোত্তা খায়, সে হাওয়ায় রং খেলা দুরহ ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। স্বাস্থ্যবিধির আগাগোড়া মেনে চলেও এ অভ্যস্ত শহরকে বশ করতে না পেরে এক সীমাহীন প্রচ্ছন্ন বিক্ষোভের প্রাদুর্ভাব ধরা দেয় রিদমের মনে। তাক বোঝাই করা বইয়ের সংগ্রহশালা হতে একটি দুটি করে অপ্রয়োজনীয় বইগুলোও যেন রিদমের এখন সময়ের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। বিকেলে মাস্ক পরে বাড়ির ছাদ ভ্রমণই এখন সারাদিনের মূখ্য সাফল্য রিদমের। দম বন্ধ হয়ে আসলে পরিহিত মাস্কের এক ফিতা থাকে রিদমের পাঁচ আঙুলের অনামিকার ভাঁজে, আরেক ফিতা দোল খায় গোধূলির মুক্ত বাতাসে!
ধারাবাহিক গল্প
সাবিত্রী শিল্ড ফুটবল ফাইনাল
বিপুল রায়
তিন
হাফ টাইমের হুইসেল ফুঁকলেন রেফারি। খেলোয়াররা মাঠে বসে পড়ল। এই সময় আমার কাছে একটু অন্য রকম। আমি চলে গেলাম জামদা দলের কাছে। খেলোয়াড়দের গা দিয়ে ঘাম ঝড়ছে। মুখে নুন লাগানো একখন্ড পাতি লেবু। কোনো খেলোয়াড় মাথা নামিয়ে আছে, কেউ আবার আকাশ দেখছে। বালাজীকে লক্ষ্য করলাম। বলিষ্ঠ ছ’ফুটের যুবক। গালে চাপ দাড়ি। ডান হাতে স্টিলের মোটা বালা। কপালের বাঁ দিকে গভীর শুকনো ক্ষত। মাথার চুল এক করে ঝুটি বাঁধা। সেই ক্ষতে হাত ঘষতে ঘষতে ফিসফিস করছে, চুতিয়া, “মুঝে নেহি পাতা। মেঁ পয়সা লোংগে অউর উসি উসুল করুঙ্গা। এ এক ছোটি টিপ হ্যায়।”
বালাজীর শরীর ঘামে ভেসে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে আগুন বেরুচ্ছে।
দ্বিতীয় অর্দ্ধের খেলা শুরু হল। আমি জায়গা পাল্টালাম। আগের জায়গাটা অপয়া ছিল। আমি উল্টো দিকে এসে দাঁড়ালাম। খুব কাছেই মৃগাঙ্ক স্যার। আনন্দে স্যারের চোখ নাচছে। হুইসেল । খেলা শুরু। চিৎকার, খিস্তি, সিটি , ঠেলাঠেলি। শিক্ষক ছাত্র সব একাকার। কোথা থেকে উড়ো মেঘ এসে টিপ টিপ বৃষ্টি ছড়িয়ে দিচ্ছে। গোল, গোল। কানাই তিনজনকে কাটিয়ে গোল দিয়েছে। হাততালি, গলা ফাটা গগনভেদী চিৎকার। মাঠ ঢুকে ছাতা ফুটানো, ডিগবাজি। এই সুযোগে দৌড়ে মাঠে ঢুকে আমি বালাজির গায়ে একবার হাত বুলিয়ে এলাম। কী শক্ত শরীর, কী প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মুখ! খেলা এক এক। সমান সমান। এবার টান টান উত্তেজনা। এতক্ষণ ঝিমিয়ে থাকার পর জামদা পুরোপুরি চার্জড। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে যাচ্ছে। পিছন ফিরে মৃগাঙ্ক স্যারকে দেখলাম। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দুর্যোধন যেন ।
একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম। গোল গোল চিৎকারে সম্বিত ফিরে পেলাম। বালাজী অসম্ভবকে সম্ভব করে মাঝ মাঠ থেকে পাঁচজনকে কাটিয়ে গোল করেছে। নিমাইভুটি মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে, বিপিনকুঁজো কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মনের মধ্যে একটা তীব্র অভিমান ছিল মৃগাঙ্ক স্যারের বিরুদ্ধে। স্যার আমাকে ক্লাসে ইচ্ছা করেই অনেকবার ছোট করেছেন। তার একটা মোক্ষম জবাব দেওয়ার সুযোগ আমার সামনে। দৌড়ে মাঠে ঢুকে পড়লাম। জীবনে প্রথম ডিগবাজি খেলাম। নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। মৃগাঙ্ক যে আমাকে বিশ্রী ভঙ্গিমা করে দেখিয়েছিল। সেটা কী ফেরত দেব?
দিতে পারলাম না। লাইন্সম্যান আমাকে হাত টেনে মাঠের বাইরে করে দিল। সেই সাবিত্রী শিল্ড ফাইনাল ট্রাই ব্রেকার পর্যন্ত গড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত জামদাই শিল্ড পেয়েছিল। বালাজীর সেই মরণপণ খেলা আজো মনে রেখেছি। আজ কত পেশাদারীত্বের কথা শুনি। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান তো আছেই আরো বিদেশী কত লিগের খেলা। মান্চেষ্টার ইউনাইটেড, লিভারপুল , বার্সেলোনা, ..। কত দামী খেলোয়াড় রোলান্ডো, মেসি, এমবাপ্পে...
মাত্র তিন বছর আগে গিয়েছিলাম সেই শহরে। মাঠটার পাশেই ছিলাম সরকারী বাংলোয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে মাঠে গেলাম। সব শেষ। পাঁচিল ভেঙে গেছে। টিকিট কাটার ঘরটা নামমাত্র অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। সেখানে দেয়ালে রাজনৈতিক স্লোগান। মাঠে গরু, ছাগল চড়ে বেড়াচ্ছে। নিঝুম, নিস্তব্ধ, নিরালা চারপাশ। যেন কোনো শ্মশানে দাঁড়িয়ে আছি। একদিন এই মাঠেই না কত রেষারেষি, লড়াই, ঘাত -প্রতিঘাত দেখেছি। বালাজীর মতন পেশাদারী খেলোয়াড়কে সবাই ভুলে গেছে। আমি কিন্তু মনে রেখেছি। তার জন্যই না মৃগাঙ্ক স্যারকে ...।
খবর পেলাম স্যার মারা গেছেন। তবে শেষ দিন পর্যন্ত খেলা খেলা করে গেছেন। এনারাই না আমাদের এত জীবন্ত করে রাখেন। (সমাপ্ত)
No comments:
Post a Comment