ছোটগল্প

শিল্প সাহিত্য ১১৪

লাল ফোরাক

আপন রহমান

-এবার পূজায়, আমারে কিন্তু একটা লাল ফোরাক দেওয়া লাগবেই বাবা।
-হ্যা; মা দেবো।
-সঙ্গে একটা লাল জুতা, লাল কিলিপ আর লাল ফিতা।
-ঠিক আছে  মা, এবার তুই ঘুমো।
-ঘুম যে আসে না বাবা; কেবল মায়ের কথা মনে পড়ে। আচ্ছা বাবা, মা আমাদের ছেড়ে এমন করে কেন চলে গেল? মায়ের কি আমাদের কথা একটুও মনে পড়ে না ?
মেয়ের কথা শুনে প্রচন্ড এক ধাক্কা লাগে শ্যামলের মনে। সারাদিন নানান জায়গায় ছুটো-ছুটি করে বেড়ায় কাজের সন্ধ্যানে। কাজও মেলেনা তেমন। গ্রামে চলছে এক নীরব হাহাকার। অনাবৃষ্টির কারণে এবার ফসল ফলাতে পারেনি কৃষক। তারা নিজেরাই খেতে পায় না, শ্যামলকে কাজে নিয়ে কি করবে। তবুও মাঝে মাঝে দুই একজন গৃহস্তের কাঠ ফেড়ে কিংবা ছোট খাট কোন কাজ করে দিয়ে দুই এক পোয়া চাল পায়। তাই নিয়ে বাড়ি ফিরে পানি-পানি করে রেধে খুব তৃপ্তির সাথে খায় বাবা-মেয়ে। দিনটা কোন রকম কেটে যায়। কিন্তু রাতে ছোট্ট মেয়ের নানান বেদনাদায়ক প্রশ্নে বুকের ভেতরটা হু-হু করে ওঠে তার। মেয়ের প্রশ্নগুলো শুধু মা সম্পর্কে হলে তো হতো। মাঝে মধ্যে মেয়ে এমন প্রশ্ন করে!
-আচ্ছা বাবা আমরা এতো গরীব কেন? পাশের বাড়ির রত্না, রূপালী ওরা তিন বেলা কত্তো ভালো ভালো খাবার খায়, ভালো পোষাক পরে। কিন্তু আমাকে কেন না খেয়ে থাকতে হয়? ছেঁড়া জামা-কাপড় পরতে হয় ? ইত্যাদি ইত্যাদি।

আজ মেয়ে আরও একটি বেদনাদায়ক ঘটনা শোনাল। জানো বাবা আজ কি হয়েছে-সকালে না খেয়ে স্কুলে গেছি রাতেও তো তেমন খাওয়া হয়নি। দুপুরে যখন টিফিন হয়েছে। তখন আমার সেকি ক্ষুধা লাগছে! ক্ষুধার যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। দেখি রত্নাদি টিফিন খাচ্ছে। আমি রত্নাদিকে গিয়ে বল্লাম রত্নাদি, আমাকে অল্প একটু খাবার দেবে? রত্নাদি বিরক্ত হয়ে আমার গালে কষে একটা চড় মারল! চড় মারার পর আমি চারদিকে কেমন যেন অন্ধকার দেখতে লাগলাম। তারপর আর কিছু বলতে পারি না। কিছুক্ষণ পর দেখি আমি লাইব্রেরিতে শুয়ে আছি। দিদিমনি আমাকে পাখা হাতে বাতাস করছে। তারপর আমাকে আস্তে করে উঠিয়ে বড় একবাটি নুডুলস আমার সামনে এনে দিল। আমি একদমে পেট পুরে খেয়ে নিলাম। তারপর দিদিমনিকে আমি সব ঘটনা খুলে বল্লাম।
Ñজানো বাবা দিদিমনি বলেছে এখন থেকে প্রতিদিন ওনার সাথে টিফিন খেতে। কিন্তু আমার যে তোমাকে রেখে একটুও খেতে ইচ্ছে করে না। মেয়ের কথাগুলো এতক্ষণ চুপচাপ শুনল শ্যামল। কথাগুলো শুনে কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে তার। কি বলবে কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না সে। শুধু এটুকুই বলল তুই ঘুমো মা।

রাত্রি দ্বিপ্রহর কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। সমস্ত পৃথিবীটা যেন ঘুমিয়ে গেছে। শুধু ঘুম নেই শ্যামলের চোখে। এ মুহুর্তে তার মনে হচ্ছে সমগ্র পৃথিবীর প্রাণীকুল ক্ষণিকের জন্য মরে গেছে-সেই পৃথিবীর একমাত্র জীবিত প্রাণী হঠাৎ শ্যামল নিজের চিন্তাকে শুধরে নিয়ে ভাবে-ধ্যাৎ কি ভাবছি আবোল-তাবোল। পৃথিবীর সকল প্রাণীরা কি একত্রে ক্ষণিকের জন্য মরে নাকি? তাছাড়া পৃথিবীতে আমি একাই জীবিত প্রাণী হতে যাবো কেন? আমি তো মৃতদের চেয়েও মৃত। তা না হলে শেফালী আমাকে ছেড়ে এভাবে চলে যাবে কেন? স্বামী জীবিত থাকতে কোন স্ত্রী কি অন্যের হাত ধরে চলে যেতে পারে? কতো ভালোই না বাসতাম তাকে। আমি না হয় মৃত হলাম। কিন্তু এত সুন্দর একটা ফুটফুটে মেয়ে সে কি এমন অপরাধ করেছিল?
যে সেই অপরাধে তাকে মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত করল সে ? ক্রোধে শরীরের সমস্ত শিরা উপশিরা ভেসে ওঠে তার।
তবুও মাঝে মাঝে আবার মায়াও হয় বউটার জন্য। বউটা যেদিন পাশের বাড়ীর দীনুর সাথে চলে গিয়েছিল সেদিন পরপর তিন ওয়াক্ত কোন রুটি-রুজির ব্যবস্থা করতে পারিনি সে। সে জানে বউটা তাকে অনেক বেশি ভালোবাসত। সেও বউকে ভালোবাসতো। কিন্তু বাসলে কি হবে সে তো ভালো করেই জানে।” অভাব যখন দরজায় এসে দাঁড়ায় ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়”। তার ভালোবাসাও যে অভাবের কারণেই জানালা দিয়ে পালিয়েছে। এটা তার বুঝতে বাকি থাকে না। সে তো একেবারে মূর্খ না। অভাবের সংসারে অনেক কষ্টে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে।
সকাল হয়েছে মেয়েটা ঘুম থেকে উঠে খাবারের জন্য বায়না ধরেছে। রাতে না খেয়ে মেয়েটার জন্য কিছু ভাত রেখে দিয়েছিল শ্যামল। সেগুলো বের করে ওর সামনে দিল। খেতে খেতে মেয়েটি বল্ল
- বাবা কাল তো মহালয়া-পূজাও তো এসে গেছে। কিন্তু আমার লাল ফোরাক তো কিনে দিলে না বাবা? মেয়ের কথা শুনে শান্ত স্বভাবের মানুষটার মাথা কেমন যেন গরম হয়ে গেলো। সে মেয়ের গালে জোরে এক চড় বসিয়ে দিয়ে বল্ল।
-তিন বেলা খেতে পারছিস না; আবার লাল ফোরাকের শখ হইছে তোর ? আমাকে আর কত জালাবি ...?
বলে ঘর থেকে একটানে গামছাটা ঘাড়ে নিয়ে রাগে গজ-গজ করতে করতে বেরিয়ে যায় শ্যামল।
পেছন থেকে মেয়েটা ডেকে বলে আমি তোমাকে আর কখনো জালাবো না বাবা।

তখন শেষ বিকেলের সূর্যটা পশ্চিমের আকাশে প্রায় ডুবু-ডুবু অবস্থা। শ্যামল গৃহস্তের বাড়িতে কাজ করে কিছু চাল গামছায় বেঁধে নিয়ে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে আসছে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই তার বুকের ভিতর বড়ো একটা ধাক্কা লাগে। সমস্ত বাড়িটা মানুষে গিজ-গিজ করছে। শ্যামল দৌড় দিয়ে এসে বাড়িতে ঢুকে দেখে তার সোনার প্রতিমা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। তার হাতে একটা চিরকুট-“ আমি তোমাকে আর জালাবোনা বাবা...।”

কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে শ্যামল-মা তুই আমাকে রেখে এভাবে কেন চলে গেলি? আমি এখন কি নিয়ে বাঁচবো? তুই কেন বুঝলি না। আমার সাধ থাকলেও সাধ্যের কোটাটা একেবারেই শূন্য।

শিল্প সাহিত্য ১১৩

শাহিনদের কুরবানি

সাঈদুর রহমান লিটন

কুরবানীর ঈদ এলেই বুকের মধ্যে ধক্ করে ওঠে শাহিনের মার। বড় লোকেরা গরু, মহিষ, উট কুরবানি দেয়। কুরবানি দেয়া কত ছওয়াব, কত ফজিলত! অডিও কল্যাণে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল শুনে শুনে জেনেছে শাহিনের মা। ইচ্ছা হয় একটা গরু কুরবানি দিতে, পারত পক্ষে একটা খাসি দিলেও আশা পূরণ হয়। সে ইচ্ছা কখনো পূরণ হয়নাই শাহিনের মার। উপরন্তু শাহিনদের জ্বালাতন। শাহিনেরা দুই ভাই। শাহিন আর মাহিন। শাহিন মাহিনের চেয়ে বছর দুয়েকের বড়। শাহিনের বয়স বছর দশেক হবে।

ওরা কুরবানির ঈদ এলে মাকে খুব জ্বালাতন করে। বিশেষ করে জুমার নামাজ পড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, মা আমরা কুরবানি দেই না কেন? হুজুর কুরবানির কত ছওয়াবের কথা কয়। কুরবানি দেয়া কত ভাল!

মা কি বলবে বুঝে ওঠে না। মা তো জানেই কুরবানি করা কত রকমের ছওয়াব, কত রকমের পাপ মোচন হয়, আল্লাহ পাক কত খুশি হয়।

কিন্তু সাধ আছে সাধ্য নাই। এই অমোঘ সত্য টুকু উপলব্ধি করার বয়স এখনো শাহিন মাহিনের হয় নাই। শাহিনদের বাবা সরকারি চাকুরী করতেন। শাহিনের বয়স যখন পাঁচ বছর তখন শাহিনের বাবা হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।

শাহিনের মা পড়ে মহা সাগরে। কি করবে না করবে ভেবে পায় না। একা একা নীরবে নিভৃতে কাঁদে। শাহিন মাহিন বুঝে উঠে না তা। তাদের কে বুঝতেও দেন না। স্বামীর সামান্য পেনশনের টাকা আর জমি থেকে আসা কিছু শস্য দিয়ে সংসার চালিয়ে আসছেন পর্যন্ত।

কার দেখা কে দেখে? যার যার সংসার নিয়ে সেই সেই ব্যস্ত। অথচ স্বামী জীবিত থাকা কালীন, দেবরের সংসার, ভাসুরের সংসারে কত সহায়তা করতো। অথচ এই দুর্দিনে কেউ পাশে নেই। দেবর ভাসুরের বাড়ি কুরবানী হয়, শাহিন, মাহিন এক টুকরো গোস্তের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। বেদনা শাহিনের মা সইতে পারে না। গোপনে কেঁদে নেন শাহিনের মা।

মাহিন মাকে বলে মা এই টুকু গোস্ত দিয়ে পেট ভরে না, ভাত খাওয়া যায় না। মা, আর একটু গোস্ত দাও না।

মায়ের বুকটা ভেঙ্গে আসে বেদনায় কে কার বেদনা দেখে, চোখের জল দেখে, অভাব অভিযোগ দেখে। তাই তো শাহিনের মা মাজায় কাপড় বেঁধে সংসার শুরু করেছেন। বাড়িতে একটা এঁড়ে বাছুর বর্গা পালন করতন শাহিনের মা। বাছুর টি এবার ঈদে বেঁচে দেওয়া হয়েছে সেই খান থেকে শাহিনের মা কুড়ি হাজার টাকা পেয়েছে। শাহিনের মার মুখে হাসি। পরিতৃপ্তির হাসি। বাচ্চাদের ইচ্ছা পূরণ করার সাধ্যতা অর্জন করার হাসি।

তাই তো শাহিন এবার যেই বলেছে- মা, এবারো আমরা কুরবানি দিবনা?

সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন- এবার আমরা কুরবানি দিব।

এই কথা বলা মাত্রই শাহিনের কি উচ্ছ¡াস, কি আনন্দ, কি যে হাসি আর লাফানো। তা বলে কয়ে শেষ করা যাবে না। সেই লাফানো, সেই উল্লাসে মাহিনও যোগ দিয়েছিল, এবার আমরা কুরবানি দিবো। মায়ের চোখে আনন্দের ঝিলিক ফুটে ওঠে। মা তো এমনি সন্তানের আনন্দ দেখলে, সুখ দেখলে, হাসি দেখলে নিজেও শান্তি পান। কষ্ট ভুলে যান, অন্তরে প্রশান্তির ছোঁয়া অনুভব করেন। এরই নাম মা। শত দুঃখেও সন্তানের শান্তি কামনা করেন।

শাহিনের মা বললেন- বাবারে, এবার তো অত টাকা নাই, এবার একটা খাসি কুরবানি দিব। পরের বার বেশি টাকা জমলে গরু কুরবানি দিতে পারবো।

শাহিন মাহিন খুব খুশি হয়। এবার আর অন্য কারো দুয়ারে দাঁড়াতে হবে না গোস্তের জন্য। আমাদের বাড়ি কেউ থাকবে কেউ আসবে। তাদের কে আমরা দিব কি মজা, কি মজা। মনের খুশিতে দুভাই বুক উঁচিয়ে চলতে লাগলো। মা ওদের খুশিতে শতগুণ খুশি হচ্ছে। আর মনে মনে হাসছে। মায়ের মন তো সন্তানের এমন কাণ্ডকারখানায় না হেসে পারছেন না।

অবশেষে আর দুদিন বাকি ঈদের। খাসি কিনতে গেলেন বাজারে, শাহিনের মা, শাহিন আর মাহিন। পশুর হাটে মানুষ আর মানুষ। গাদাগাদি করে মানুষ হাঁটছে। অনেক গরু ছাগল উঠেছে হাটে। তারই মধ্য থেকে একটা খাসি পছন্দ হলো সবার। দাম দর ঠিক করা হলো। মাহিন শাহিনের চোখ খুশিতে চিক করছে। অবশেষে আমরা কুরবানি দিব। খাসির দড়ি শাহিন, মাহিন হাতে নেয়।

শাহিনের মা কাপড়ের আঁচল হতে টাকা দিতে গিয়ে দেখেন আঁচলে টাকা নাই, ভাল করে ঝারি দিয়ে দেখে টাকা নাই, চার পাশ তল্লাশি করে দেখে টাকা নাই। শাহিনের মা অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকেন। গগন বিদারি কান্না। মাহিন, শাহিন মায়ের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকে। খাসির মালিক শাহিন, মাহিনের হাত থেকে খাসির দড়ি ছিনিয়ে নিয়ে যায়।



শিল্প সাহিত্য ১১২

স্বপ্নের হাত 

এম. এম. বাহাউদ্দীন

আমি ফাগুনের হাত ধরেই হাটছিলাম। অতি প্রেমে আপ্লুত হয়ে নয়; ভয়ে। আমার মফসল শহরে এতো ভিড় এতো চোখ আমি আগে কখনও দেখিনি। সেও ভিষণ বিস্মিত ছিলো আমাকে দেখে। হঠাৎ কোন খবর ছাড়াই যে সে আমাকে তার শহরে দেখতে পাবে ভাবিনি সে। আমি নিতান্তই অগোছালো ভাবে গিয়েছিলাম সেই শহরে। আমার এই ভবঘুরে জীবনে এমন মুক্ত হাত আমি স্পর্শ করিনি আগে। সে আমার চোখে মুখে লজ্জা আর ভয় দেখে হো হো করে হেসে উঠেছিলো।

-ফেসবুকে তো তোমাকে বেশ স্মার্ট মনে হয়। আসলে তুমিতো তেমন নও।

আমি তার দিকে তাকিয়ে শুধু একটু বোকার মত হেসেছিলাম।

আমি বললাম হাতটা ছাড়ুন। দেখছেন কত লোক দেখছে?

সে আরও জোরে হেসে বললো- কে দেখছে? এটা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর শহর। তোমার গ্রামের মফসল শহর নয়। তাছাড়া হাত ছেড়ে দিলে তুমি হারিয়ে যাবে।

আমি সম্মতি সূচক মাথা নাড়লাম।

আবার হাটছি, শহরের ধুলো গাড়ির বিকট আওয়াজ কোন কিছুই আমাকে স্পর্শ করছেনা। শুধু লক্ষ কোটি জোড়া চোখ যেন বিধে ছিলো তার আর আমার জোড়া হাতে।

-তুমি কি সত্যি আমাকে দেখতে এসেছো এই শহরে?

আমি হ্যা না কোন কিছুই না বলে তার চোখে একবার তাকিয়েছিলাম। সে আমার এলোমেলো চুল গুলো হাতের আঙুল দিয়ে আচড়ে দিলো।

-একটা ম্যাসেজ তো করতে পারতে? কত দিন ঘুরছো এই শহরে?

-এই তো কিছু দিন। ম্যাসেজ করিনি আপনাকে হঠাৎ কোথাও দেখবো বলে।

আমি যে পুরুষ আর সে যে নারী আমি সেটা তখন ভুলেই গিয়েছিলাম।

এমনি আবেগময় কথায় হাটার মাঝে চোখ মোটা মাথায় টাক ওয়ালা এক লোক আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। তাকে দেখে আমি ভড়কে গেলাম। সে ফাগুনকে বকতে লাগলো খুব। এই করে বেড়াও সারা দিন? আরও কত কথা। আমার কানে সেসব কথা মোটেও বিধলোনা। আমি যেন কোন ঘোরের মধ্যে চলে গেছি। তখনও আমার হাত তার হাতের মুঠোয়। সেই হাতেই লোকটা একটা লোহার রড দিয়ে আঘাত করলো।

তারপর যখন বুঝতে পারলাম তখন ঘরটাকে হাসপাতাল মনে হলো।



শিল্প সাহিত্য ১১১

এ্যাম্বুলেন্স

দেবাশীষ ধর

কাঁচপুর ব্রীজটি হেঁটে পার হওয়ার পর একটি এ্যাম্বুলেন্স পেয়ে তাতেই উঠে পড়লো সাদ্দাম। যাত্রী ছিল মাত্র একজনসামনে বসা এক তরুণ মুখে অক্সিজেন মাস্ক। ছেলেটার পাশের দিকে লম্বা সিটটায় একটু দূরত্বে বসলো সে। প্রায় এক ঘন্টা যাবত একনাগাড়ে হেঁটে পা পুরোটায় ব্যাথায় জ্বলছে। এ্যাম্বুলেন্স থেকে ঔষুধের কড়া গন্ধ বের হচ্ছেজানালাও বন্ধ। সাদ্দামের একটু টেনশন শুরু হলোনাকে মরা মানুষের গন্ধকোন মরা মানুষ এটা বয়ে নিয়ে যায়নি তোআমাদের দেশে এ্যাম্বুলেন্সেই তো অর্ধেক মানুষ মরে যায়।’ কিন্তু কি আর করাসে ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে এই পর্যন্ত আসতেই এটাসহ বার গাড়ি পরিবর্তন করেছে। পথে পথে পুলিশের চেকপোস্ট তো আছেই। এটাও ফেনী পর্যন্তই যাবে। তারপর অগত্যা হাঁটা বা গাড়ির অপেক্ষা। যত তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে যেতে পারে ততই ভাল এই সঙ্কট সময়ে। আম্মার তিনটা কল ধরা হয়নি। রাস্তায়  কোন গাড়ি নেইখুব দ্রুত চলছে। সামনের ছেলেটা একবার কাশি দিলো। সিটের ব্যাক পকেটে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের স্প্রেটা দিয়ে হাতটি ধুয়ে নিল। অনেকক্ষণ যাবত হাত পরিস্কার করা হয়নি। ছেলেটার আবার কাশি দিতেই মুখের মাস্কটা আবার নাকের উপরে তুলে দিল। খুব বিরক্তি আর টেনশন বাড়ল যেন নিঃশ্বাস নিতে পারছে না- ‘বয়সে তার কাছাকাছি হবেই মনে হচ্ছে অসুস্থ না তো’! গাড়ির ভেতরে এসি সেজন্যই বোধহয় ঠাণ্ডায় লেগেছে। তাকে দেখে ক্লান্ত মনে হচ্ছে। ‘সাদ্দামেরও ক্লান্ত লাগছে। কুমিল্লায় নেমে গেল ছেলেটা। এইবার সে একা যাত্রী এ্যাম্বুলেন্সে। বলা যায় না ড্রাইভার সামনে থেকে নিতেও পারে। আর বেশি দেরি নেই। সে সামনের সিটসহ আশেপাশে পুরো স্প্রে করলো। নিজের ব্যাগেহাতেও করলো। জীবাণু ধ্বংস হলো। কিছুটা সুস্থ অনুভতিতারপরও নাকে মেডিসিনের গন্ধ।

হঠাৎ গাড়িটি থামলো। সাদ্দাম জানালায় সেঁটে হাতটি স্পর্শ করে দেখলো পুলিশের চেকপোস্ট। হয়তো এবার নামতে হবে। বালের চাকরিটায় ছেড়ে দিবে এবার সে। এই কয়দিন পর পর আশা যাওয়া তার আর ভাল লাগছেনা। এবারে দশ দিনের ছুটি দিল। পুলিশ ছেড়ে দিল। গাড়ি আবার থামলো। আবার পুলিশ বড় রাস্তার মোড়েএ্যাম্বুলেন্সে যাত্রী নেয়া নিষেধ। সার্জেন্ট ছিল। গাড়ি ঘুরিয়ে পেছনে কিছুদূর এসে থেমে ড্রাইভার তাকে নামিয়ে দিয়ে দিল। এরপর যেভাবে বললো সে তা করলো। সামনে হেঁটে চেকপোস্ট অতিক্রম করে আরো কিছুদূর গিয়ে সাদ্দাম দেখে এ্যাম্বুলেন্সটি ততক্ষণে তার আগেই চলে এসে অপেক্ষা করছে। এরপর আবার যাত্রা। চৈত্রের দুপুরের খাঁ খাঁ রোদ। খিদাও লেগেছে। নাকে মরা গন্ধ। ফেনী এসে এ্যাম্বুলেন্সটি থামলো। সাদ্দাম আবার হাঁটা শুরু করলো। আরো অনেক দূর। রাস্তায় কোন গাড়ি নেই। জনমানবহীন ধু ধু কিছুই দেখা যায় না। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সামনের দিকে বড় রাস্তার বাঁ পাশে তাল গাছের ছায়ায় একটা মুদির দোকান। সারা শরীর অবশ হয়ে আসলো তার। সেখানে গিয়ে পানি কিনে খেল। টিভিতে নিউজ শোনা যাচ্ছে। একটু আগে আরো তিনজন সনাক্ত হয়েছে করোনা আক্রান্তএবারে কুমিল্লায়। একজনকে রাস্তায় অসুস্থ অবস্থায় পাওয়া গেছে। বয়স ৩৫ এর কাছাকাছি।

-কি বলে এসবসাদ্দামের মাথা ঘুরাচ্ছে। কে শুয়ে ছিল রাস্তায়কোন রাস্তায়গরম পানি খেতে পারলে ভাল হতো। অবশ্য রোদের তাপে বোতলটি এমনিই গরম। একটা ট্রাক আসতেছে ডান দিক থেকে হাত দেখালো। ভীষণ খারাপ লাগছে তার। নাকে মরা মানুষের গন্ধ। মাস্কটা গরমে ঘেমে গেল। ট্রাকে উঠলোড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতেই বললোহা ঠিক কুমিল্লায় যাকে পাওয়া গেছে সে নাকি একজন যাত্রী। ঘণ্টাখানিক আগেই ঢাকা থেকে একটা এ্যাম্বুলেন্সে যাত্রী হয়ে এসেছিল। আশ্চর্যএ্যাম্বুলেন্সকোন এ্যাম্বুলেন্সকিন্তু ছেলেটা তো ঠাণ্ডায়ও কাশতে পারে। অন্য কোন এ্যাম্বুলেন্সও হতে পারে। আশেপাশে তাকাল। একটা জোরে ঝাকুনি খেল। হঠাৎ সাদ্দাম দেখলো নিজেকেসে এখন একটা এ্যাম্বুলেন্সে বসে আছে। আরে এখানে এ্যাম্বুলেন্স কোত্থেকে এলোসে তো ট্রাকে উঠেছিল। হা ঠিক তো তাইসামনের সিটে সেই ছেলেটা বসে আছে।  এখানে কি করছেকুমিল্লায় না নেমে গেলনাকে মরা মানুষের গন্ধ। খুব খারাপ লাগছে তারবমি আসলো মনে হয়। সে ছেলেটার দিকে চাইলো। গাড়ি কেবল চলছে আর থামে না। মনে হয় তাকেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

খুব জোরে হর্ন বাজলো। একেখান মোড়ে এসে থামল। সাদ্দাম চোখ মেলে দেখে বিকেলের ঝকঝকে আকাশ। ট্রাকের মালের বস্তাগুলোর উপর কখন সে ঘুমিয়ে গেল খেয়াল নেই। খারাপ স্বপ্ন দেখছিল। উপর থেকে নামলো। ভীষণ চা এর তেষ্টা পেল। সারাটা পথ তাকে খুব ক্লান্ত করে দিল। কিন্তু সংশয় এখনো যায়নি। ‘ওই এ্যাম্বুলেন্সটায় কি আক্রান্ত আসলে ধরা পড়েছিলএরকমও হতে তারও আগে কোন আক্রান্ত ব্যক্তির ছিল তার সংস্পর্শে ছেলেটাও আক্রান্ত। আর এখন হয়তো ভাইরাসটি তাকে টার্গেট করবে।

এসব সাত-পাঁচ উত্তরহীন প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাকে সাদ্দাম একটা জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো।


শিল্প সাহিত্য ১০৪-১১০

পচন

স্বপঞ্জয় চৌধুরী
       

এক

সারাদিনের ভিক্ষাকর্ম সেরে ফুলমন বিবি তার বস্তিতে ফিরছে। যেমনটি আপনি আমি ফিরি অফিস কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। কারো উদ্দেশ্য অর্থ আবার কারোবা অর্থের জন্য বিদ্যা। ফুলমন বিবির উদ্দেশ্য বাঁচার জন্য ভিক্ষা করা। স্বামী গত হয়েছে প্রায় বিশ বছর আগে। ছেলেপুলে বিয়ে থা করে আলাদা সংসার পেতেছে। বৃদ্ধা মায়ের দিকে ফিরে তাকাবার সময় সময় ওদের নেই। তারপরও মানুষ বাঁচতে চায় একান্ত বাঁচার জন্যই। ফুলমন আজ ভিক্ষা করে পেয়েছে সাতান্ন টাকা পঁচিশ পয়সা আর সোয়া দুই কেজি চাল। শহুরে মানুষগুলো অনেক কৃপণ হয়ে গেছে। আর হবেইবা না কেন, ভিক্ষাবৃত্তির নব নব কৌশলের সূত্র ধরে  ফেলেছে শহরবাসী। আমার বৌ এর অসুখ, মেয়ের বিয়ে, পরীক্ষার ফিস, ছেলে হাসপাতালে এরকম আরো কত উপায়ে যে ভিক্ষা নেয়া হচ্ছে বাস, লঞ্চ, পথেঘাটে, দোকানপাটে সব জায়গাতে! সেখানে ফুলমন বিবিদের মতো অদক্ষ অভিনেত্রীদের সুযোগ কমই বৈকি।

 

বাজার থেকে তেল, নুন, তরিতরকারি কিনতেই সব ফুরিয়ে যায়। তার উপর আবার প্রতিমাসে বস্তির ঘর ভাড়া তিনশত টাকা দিতে হয়। ফুলমন বিবিরা সমুদ্র যাত্রায় হেঁটে চলা কচ্ছপের মতো প্রতিদিনের ভিক্ষাকর্ম সেরে রাজধানীর অভিজাত পথ মাড়িয়ে বস্তির কুঁড়েঘরে ঠাঁই নেয়।

 

দুই

বাঁদিকের রাস্তা পেরিয়ে সামনে এগুলেই আরেকটি রাস্তা। রাত আটটা বাজলেই রাস্তাটি খানিকটা ভুতুড়ে হয়ে যায়। মাঝে মধ্যে দুএকটা প্রাইভেট কার এসে হর্ন বাজিয়ে কোনো বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে, নতুবা রাস্তা মাড়িয়ে অন্য কোনো রাস্তায় চলে যায়। অভিজাত বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে বাগানবিলাস। সমগ্র রাস্তাটিতে হাঁটলে ফুলমন বিবির স্বর্গসুখ অনুভ হয়। ঠিক তার বিপরীত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় রাস্তার মোড়ে ডাস্টবিনটার কাছে গেলে। পেটের নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে আসতে চায়। প্রতিদিনের মতো আজও নাকে কাপড়ের আঁচল টিপে ডাস্টবিনের সীমানা পেরুচ্ছে ফুলমন। হাত দশেক দূরে যেতেই ফুলমন বিবির কানে খানিকটা চেনা সুর ভেসে আসে। ফুলমন সুরের তোয়াক্কা না করে আরও দু কদম পা ফেলে। আবারও সেই সুর ফুলমন বিবির কান মস্তিষ্ককে আন্দোলিত করে। 

এবার পূর্বাপেক্ষা আরোও সচেতনভাবে ফুলমন বিবি সুরটিকে শ্রবণ করে। কান খাড়া করে শুনতে থাকে সুরটি বেড়ালের গর্জন নাকি কোনো নবজাতক শিশুর কান্না। ফুলমন বিবি আরো ভালোভাবে সুরটি শোনে আর বিড়বিড় করে বলেন ঠিকইতো কুট্টু পোলাপানের কান্দনের আওয়াজ ফুলমন বিবি নিশ্চিত হয় সুরটি পিছন দিক থেকে আসছে। সে পশ্চাতে ফিরে আস্তে আস্তে এগুতে থাকে এবং ডাস্টবিনের কাছে আসতেই আওয়াজটি আরও ঘনিভ হয়। ফুলমন বিবির আর বুঝতে বাকি থাকে নাহায় আল্লা এই কাম কেডায় করলো, এই রহম এট্টা জ্যান্ত বাচ্চারে ময়লার মধ্যে ফালাইয়া গেলোখানিকটা আতংকিত হয়ে বলে ফুলমন। বাচ্চাটার দিকে ফুলমনের দৃষ্টি আরোও প্রবলভাবে যায়। নবজাতকটি ছেলে শিশু এবং খুব বেশিক্ষণ হয়নি কেউ ফেলে গেছে। পনের বিশ মিনিট হবে এরকম অনুমান করে ফুলমন। যাউগগা তাতে আমার কী! বড়লোকের কুকামের ফসল ফালাইয়া থুইয়া গেছে। এই বলে হাঁটা ধরে ফুলমন। আবারও সেই কান্নার সুর ফুলমনকে অস্থির করে তোলে। ফুলমনের দ্বিতীয় সত্তা তাকে প্রশ্ন করে- কি পালাইয়া যাইতাছোস? এই বাচ্চাডাতো তরও হইতে পারতো। সে আবারও পিছন ফেরে এবং ভাবে বাচ্চাটাকে কি সে সাথে নেবে নাকি বস্তির লোকেদের ডেকে নিয়ে আসবে। বস্তির লোকেদের ডাকতে গেলে কেউ যদি বাচ্চাটাকে নিয়ে যায়।

যাউগগা তাতে আমার কী?” ফুলমন বিবি আবারও সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে বাঁদিকের রাস্তায় চলে যায়। ফুলমনকে পাশ কাটিয়ে একটি কুকুর চলে যায় সেই ডাস্টবিনের দিকে। ফুলমন দুতিন কদম হাঁটে। হঠাৎ সে আঁতকে উঠে বলে-  “কুত্তাডা যদি বাচ্চাডারে মাইরা ফালায়। ফুলমন পিছন ফিরে দেখে কুকুরটা ডাস্টবিনের দিকেই এগুচ্ছে। লেমন বিবি এবার দৌড়াবার মতো করে হাঁটতে থাকে। কুকুরটা ডাস্টবিনের ময়লার কাছে যায়। বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে কুকুরটা জিহ্বা বের করছে। ফুলমন বিবি হাতে একটা ইটের কণা নিয়ে হুংকার করতে করতে আসে ঐকুত্তা যা ভাগ এহেনতোন। কুকুরটি ফুলমন বিবিকে দৌড়ে আসতে দেখে ঘেউঘেউ করতে থাকে এবং গররর আওয়াজ করতে থাকে। ফুলমন বিবিও কম যায় না সেও কুড়ি বছরের তরুণীর মতো শক্তি নিয়ে বলে ওঠে যদি বাচ্চাডার গায়ে আঁচড় পড়ে খাইয়া ফালামু তোরে। হাতে নেয়া ইটের কণাটি সে কুকুরের দিকে ছুড়ে মারে। কুকুরটি এবার লেজ গুটিয়ে কেউ কেউ আওয়াজ করে পালিয়ে যায়। ফুলমন বিবি এবার দিশেহারা মায়ের মতো বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিয়ে চুমু খায়। বাচ্চাটির চোখে যেন চাঁদের আলোচ্ছটা পড়ে। ফুলমন বিবি বত্রিশ বছর আগে ফিরে যায়। যখন সে প্রথম মা হয়েছিল উনিশ বছর বয়সে। 

 

তিন

শহরের অন্যতম নার্সিং হোম নিরুপমা নার্সিং হোম। এই নার্সিং হোমে বাচ্চা ডেলিভারির একটা সুনাম রয়েছে। রাত নয়টা পাঁচ। পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখে নেন লোপার বাবা। মোবাইল পকেটে রাখতেই ফোন বেজে ওঠে। মোবাইলে নম্বর ভেসে উঠতেই আজাদ সাহেব গর্জে ওঠেনসান অফ বিচ আমি তোকে পুলিশে দেব। কেন তুই আমার মেয়ের সর্বনাশ করলি?” মোবাইলের ওপাশ থেকে প্রতারক লম্পট প্রেমিকের কণ্ঠদেখুন আংকেল এযুগে এগুলো কোনো ঘটনাই নয়, বাচ্চা ফেলে দিয়েছেন ভালোই করেছেন। এখন ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দিন।আজাদ সাহেব ক্ষিপ্ত কণ্ঠে- শাট আপ বাস্টার্ড, বলে মোবাইল বন্ধ করে দেন। নার্সিং হোমের আয়া আজাদ সাহেবের কাছে এসে কানে কানে বলেস্যার কাম কমপ্লিট আজাদ সাহেব পকেট থেকে দুটো পাঁচশত টাকার নোট বের করে দেন। আয়া বিরক্তির স্বরে বলে- আমারে কি ভিক্ষুক পাইছেননি স্যার? এইজন্যই এইসকল রিক্সের কামে যাইতে চাই না। চুপ করো, ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বলেন আজাদ সাহেব। এরপর পকেট থেকে আরো দুটি পাঁচশত টাকা বের করে দেন। এবার আয়া তার দন্ত প্রদর্শন করে। আজাদ সাহেব নার্সকে ডাকলেন। নার্স ব্যস্ততা নিয়ে বললেন, জ্ঞান ফিরেছে স্যালাইন চলছে। শরীর অনেক দুর্বল, বেশি কথা বলবেন না।

 

চার

বস্তিতে হৈ চৈ পড়ে গেছে। ফুলমন বিবির ঘরে কুড়িয়ে পাওয়া নবজাতক শিশু। সবাই এক নজর দেখতে ভিড় জমালো ফুলমন বিবির ঘরে। হৈ চৈ ঠেলে বস্তির মাতবর ঘরে ঢুকলো। কোন পাপের বীজ ঘরে আনছো ফুলমন? যেইখান থিকা নিয়া আসছো সেইখানে রাইখা আসো। বুড়া বয়সে ঝামেলা করার দরকার কী? অন্য একজন জোয়ান বললো এইডাতো মানুষের মতো কথা হইলোনা মাতবর সাব। শত হইলেও এইডা মানুষের বাচ্চা, কুত্তা বিলাইয়ের বাচ্চা না। সকলেই মাথা নেড়ে বলে, ঠিকই কইছো। অন্য একজন বৃদ্ধা মহিলা বললো- তোমরা কি খালি প্যাঁচালই পারবা? বাচ্চাডারেতো আগে বাঁচানো লাগবো নাকি? ওর দুধ খাওনের ব্যবস্থা করো। অন্য এক মহিলা বললো- এইমুহূর্তে ওরে মায়ের দুধ দেওন লাগবো। কিন্তু দুধ দিব কেডায়? বলে ওঠে অন্য এক মহিলা। ঘরের ভিড় আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এক বৃদ্ধা বলে উঠলো, আচ্ছা কুসুমেরতো দুধের বাচ্চাডা মইরা গেলো। ওর কাছে নিলেতো মনে হয় কাম হইতো। অন্য এক বৃদ্ধা হাহুতাশ করে বলে- আরে, পর পর দুই বাচ্চা মরলো তারপর গত হপ্তায় গাড়ির তলে পইড়া ভাতার মরলো, ওর কি এহন মাতা ঠিক আছে? ওতো একটা পাগলি! একথা বলতে না বলতেই কেউ একজন ভিড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। কেউ একজন ঠাট্টা করে বলেছিল, তোর ছেলে ফিরে এসেছে। একথা শুনেই ছুটে আসে। দে আমার পোলারে, দে বুড়ি। এই বলেই ফুলমনের কাছ থেকে নবজাতকটিকে চিলের মতো ছোঁ মেরে কোলে নেয় কুসুম। সকলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে যার যার ঘরে ফিরে যায়।

 

পাঁচ

এরপর এগারো বছর কেটে গেলো। ফুলমন বিবি পটল তুলেছে প্রায় ছয় বছর আগে। কুসুম যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছে কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে সলিমকে। বস্তির মানুষ অবশ্য ওর নাম দিয়েছে পচন। ওর পচন নামের আড়ালে ভালো নাম আব্দুস সলিম ঢাকা পড়ে গেছে। 

সবাই ওকে পচন নামে ডেকেই স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করে বেশি। কুসুমও ওকে এখন পচন নামে ডাকতে শুরু করেছে। অবাধ্য ছেলেটি সারাদিন পথে পথে ঘুরে বেড়ায় আর কুসুম মানুষের বাড়িতে ঝি এর কাজ করে খেটে মরে। ব্র্যাক স্কুলে ওকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়েছে। স্কুলে একদিন যায় তো তিনদিন যায় না। ওর বয়সী আরো অনেক ছেলেদের সাথে রাস্তায় রাস্তায় ঘুড়ে বেড়ায়। রোদে পোড়ে, বৃষ্টিতে ভেজে আবার কখনোবা বুড়িগঙ্গার ময়লা পানিতে ঝুপাঝুপ ডুব দিয়ে সেরে নেয় গোসল। বাসে উঠে বলে ভাড়া নেই, হেলপার এক চপেটাঘাত দিয়ে নামিয়ে দেয়। পরের স্টপেজে এরকম আরো নানা ঘটনা ঘটিয়ে থাকে অবাধ্য বালক পচন। 

ইদানিং বিড়ি সিগারেটের পশ্চাৎদেশ কুড়িয়ে টান দিতেও নাকি শুরু করেছে। মাঝেমধ্যে গঞ্জিকাসেবকদের কাছ থেকে এক দুটান ভাগও পেয়ে থাকে। ময়লা সাদা রঙের ছেঁড়াফাটা গেঞ্জি হাফপ্যান্ট পরিহিত বালক পচনকে মাঝে মাঝে গার্লস স্কুলের সামনে দেখা যায় কারো কাছ থেকে আইসক্রিম চেয়ে খেতে। ওর ভাষ্য মতে আফারা খুব ভালো হয় চাইলেই দেয় কিন্তু ভাইয়ারা দেয় ধমক তাই তেনাগো কাছে চাই না। কখনোবা রাতের বেলায় একা একা ঘুরে বেড়ায় ঢাকার রাজপথে। মাঝরাস্তার আইল্যান্ড ধরে দুহাত দুপাশে প্রশস্ত করে শৃঙ্খলমুক্ত পাখির মতো যেন উড়ে যায় দূরে।

 

ছয়

এরপর আরো দুইবছর কেটে গেলো। পচনের শরীরে কুষ্ঠরোগীদের মতো ফোস্কা দাগ উঠতে লাগলো। মাঝে মাঝেই জ্বর আসে। ডাক্তার বলেছে সুচিকিৎসার প্রয়োজন। কুষ্ঠ ছোঁয়াচে রোগ এই আতঙ্কে ওর সাথে কেউ মিশতে চায় না। এমনকি ওর মা কুসুমও ওর থেকে যেন খানিকটা দূরে সরে যাচ্ছে। মানুষের বাড়ি কাজ করে ওর চিকিৎসা খরচ মেটানো সম্ভব নয়। তাই ওকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে শুয়ে বসে ভিক্ষা করতে হয়। কেউ হয়তো দুচার আনা দেয় কেউ আবার আতঙ্কে সরে যায়।  দিন শেষে যা কামাই হয় তা দিয়ে ওষুধ পথ্য কেনা হয় না। অবশ্য একটি এনজিও ওর চিকিৎসা খরচ বহনের আশ্বাস দিয়েছে। বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও নাকি চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় খবরও জানে পচন। কিন্তু তবুও সেসব চিকিৎসা সেবা নেয় না। কারণ কুষ্ঠ রোগকে পুঁজি করে ভিক্ষার মাধ্যমে কিছু পয়সা কামাই করে যদি দুগ্ধদাত্রী মাকে একটু আর্থিক সহয়তা করা যায়। রোগ ভালো হয়ে গেলে সুস্থ্য মানুষকে কেউ ভিক্ষা দেবে না।

 

সাত

সদরঘাটে শুয়ে আছে পচন। ভোর ছটা বাজে। হিম হিম বাতাস বইছে সমস্ত টার্মিনালে। পচন শুয়ে শুয়ে দেখছে মানুষের হেঁটে চলা অগণিত পা জুতোর বাহার। মাঝে মাঝে ওর বেছানো আঙ্গুলকে থেতলে যায় কোনো পা। আবার পুলিশের ডান্ডাবাড়িও পড়ে কোনো কোনো সময়। লঞ্চ থেকে নেমে এক মহিলা যাচ্ছে সাথে দশ বছরের একটি মেয়ে, কোট পরিহিত এক বুড়ো ভদ্রলোক এবং পঁয়ত্রিশোর্ধ বয়স্ক একজন লোক পচনের এদিকেই আসছে। পচন এমনভাবে ওদেরকে দেখছে যেন সবাইকে চেনে। নিশ্চয়ই অনেক বড়লোক হইবো কিছু চাইলে দশবিশ টাকাও দিতে পারে মনে মনে এসব ভেবে পচন বৃদ্ধ লোকটার পা জড়িয়ে ধরে স্যার আমি এক অসুস্থ রোগী কিছু দিয়া যান। পা ছাড়, হতচ্ছাড়া! এই বলে পা ঝাড়া দিয়ে লাথি মারে বৃদ্ধ লোকটি। পচন মাগো বলে চিৎকার করে ওঠে। পচনের চিৎকারে পাশের মহিলার বুকের ভেতর যেন কেউ ঘণ্টা বাজিয়ে দিলো। পচনের আর্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তার বড় মায়া হয়। সে ভ্যানিটি ব্যাগ হতে বিশ টাকার একটি নোট বের করে পচনকে দিতে চাইলো। কিন্তু পচনের কেন যেন তার কাছ থেকে ভিক্ষা নিতে ইচ্ছে হলো না। পচন চোখ মুছতে মুছতে বলেন ম্যাডাম আপনে খুব ভালো, টেকা লাগবো না। বৃদ্ধ লোকটি পিছন ফিরে মহিলাটিকে ডাকে এই লোপা পথেঘাটে কী নাটক শুরু করলি? তাড়াতাড়ি আয়।

লোপা ব্যাগের হুক বন্ধ করে বলে, আচ্ছা ঠিক আছে, আসি। যাওয়ার সময় লোপার শাড়ির আঁচল পচনকে ছুঁয়ে যায়। পচনের মনে হলো তার গায়ে কেউ যেন স্নেহের পরশ বুলিয়ে  গেলো। পচন লোপার হেঁটে চলে যাওয়া দেখতে থাকে। একসময় ওরা সবাই লঞ্চ টার্মিনালের বাইরে চলে যায়। পচন নিজের নিয়তির কথা ভেবে চোখ মোছে আর বলতে থাকে স্যার কুষ্ঠ রোগীরে কিছু দিয়া যান। (সমাপ্ত)


শিল্প সাহিত্য ১০২


স্বৈরাচারের ডিনার টেবিল

আপন রহমান

শরীরটা আজ বেশি ভাল নেই। প্রচন্ড মাথায় যন্ত্রণা, জ্বরও আছে সাথে। ঘরে প্যারাসিটামল ছিলো খেয়ে; খাটের উপর শরীর এলিয়ে দিয়ে। মনে মনে ভাবছিলাম আজ নিশ্চয় আসবে। আমি অসুস্থ্য হলে একা থাকলে আসে। হচ্ছে আমার বন্ধু নীল পরী রিম্বা। ওর বাড়ি পরিস্থানের সেওগুণ রাজ্যে। প্রতিবার আমাকে এক একটি অদ্ভুত দেশে নিয়ে যায় বেড়াতে। তবে স্বপ্নের ঘোরে। এবারও হয়তো.....

 

ভাবতে -ভাবতে চোখটা কখন যে বুজে এলো টেরও পেলাম না। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ঘরটা আলোকিত হয়ে গেল বুঝতে পারলাম, এসে গেছে।

 

হ্যাঁ, এসেছে। আমার মাথার কাছে এসে বসলো। তারপর কোমল হাতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মুচকি হেসে বল্ল- শরীরটা কি খুবই খারাপ?

আমি বল্লাম- কৈ, না তো একটু...

- যাবে তবে নতুন দেশে?

আমি বল্লাম- হ্যাঁ।

 

আমার হাতটা ধরলো। মূহুর্তে আমরা পৌঁছে গেলাম সেই আজব দেশে। বল্ল এটাসব খেয়েছির দেশ এদেশের সর্বোময় ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে সম্মানের সহিত বলা হয় স্বৈরাচার। এটা এদেশের একটি সম্মানজনক শব্দ। এদেশের ক্ষমতাধরেরা সর্বভক।

 

চলো এবার তোমাকে এদের বৈচিত্র্যময় ডাইনিং রুমে নিয়ে যাই।

 

কিছুটা ভয় কিছুটা সংকোচে আমি রিম্বার হাত ধরে এগিয়ে গেলাম ডাইনিং রুমে। বল্লÑ ভয় নেই বন্ধু যাদু বলে আমরা অদৃশ্য। ওরা আমাদেরকে দেখতেই পাবেনা।

 

রিম্বা একে একে ওদের খাবারগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল আর আমি অবাক হচ্ছিলাম।

 

সেখানকার অর্থাৎ স্বৈরাচারের ডিনার টেবিলের খাদ্য তালিকায় ছিলো।

- আধ সিদ্ধ গণতন্ত্র

- গরীবের চামড়ায় তৈরি মোঘলাই পরোটা।

- ধর্ষিতা রমনীর দেহ পেষা স্যুপ।

- বিপ্লবী কবির সুগঠিত রানের কাবাব।

- গণতন্ত্রকামী ছাত্রদের দেহের টুকরো টুকরো মাংস-ণা আরও কত কি!

 

এবার গেলাম তাদের পানশালায়।

সেখানে গরীবের রক্তমদে নেশায় বুদ হয়ে আছে। কতিপয় -পুংশক মন্ত্রী, ফ্যাসিবাদীর দালাল, সেবা ব্যবসায়ী, ঘোড়েল আমলা, বাম-ডানের কিছু পল্টিবাজ নেতা ইত্যাদি।

 

আমি দেখছিলাম আর অবাক হয়ে ভাবছিলাম। বাহ্! কুকুর-শেয়াল-আর হায়েনার মাঝে কি অদ্ভুত মিল!

 

হঠাৎ পাশের বাড়ির নেড়ী কুত্তাটার ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেলো আমার। বাইরে কারা যেন চিৎকার করে বলছিলো; চোর - চোর - চোর...

 

লুঙ্গির খুট গুঁজতে -গুঁজতে মধ্যরাতের ঘুট ঘুটে অন্ধকারে ছুটে গেলাম বাইরে। দেখলাম হারিকেন আর লাঠি হাতে কিছু লোক ছুটছে চোর ধরতে। তাদের কিছুটা পেছনে অর্ধনগ্ন অবস্থায় খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে ছুটছে জহির পাগলা।

আমি বল্লাম- কি হে বাপু ছুটছো কেনো?

জহির একগাল হেসে বল্লো- আর বলোনা বাপু-চোরে দ্যাশটা খেয়ে নিলো রে...

 

বাড়ি ফিরে আসতে আসতে আমিও ভাবলাম সত্যিই তো! চোরে দেশটা খেয়েই নিলো...

 

এরপর আমার মনটা আরও খারাপ হয়ে গেলো যখন মনে পড়ল রাতের সেই অদ্ভুত স্বপ্নের কথা...


শিল্প সাহিত্য ৯৩-৯৮


অন্ধকারাচ্ছন্ন

প্রণব কুমার চক্রবর্তী

এক

শেষপর্যন্ত কেল্লার সিকিউরিটি ইনচার্জ রজনীশ গ্রেভারের কথাতেই সুন্দরলাল বাধ্য হয়েছিলেন, রাত্রের গান-বাজনার আসরটাকে গেস্ট হাউজের ঘর থেকে টেনে বাইরে কেল্লার ভেতরে রাজকীয় মহলের বাগিচায় নিয়ে যেতে ।

       আসলে, আগামীকাল সকালেই আমরা এখান থেকে অন্যত্র চলে যাব । তাই বিকেলে আমাদের ঘোরাঘুরি পর্ব মিটিয়ে সন্ধ্যায় সুদীপ্ত নিজেদের মধ্যে একটা আলোচনা করে ঠিক করলো যে সন্ধ্যার পরে সবাই একসঙ্গে বসে একটু মাল ঝাল খেয়ে, গান-বাজনা এবং আনন্দ ফুর্তি করে, আমাদের এই সফরের প্রথম পর্বের শেষ রাত্রিটাকে সেলিব্রেশন করব। কেউ অন্য থা করেনি। সত্যজিৎ সঙ্গে সঙ্গেই সকলের কাছ থেকে চাঁদা তুলে, একটা থোক টাকা বিশ্বজিতের হাতে দিয়ে বলেছিল - সন্ধ্যার পরে ঘরেই গোটা ব্যাপারটা অ্যারেঞ্জ করতে, আর কেল্লার কেয়ারটেকার এবং সিকিউরিটি ইনচার্জকেও ইনভাইট করতে ওই আসরে আসার জন্য। সেই মতই সুন্দরলাল  রজনীশজিকে সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যার একটু আগেই এসে হাজির । বাদশাহী কেল্লার গেস্ট হাউসে আনন্দ-ফুর্তির আসর। সেই আসরে বাদশাহী মেজাজ আনার জন্য, সবাইকে বলা হয়েছে পাঞ্জাবি আর পাজামা পরতে। অতিথিরাও অন্যথা করেনি ।

      বিশ্বজিৎ ঘরটাকে বেশ সুন্দর করে রঙিন কাগজের চেনো আর স্টিকার দিয়ে সাজিয়েছে ।
হাশরের ড্রেসকোডের সাথে মিল রেখে প্রত্যেকের জন্য কাগজের রঙিন টুপি কিনছে । ঘরের টেবিলে সাজিয়ে রেখেছে গোটা কয়েক দামি মদের বোতল - রাম আর হুইস্কি । একটা বড় কাগজে রং দিয়ে লিখেছে - ‘ফেয়ারওয়েল টু আগ্রা’।
      - ইয়ে তো বরিয়া ব্যাপার! কিস লিয়ে মানায়া জাতা ? রাজনিশ সাহেব জানতে চায় ।
      সুন্দরলাল কিছু বলবার আগেই সুদীপ্ত ওদের দু’জনের মাথায় দুটো কাগজের টুপি পরিয়ে দিয়ে বলে - নাথিং । বাট টু গেট টুগেদার অ্যান্ড রিলাক্স ।
      - কিউ ?
      - আজ এখানে আমাদের শেষ দিন। কাল সকালেই চলে যাব। সেই কারণেই আমরা আপনাদের সবাইকে নিয়ে রাত্রে এখানে একটু আনন্দ ফুর্তি করতে চাই।
      - ভেরি নাইস। রাজনিশ বাবু কাল বিলম্ব না করে সুন্দরলালের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন - হাজী ? ইয়ে ফাংশন ঘারমে আচ্ছা নাই লাগতে। বাহার মে লে চলে। ও মহলকা গার্ডেনমে। হাম আভি কুছ গানা আউর নাচনেওয়ালিকো বুলাকে লে আতে।
     -  ঠিক হ্যয় । হাম আভি করবাতে। সুন্দরলাল হাত দিয়ে ডেকে নেয় গেস্ট হাউজের ছেলেদের ব্যাপারটাতে আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম ।

দুই

আসলে, আমি এর আগে বহু জায়গায় ঘুরতে গিয়েছি। কিন্তু এই আগ্রা এবং ফতেপুর সিকরিতে আমার আসাটা হয়ে ওঠেনি। এবারে তাই যখন আমাদের অফিসের কলিগরা এই আগ্রা এবং ফতেপুর সিক্রি সহ অন্যান্য জায়গায় ঘুরতে আসার ব্যাপারে প্রস্তাবটা দিয়েছিল, আমি ফেরাতে পারিনি। রাজি হয়ে।

আগ্রা এবং ফতেপুর সিক্রি নাম দুটো শুনলেই আমার মনের ভেতরে কেমন যেন একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভ‚ত হয়। মুঘল বাদশাহদের আমলের এই দুটো জায়গার সাথে ইতিহাসের অনেক উঠানামার গল্প জড়িয়ে আছে। কেন যেন মনে হয এই জায়গা দুটো আমার বহুদিনের পরিচিত। এই জায়গা দুটোর মাটি, মানুষ এবং জলবায়ুর সাথে আমার একটা আত্মীয়তার বন্ধন রয়েছে। আমি আগের কোন একটা জীবনে এইসব জায়গায় কাটিয়ে গিয়েছি। আগ্রা শহর থেকে যখন ঘোড়ার গাড়িতে চেপে এই বাদশাহী কেল্লার দিকে আসছিলাম, তখন আমার চোখের সামনে কল্পনায় ভেসে উঠেছিল যেমন রাস্তার দু’পাশের বিস্তীর্ণ ধূসর মাঠের ছবি, তেমনি ঘরের ভেতরের ছোট বড় সব হাভেলি, রাজপ্রাসাদ, বিভিন্ন জেনানা মহল, মসজিদ, দোকান-বাজার এবং নানারকম দেশি এবং বিদেশি ফুলের বাগিচা। সব যেন একটা বিষাদ মাখা রোমান্টিক স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আমার এইসব ভাবনার মাঝেই রাম রতন টাংগা ওয়ালা হাভেলি থেকে একটু দূরে গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে বলে উঠলো - বাবুজি? ওটাই আছে কেয়ারটেকার সাহেব কা কোয়াটার। উসকি বাগাল মে সফেদয়ালা বিল্ডিংটা মালুম হচ্ছে আপকি গেস্ট হাউস। আপ থোরা রুকিয়ে হিয়া।

হাম যাকে উনকো বুলাকে লে আতে।

তিন

আগ্রার এই কেল্লাটা মুঘল ইতিহাসের একটা খন্ড চিত্র মাত্র। এটা একটা নাম। একটা ইতিহাস।
এই কেল্লাটার নাম শুনলেই, চোখের সামনে ভেসে ওঠে অসংখ্য প্রেমের উপাখ্যান। সেই সব উপাখ্যানের কোনটা প্রেমের কাহিনীতে ভরপুর, আবার কোনটা প্রেমের দ্ব›দ্ব এবং সংঘাতের ঘটনায় সম্পৃক্ত। পাশ দিয়ে বয়ে চলা অবিরত স্রোতধারার নদী যমুনা আজও রয়েছে। সিন্ধু নদীর তীর ঘেঁষে ভারতের মাটিতে যে নতুন ইন্দো- পারসিক ইসলামিক শিল্প, সংস্কৃতি এবং  সভ্যতার সূচনা ঘটেছিল, যমুনাতে তার মিলন, ব্যাক্তি এবং সমাপ্তি ঘটেছে।    
ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে পানিপথের প্রথম যুদ্ধের পর হিন্দুস্থানের বুকে যে মুঘল রাজবংশের প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার একটা দীর্ঘ লম্বা ইতিহাস আছে। সেই দীর্ঘ ইতিহাসের কালক্রমে মুঘল সম্রাট এবং বাদশারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যতসব গড়, কেল্লা, রাজপ্রাসাদ, হাভেলি এবং মঞ্জিল আর মহল নির্মাণ করে গেছেন, ইন্দো-পারসিক শিল্প এবং কারুকার্যের নিদর্শন রেখে গেছেন, এটা কেল্লাটা নিঃসন্দেহে তারই একটা অন্যতম সংস্করণ মাত্র। বাবর এর আমল থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের সময় পর্যন্ত, প্রায় তিন শ’ বছরের প্রাচীন সেই ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই কেল্লার নাম- আগ্রা ফোর্ট। এই কেল্লার দেয়ালে, প্রাসাদে এবং মহলের গায় কান পাতলে এখনো নাকি শোনা যায়- সেই অতীতের সব ইতিহাস।
বিশাল ফটকটা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। ভেতরে ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে রাজপ্রাসাদ, হারেমের বেগম থেকে শুরু করে রক্ষিতা, বাদী, সেবাদাসী, নর্তকী, গাইয়ে, ইত্যাদি এর থাকার বিভিন্ন মহল। এছাড়াও রয়েছে রংমহল, নাচঘর, জলসাঘর, বাদশাহী মজলিস কক্ষ- দেওয়ান-ই-আম এবং দেওয়ান-ই-খাস। 
ফটকের দুপাশে প্রাচীরের গা ঘেঁষে কেল্লার রক্ষী আর প্রহরীদের বাসস্থান এবং অন্দরমহল এর মত- বাদশাহী বাহির মহল। এই বাহির মহলে বসেই বাদশাহী প্রশাসনের মাথারা- শাহজাদারা এবং আমির-ওমরাহ, মন্ত্রিপরিষদ, সবাই তাদের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করতেন। দেশ-বিদেশের রাজা মহারাজা, সুলতান এবং নবাবরা সম্রাটের জন্য নানা ধরনের নাজরানা এবং ভেট পাঠাতেন। ওইসব নজরানা এবং উপহারের ভিতরে থাকতো দামি দামি মণি-মাণিক্য, হীরা-জহরত, স্বর্ণমুদ্রা এছাড়াও সম্রাটের হারেমের জন্য সুন্দরী সব সঙ্গীত এবং নৃত্য পারদর্শী যুবতী মহিলা। কখনো কখনো সম্রাটের শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার জন্য অল্প বয়সী সুন্দরী রমনীকে সেবাদাসী হিসেবে পাঠানো হতো।

চার 

আজ শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশী রাত্রি। জ্যোৎস্নার আলোতে চারপাশটা ঝলমল করছে।
এইরকম জ্যোৎস্নাস্নাত রাত্রে প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞার কারণে তাজমহলটা ঘুরে দেখতে না পারার ব্যথা এবং যন্ত্রণাটা মনের ভিতর যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে, সেটা হয়তো আজ একটু চেষ্টা করলে- সফল হতে পারে। যে আকাক্সক্ষাটা তাজমহলের ক্ষেত্রে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল, এই কেল্লার বাগানের মাঠের আনন্দ মজলিসে বসে সেটা হয়তো সুন্দরলাল আর  রাজনিশ দিকে বলে ম্যানেজ করা সম্ভব হবে! আকাক্সক্ষাটা আমাকে এতটাই খোঁচানো শুরু করেছিল যে আমি আর অপেক্ষা না করে, বলেই ফেললাম।
সুন্দরলাল আমার কথা শোনা মাত্রই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। চোখ দুটো কপালে তুলে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন - গভীর রাত্রে জান্নাত মহল ঘুরে দেখা, সে কি করে সম্ভব! 
ইয়ার ? ও নেহি হোগা। সরকারি কানুন মে নিষেধ আছে। তাছাড়া, গভীর রাত্রে মহালমে ঘুমনা ঠিক নেহি হোগা। বহুৎ খাতরা!
      - কেন? কিসের খাতরা? আমি জানতে চেয়েছিলাম।
      - রাত মে এইপে সব হুরি উরি, ভুত উত এসে ঘুরে বেড়ায়। ওরা জান্নাত মহলে কোন পুরুষ মানুষ দেখলে, রেগে যায়। ক্ষতি করে বসে!
      - কেন ? রাগবে কেন?
      - জান্নাত মহলে সম্রাট ছাড়া অন্য কোনো মরদ আদমির যাওয়া নিষেধ। ওরা এখনো সম্রাটের সেই নির্দেশ পালন করে। দু’সাল পহেলে আপনার মতই কলকাতার এক বাঙালি দাদা, এই রকমই এক রাত্তিরে মহলটা ঘুরে দেখবার চেষ্টা করেছিল। ওরা ওই দাদাকে এমন পিটাই করেছিল যে, হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করতে হয়েছিল। ইস লিয়ে...
সুন্দরলালের কথার মাঝখানে সাহেব হাতের ইশারায় আমাকে বলে- আমরা তো এখানে বসে আছি। আপকো মন চাহে তো, যাকে ঘুম সকতে। ইফ রিকোয়ার্ড, উইল অ্যাকম্পানি ইউ। যাইয়ে।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে, চুপ করে গিয়েছিলাম।

পাঁচ

এই মুহূর্তে আমার নিজেকে মনে হচ্ছে আমি আগ্রার এই বাদশাহী কেল্লার অন্দরমহলের একজন মেহমান। চাঁদের রূপালী আলোয় শাহী মহলের নিঝুম হয়ে থাকা লাল বেলেপাথরের রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলটা যেন সেই মুহূর্তে এক আলোকিত বর্তমান হয়ে উঠেছে! জোছনার কোন বর্ধমান।
শুভ্রতার মতই আমাদের নেশার মাত্রাটাও যেন একটু একটু করে বেড়ে চলেছিল। হারেমের ভেতরের ইট, কাঠ এবং কংক্রিট, মহলের দেয়ালের গায়ে আঁকা সব নকশা এবং ছবি সবকিছুই যেন হঠাৎ জীবন্ত হয়ে, আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসছে! অন্ধকার থেকে ক্রমশ আলোকিত হয়ে উঠছে! ভেতর থেকে কেমন যেন একটা স্মৃতিমাদুরতার আকর্ষণ উঠে এসে- আমাকে রীতিমতো খোঁচানো শুরু করেছে!
মনে করিয়ে দিচ্ছে অতীতের কোন এক সময় আমি এই মহলেরই কোন এক হাভেলি বা মঞ্জিলে কিছুকাল কাটিয়ে গেছি! কি জন্য একটা নাম ছিল আমার! কিন্তু বাদশাহী শাসনের কোপে পড়ে আমাকে প্রাণ হারাতে হয়েছিল!
হঠাৎ, দেখলাম প্রাসাদের ভেতরের রংমহলটা যেন আলোয় সেজে উঠল। ভেতরের এবং বাইরের রক্ষী এবং প্রহরীরা ব্যস্ত হয়ে উঠল। আমার ভেতরে কেমন যেন একটা অদ্ভুত ব্যস্ততা অনুভ‚ত হওয়া শুরু করল। বুঝলাম সম্রাট অন্দরমহলের মেহেফিলে আনন্দ উপভোগ করতে। সারারাত ধরে সুন্দরী নর্তকী আর বাইজির নাচ এবং গানের সাথে সুরার ফোয়ারা চলবে!
মনে পড়ছে- অতীতে এই রকম বিশেষ রাত্রে আমাকেও অন্দরমহলের অন্যান্য রক্ষী এবং প্রহরীদের মতো ব্যস্ত হয়ে উঠতে হত।
হঠাৎ কানে ভেসে এলো টকবক টকবক ঘোড়ার গাড়ির আওয়াজ! 
চোখ ফিরিয়ে দেখলাম কালো দুটো আরবি ঘোড়ায় টানা চারপাশে রঙিন ঝলমলে কাপড়ে ঢাকা ঘোড়ার গাড়ি এসে কেল্লার রাজ-প্রাসাদের অন্দরমহলে প্রবেশের রাস্তার প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়ালো। গেটের প্রহরীরা সব শশব্যস্ত হয়ে উঠলো। রক্ষিরা সব ছুটে এসে গাড়িটাকে  গোল করে ঘিরে দাঁড়ালো। হারেমের মহিলা দারোগা এবং রাজন্য বর্গরা ছুটে এলে স্বাগত জানাতে। পালকিবাহকরা পালকি নিয়ে এসে দাঁড়ালো।
অতীতের অব্যাহত আমিও আগন্তুককে স্বাগত জানাতে উঠে দাঁড়ালাম। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম ঐ দিকে। হাভেলির অলিন্দের মোটা ধনের আড়াল থেকে দেখলাম, সাদা ঝলমলে সিল্কের ঢিলেঢালা কুর্তা পাজামা পরা এক অপূর্ব সুন্দরী মহিলা, সারা অঙ্গে দামি মণিমুক্তা খচিত স্বর্ণালংকার, মাথায় হীরক শোভিত বাদশাহী মুকুট আর হাতের বুড়ো আঙুলে মুঘল ঘরানার আয়না আংটি। ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে, একবার এদিক ওদিকে তাকিয়ে কাসেম আলী বলে ডাক দিয়ে, পালকিতে উঠে ভেতরে চলে গেল। 
কাসেম আলী ডাকটা কানে যেতেই আমার কেন যেন মনে হলো, ওই মহিলা আমাকে কিছু নেবার জন্য ডাকলো। ভেতরটা কেমন যেন উঠাল পাতাল হওয়া শুরু করল।
আমি এগিয়ে গিয়ে ভেতরের ঢুকবার চেষ্টা করতেই রক্ষীরা আমায় আটকে দিয়ে বলল- আপ অন্দর নেহি যা সাকতে। বাদশা আভি হিয়া মাহফিল মানায়েঙ্গে।
মহিলাটির মুখের আদল টা আমার খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। আগে ওকে কোথাও যেন দেখেছি।


ছয়

ঢুকতে বাধা পেয়ে আমি বাধ্য হয়ে গেটের সামনে থেকে সরে আসলাম। রংমহল এর বাইরে দাঁড়িয়ে ওই মহিলাটির কথাই শুধু ভাবতে লাগলাম। ভাবনার ভিতরেই মনে হল- মহিলাটির নাম খুব সম্ভবত শরীফুন্নেসা বেগম কিম্বা নাদিরা বেগম!
তুরস্কের রাজা সম্রাট আকবরকে খুশি করার জন্য শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে একে আগ্রায় পাঠিয়েছিলেন।
সম্রাটাট আকবর খুশি মনে সেটা গ্রহণ করেছিলেন। ভালোবেসে সর্বসমক্ষে ওর নাম দিয়েছিলেন- আনারকলি। ও ও হয়ে উঠেছিল সম্রাটের অন্যতম প্রিয় রক্ষিতা। কিন্তু শাহজাদা সেলিমও ওকে ভালোবেসে ফেলেছিল। চেয়েছিল নিজের বেগম করে সংসার পাতবে। কিন্তু সেটা হতে পারেনি।
আকবর জান্নাত মহলেরই গোয়েন্দা মারফত ছেলের ওই প্রেমের খবরটা জানতে পেরে এতটাই কুপিত হয়েছিলেন যে, আনারকলিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। লাহোরের দুর্গে ওকে জ্যান্ত কবর দিয়ে মারা হয়েছিল। সেই শরীফুন্নেসা এখানে কেন এসেছে? কেন সে হত্যাকারী আকবরের সাথে আবার মেহেফিল মানাতে এসেছে? তবে কি, আনারকলি কে লাহোরের দুর্গে জ্যান্ত কবর দেওয়া টা একটা লোক দেখানো ব্যাপার! তার প্রিয় রক্ষিতা আনারকলিকে জাহাঙ্গীরের প্রেম থেকে থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার জন্য- এটা আকবরের একটা বানানো ইতিহাস! 
তবে কি এটা আনারকলির অশরীরী আত্মা! সুন্দরলালের ভাষায় আনসেটিসফাই আত্মা!
আমি যখন এইসব চিন্তায় ব্যস্ত তখনই আবার কানে ভেসে এলো ঘুঙুরের আওয়াজ, তবলার বোল এবং বাইজীর গানের কলি! সাইয়া, তু মেরি পাস আনা / মুঝে তুমহে জরুরাত হ্যায় / মুঝে তুমহে কুছ বাতানা...
তার মানে, ও আমাকে চিনতে পেরেছে! আমাকে ডাকছে! বলছে আমার সাথে ওর কথা আছে!
তাহলে, আমার ধারণাটাই ঠিক যে, একসময় আমি ছিলাম এই কেল্লার জান্নাত মহলেই সুন্দরী নর্তকী আনারকলির খোজা প্রহরী কাসেম আলী হয়ে। আমিই ওকে মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার পরে এই আগ্রা কেল্লা থেকে সুরঙ্গপথে নদীতে স্নান করতে যাওয়ার নাম করে- গোপনে লাহোরে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলাম। বলেছিলাম, আমি ওখানে গিয়ে ওর সাথে দেখা করব। কিন্তু সম্রাটের রোষানলে পড়ে আমাকে প্রাণ হারাতে হয়েছিল।
কাসেম আলী নামটা কানে যেতেই আমার সারা শরীরে একটা অদ্ভুত শিহরণ শুরু হয়েছে।
খুব সম্ভবত আনারকলি আত্মা আমাকে এখানে দেখতে পেয়ে এসে হাজির হয়েছে- কিছু গোপন কথা বলার জন্য।
মহলের ভেতরের আলো-আঁধারিতে গোটা ব্যাপারটা কেমন যেন একটা কুয়াশা ঢাকা অদ্ভুত ঘটনা বলে মনে হতে লাগলো। ঘুঙুরের আওয়াজ আর গানের ঝংকার ক্রমশই বাড়ছিল! মনে হচ্ছিল ঘটনাটা সত্যি। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। এগিয়ে গিয়ে বাইরের থেকে রংমহল’ এর জাফরী লাগানো জানালা দিয়ে উঁকি মেরে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। জাফরির বাইরে থেকে ঘরের ভেতরের কিছুই দেখা যায়না। সবটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন- আকবর, আনারকলি এবং সেলিমের ত্রিকোণ প্রেমের আখ্যানের মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন।
- দাঁড়াও আনারকলি!
আমি চিৎকার করে উঠতেই, পাশে বসে থাকা
সত্যজিৎ আর সুদীপ্ত আমাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলে বলে- কিরে! কি হলো? চিৎকার করে উঠলি কেন ওই ভাবে? নেশাটা তো দারুন চাগিয়েছে দেখছি? চল, আর এখানে বসে থাকতে হবে না। (সমাপ্ত)


শিল্প সাহিত্য ৮৯


টিন এজ লাভ
জাহিদুল মাসুদ

ওটা কে? রুবিনা না! হ্যাঁ, রুবিনাই তো।
কি আশ্চর্য! এই নির্জন মাঠে একাকী রুবিনা! মাঠের দক্ষিণ দিক থেকে নির্জন মেঠোপথ ধরে একাকি হেঁটে আসছে। ওর পিছনের পটভ‚মিতে এই নির্জন মাঠ, আরও পিছনে ধূ ধূ করছে রসূলপুর গ্রাম। পরনে সালোয়ার কামিজ, বাতাসে মৃদু উড়ছে ওড়না।

ইনছানের বুকের মধ্যে হৃদকম্পন শুরু হয়ে গেলো। গত তিন চার বছর ধরে সে রুবিনাকে তার মনের কথা বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই পারছে না। কখনো রুবিনাদের স্কুল মাঠে দেখা হয়ে গেলে বলার চেষ্টা করে, কখনো ওদের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে কোথাও যাবার সময় দেখা হয়ে গেলে বলার চেষ্টা করে। কিন্তু বলতে পারে না। কখনো ওর সাথে কেউ না কেউ থাকে। কখনো কেউ ওর সাথে না থাকলেও এতই হৃদকম্পন বেড়ে যায় যে ও কিছু বলতেই পারে না। তাই সে কখনো অন্য উপায় খোঁজে। কখনো ওকে লেখা চিঠি বুক পকেটে রাখে, সুযোগ পেলে ওর হস্তগত করবে বলে। কিন্তু সুযোগ কখনো এলেও সে সুযোগ সে কাজে লাগাতে পারে না। বাড়িতে এসে চিঠিটা লুকিয়ে রেখে দেয়। সকালে বের হওয়ার সময় আবার পকেটে ভরে। চিঠিটা আবার ফেরত আসে, কোনদিন কোন সুযোগ তেরী হয়না, কোনদিন সুযোগ তৈরী হলেও কাজে লাগাতে পারেনা। তবে কিছুদিন পরপর চিঠিটা নতুন হয়। নতুন ভাবনা এলে সে আবার নতুন একটা চিঠি লিখে আগেরটা পুড়িয়ে ফেলে। তারপর নতুন চিঠিটা সে বারবার পড়ে আর কল্পনা করে রুবিনা তার চিঠি পড়ছে। পড়তে পড়তে রুবিনার মন ও মুখমন্ডলে কেমন শিহরণ হচ্ছে-তা সে অনুভব করে। সেই অনুভব নিজের শরীর ও মনে মেখে নেয়। এভাবে দিন যায়, মাস ও বছর পার হয়, তার চিঠির সংখ্যা বাড়ে, চিঠির ভাষা পরিপক্ব হয়। লিখতে লিখতে কিছু কথা কবিতা হয়ে যায়। ইনছান কবি হয়ে ওঠে। কিন্তু রুবিনা এসবের কিছুই জানতে পারে না। হয়তোবা জানতে পারে। পারে কি? ইনছান যখন ওর সামনে দাঁড়ায়, নার্ভাস ফিল করে, চোখ তুলে ঠিকমতো তাকাতে পারেনা, কথা বলতে গিয়ে জবান আটকে যায়- কেন যায়? রুবিনা কি এসব বোঝে না? বোঝে হয়তো। কিন্তু ইনছানের মনের সাথে সে যোগাযোগ হয় না। আজ ইনছানের ভালোবাসার কথা বলার জন্য আবার একটা সুযোগ এসেছে,  সুবর্ণ সুযোগ। এই নির্জন মাঠের নির্জন মেঠোপথ ধরে প্রায় বিশ মিনিট সে পাশাপাশি হাঁটার সুযোগ পাবে। এর মধ্যেই তাকে কথাটা বলে ফেলতে হবে।

শেষ বিকেল। মাঝ মাঠ। চারদিকের গ্রামগুলো দুরে সরে গিয়ে ধূ ধূ করছে। কৃষকরা ইরি ধান আবাদ করার জন্য মাঠে নামতে শুরু করেছে। মটর পাম্প থেকে তারা পানি সেচ করে এই শুকনো মাটি ভিজাবে, পাওয়ার টিলার দিয়ে কাদা মাটি চাষ করে ধান রোপন করবে। রুবিনার বাবা হয়তো তাঁর মটর পাম্প নিয়ে মাঠে নেমে পানি সেচ করতে শুরু করেছে। রুবিনা হয়তো ওর বাবাকে রাতের খাবার দিতে গিয়েছিল। এই সময়টা কৃষকরা এত ব্যস্ত থাকে যে খাবার জন্য তারা বাড়ি যাওয়ার সময় পায় না।
ইনছানরা এখনো মাঠে নামেনি। তার বাবা তাকে জমি দেখতে পাঠিয়েছিল। দুই একদিনের মধ্যে তারাও আবাদ করার জন্য মাঠে নামবে।
মাঠের মাঝখান দিয়ে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা। রাস্তাটি গ্রাম থেকে নামতে নামতে মাঠের মধ্যে নেমে এসেছে। মাঠের মধ্যে নেমে রাস্তাটির উচ্চতা কমতে কমতে মাঠের জমির সাথে মিশে গেছে।
এই রাস্তা ধরে দক্ষিণ দিক থেকে হেঁটে আসছে রুবিনা। ইনছানদের জমির পূব ঘেঁষে এই রাস্তা। ইনছান তাদের জমির আল ধরে এমনভাবে হেঁটে রাস্তার দিকে আসছে যাতে তারা দুজন একসাথে মিলিত হয়।
হলোও তাই। ইনছান রুবিনার সাথী হলো। কাছাকাছি হতে ইনছানের হৃদকম্পন আরও বেড়ে গেলো। কিন্তু রুবিনার কি তাই হলো? রুবিনা নতমুখে হাঁটছে, যেন সে ইনছানকে চেনে না। কি সুন্দর মেয়ে রুবিনা! এত সুন্দর মেয়ে সে জীবনে দেখেনি। তার গায়ের রঙ ফর্সা, ছিপছিপে শরীর। নাকটা সরু, ফর্সা থুতনিতে একটি কালো তিল। এই তিলটাই রুবিনার সৌন্দর্য শতগুণে বৃদ্ধি করেছে।
ইনছান কাপা বুকে অন্য কথা বললো, ‘কোথায় গিয়েছিলে?’

রুবিনা নতমুখে বললো, ‘জমিতে’।
প্রশ্নটা করেই তার অস্বস্তি হলো। প্রশ্নটা করা কি অর্থহীন হয়ে গেলো! ও যে জমিতে গিয়েছিল এটাতো জানা কথা। সে বললো, ‘তোমাদের আবাদের কাজ শুরু হয়েছে? ' ইনছানের গলা কাঁপছে?
রুবিনা নতমুখে বললো, ‘হ্যাঁ’। 
‘তোমার বাবাকে খাবার দিতে গিয়েছিলে?' রুবিনা বললো, ‘হ্যাঁ’। রুবিনার স্বরও খুব নিচু। ওর বুকের মধ্যেও কি ইনছানের মতো হৃদকম্পন হচ্ছে?  কি জানি, ইনছান বুঝতে পারছে না। আর কিছু বলার মতো কথাও সে খুঁজে পাচ্ছে না। কেবল নিরবে পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। মাঠ জুড়ে হিমেল হাওয়া বইছে। ইনছানের বুকের মধ্যে মাত্র একটি বাক্য ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘রুবিনা, আমি তোমাকে ভালবাসি।’ বাক্যটা বুক থেকে গলা পর্যন্ত উঠে আসছে; কিন্তু মুখ থেকে কথাটি বের হচ্ছে না। সে বারবার চেষ্টা করছে। এইতো, কথাটা সে বলে ফেললো প্রায়, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি রুবিনা।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর কথাটা গলা বেয়ে বের হচ্ছে না। আজ তার পকেটে কোন চিঠিও নেই। ইস! তার পকেটে প্রায় প্রতিদিন চিঠি থাকে। কিন্তু আজ কেন যে সে চিঠিটা পকেটে তুললো না! বড়ই আফসোসের কথা। আজ সে চিঠিটা অনায়াসেই দিতে পারতো। আর শেষ চিঠিটার ভাষা বেশ পরিপক্ক আর কাব্যিক হয়েছিল। এই চিঠিটা পড়লে রুবিনা ইনছানের কাব্যিক মনের সন্ধানও পেত। কিন্তু তা আর হলো না। আফসোস! দুটি মানুষ এভাবে নির্বাক হাঁটাও অস্বস্তিকর। কেবল এই মাঠ, শেষ বিকেলের হিমেল হাওয়া অনেক কথাই বলছে যেন। রুবিনা যেন এই হিমেল হাওয়া হয়ে সারা মাঠে ছড়িয়ে পড়েছে ।

সামনে একটি পুকুর। মাঠের মাঝখানের এই পুকুরটার ইতিহাস ইনছান জানে না। সে ছোটবেলা থেকেই  দেখে আসছে। পুকুরের চারপাশে কয়েকটা তালগাছ, ঝোপঝাড়। বর্ষা কালে যখন সারামাঠ পানিতে ডুবে যায় তখন তাদের বাড়ি থেকে এই তালগাছ দেখা যায়। পুকুর পাড়ের ধার দিয়ে রাস্তা। এই নির্জন রাস্তায় উঠেও ইনছান কথাটি বলতে চায় কিন্তু পারে না। এভাবে হাঁটতেও তার অস্বস্তি লাগছে। নিজের শরীরটাকে যেন খাপছাড়া কিছু মনে হচ্ছে। কিছু না বলে এভাবে হাঁটার কোন মানে হয়? ওর পিছনে পড়াটাও বিব্রতকর। এই পৌষ মাসেও যেন ঘামছে ইনছান। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

পুকুরটাকে তারা পিছনে ফেললো। সামনে তাদের গ্রামটা এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বিকেলটাও শেষ হয়ে এসেছে। চরাচরে সন্ধ্যার অন্ধকার ঝিরঝির করে ঝরে পড়ছে।
গ্রামটা শুরু হয়েছে যে বাড়ি দিয়ে সে বাড়ির সামনে একটি খড়ের পালা। বর্ষার পানির সাথে লড়াই করে টিকে আছে এই পালাটা। এই পর্যন্ত এসে কিছু বলতে না পারার উত্তেজনায় ইনছানের মনের চাপ প্রচন্ড বেড়ে গেলো। সে কোন মতো বলে ফেললো, ‘শোন’।
রুবিনা দাঁড়িয়ে গেলো, ‘কিছু বলবেন?’
রুবিনার বলা এই শব্দ দুটি তার হৃদকম্পন আরও বাড়িয়ে দিল। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে ইনছান; কিছু বলতে পারছে না।
রুবিনা এই প্রথম চোখ তুলে ইনছানের দিকে তাকালো। সন্ধ্যার নরম আলোয় রুবিনার সুন্দর মুখটা দেখা যাচ্ছে। আহা! কি সুন্দর মুখটা রুবিনার! সে মুখে আবার হাসি। বুকটা ভরে গেল ইনছানের। রুবিনা মৃদু হেসে চোখ নামালো। ইনছান হঠাৎ বলে ফেললো, ‘হাসছো যে!’
রুবিনা মৃদু হেসে বললো, ‘আপনার অবস্থা দেখে হাসছি। একটি কথা বলার জন্য সারা মাঠ হেঁটে হেঁটে চেষ্টা করলেন; তবু কথাটি বলতে পারলেন না। ‘রুবিনার এই মৃদু হাসি থেকে কি মিষ্টি তাচ্ছিল্য ঝরে পড়ছে?
ইনছান এবার বলতে পারলো, ‘আমি যে তোমাকে একটি কথা বলতে চাই, তা তুমি কি করে বুঝলে?’
‘মেয়েরা এসব কথা বুঝতে পারে।’
ইনছান উত্তেজিত, ‘তাই নাকি! আমি কি বলতে চাই, তুমি তা জানো?’
রুবিনা কেবল মৃদু হাসলো, কিছু বললো না।
‘আচ্ছা, বলোতো দেখি, আমি কি বলতে চাই?'
রুবিনা আবার চোখ তুলে তাকালো,‘আপনার কথা আমি কেন বলবো? আপনার কথা আপনাকেই বলতে হবে।’
রুবিনার মুখে সন্ধ্যার আলো আধারী। কিন্তু সে আধার থেকেও ওর চোখ দুটো জ্বলছে, ভালোবাসার আলোয়।


শিল্প সাহিত্য ৮৬


বাবা
আপন রহমান

আজ দুইদিন যাবত বাবা কিছুই খাচ্ছেন না। কোন কথাও বলছেন না। বিছানায় শুয়ে শুধুই কাতরাচ্ছেন।
- বাবা গো, মাগো মরে গেলাম’।

মরে গেলাম শব্দটা শুনলেই কেমন যেন একটা ধাক্কা লাগে চয়নের মনে। কেননা বাবা ছাড়া যে এ পৃথিবীতে তার আপন বলতে আর কেউ নেই। সেই বাবা যদি মারা যায়, তবে সে কার কাছে থাকবে। দু:খ-সুখে কার বুকে মাথা রাখবে? বাবা ছাড়াও অবশ্য আপন বলতে তার আরও একজন আছে। তবে তাকে ঠিক আপন ভাবতে ঘৃণা হয় চয়নের। তার কথা মনে পড়লে ক্ষোভে ঘৃণায় তার মুখ দিয়ে থু-থু বেরিয়ে আসে। সে আর কেউ নয়, চয়নের মা।

সে অনেক ঘটনা ...

চয়নের বাবার এক সময় অনেক টাকা-কড়ি ছিল। পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান সবই ছিল। ছিল পাটের বড় কারবার। আর ছিল পয়সার মত সাদা একটি হৃদয়। বিপদে-আপদে অভাবে-অনটনে সব সময় সে মানুষের পাশে দাড়াতেন তিনি।
সেদিন আড়ৎ থেকে সাইকেলে করে বাড়ী ফিরছিলেন তমাল মিয়া অর্থাৎ চয়নের বাবা। হঠাৎ রাস্তার পার্শ্ববর্তী একটি বাগানে একটি মেয়ের গোঙানীর আওয়াজ শুনতে পেলেন। সাইকেল ফেলে তিনি ছুটে গেলেন বাগানে দেখলেন, একটি মেয়ে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। অনেক কষ্টে সে মেয়েটিকে রক্ষা করে এবং মেয়েটির কাছে জানতে চায় তার আত্মহুতির কারণ। জবাবে মেয়েটি তাকে জানায়-
“আমি অনেক গরীব ঘরের একটি মেয়ে। অনেক কষ্টে এবার এস.এস.সি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছি, তা প্রায় নয় মাস হল। কলেজে রফিক নামের একটি ছেলের সঙ্গে আমার খুব গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রফিক আমাকে নানাভাবে প্রলোভীত করতে থাকে এবং আমার সঙ্গে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে। প্রথম দিকে আমি নানা অজুহাতে তার কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করি। কিন্তু একসময় কিভাবে যেন নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি এবং তার লালসার শিকার হই। এভাবে চলতে থাকে বেশ কিছুদিন। এক সময় আমি অন্তসত্ত¡া হয়ে পড়ি। আমি বুঝতে পারি না আমি কী করব। চারপাশের পৃথিবীকে কেমন যেন অন্ধকার মনে হতে থাকে। লজ্জায় কাউকে কিছুই বলতে পারছিনা। এমনকি রফিককেও না। এভাবে কেটে যায় দুই-দুই মাস। আমি একদিন রফিককে সব খুলে বলি। ও আমাকে তখন বলে এটা নিয়ে কোন চিন্তা করো না। এবং কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। আমরা খুব শীঘ্রই বিয়ে করবো। এভাবে আরো ৩ মাস কেটে যায়। হঠাৎ করে আমাকে কিছু না বলে গতকাল রফিক বিদেশ চলে গেছে। এখন আপনিই বলুন আত্মহত্যা ছাড়া আমার আর কোন পথ কি খোলা আছে?

জবাবে তমাল মিয়া বলে, হ্যাঁ, আছে।
- কি সেই পথ!
- আমি তোমাকে বিবাহ করবো। তুমি আমাকে তোমার বাবা মায়ের কাছে নিয়ে চলো।

এভাবেই তমাল মিয়া তাকে বিবাহ করেন। কিছুদিনের মধ্যে ঘর আলোকিত করে চয়নের জন্ম হয়। কিন্তু কিভাবে যেন গ্রামে এই ঘটনা জানাজানি হয়ে পড়ে। কথায় বলে “সত্য কখনও চাপা থাকে না, সত্য তার নিজ যোগ্যতায় প্রকাশ হয়ে পড়ে”। কত লোকে কত কিছু বলে।  কিন্তু তমাল মিয়া কারও কথায় কান দেয় না। তিনি আদর-স্নেহে নিজের সন্তানের মত চয়নকে লালন-পালন করতে থাকে। সেই চয়ন এখন ৮ বছরের বালক।

বেশ কিছুদিন হল গ্রামে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেছে। সকাল-সন্ধ্যা লোক মুখে আলোচিত হচ্ছে ঘটনাটি। সবাই আফসোসের সঙ্গে বলছে আহ্ তমাল মিয়ার মত একটা ভাল মানুষের  সাথে এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতা টা কিভাবে করল সে। শালী একটা আস্ত নিমুক হারামী! হ্যাঁ, এই নিমুক হারামীটা আর কেউ না, চয়নের মা। যাকে তমাল মিয়া বিশ্বাস করে ভালবেসে নিজের সর্বস্ব তুলে দিয়েছিল যার হাতে সেই। নতুন ব্যবসায় হাত দেবে বলে সেদিন তমাল মিয়া তার পুরানো ব্যবসার সমস্ত মূলধন আড়ৎ থেকে বাড়ি এনেছিল। কিন্তু কোন এক ফাঁকে চয়নের মা সমস্ত টাকা নিয়ে নিরুদ্দেশ! কিছু দিন পর অবশ্য বিষয়টা সকলের কাছে পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল। রফিক দেশে ফিরে ঢাকায় নতুন বাড়ি করেছে। সে তমাল মিয়ার সর্বস্ব নিয়ে রফিকের কাছে চলে গেছে। নিষ্ঠুর পৃথিবীতে হয়তো এটাই তমাল মিয়ার উপকারের প্রতিদান। মা চলে গেলেও চয়ন কিন্তু একদিনও মায়ের জন্য কাঁদেনি। বরং তার নাম শুনলে সে প্রচন্ড রকম রেগে যায়। কেননা নিষ্ঠুর পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা বোঝার মত যথেষ্ট বয়স তার হয়েছে। তার যত চিন্তা বাবাকে নিয়ে। সে এখন বুঝতে শিখছে এবং বোঝে। তমাল মিয়া তার আপন বাবা নয়। গ্রামের নানান মানুষের নানান আলোচনায় সে এখন প্রায় সব ঘটনায় জেনে গেছে। তবুও জন্মের পর যাকে সে বাবা হিসেবে জেনে এসেছে। যে তাকে আপন বাবার চেয়ে অনেক বেশি স্নেহ-মমতায় মানুষ করেছে। তার জন্য শরীরের শেষ রক্ত বিন্দু দিতেও প্রস্তুত সে। যেদিন সর্বস্ব নিয়ে রাক্ষসীটা চলে গিয়ে ছিল।
তার কিছুদিন পর থেকে তমাল মিয়া বিছানা ধরা ডাক্তার কবিরাজ অনেক দেখানো হলে, কিন্তু কোন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। শহরে নেওয়ার মত যথেষ্ট টাকা তার অবশিষ্ট নেই। শুকোতে-শুকোতে শরীরটা হাড্ডিসার হয়ে গেছে তার। তারমধ্যে আজ দুদিন খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুই খাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরপর -মরে গেলাম, মরে গেলাম বলে চিৎকার করছে। গ্রামের লোকজন পাড়া-প্রতিবেশী প্রথম দু-একদিন তাকে দেখতে এসেছিল। কিন্তু এখন আর কেউ ফিরেও তাকায় না। যে যার কাজে ব্যস্ত । অথচ; বিপদে-আপদে এই লোকটাই এক সময় সকলের আগে ছুটে যেত তাদের পাশে। আজ তার পাশে সেই কুড়িয়ে পাওয়া ধন-চয়ন ছাড়া কেউ নেই।

তখন দিনের সূর্যটা প্রায় ডুবু-ডুবু করেছে। তমাল মিয়া চিৎকার করে ডাকছে।
- চয়ন; বাবা চয়ন-তুই কোথায়?
- আমি এখানে বাবা; ভাত রাধছি।
- ভাত আর রাধা লাগবে না, বাবা; তুই-তুই একটু আমার পাশে আয়।
- আমি আসছি বাবা...

চয়ন দৌঁড়ে বাবার কাছে আসে। বাবার মুখে হাত দিয়ে বলে,
-বাবা, ও বাবা; কি হয়েছে? ডাকছো কেন?

তার বাবার মুখ থেকে আর কোন কথা বের হয় না। সমস্ত শরীর নিথর হয়ে গেছে। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন তমাল মিয়া। তিনি আর কোন দিন ডাক শুনবেন না। ছোট্ট বালক চয়ন সেটা বুঝতে পারে না। সে ডেকেই যায়, বাবা ও বাবা; কথা বলছো না কেন? বাবা-বাবা ...


শিল্প সাহিত্য ৮৫


‘গন্ধ’
শুভা গাঙ্গুলি

এই বিশ্বভুবনের প্রতিটি মানুষ এই দুনিয়াকে চিনতে বুঝতে আর পরিচিত হতে যে কয়েকটি ইন্দ্রিয়র সাহায্য নেয় তার মধ্যে চোখ কান নাক আর স্পর্শ মানে ‘touch’ টাই বেশি কার্যকরী,

এই অবধি বলে সিদ্ধার্থ ওর বান্ধবী পল্লবী ওরফে পলির দিকে তাকিয়ে দেখলে সে ব্যাগ থেকে একটা সেন্টের শিশি বার করে নিজের গায়ে স্প্রে করছে। তা দেখে সিদ্ধার্থ যাতে আপনারা আগেই চেনেন একজন বিচক্ষণ বুদ্ধিমান আর শিক্ষিত ডিটেকটিভ মানে টিকটিকি, আর পল্লবী ওর ক্লাসমেট থেকে সহকারী কিন্তু ঘরণী নয়, যদিও বাড়ীর সবাই ওকে একদিন ঘরণী হবে বলেই জানে, পল্লবী নিজেও তাই মনে করে, কিন্তু সিড সেটা মোটেই বলে না। যেহেতু পলি একজন ইন্টেলিজেন্ট ইঞ্জিনীয়র আর ব্ল্যাক বেল্ট আছে তাই পলিকে ও টীমে রেখেছে, মাত্র।

ওর সেন্ট মাথা দেখে সিড বললে- তুই এটা মাখলি কেন? কথা শুনছিস না তাহলে? মানে কেসটায় তোর কোনো আগ্রহ নেই?
-কথা তো শুনলাম আসলে তোর বক বক শুনতে শুনতে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো তাই একটু গন্ধ মাখলাম, এখন বেশ লাগছে রিলীভ্ড।
-আচ্ছা তুই কি শুনেছিস,
“শুনেছো কি বলে গেলো সতীনাথ বন্দ্যো,
আকাশের গায়ে নাকি টকটক গন্ধ

সুকুমার রায়?
.............
সেই রকম আর কি, তোর গায়ে গন্ধ তাই।
আসলে এটা কি বলতো সিড,
একে বলে ‘অ্যারোমা থেরাপী’
যেমন পুজোর ঘরে ধূপ ধুনোর গন্ধ আমাদের টেনশন দূর করে, আমরা কিছুক্ষণের জন্য worry anxiety থেকে মুক্ত হই,
পুজো করার অর্থ concentration  of mind in presence of essential oil
কিছু বুঝলি সিড?”

সিড বললে “তুই কি এটা জানিস পৃথিবীর যত রকম বিখ্যাত এবং বহুমূল্য essence আছে, প্রায় সবই মানে আক্ষরিক ভাবে সবই জীব জন্তুর মল মূত্র আর বমি দিয়ে তৈরী? আর এটা জানিস আজ ও কিছু কিছু প্রাণী endangered শুধুমাত্র cosmetic Industry’র চরম লালসার জন্য এই লকডাউনেও কিছু পোচার ভীষণ ভাবে চরম অত্যাচার করে চলেছে নীরিহ প্রাণীদের ওপর। এই ধর সঁংশফববৎ এদের তো চরম অবস্থা, হিমালয়ের বা হিমশীতল এলাকার ছোটো ছোটো সাইজের এই white bellied musk deer বা কস্তুরীমৃগদের মধ্যে একমাত্র পুরুষরাই এই স্বর্গীয় সুগন্ধ সৃষ্টি করতে সক্ষম, এদের জননেন্দ্রিয়তে ছোটো নারকেলের মতো একটা growth যেটার ভিতরে semi liquid type থাকে। কিছু chemicals থাকে যেটা তারা মেয়ে হরিণের মনোহরণ করার জন্য তৈরী করে, আর এই অপূর্ব সুন্দর কস্তুরী কে সুগন্ধি আতর বা expensive essence তৈরীর বেস হিসাবে ব্যবহার করা হয়।”

-সিড, আমিও কিছু জানি রে টিকটিকি,
-এই যে বন বেড়াল বা খটাশ আমরা গাঁয়ে গঞ্জে দেখি এরাও ছিু কম নয় রে, এদের গন্ধ গোকুল বলে, কারণ ওই একই গন্ধছড়ায় এরা যখনই দরকার বোঝে, tropical rain forest এর অধিবাসী এরাও কিন্তু নীরিহ প্রাণী, কখনও চট করে আক্রমণ করে না মানুষকে। এদের ও জননেন্দ্রিয়তে musk তৈরী হয় পুরুষ এবং মেয়ে  দুরকম বন বেড়ালের শরীরে।
এদের  glands অথবা analglands এ এই chemicals তৈরী হয় , খুব pungent গন্ধ বের হয় কিন্তু তারপর এটাকে শোধন করার পর অসম্ভব উঁচুমানের কসমেটিক তৈরী করা সম্ভব হয়। বুঝলি টিকটিকি? আর একটা কথা এরাও কিন্তু এই কারণেই দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। সুন্দর গন্ধ এদের দূর্ভাগ্য।

একটু থেমে আবার বলে, “কোন বন জঙ্গলের পাশ দিয়ে রাতের বেলা যেতে যেতে ,তুই যদি হঠাৎ পোলাও রাঁধার গন্ধ পাস,তুই তোর ডিটেকটিভ কাজের জন্য নিশ্চয়ই বনে বাদাড়ে ঘুরিস, তখন এটা ভাবিস নি যেন  জঙ্গলে অন্ধকারে ভুতের  বিয়ে হচ্ছে,
জানবি কাছেই কিছু গন্ধগোকুল ঘোরাফের করছে।”
-একটু কফি খাওয়াবি সিড?
-কফি খাবি? আচ্ছা ভালো কথা মনে করে দিয়েছিস, আগের যে কেসটা মানে খুনের  সটা solve করেছিলাম না সেই পার্টি টা হেবিয়াস বড়লোক ছিলো খুব খুব দামী কফি এনেছিলো গিফ্ট হিসাবে। তুই তো জানিস আমি গিফ্ট নিই না, তাই মা’কে জোর করে গছিয়ে দিয়ে গেছে, যা তো খেয়ে ফিদা হয়ে গেছিলো, তারপর দোকানে দিয়ে দর করে অজ্ঞান, রলে আমরা কি আর এসব খেতে পারি?”
-তাই, দেখি কেমন?
-দেখ

“কি দারুণ গন্ধ রে, কি ডিভাইন টেস্ট রে?”

তাহলে তোকে এর ব্যাকগ্রাউন্ডটা ক্লীয়ার করি, একে বলে Luwak Coffee  অথবা poo coffee
দুর্মূল্য এই কফি তৈরী হয় আগে civet বা গন্ধগোকুলকে পাকা পাকা কফির বীজ খাওয়ানো হয় তারপর তার পেটে এই বীজ ফারমেন্টেশন হয়, তারপর মলের সাথে বীজ বের হয়ে আসে তাই দিয়ে এই স্বর্গীয় কফি তৈরী হয়”

“ওয়াক। ওয়াক। থুঃ থুঃ”
যা বেসিনে বমি করে আয়।”

দাঁড়া। আরও কিছু। জ্ঞান দিই তোকে , জীব জন্তুদের জীবন শেষ করে তাদের স্পেশিসদের চিরতরে পৃথিবী থেকে বিদায় করে
আমরা আমাদের ড্রেসিং টেবিল সাজাই,
অবশ্য এখন সরকার সব বন্ধ করে দিলেও গন্ডার তার একমাত্র অস্ত্র শৃঙ্গের জন্য
মাসিক ডীয়ার তার মাস্কের জন্য
আর স্পার্ম হোয়েল তার excretion এর জন্য, এই যে লিপস্টিক না লিপগ্লস কি যেন মিনিটে তিনবার পকেট মিরর বার করে লাগাল সেটাও আসে মানে এই যে ঘর ভরে গেলো ভুর ভুর গন্ধে সেটাও আসে তিমি মাছের পেট কেটে
আবার তাদের poo যদি দলে ভাসে তো তাকে বলা হয়
Floating Gold.
এরা জানে না এই সব প্রাণীদের কোনো ধারণাই নেই তারা পৃথিবীর
শ্রেষ্ঠ সুগন্ধির বাহক।”

“দেখ সিড রবী ঠাকুরের সেই কবিতাটা মনে পড়ে তোর

“একদা প্রাতে কুঞ্জতলে অন্ধ বালিকা
পত্রপুটে আনিয়া দিলো
পুষ্পমালিকা

কণ্ঠে পরি অশ্রুজল ভরিলো নয়নে

কহিনু তারে অন্ধকারে দাঁড়ায়ে রমণী
কি ধন তুমি করিলে দান না জানো আপনি।”

এই প্রাণীরও তাই।


শিল্প সাহিত্য ৮১


এই সময়
জাহাঙ্গীর ডালিম

রোদটা বেশ হেলে পড়েছে। গামছাটা দিয়ে ভালো করে কপালের ঘামটা মুছে নিলো চৈত্র মাস অথচ আকাশে ছিটে ফোটা মেঘও নেই। এই রিকশা যাবেন? রিন রিনে কণ্ঠে শুনে ফিরে তাকাল ফেলু মিয়া। দুটি মেয়ে একজন সাদা সালোয়ার কামিজ পরা,  অন্যজন নীল, কই যাইবেন? নতুন বাজার। দূর - দূরান্ত রেস্তোরা উঠেন।
কত দিব? 
দিয়েন, সব সময় যা দেন।
পনেরো টাকা দিব।
কম হইয়া যায় গো মা। জ্যাম ঠেইলা যাওন লাগবো। পঁচিশ টাকা দিয়েন। কিসের পঁচিশ টাকা। পনেরো টাকা দিয়ে রেগুলার যাই। না, যামুনা।
মেয়ে দুটো এগিয়ে গেল। ফেলু মিয়া শরীরটা ভালো না। গা- টাও কেমন যেন ম্যাজ ম্যাজ করছে।
বাড়িতে ছোট মেয়েটার জ্বর। ঔষুধ নিতে হবে, না হলে আজ আর বের হতো না সে। মেয়ে গুলো মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিকশা নেই নীল জামা ব্যস্ত ভাবে ঘরি দেখছে।
ফেলু মিয়া এগিয়ে গেল-
উঠেন বিশ টাকা দিয়েন,
মেয়ে দু’টো চোখা চুখি করল। তারপর উঠে বসল।
ফেলু মিয়া প্যান্ডেল মারতে শুরু করল। শরীর আর আগের মতো
জোর নেই বয়স এখন পঞ্চাশ। রোগ - শোক শরীরে ঘর বাঁধবে, এটাই স্বাভাবিক। রিকশায় ডান পাশ থেকে একজন বলল, দূরে!  শোন, এত এক্সাইটেড হয়ে পড়িস না। আগে দ্যাখ ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়। ভালো কথা, তুই তাকে চিনবি কি করে? রাশেদ তো বলেছে নীল শার্ট পরপ আসবে। আচ্ছা! এই জন্য তুই ও নীল জামা পরেছিস। শোন, ফাজলামে করবি না।
কি জানি করে ছেলেটা? 
কতবার বলব তোকে, ব্যাংকে চাকরি করে।
থাকেতো গাজিপুরে তাই না? 
হু।
গ্রামের বাড়ি কই রে? 
আশ্চর্য। গ্রামের বাড়ি কোথায়, আমি কি করে বলবো? 
ছয় মাস মোবাইলে প্রেম করলি। কথা বলতে বলতে রাতের পর রাত পার করে দিলি, অথচ তার সম্পর্কে কিছুই জানিস না। কিছুক্ষণ দু’জনই চুপচাপ।
ফেলু মিয়া খুব ক্লান্ত লাগছিল।
ছোট মেয়েটার জ্বর।
দুশ্চিন্তা ও হচ্ছিল।
তুই কি ছেলেটার সংগে পাকা পাকি রিলেশন করবি।
যদি সে রকম ছেলে হয়। আর আকাশে কি হবে? 
ধেৎ! ওটা তো ছিল টাইম পাশ। রিকশা মাঝে মধ্যে জ্যামে পড়ছে, আবার চলছে। এই ছোট্ট শহরেও জ্যাম লাগে।
চাচা, বায়ে একটু রাখেন।
ফেলু মিয়া থামল। সাদা জামা নেমে পড়লো।
যাইরে।
এই দীপা ... শোন। তুই প্লিজ আমার সঙ্গে আয় না।
মাথা খারাপ। আমার টিউশনি আছে না।
তুই যা। কী সমস্যা? 
আরে বাবা, যা না।
আচ্ছা ... বাই।
বাই
ফেলু মিয়া আবার চলতে শুরু করল। পেছনে খুব সুন্দর একটা রিংটোন বেজে উঠল। মেয়েটা ফের সময় নিয়ে ফোন ধরল।
হ্যালো ... আমি। আমি তো রাস্তায় ... ঝর্নাদের বাসায় যাচ্ছি ... একটা নেট আনতে হবে। আজ কি করে দেখা করব... আজ পারব না ... খুব বিজি ... না ... না ... তো ...  কালকে মাস্ট দেখা করবো ...  হ্যাঁ ঠিক আছে ... আচ্ছা ... রাখি ... বাই
রেস্তোরা এসে গেছে। বেশ সাইড করে রিকশাটা দাড় করাল ফেলু মিয়া। ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে নীল জামা ঢুকে গেল ভিতরে। ফেলু মিয়া বেশ খিদে পেয়েছে। ফুটপাতের ছোট চায়ের দোকানটায় ঢুকল সে।
কী খাবে ভাবছে। চায়ের সঙ্গে কী খাওয়া যায়? বিস্কুট নাকি পাঊরুটি। দুই ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। ফেলু মিয়া সেই রেস্তোরার সামনেই আছে। জ্বর জ্বর লাগছে, মন মতো পেসেঞ্জার ও পায়নি। রেস্তোরার কাঁচে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এক নীল জামার সঙ্গে নীল শার্ট পরা একটা ছেলে, ছেলেটা  মেয়েটাকে একটা রিকশা করে দিল। মেয়েটা চলে ও গেল। নীল শার্ট এদিক ওদিক তাকাল। একটা সিগারেট ধরাল। একটু হাটা হাটি করল। তারপর এগিয়ে এল ফেলু মিয়ার দিকে।
এই বাসস্ট্যান্ড কত? 
তিরিশ টাকা।
ছেলেটা দিরুক্তি না করে উঠে বসল। ফেলু মিয়া খুব কষ্ট হচ্ছে। সে প্যান্ডেল মারতে থাকল। ছেলেটার ফোন এসেছে।
হ্যালো ...  আমি ও ... কই তুই?  ছেলেটা কার সঙ্গে  যেন ফোনে কথা বলছে।
হু ... দেখা হয়েছে...  আরে না ... মোটামুটি ...  নীরার সামনে দাড়াতে পারবে না। না ... না... আর ধেৎ!
প্রশ্নই আসে না ... 
আমি আজই আসছি ... এই অমিত... তুই যেমন লোক, রিতু ফোন দিচ্ছে ... আচ্ছা ... হ্যাঁ ...
রাখি।
হ্যাঁ ... রিতু ... কেমন আছ তুমি? আমি তো অফিস থেকে বের হলাম ...  বাসায় যাচ্ছি ... তোমার জন্য।
ফেলু মিয়া কেমন হাপিয়ে গেছে। জ্বরটা বোধ হয় বেড়েছে। ধীর পায়ে সে প্যান্ডেল মারতে থাকে।  রাস্তার দৈর্ঘ্য কি বেড়ে যাচ্ছে ...


শিল্প সাহিত্য ৭৭/৭৮


ধারাবাহিক গল্প
সে রাতে কেউ ছিলনা
আপন রহমান

তখন প্রায় ভর দুপুর। বিরামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোপীনাথ বাবু একাকি অফিস কক্ষে বসে কী যেন ভাবছেন। সম্ভবত অন্য শিক্ষকেরা যার যার ক্লাসে চলে গেছেন। আমি ওনার রুমের সামনে দিয়ে একবার এদিকে একবার ওদিকে পায়চারী করছি। ভিতরে ঢুকতে কিছুটা সঙ্কোচ হচ্ছে। কেননা; না খেয়ে না নেয়ে, অনাদরে অবহেলায় চেহরার যে শ্রী হয়েছে তা একটা জাত পাগলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। পাছে পাগল ভেবে আমাকে আবার তাড়া না করেন। কিন্তু আমাকে তো ঢুকতেই হবে। তা না হলে ...। অনেক ভেবে চিন্তে অবশেষে পা বাড়ালাম রুমের ভিতর। স্যার আসবো ? -আসবো মানে; এসেই তো পড়েছেন। এসে পড়িনি স্যার এসে দাঁড়িয়েছি। -আচ্ছা ঠিক আছে এবার বসুন। কোথায় বসবো স্যার, চেয়ারে নাকি মাটিতে ? চেয়ারেই বসুন। ধন্যবাদ স্যার, তাহলে বসলাম। -এবার বলুন আপনার জন্য কী করতে পারি? -আমার জন্য তেমন কিছু করতে হবে না স্যার, আসলে আমি এখানে এসেছি আপনার কাছ থেকে কিছু তথ্য জানতে। দয়া করে সেটুকু জানালে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। -আচ্ছা বলুন, কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি? অবশ্য আমার হাতে বেশি সময় নেই ক্লাসে যেতে হবে। যা বলার দ্রুত বলুন। বলছিলাম স্যার, আপনি ইরা নামে কাউকে চেনেন? -ইরা! বিস্মিত চোখে গোপীনাথ বাবু তাকালেন আমার দিকে। তারপর নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বল্লেন হ্যাঁ চিনি-চিনিতো। তবে এত বছর পর আবার সেই পুরনো কাসুন্দি ঘেটতে এসেছেন কেন? বিস্ময়ের সঙ্গে আমি জানতে চাইলাম। -পুরনো কাসুন্দী মানে? চশমাটা মুচতে মুচতে গোপীনাথ বাবু বল্লেন না-না-কিছু না। বলুন আপনি কী জানতে চাচ্ছিলেন। আমি বুঝতে পারলাম গোপীনাথ বাবু কী যেন একটা লুকাচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন করতে সাহস পেলাম না। ওনাকে দেখেই বোঝা যায় উনি কিছুটা রাশ ভারি লোক, পাছে আমার আসল উদ্দেশ্য মাটি হয়ে যায় সেই ভয়ে। আমি বলতে শুরু করলাম। আমার বয়স তখন ২২ বছর। ঢাকার চারুকলায় সবে ভর্তি হয়েছি। ভর্তির কিছুদিন পর ক্যাম্পাসে ইরা নামের এক অপরূপ সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। চমৎকার বন্ধুত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি হয় দু’জনের মধ্যে। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম, প্রেম থেকে বিয়ে। কিন্তু বিয়ের রাতে ঘটল এক অদ্ভুত  ঘটনা। যে ঘটনার কথা চিন্তা করলে, আজও আমার সমস্ত শরীর পাথর হয়ে যায়। বিয়ে করে আমরা উঠেছিলাম আমাদের এক বন্ধুর বাড়িতে। বাড়িটি ছিল একেবারে নির্জন। বন্ধুর বাবা, মা বিদেশ থাকেন। ও থাকে বারিধারায় ওর খালার বাড়িতে। বাড়িটি দেখা-শোনা করে কেয়ার টেকার রহিম খাঁ। রহিম খাঁ ও এক রহস্যময় ব্যক্তি বয়স পঁচাত্তরের কাছাকাছি হলেও বেশ শক্ত সামর্থ্য। খান্দানী গোঁপ, লাল টকটকে গোলাকার দুটো চোখ। কী এক গভীর রহস্যময় তার চাহনি। কিন্তু লোকটা নাকি বোবা কথা বলতে পারে না। কোথা থেকে এসেছে কী পরিচয় কেউ জানে না। একাত্তর সালের এক রাতে নাকি লোকটা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসে ওদের বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিল তখন বন্ধুর বাবা মা দেশেই ছিল। যুদ্ধের পর যখন ওনারা বিদেশ চলে গেলেন। তখন ওকে বলে গেলেন। ‘লোকটা খুব ভালো ওকে কখনও তাড়িয়ে দিস না।’ সেই থেকে আজ অবধি উনি ও বাড়িতে থাকেন। রহিম খাঁ সম্পর্কে এ তথ্য টুকু বন্ধুটি একদিন আমায় বলেছিল। কিন্তু যেদিন ও বাড়িতে উঠলাম সেদিন ঘটল অদ্ভুত সেই ঘটনা। তখন রাত সাড়ে দশটা আমি ইরা, আর নীরব (আমার বন্ধু) আমরা গেট পর্যন্ত সবে পৌঁছেছি। হঠাৎ নীরবের ফোন বেজে উঠল। অপার প্রান্ত থেকে কে যেন বল্ল তার খালা ভীষণ অসুস্থ। নীরব কোন রকম আমাদেরকে লোকটার হাতে তুলে দিয়ে ছুটতে ছুটতে চলে গেল। লোকটা আমাদেরকে দোতলার একটা কক্ষে নিয়ে গেল। কক্ষটা খুলতেই আমি অবাক সমস্ত ঘর চমৎকার করে ফুল দিয়ে সাজানো! লোকটা জানলো কীভাবে? যে আজ আমরা এখানে উঠব। আজ আমাদের বাসর রাত, কিন্তু পরক্ষণে ভাবলাম নীরব নিশ্চয় এনাকে বলেছে এভাবে সাজাতে আমাদের চমকে দিতে এসব ওরই কারসাজি। আর দশটা স্বামী স্ত্রীর মতোই বাসর রাতে বেশ গল্পগুজব আনন্দ ফুর্তি করতে-করতে ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙলো তখন আনুমানিক সকাল দশটা। পাশ ফিরে দেখি পাশে ইরা নেই । এ দিক ওদিক ঘরের কোথা ও তাকে খুঁজে পেলাম না, ঘরের ভিতর থেকে রাতে যেভাবে শিকল এটে দিয়েছিলাম সেভাবেই আটা। আমি চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম কিন্তু কোথাও কোন সাড়া শব্দ কিংবা প্রতিউত্তর পেলাম না, ফোনটাতেও চার্জ নেই ডেড হয়ে পড়ে আছে। ঘরটাতে রাতে আলো দেখেছিলাম কিন্তু এখন আর বিদ্যুৎ কিংবা আলোর কোন অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছি না। দরজায় আঘাত করতে শুরু করলাম তাতেও কোন লাভ হচ্ছে না। ভাঙ্গতে চেষ্টা করলাম তাও পারলাম না, এভাবে চিৎকার চেচামেচির এক পর্যায়ে আমি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লাম যখন জ্ঞান ফিরলো তখন চারদিকে গভীর অন্ধকার। বুঝতে পারলাম গভীর রাত। এখন আর আমার ভয় করছে না। দীর্ঘক্ষণ দুর্গন্ধ যুক্ত স্থানে থাকলে দুর্গন্ধকে আর দুর্গন্ধ মনে হয় না। সেরকম দীর্ঘক্ষণ ভয়ের মধ্যে থাকলে এক সময় আর ভয়কে ভয় মনে হয় না। এটাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আমারও তাই হল। আমি তখন নিজেকে এই ভয়ংকার পরিবেশের সাথে বেশ মানিয়ে নিয়েছি। অন্ধকারটাই যা একটু সমস্যা । তাছাড়া অন্য কোন সমস্যাকেই আর সমস্যা মনে হচ্ছে না। শুধু ইরার জন্যে প্রচন্ড দুঃচিন্তা হচ্ছে। কী অদ্ভুত কান্ড হঠাৎ কাকের পালকের মত অন্ধকার ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠল। আর্শ্চয় ব্যাপার আমি একটু চমকেও উঠলাম না। আগেই বলেছি দীর্ঘক্ষণ ভয়ের মধ্যে থাকতে থাকতে আমার কাছে ভয়কে আর ভয় মনে হচ্ছিল না। কিন্তু একটা জিনিস দেখে আমার ভয়ের অনুভ‚তিটা পূণরায় জাগ্রত হল । হঠাৎ দেখি সেই অদ্ভুত লোকটা ! সেই অদ্ভুত লোকটা আমার সামনে দন্ডায়মান। লোকটা তার লাল চক্ষু দু’টো পাকিয়ে বিশালকার ভ‚ড়িটা দুলিয়ে দুলিয়ে অদ্ভুত শব্দে খিক্ খিক্ করে হাসছে। হাসছে তো হাসছেই। সে এক রহস্যময় হাসি। ভয়ে আমার সমস্ত গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসছে। আমি ক্রমেই আমার নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি। এবং একপর্যায়ে আমি সম্ভবত জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। যখন জ্ঞান ফিরলো হাতের ঘড়িতে দেখলাম ১৩ তারিখ শুক্রবার বেলা ১২ টা ১ মিনিট ৪২ সেকেন্ড। আমি বুঝতে পারলাম তিন দিন তিন রাত পর আমার জ্ঞান ফিরেছে। ১০ তারিখ বুধবার রাতে ঐ অদ্ভুদ মানুষরূপী জন্তুটা আমাকে দর্শন দিয়েছিল। সামনে টেবিলের উপর চোখ পড়তেই মনে এক অন্যরকম আনন্দের উদয় হল। টেবিলের উপর নানা রকম ফল- ফলাদি সহ বড় একবাটি মুরগির রোস্ট দেখে জিবে পানি এসে গেল। বেশ কিছু দিন না খাওয়া। পেটের ভেতরটা ক্ষুধায় চো-চো করছে। জানতাম ৩-৪ দিন কোন ব্যক্তি পানাহার না করলে সে মৃত্যুর মুখে চলে যায়। আমার সে রকম কিছু মনে হলো না কিন্তু প্রচন্ড ক্ষুধাটা অনুভব করছিলাম। আমি দৌড়ে গিয়ে গপা-গপ খাবার গুলো সাবাড় করতে লেগে গেলাম। খাওয়ার এক পর্যায়ে হঠাৎ আমার পিঠের উপর একটি হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। হাতটা স্বাভাবিক মানুষের হাতের মত নয়। প্রচন্ড শীতল একটা হাত, সেই সঙ্গে গভীর একটা কণ্ঠস্বর। ধীরে খাও বৎস, তোমরা মানুষেরা বড় অদ্ভুত! ক্ষুধা পাইলে তোমাদের আর অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত জ্ঞান থাকে না। তখন তোমরা সম্মুখে যা পাও, তাই গিলতে থাকো। যেমন দেখো ক্ষুধার কারণে তুমি তোমার অতীত বর্তমান সব ভুলে খাওয়া শুরু করে দিয়েছো। তুমি একবার ভেবেও দেখলে না। খাবারটা ভালো নাকি, মন্দ, তবে আমি জানি তোমার খাবারের ক্ষুধাটা মিটে গেলেই তোমার আর একটা ক্ষুধা পাবে। সেটা হলো ইরার ক্ষুধা। তোমার সঙ্গীর ক্ষুধা’। আমি চারিদিকে তাকাতে লাগলাম কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে পেলাম না। আমি প্রশ্ন করলাম আপনি কে? আপনাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন? তিনি সেই অদ্ভুত লোকটার মত খিক্ খিক্ করে হাসতে হাসতে বলল আমাকে তো তুমি দিনে দেখতে পাবে না বৎস। রাতে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে। তখন তুমি সব কিছু জানতে পারবে। নানা ধরনের চিন্তা ভয় আর মুক্তির পথ খুঁজতে-খুঁজতে দিন ফুরিয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করলাম রুম থেকে বের হওয়ার কোন ফল হলো না। দরজা জানালা গুলো যেন লোহাও নয় তার থেকে কঠিন কোন পদার্থ দিয়ে তৈরি, ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এলো। আমি যেন হারিয়ে যেতে থাকলাম। গভীর অন্ধকার আচ্ছন্ন কোন ভিন্ন জগতে। সে অন্ধকার এতই গভীর ছিল যে জাগতিক সকল অন্ধকার তার কাছে তুচ্ছ। আমি বসে আছি। চুপ চাপ বসে আছি। হঠাৎ প্রচন্ড একটা শব্দে দরজাটা খুলে গেল। দরজার দিকে আমার চোখ যেতেই প্রচন্ড এক আনন্দের ঢেউ খেলে উঠলো আমার হৃদয়ে। আরে এ দেখি ইরা! নীল শাড়ী, নীল চুড়ি, নীল টিপে অপরূপ সুন্দর লাগছে তাকে। তার সমস্ত শরীর দিয়ে বের হচ্ছে এক অদ্ভুত আলোক রশ্মি। সে রশ্মিতে মুহুর্তে আলোকিত হয়ে গেল সমস্ত অন্ধকার। ইরা হাসছে। চমৎকার ভঙ্গিতে আমার দিকে চেয়ে হাসছে সে। ওকে দেখে মুহুর্তের মধ্যে আমি ভুলে গেলাম এ কয়টাদিন আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাগুলোর কথা। আমি দৌড়ে গোলাম দরজার কাছে, কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার, আমি ইরাকে দেখতে পাচ্ছি কিন্তু স্পর্শ করতে পারছিনা। আমি ইরার সমস্ত শরীরের উপর হাত বুলাচ্ছি, কিন্তু তার কোন স্পর্শ অনুভব করছি না। ছায়ার উপর হাত বুলালে যেমনটা ঘটে ঠিক তেমনই। স্পষ্ট একটা মানুষকে আমি দেখছি। তাকে ছোঁয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছি। কিন্তু ছুঁতে পারছি না। কী এক অস্বস্তিকর অবস্থা। হঠাৎ আবার সেই অদ্ভুত হাসির শব্দ খিক্ খিক্ খিক্ তুই ভুল করছিস বালক। ও তোর ইরা নয়। ওটা ছায়ামূর্তি। খিক্ খিক্ খিক্ । ছায়ামূর্তি ? তাহলে ইরা, ইরা কোথায় ? ইরা’কে চাস বালক? আমি জানি তুই ইরাকে খুব ভালোবাসিস। তাহলে যা বিরামপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক গোপীনাথ বাবুর কাছে যা। উনিই তোকে ইরার সন্ধান দিতে পারবে। তুই আজ এ ভ‚ত চক্র থেকে মুক্ত। ভ‚তচক্র! সেটা আবার কী ? অত কিছু জানতে চাস না, বালক বিপদ হবে। যা তুই চলে যা, খিক্ খিক্ খিক্। তারপর বিরামপুর আর আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে কেটে গেল অনেক দিন। অদ্ভুত লোকটা আমাকে শুধু বিরামপুর আর আপনার নাম বলেছেন। আর কোন কিছু বলেননি। এদেশে বেশ কয়টি বিরামপুর আছে। খেয়ে না খেয়ে পাগলের মত ঘুরেছি এসব বিরামপুরে খুঁজতে-খুঁজতে আজ সৌভাগ্য ক্রমে পেয়ে গেছি আপনার দেখা। শুরুতে আপনার সঙ্গে একটু বেয়াদবি করছি, এজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী! আসলে ছেলেবেলা থেকেই চরম বিপদ কিংবা দুঃখের মধ্যে আমার মধ্যে কি যেন একটা ঢুকে যায় আর তখনই আমি সকলের সাথে মজা করতে থাকি। তখন দুঃখ কিংবা বিপদ বেমালুম ভুলে যাই। আমার নানী বলতেন আমার উপর নাকি দুষ্টু জিনের আছর আছে। আমি অবশ্য ওসব মানিটানি না। দয়া করে আমার বেয়াদবি ক্ষমা করে আমাকে ইরার সন্ধানটা বলুন জনাব। নীলয়ের কথা শুনতে শুনতে মাষ্টার মশাই অনেকবার গোপনে চোখ মুচেছেন। এটা সে খেয়াল করেছে খুব ভালো ভাবেই। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি মাষ্টার মশাই কেন এমন করছে ? আবার প্রশ্ন করে তাকে বিব্রত করতেও চাইনি। -এতক্ষণ নীলয়ের কথা গুলো তিনি মনোযোগ সহকারে শুনলেন। তারপর কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলেন। হঠাৎ নীরবতা ভেঙ্গে তিনি বলা শুরু করলেন আর এক লোমহর্ষক কাহিনী। ইরা চক্রবর্তী; আমার একমাত্র মেয়ে। একমাত্র সন্তানও, ওর জন্মের সময় ওর মা মারা যায়। তখন আমার বয়স ত্রিশ ছুঁই-ছুঁই। পরিবারের অনেকের পীড়া-পীড়ি সত্ত্বেও ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আর দ্বিতীয় বিয়ের কথা চিন্তা করিনি। তখন সবে নতুন চাকরিতে যোগদান করেছি। পারিবারিক কলহের কারণে আমি মা বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। এক দিকে চাকরি অন্যদিকে ইরাকে নিয়ে ভীষণ সমস্যায় পড়ে যাই আমি। অনেক কষ্টে ওকে লালন পালন করতে থাকি। ছবি আকার প্রতি ছোটবেলা থেকেই ওর খুবই আগ্রহ ছিল। স্কুলের আর্টের শিক্ষকও ওকে আগ্রহের সাথে সাহায্য করত আর বলত ইরা একদিন এদেশের বড় নামকরা আর্টিস্ট হবে। দেখতে দেখতে মা আমার অনেক বড় হয়ে গেল। কলেজ পাশ করে বায়না ধরল আর্ট কলেজে পড়বে। পড়বে তো পড়বেই। কোন কারও কথা সে বুঝতে চায় না। আমি পড়ে গেলাম দোটানায়। একদিকে মেয়ের ইচ্ছা অন্যদিকে তাকে ছেড়ে আমাকে থাকতে হবে কোনটা করব ভেবে পাচ্ছি না। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম মেয়ের ইচ্ছাই পূরণ করবো। ওকে ভর্তি করে দিলাম আর্ট কলেজে। দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেল। একদিন দুপুরে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে ইরার কণ্ঠ-বাবা...বাবা। - আমি বেড রুমে শুয়ে শুয়ে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা পড়ছিলাম। বইটা একপাশে রেখে দৌড়ে গেলাম। বারান্দায়। ইরাকে দেখে আমি হঠাৎ যেন থমকে গেলাম। ইরা! ইরার সঙ্গে অচেনা একটা ছেলে। ইরার হাত ছেলেটির হাতে ধরা। ইরা বল্ল ও আমার ক্লাসমেট বাবা। আমি নিজেকে কিছু সামলে নিয়ে বললাম এসো তোমরা ঘরে এসো, ওরা ঘরে গেল। আমি চুপ-চাপ নিজের ঘরে ফিরে গেলাম। কিছুক্ষণ পর ইরা আমার ঘরে এসে ভয়ে ভয়ে বলল ছেলেটির নাম ধ্রুব। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। আমি বললাম বলো। ইরা বল্ল বাবা আমি আপনাকে না জানিয়ে বড় একটা ভুল করে ফেলেছি। দয়া করে আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি ধ্রুবকে বিয়ে করেছি ও আমার স্বামী। কথাটি শোনার পর আমি নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। আমি ওর গালে স্ব-জোরে একটা চড় মেরে বসলাম। আর; আর বললাম বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে আর কোনদিন যেন তোর মুুখ আমাকে দেখতে না হয়। আসলে যে মেয়েটার মুখের দিকে তাকালে আমি আমার পৃথিবীটা দেখেতে পেতাম। যাকে ঘিরে আমার আশা আকাঙ্খা স্বপ্ন সবকিছুই। সেই আমাকে না জানিয়ে এত বড় একটা কাজ করেছে আমি সেটা সেদিন মানতেই পারিনি। সারারাত আমি ঘুমাতে পারলাম না। যে মেয়ের গায়ে আমি কখনো একটি পিঁপড়াকেও কামড় বসাতে দেয়নি আজ সেই মেয়েকে আমি নিজে মারলাম? ভাবলাম; এ বয়সে টুকটাক ভুল সবারই হয়। তাছাড়া প্রেমে পড়লে কারো ভালো মন্দ, জ্ঞান থাকে না। ভাবলাম সকালে গিয়ে ওর মুখ থেকে সব শুনে সম্ভব হলে সব কিছু মেনে নেব। --সম্ভব হলে মানে ? ছেলেটার অনেক অর্থকড়ি দাদা ঠাকুরদাদার বংশীয় মর্যাদা এসব থাকলে? না, না বাবা তুমিও আমাকে ভুল বুঝছো। ওসবের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমার আদরের কন্যাকে আমি চেয়ে ছিলাম। গরীব হলেও নম্র, ভদ্র মানুষের মত মানুষের হাতে তুলে দিতে। আজকাল কার বাবা মায়েরা তাদের সন্তানদের বিয়ে দেয় ভাল পাত্র-পাত্রীর সঙ্গে নয়। পাত্র-পাত্রীর বাবা ঠাকুরদার বংশ মর্যাদা আর টাকার সঙ্গে। আসলে বাবা; পৃথিবীতে অর্থবিত্ত বংশ মর্যাদা ও সব কিছুই না, ওসবের মধ্যে সুখ থাকে না। একটা ভালো মানুষের সঙ্গে কুড়ে ঘরে বাস করলেও সেখানে স্বর্গীয় সুখেরতৃৃপ্তি অনুভব করা যায়। আর একটা বংশীয় মর্যাদাবান বিত্তবান মানুষরূপী পশুর সঙ্গে অট্টালিকায় বাস করলেও সেখানে ভোগ করতে হয় নারকীয় যন্ত্রণা। আমি চেয়েছিলাম মেয়েটাকে একটা সু-পাত্রে দান করতে। কিন্তু পরদিন সকালে উঠে দেখি ইরার ঘরের দরজা খোলা। ইরা কিংবা সেই ছেলেটা কেও নেই। আমি সমস্ত বাড়ি তাদের খুঁজতে লাগলাম। কাজের মেয়েটা জানালো-‘আপায় খুব বিয়ানে চইলা গ্যাছে, আর বলছে আর কুনো দিন ফিরা আইবো না’ পরদিন জানতে পারলাম ইরা এবং সেই ছেলেটি ঢাকায় এক বন্ধুর বাসায় আত্নহত্যা করেছে। ও বাড়ির দারোয়ান এবং তার বন্ধু ওদেরকে বাঁধা দিতে যাওয়ায় ওরা ওদেরকেও মেরে ফেলে। তারপর নিজেরা বিষপান করেছে। আসলে ওরা ওদেরকে কোন শত্রুতার জেরে মারেনি। কোনো-কোনো মানুষ আত্মহত্যা করার পূর্বে অনেক বেশি হিংস্র হয়ে যায়। ওদের বেলায় হয়তো তাই ঘটেছিল। - মাষ্টার বাবুর কথা শুনে আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যেতে লাগলো। তাহলে ইরা, নীরব যাদের সঙ্গে আমার এতটা গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ওরা সবাই অশরীরী আত্মা! এমনকি ঐ দারোয়ানটিও?
তাহলে; তাহলে কী? সে রাতে আমার সঙ্গে কেউ ছিল না?


শিল্প সাহিত্য ৭২


খুন
রিয়ানো

একটা আধ ভাঙ্গা চৌকি। কিছু ছাড়পোকা। একটা পুরনো টেবিল। পোকায় খাওয়া কিছু একাডেমিক বইপত্র। ধুলাবালি। নষ্ট হওয়া টেবিল ল্যাম্প। দেয়ালজুড়ে মাকড়সার জাল। এলোমেলো পড়ে থাকা জামাকাপড়। বন্ধ জানালা। একরাশ বিষণ্নতা। দম বন্ধ করা অন্ধকার।

ছেলেটাডুবে আছে এসবের ভেতর। কেটে গেছে ২৮ টি বছর। ডুবে যাওয়ার কাল শুরু হওয়ার পর থেকে ঘড়ির কাঁটার সাথে সাথে ডুবছে তো ডুবছেই। কিন্তু সে কি মরতে চায়?

বোধহয় না। তাইতো রোজ রাতে আঁকড়ে ধরে সিগারেট। রোজ রোজ সিগারেটের পয়সাটা জোগাড় করাও এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।

ক্রিং! ক্রিং!
সমস্ত নীরবতাকে তীব্র শক্তিতে পদানত করে আগুনের মতো ঝলসে উঠলো ফোনের রিংটোন। সিগারেটের আগুন ছাড়াও ঘরে তৈরী হলো আলোর উৎস। আর তার নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়াও তৈরী হলো নতুন শব্দ। ছেলেটা চিন্তায় ডুবে ছিল। বাস্তবে ফিরতে যতখানি সময় লাগলো, তারই মাঝে ফোনটার শব্দ থেমে গেল।

কে ফোন দিয়েছে? দেখার জন্য ফোনটা হাতে নিতেই আবারও সেই আলোর ঝলকানি, সঙ্গে তীব্র শব্দে।
ছেলেটা ফোনের কাছে মুখ নিয়ে বললো- হ্যালো!
ওপাশ থেকে ভেসে এলো অন্য একটা কণ্ঠস্বর। উচ্ছ্বাসে প্রাণবন্ত, তার মতো প্যাঁতপ্যাঁতা নয়। উচ্ছ¡াসভরা কণ্ঠস্বরের  মালিক তার বন্ধু- চাকরিটা হয়ে গেছে আমার!

একটা ধাক্কা। হজম করতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগলো তার। একসাথেই ইন্টারভিউ দিয়েছিলো তারা। বন্ধুর চাকরি হয়েছে, তার হয়নি!
ইন্টারভিউ বোর্ডে সেদিন কেতাদুরস্ত এক ভদ্রলোক তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘আচ্ছা, আপনার চোখের নিচে অমন কালশিটে দাগ কেন? নেশা-টেশা করেন বুঝি?’
সে জবাব দিতে পারেনি। প্রতিরাতের মতো আজও যখন সে ডুবে আছে, তখন সেই স্মৃতিটা তাকে আরেকটু ডুবিয়ে দিলো। ডুবতে ডুবতেই বন্ধুকে অভিনন্দন জানালো সে। বিনিময়ে পেল আশার বাণী আর সান্ত¡না।
‘তুই দুঃখ করিস না দোস্ত, চেষ্টা কর। এক জায়গায় না এক জায়গায় চাকরি হয়েই যাবে!’
এমন মূল্যবান উপদেশ! তাকে বাধ্য হয়েই একখানা হাসি উপহার দিতে হলো।

বন্ধু ফোন রাখলো। আসলে সবাই এখন ব্যস্ত। ব্যস্ত তার প্রেমিকাও, যে একসময় ছিলো তার ব্যস্ততার কারণ, এখন সব ব্যস্ততাই তাকে ছুটি দিয়ে চলে গেছে। মাসের পর মাস চলে গেলেও একটা চাকরি সে জোগাতে পারেনি -এই অজুহাতে।
চলে গেছে টিউশন, হাত খরচের একমাত্র উৎস। চলে গেছে সুখ।

এখন এই পৃথিবীতে অল্প ক’জনই নিয়মিত তার খোঁজ নেয়। এ তালিকায় প্রথমেই আছে তার বাড়িওয়ালি। রোজ সকালে দরজায় শব্দ কওে দেখে সে আছে কিনা। ব্যস, এতোটুকুই!

থাকগে, সে বোঝায় নিজেকে, না-ই জিজ্ঞেস করুক আমি কেমন আছি, কি অবস্থায় আছি, অন্তত আছি কিনা এটা তো খেয়াল রাখে! তার অস্তিত্বের খেয়াল রাখার জন্য এই যে একটা মানুষ আছে, এটা তাকে বেশ স্বস্তিÑ দেয়। সেই স্বস্তির বিনিময়ে সে অনুভব করে, তার সঙ্গী ছাড়পোকারা ক্ষুধার্ত হয়ে আছে। তাদের খাদ্য দেয়া প্রয়োজন।
খেয়াল হয়, আরে! ক্ষুধার্ত হয়ে আছে আরো কিছু প্রাণী! রোজ রোজ খাদ্যের জন্য চেঁচায় তারা। অন্য ভাষায় এটাকে বলা যায় তাগাদা। সকাল হলেই যে তার অস্তিত্বের খেয়াল রাখে, তাকে দিয়ে শুরু হয়। এরপর আছে মুদি দোকানদার, চা ওয়ালা, বাদামওয়ালা--- আরো কত কে! সকলকে নিজের অস্তিত্বটা জানান দিয়ে একটা সিগারেট জোগাড় করে ছাদের একাকী রুমটায় ফিরে আসে সে। সকলের শান্তির জন্য রোজ একটু বেরোতে হয় তাকে। ‘আমি আছি!’ হাজিরা দেয়ার পর কিছুক্ষণের জন্য লেকচার। এরপর বিদায় নিতে হয় তার কাছ থেকে। এরপর আরেকজন। এরপর আরেকজন!

‘ আছি!’ আছি! আছি!’ তবু যেন সে নেই! শহর যখন সন্ধ্যার অন্ধকারে ডুবতে শুরু করে,তখন তার মাথার ভেতর কে যেন চিৎকার করে, ‘আমি কি সত্যিই আছি...?
‘আমি কি সত্যিই আছি?’
‘আমি কি সত্যিই আছি?’

ওহ! সে কি যন্ত্রণা! এমন লাগে কেন? সে ছুটতে থাকে। এ গলি, সে গলি ছুটতে ছুটতে যেখান থেকে ছোটা শুরু করেছিলো, সেখানে এসেই থামে। কারণ, পৃথিবী গোলাকার। হাঁপাতে হাঁপাতে পকেট হাতড়ে ঘরের চাবি বের করে। বিক্রির মতো জিনিসের সংখ্যা ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। পুরনো তালা কেউ কেনে কিনা, জানতে হবে।
বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ঘরটায় ছেলেটা শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ায়। চৌকির মচমচ  করা শব্দ তাকে জানায়, তোমার ওজন কমে আসছে।
সিগারেটের অপ্রয়োজনীয় অংশটা ফেলে সে টেবিলের কাছটায় গিয়ে দাঁড়ালো। অল্প সময়েই খুঁজে পেল নতুন পত্রিকায় যত্ন সহকারে মুড়ে রাখা চকচকে জিনিসটা। অন্ধকারেই তার ঔজ্জ্বল্য অনুভব করে। হাতের তালুতে ঘষে উপভোগ করে জিনিসটার ধার। পরীক্ষা করে ওজন। আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায় তার অন্তরে। খুব সহজেই ব্যবহার করা যাবে এমন একটা জিনিস সেটা। ‘চমৎকার!’
তার মতো শীর্ণকায় ব্যক্তির পক্ষে খুব কঠিন কিছু নয়।

এলাকার যে বড় ভাই এই অত্যন্ত চমৎকার কিন্তু মূল্যবান জিনিসটা তাকে উপহার দিয়েছে, তাকে মনে মনে ধন্যবাদ জানায় সে। জিনিসটাকে পরম মমতায় বুকে আগলে রাখে, চুমু খায়। চোখ বুজে চলে যায় সময়ের কিছুটা পেছনে।
ছোটবেলায় তার মা তাকে বলেছিলো, ‘বাবা, ব্লেডের মত ধারালো হবি। যাতে করে সামনে যত বাঁধা আসবে, সব কেটে কুটে বেরিয়ে যেতে পারিস!’ কিন্তু না। সে ব্লেডের মতো ধারালো হতে পারেনি। কারণ বাবা তার জন্য কোন হীরার টুকরা রেখে যাননি। তাই তাকে এ সমস্ত বড় ভাইদের দেয়া ধারালো জিনিসের সাহায্য নিতে হয়।

‘বাধা!’ ‘বাধা!’ ‘বাধা!’

সে বেশ কয়েকবার শব্দটা উচ্চারণ করে।

হ্যাঁ আসলেই তো! ‘বাঁধা।’
পাঁচ মাসের জমে থাকা ঘরভাড়া একটা বাঁধা।
মুদি দোকানের বাকির খাতা একটা বাঁধা।
চা ওয়ালার দাগওঠা চায়ের কাপ আরেকটা বাঁধা।
এমনি বাঁধা বাদামওয়ালা, লন্ড্রি দোকান, ভাতের হোটেল......উফফফ! তাকে এসব বাঁধা কেটে বেরিয়ে আসতেই হবে! তাই সে টুক করে দরজা খোলে। শব্দ না করে সিঁড়ি বেয়ে হেঁটে যায় নিচের দিকে। এ সময় তার মনে হয়, সে যেন একটু একটু করে ভেসে  উঠছে। সিঁড়ির প্রতিটা পদক্ষেপে পানির ওপরে দেখা যাচ্ছে  সূর্যালোকের প্রতিফলন।

দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাই সে বাড়িওয়ালির ফ্ল্যাটের কলিংবেলে চাপ দেয়।


শিল্প সাহিত্য ৭০


সংক্ষিপ্ত জীবন
মাহমুদুল হক আরিফ

খুব কম দিন নীলু খালা আমার খালুকে কাছে পেয়েছে। আমি বড় হওয়ার পর বুঝতে পারি এটা একরকম সেক্রিফাইজ। কাজের সূত্রে খালুজান মধ্যপ্রাচ্যের মরুভ‚মি অঞ্চলে থাকতেন, তিন বছর বাদে বাদে আসতেন। প্রায় আঠের বছর তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। নীলু খালার ছয় ছেলেমেয়ে। তাদের বয়সের পার্থক্য তিন বছর করে। খালু কর্ম জীবনে দেশে এসেছেন ছয়বার। বছরে একুশ দিন ছুটি পেতেন কিন্তু প্লেন ফেয়ারের কথা বিবেচনা করে এক সাথে তিন বছরের জমানো ছুটি- নয় সপ্তা হাতে নিয়ে তিনি দেশে ফিরতেন। খালু ছুটি কাটিয়ে চলে যাওয়ার পর খালার শরীরে একটা পরিবর্তন আসতো। তিনি প্রতিবার খালার জঠোরে একটি বীজ বপন করে যেতেন, তার রেখে যাওয়া চিহ্ন বেড়ে উঠতো খালার শরীর বেয়ে। খালু প্রতিবার ফিরে এসে দেখতেন তার নতুন সন্তানটি উঠোনে আলতো পায়ে হাঁটছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। একটা খেলনা হাতে তুলে দিয়ে বলতেন মাশাল্লা আল্লার নেয়ামত। অগন্তুককে দেখে বাচ্চাটি গুটিগুটি পায়ে দৌঁড়ে পালাতো। খালু শাসকের মতো দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে গর্বিত চোখে তার বংশের বিস্তার দেখতেন। ছেলে-মেয়েদের ডেকে, জরিয়ে ধরে উষ্ণ হতেন, ওম নিতেন। কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তাপ দিতেন। তারপর একটা আর্ম চেয়ারে বসে আমীরের ঢংয়ে পর্শীদের খেজুর খুরমা, বড়দের জন্য জায়নামাজ, ছোটদের জন্য চকলেট চুইংগাম বিলি বণ্টন করে একটা সময় উঠে দাঁড়াতেন। এক জীবনের সঞ্চয়- তাঁর কষ্টসাধ্য শ্রমের টাকায় একচালা ইটের বাড়িটা কতটা পোক্ত হয়েছে ঘুরেঘুরে দেখতেন! বাড়ির চতুরদিকে আর্মি জেনারেলের মতো পা ফেলতেন এমন এক ভঙ্গি করতেন এ সাম্রাজ্য তার।

খুব অনভিপ্রেত কথাগুলো বিবৃতির মতো বলতে থাকে সাদেক। ও জীবনের মানে খুঁজছে। এক জীবনে মানুষের কাজ কী? মিনিংফুল লাইফের মানে কী? ইদানীং ভাবছে আর মানুষের জীবনকে সারসংক্ষেপ করে বলছে। এমন লোককে কে মনে রাখবে? কেন মনে রাখবে? মরে গেলে আমরা আর মনে রাখি না কেন? উত্তর খুঁজছে! পরিবারের একমাত্র কাজ কী বংশ বিস্তার! রুস্তমকে জোরকণ্ঠে স্বর বাড়িয়ে আরেক কাপ করে চা দাবি করে- সাদেক। 
বসে থেকে শুনছিল মতি। সে বলল তোমার স্টেটমেন্টে একটা বিষয় খুব পরিষ্কার। 
কী? 
খালুর প্রতি তোমার কোন ক্ষোভ আছে। বিবৃতিটা বিচার করলে দেখবে বিদ্বেষে ঠাসা। তুমি সংক্ষেপে তাঁর বিরুদ্ধে উত্তেজনা তৈরি করছো। 
সাদেক কিছুতেই মানতে নারাজ। বললো নীলু খালার জীবনটা তো আরো সংক্ষেপ! 
কী রকম!
খালার জীবনে সে ছয়বার আতুরঘর দেখেছে পারস্যদেশ দেশ থেকে এসে বিশ বছরে খালু তাকে আর কোন ঘর দেখাতে পারেনি। কোথাও বেড়াতে নিয়ে যায়নি। খালা বাপের বাড়ি আর নিজের বাড়িতেই পুরো একটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। যদি জিজ্ঞেস করতাম খালা তোমার বাইরের দুনিয়া দেখতে ইচ্ছে করে না?
উত্তরে খালা বলেছিল একবার তোর খালুকে বলেছিলাম সমুদ্র কেমন একবার দেখাবা? তোর খালু ঐ বার বাড়ির পাচিলটা আরো দুই ফিট উঁচু করে দিয়ে যায়। বললাম কেন? বলেছিল তাঁর আমীরের ঘরে মেয়ে সন্তান হওয়ার পর পাচিল আরো উঁচু করে দিয়েছিল। সে বার লিলি জন্ম গ্রহণ করেছিল।

আমার নীলু খালা জীবন ভর আমীরদের সংস্কৃতি টেনে নিয়ে গেছে। তাঁর দীর্ঘ বেঁচে থাকা জীবনের আলোচনা, এক কাপ চায়ের গল্পের চেয়েও সংক্ষিপ্ত!


শিল্প সাহিত্য ৬৯


রাসেল আহমেদ
অসমাপ্ত ভালোবাসা

সেদিন আমি একাই বের হয়েছিলাম নিজেকে নিজে সময় দিবো বলে। হ্যাঁ, সেখানেই গিয়েছিলাম যেখানে প্রায়’ই যাওয়া হত আমার মন খারাপের সময়। এখানকার সবচেয়ে মজার ব্যাপার কি জানেন? এখানকার পরিবেশটা কেন জানিনা কখনো পাল্টায় নাহ! এই তো অনেকগুলো গাছের পাশেই সেই প্রিয় বড় গাছটা। বট গাছ নয়, খুব বড় একটা রেইনট্রি গাছ। একটু দূরে বেঞ্চটা। সামান্য হেঁটে গেলেই সিঁড়ি বেয়ে পুকুর ঘাট। সবই আমার প্রিয়। আর সবথেকে ইন্টারেস্টিং বিষয় হল বেঞ্চে বসা মেয়েটি।  আমাকে এখন তাকে এই পরিবেশ এর একটি নিয়ামক বলে মনে হয়। এই মেয়েটাকে বসে থাকতে দেখলে কখনোই অস্বাভাবিক মনে হয় না। বরঞ্চ যেদিন এই মেয়েটিকে দেখতে পেতাম না সেদিন প্রকৃতিটাকেই অস্বাভাবিক ও অসম্পূর্ণ মনে হতো। সে যেন ছিল এই প্রকৃতি ও পরিবেশেরই অংশ। 

মেয়েটা অনেকটাই বোকা, দেখে যা মনে হতো। আর আমি বোকাদের প্রতি বরাবরই একটু দুর্বল। তবে মেয়েটা চোখে দেখতে পেতো না! প্রায় সময়’ই একা বসে থাকতে দেখা যায়। প্রথমদিকে কয়েকদিন একটা ছেলেকেও দেখতে পেতাম এখন মেয়েটা একাই বসে। ছেলেটা আসছেনা কিছুদিন কে জানে কি হয়েছে! সাংবাদিক হওয়ার সুবাদে সবার সাথেই মিশতে পারতাম এবং সুন্দর করে কথা বলতে পারতাম। কিন্তু তার সামনে আসলেই আমার এতো দিন ধরে জমানো সে অভ্যাস যেন নিস্তেজ হয়ে উঠে। হাজার প্রশ্নের উদ্রেক ঘটা সত্ত্বেও নির্বাক দর্শক হয়েই বসে থাকতে হয় সারাটি ক্ষণ। পাখিরা উড়ে যায়, তাদের কলকাকলীতে চারপাশ মুখোর হয়। কিন্তু বরাবরের মতোই নীরব সে আলো-আঁধারি মানবী।

সেদিন মেয়েটিকে আমার কেমন একটা সাধারণ এর মাঝে অসাধারনই লেগেছিলো। এই প্রথম যেন তার পূর্ণ আবির্ভাব ঘটল। অল্প অল্প বৃষ্টি যেমন মানুষকে ভিজতে ইচ্ছে জাগায় আমাকেও সেদিন তার অলস মায়াবী মুখখানা কিছু একটার ইচ্ছে জাগিয়েছিল। সেই কিছু একটা যে কী তা আজ পর্যন্ত আমি আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি।

“গল্পের শুরুটা এখানেই!!!”

সেদিনের পর থেকে আমার রুটিন হয়ে যায় মেয়েটিকে প্রতিদিন একবার করে দেখা। মেয়েটির সরলতাই আমার দুর্বলতার মূল, এই সত্যটা আমি আবিষ্কার করেছি বেশ কিছুদিন পর। প্রায় সময়ই মেয়েটি আসতো না। তখন মনে হতো তাকে না দেখে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া আরও শান্তির। কেন এমন হয় তার কোন সংজ্ঞা আমার জানা ছিলো নাহ। এ এক অসহ্য যন্ত্রণা। তার প্রতিটা দিনের অনুপস্থিতি আমাকে জানান দিচ্ছিল আমার হৃদয়ের অস্থিরতা সম্বন্ধে। 
আমি প্রায়ই অনুসরণ করে যেতাম তাকে। আশেপাশেই থাকতাম সবসময়।  ভাবতাম আমার উপস্থিতি সে বুঝছে নাহ। তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হতো। সাংবাদিক জীবনে অনেক কঠিন, অসহায় পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। নিজেকে দুঃখী মনে হয়নি কখনো। কিন্তু আমি যার জন্য নিজের মন বিসর্জন দিয়েছি সে আমার দিকে সামান্য দৃষ্টিপাত পর্যন্ত করে না!

একদিন তাকে খুব কাঁদতে দেখেছিলাম আমি। চোখের জ্বল পুরো গাল গড়িয়ে মাটিতে পড়ছিল। নিজেকে তখন পৃথিবীর সবথেকে দুঃখী মানুষ মনে হচ্ছিলো। না পারছি চোখের জল মুছে দিতে না পারছি সহ্য করতে। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম, “এটা কী ভালোবাসা, নাকি শুধুই একটা মেয়ের প্রতি একটা ছেলের আকর্ষণ? হ্যাঁ, এটাই ভালোবাসা। যে বোধটা আমার মাঝে এসেছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে। সেদিনই সে আমায় প্রথম ডাকল। আমি চুপচাপ বসে পড়লাম পাশেই। মেয়েটি বলল,
“আমায় চেনেন?”
“হু!!”
“কে আমি?”
“আলো-আঁধারি!”
“এ আমার কার নাম? আমি তো...
তাকে থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম,
“প্রথম আপনাকে দেখেছিলাম আলো-আঁধারের মিলনমেলায়। তখন আলোও ছিল না, আঁধারও ছিল না। আবার আলোও ছিল এবং আঁধারও ছিল।”
“কী যা তা বলছেন! পাগল হলেন নাকি?”
“সে তো অনেক আগেই হয়েছি। তা না হলে কোন সাংবাদিক প্রতিদিন এক জায়গায় বসে কারো জন্য অপেক্ষা করে না।”
মেয়েটি হাসলো। সামান্য হেসে বলল, 
“জাস্ট এতটুকুই?” 
আমি তার হাসিটার দিকেই তাকিয়ে রইলাম।  কান্নার পর মেয়েরা যখন হাসে সে হাসি পৃথিবীর সবথেকে মূল্যবান আমি সেদিনই বুঝেছিলাম। আমি উপভোগ করছিলাম পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর জিনিসটি। বৃষ্টির পর রোদ উঠলে সূর্যকে যেমন হাস্যোজ্জ্বল মনে হয় ঠিক তেমনি আরেকটি হাসি দিয়ে মেয়েটি বলল,
“আপনি আমায় অনেকদিন ধরেই দেখছেন তাই না?” 
“জ্বি, কেন?” 
“আমার পাশে একটা ছেলে থাকতো দেখেছেন হয়তো?”
“হ্যা! দেখেছি, আপনার কাছের কেউ হয়তো! আলাদা হলেন কেন?”
“আমি চোখে দেখতে পাইনা তাই আমায় নিয়ে তার ফ্যামিলি’র কাছে বলা তার পক্ষে সম্ভব নাহ।”
এ কথা শুনে আমি খানিক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে রইলাম। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যে দু’চোখে আমি পুরো জগতের প্রতিবিম্ব দেখতে পাই, সে চোখ জোড়াই কিনা এই সুন্দর জগতের দেখা পায় না! এ কথা শুনে আমি মোটেও চিন্তিত নই, এমন ভঙ্গিতে তাকে আবার প্রশ্ন করলাম,
“সেটা আগে কেন ভাবেননি?”
“আমার ভাগ্যই এমন। তার কোন দোষ নেই। যাহোক আমায় এখন যেতে হবে।”
আমি দাড়িয়ে বললাম শুনুন, “আপনাকে না দেখলে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনা। ছয় মাস ধরে দেখে আসছি। একদিন না দেখলে ভালো থাকতে পারিনা। মরে যেতে ইচ্ছে করে আমার। আপনি কি আমার সাথে থেকে, পাশে থেকে আমার চোখের মনি হয়ে আমার ভালো থাকার কারণ হবেন?”

লাল চোখ থেকে লালচে মুখটা বেয়ে আরও কয়েক ফোঁটা জ্বল আমায় উপহার দিয়ে  সে চলে যায়। ছয় মাস অপেক্ষা করেছি, অনেক খুঁজেছি পাইনি তাকে। ভালো থাকুক বলেই নিজেকে সান্তনা দিয়েছি।”

দশ বছর পর আজ আমি আমার স্ত্রী এবং তিন বছরের বাচ্চা কে নিয়ে এখানে আবার এসেছি। ভাগ্যদেবতা হয়তো আজই আমায় নিয়ে এসেছিল তাকে আরেকবার দেখার জন্য। আজ তার হাতে সাদা কাগজ দেখেছি আমি। খুলেই দেখলাম দশ বছর আগের আমাকে একেছে সে কাগজে আর কলমে।


শিল্প সাহিত্য ৬৮


মোগল চপ্পল
স্বপঞ্জয় চৌধুরী

অফিস থেকে ফিরছে মোকসেদ। তার হাতে খালি টিফিন ক্যারিয়ারের বাটি আর একটা কালো রঙের রঙচটা ছাতা। সে অন্য মনস্ক হয়ে হাঁটছিল আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। মাসের শেষ সামনের শুক্রবার একটা বিয়ের দাওয়াত আছে। ছোট সালার বিয়ে। একমাত্র শ্যালক না গেলে বৌয়ের কথা শুনতে হবে। পকেটের অবস্থা আত্মীয় স্বজন বুঝবে না। টাকা পয়সা নাহয় ধার করে যাওয়া গেল বিয়েতে। কিন্তু বিয়েতে কত মানুষ আসবে যাবে একটা ভালো জামা কিংবা জুতো কোনটাই নাই তার। জামাটা না হয় লন্ড্রী থেকে ভাড়া নেয়া যাবে কিন্তু জুতো পাবে কই। আজীবন সে মোগল চপ্পল এর স্যান্ডেল পড়েই কাটিয়ে দিচ্ছেন। পন্সের উপর হলুদ রঙের ছোপ-ছোপে দাগ। হলুদ রঙের জুতোর বেল্ট ছোটবেলা থেকেই এই কোম্পানির পন্স পড়ে আসছে। নাম মোগল চপ্পল হলেও। এতে কোন মোঘলীপনা নেই। আছে দারিদ্রের উপহাস। তার বাবা তাঁর চেয়েও দরিদ্র ছিল। তারা দু’বেলা খেত এক  বেলা উপোস করতো। খুব কমদিনই তারা তিন বেলা খেতে পেরেছে। তার বাবাও এ কোম্পানির পিয়ন ছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর তার চাকরিটা তিনিই করছেন। সংসারে এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ, খাবার খরচ বাড়ি ভাড়া এসব দিয়ে মাসে এক টাকাও থাকেনা। তাই তিনি প্রতিদিন ৪ কিলোমিটার হেঁটে অফিস করেন। আজ বিকেলে খুব একটা ভ্যাপসা গরম পড়েছে। তার হাই প্রেসারের সমস্যা আছে। গরম পড়লে অতিরিক্ত ঘেমে যান।

হঠাৎ কোথা থেকে একটা বড় আকৃতির ট্রাক এসে তার সামনে হার্ডব্রেক করে। অল্পের জন্য রক্ষা। মোকসেদ ভয়ে লাফিয়ে উঠে। তার টিফিন বাটি তিনটা তিন দিকে ছুটে গেছে। মানুষজন এসে তাকে গালমন্দ করছেন। ট্রাকড্রাইভার মারার জন্য তেড়ে আসেন। কয়েকজন যুবক বাঁধা দেন। মোকছেদ ঘাম মুছতে মুছতে বলে- আসলে বাবারা আমার শরীরটা ভালো না। তাই একটু অন্য মনস্ক ছিলাম। ট্রাকড্রাইভার ট্রাকে উঠে ট্রাক স্টার্ট দেয়। লোকজন যে যার কাজে চলে। হাঁটতে গিয়ে মোকসেদ টের পায় তার মোগল চপ্পল এর একটা পন্সের বেল্টের বল্টু ছিঁড়ে গেছে। সে হাঁটতে পাড়ছেনা। ছিঁড়ে স্যানডেলটা হাতে নিয়ে হাঁটছেন। একটু দূরেই একজন মুচি বসেছিল রাস্তার পাশে। মোকেছেদ মুচির কাছে গিয়ে বলে আগেটার মতো এইটারও পেরেক লাগাইয়া দাও। মুচি তার দিকে তাকিয়ে একটা প্রশস্ত হাসি জুড়ে দেন। চাচা জোড়াতালি দিয়া আর কতদিন চলবেন। একটা নতুন জুতা কেনেন। আমার কাছে সেকেন্ড হ্যান্ড জুতা আছে। কালি কইরা দিলে কেউ বুঝতে পারবোনা নতুন না পুরাতন। মোকছেদ কিছু বলেনা। ছোট ছেলের জুতা ছিড়ে গেছে অনেক দিন থেকে বলছে জুতোর কথা। কিনে দিতে পারছেনা। তাই ভাবলেন এই মুচির কাছ থেকে যদি একটা সেকেন্ড হ্যান্ড জুতা পাওয়া যায়। মুচি পন্সের বেল্টে একটা কৃত্রিম বল্টু সেলাই করে দেয়। মোকসেদ স্যাকেন্ড হ্যান্ড জুতোর দাম জিজ্ঞাসা করে। মুচি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে। এইটা চোরাই জুতা। মার্কেটে নতুন কিনতে গেলে হাজার টাকার উপরে পড়বো। আমারে তিনশ টাকা দিলেই চলবো। মোকসেদের মুখে চিন্তার ছাপ। তার চিন্তিত মুখ দেখে মুচি বুঝতে পারে। এইটা আপনের জন্য শুধু এখন একশো দেন বাকীটা পরে দিলে দিলেন না দিলে নাই। দেখেন পায়ে লাগে কিনা। মোকছেদ আর তার ছেলের পায়ের মাপ প্রায় একই। সে পায়ে দিয়ে দেখে সাইজ ঠিক আছে। একশত টাকা দিয়ে একটা পেপারে জুতো জোড়া মুড়িয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা দেন।

মোকসেদের ছেলে জুতো পেয়ে খুশি হয়। সে ঘরের ভিতর এমাথা থেকে ওমাথা হেঁটে হেঁটে ট্রায়াল দেন। ঠিকই আছে কিন্তু একটু পুরান পুরান লাগতাছে। মোকসেদ হেসে বলে নারে পাগল এইডার কালারই এমন। দেখতে দেখতে শ্যালকের বিয়ের দিন চলে আসলো। শ্যালক নতুন সরকারি তৃতীয় শ্রেণির পদে চাকরি পেয়েছে। ঘুষ লেগেছ পাঁচ লাখের মতো। বিয়ে করে যৌতুক নিয়ে টাকা উসুল করবে। তার উপর বিয়েতে সবাইকে পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে সবাই যাতে ক্যাশ টাকা দেয়। মোকসেদ তার অফিসের কলিগ সোবাহানের কাছ থেকে দেড় হাজার টাকা ধার করেছে। এক হাজার দিবে বিয়েতে আর পাঁচশো যাতায়াত খরচ। কিন্তু তার একটা ভালো স্যান্ডেল নেই। এই জোড়া তালি দেয়া মোগল চপ্পল পড়লে মানসম্মান যে আর থাকবে না। তাই ছেলে বুদ্ধি করেছে। বাবা বিয়ে বাড়ি থেকে একটু দূরে থাকবে। নিজে আগে খাওয়া শেষ করে তারপর বাবার সাথে জুতো পরিবর্তন করবে।

জুম্মার নামাজ শেষ করে পরিবার নিয়ে বিয়েবাড়ি রওয়ানা দিল মোকসেদ। বউ বাচ্চা আগে গেল রিসিপশনে গরমের মধ্যে কোট পড়ে দাঁড়িয়ে আছে তার শ্যালক মজনু মিয়া। কাবিন আগেই হয়ে গেছে আজ বৌভাত। মজনু একটা কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলে দুলাভাই কই? মোকসেদের বউ চম্পা একটু ইতস্তত হয়ে বলে। তোর দুলাভাই আসতাছে একটা জরুরি কাজ শেষ কইরা। মজনু একটু বিরক্তি মাখা হাসি দিয়ে বলে আজকে ছুটির দিনে তার আবার কিসের জরুরি কাজ। চম্পা ছেলে মেয়ে নিয়ে ফাস্ট ট্রিপেই খেয়ে ওঠে। তারপর ছোট ছেলে হোসেনকে বলে তোর বাবা দাঁড়াইয়া আছে রোদের মধ্যে তাড়াতাড়ি যা। হোসেন বাবার কাছে গিয়ে জুতো পরিবর্তন করে নেয়। মোকসেদ হোসনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে- বাবা খাইছো ঠিকমতো। হোসেন মাথা নেড়ে বলে হ আব্বা খাইছি। মোকসেদ বিয়ে বাড়িতে চলে যায়।

রাস্তায় একা একা হাঁটছে হোসেন। তার পায়ে মোগল চপ্পল। সে হাঁটতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেনা। মুচির কাছ থেকে সেলাই করার পরও দু’বার ছিড়েছে। পন্সের বেল্টে পেরেক লাগানো আছে। বারবার সে পেরেকের গুতো খাচ্ছে। তার চেতনায় ধরা পড়ে বাবাকে কতদিন সে এই জুতো নিয়ে ঠাট্টা করেছে। নতুন জুতোর জন্য বাবাকে কতদিন মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে সে। এ জুতো পড়ে কান স্বাভাবিক মানুষ হাটতে পারবে না। তার বাবাতো একজন অস্বাভাবিক মানুষ। কোন দিন নিজের চাহিদা, নিজের কষ্ট সন্তানদের বুঝতে দেননি। রোদ, বৃষ্টি মাথায় করে সারা জীবন পায়ে হেঁটে অফিস করেছে। এই মোগল চপ্পল পায়ে দিয়ে। আজ সে বুঝতে পারছে বাবার না বলা কথাগুলো। তার বুকের ভেতর দুমরে মুচরে থাকা কষ্টগুলো তাকেও যেন তাড়া করছে। অজান্তেই হোসেনের চোখে জল চলে আসে। সে মোগল চপ্পল খুলে খালি পায়ে হাঁটতে থাকে।


শিল্প সাহিত্য ৬২


প্রায়শ্চিত্ত
রিয়ানো

ঝড় বাড়ছেই। বাজ পড়ার প্রবল শব্দ। বৃষ্টির পানি আর ঠাণ্ডা বাতাসে ওদের গায়ে কাঁপুনি ধরে গিয়েছে।
কাঁপতে কাঁপতেই আজমল বললো, ‘তর কি মনে অয় হাসমইত্যা, হেদিনের পাপের কারণেই আমগো এই অবস্থা?’
হাসমত বিরক্ত হলো। ‘দ্যাখ আজমল, একটার মইদ্যে আরেকটা আনবি না।’
ঝড়ে, বৃষ্টিতে নাস্তানাবুদ অবস্থা তাদের। এর ভিতর আজমলের উল্টাপাল্টা প্রশ্ন। হাসমত একটু গোড়া থেকে ভাবে।
বরাবরের মতো খ্যাপ মারতে বেরিয়েছিল তারা। মাঝে মাঝেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডেলিভারী পড়ে তাদের। আর্জেন্ট ডেলিভারী থাকে প্রায়ই। এমনি ডেলিভারী শেষে শহরে ফিরছিল তারা।
 গ্রামের রাস্তা। গাছ গাছালিতে পূর্ণ। বিকেল বেলা হলেও আবছা অন্ধকার। মাটির রাস্তা দিয়ে পথ চলায়য় গাড়ির গতি ছিলো কম। ড্রাইভ করছিলো হাসমত। হঠাৎ কি হলো! কোথেকে এক বিরাট গাছের ডাল এসে পড়লো তাদের সামনে। প্রায় ভৌতিক ব্যাপার।
এরকম বলা নেই, কওয়া নেই, ট্র্যাকের সামনে ডাল ভেঙ্গে পড়ার বিষয়টা নতুন। হাসমতের মনে একটু খটকা লাগলেও পথ চলতে হলে এটা সামনে থেকে সরাতেই হবে। সে সাতপাঁচ না ভেবে টর্চ হাতে  নেমে পড়লো ট্র্যাক থেকে। আজমলও নামলো। ঠাণ্ডা বাতাসে গা জুড়িয়ে গেল তাদের।
চারপাশে বেশ অন্ধকার। অনেক বড় বড় গাছপালা। মনে হচ্ছে জঙ্গল ঘেরা একটা জায়গায় ঢুকেছে তারা। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখলো, গাছের ডালটা লম্বায় তাদের দু’জনের সমান! প্রশাখা, লতাপাতায় ভরপুর। এতো বড় একটা ডাল কোন কারণ ছাড়াই উড়ে এসে পড়লো তাদের সামনে! আলগাতে গিয়ে দেখলো, ওজনে যথেষ্ট ভারী।
চিন্তায় কোন ক‚ল পেল না হাসমত। আজমল কোমড়ে গোঁজা পোঁটলা থেকে সিগারেট আর দিয়াশলাই বের করলো। সিগারেট টানতে টানতে তারা ভাবলো কি করা যায়। শেষে এটা সরানোর সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু যেই দু,জনে মিলে ডালটা সরাতে যাবে, অমনি  প্রচণ্ড জোরে বাতাস বইতে শুরু করলো। সেইসাথে ধুলা। ধুলায় ওদের চোখ জ্বালা করে উঠলো।
দু’হাতে চোখ ঢেকে ধুলা থেকে বাঁচতে ট্র্যাকে উঠতে যাবে, অমনি ডালের সাথে পা বেঁধে পড়ে গেল দু'জনেই। হাসমতের হাত থেকে টর্চটা ছিটকে গেল। এরই মধ্যে শুরু হলো বৃষ্টি।
হাসমত কোন রকমে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু আজমল পারলো না। একটা চিকন ডালের সাথে পা আটকে গিয়েছে তার। হাসমতকে ডাক দিলো সে। হাতড়ে হাতড়ে টর্চটা খুঁজে বন্ধুকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো হাসমত। অনেক কষ্টে বের করে আনলো আজমলের পা। কিছুটা ছিলে গিয়েছে গোড়ালির কাছটায়। ব্যথা করে উঠেছে।
ইতোমধ্যে দু’জনেই ভিজে গেছে। বৃষ্টির সাথে জোরালো বাতাস থাকায় শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে দু’জনেরই। লম্বা লম্বা পা ফেলে ট্র্যাকের কাছটায় গেল তারা। বৃষ্টির পানিতে মাটি ভিজে কাঁদার সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু তখন বাঁধলো আরেক বিপত্তি। ট্র্যাকের দরজা কিছুতেই খুলছে না। অনেক টানাটানি করেও কিছু হলো না। হতভম্বের মতো একে অন্যের দিকে তাকালো আজমল আর হাসমত। এসব কি হচ্ছে?
এখন এসব ভাবার সময় নেই। বৃষ্টির ঝাপটা থেকে বাঁচা দরকার। নাহয় ঠাণ্ডায় মরতে বসবে দু’জনেই। শেষে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল তারা। উদ্দেশ্য, বড় কোন গাছের নিচে আশ্রয় নিবে। এরই মধ্যে প্রচণ্ড শব্দে বিদ্যুৎ চমকালো। সেই আলোয় ওরা দু’জন দেখতে পেল অদূরেই পুরনো টিনের একটা ছাউনি রয়েছে। সেদিকে এগিয়ে গেল দু’জন।
টিনের ছাউনিটায় ঢুকতেই বোঁটকা এক গন্ধ নাকে এসে লাগলো তাদের। সম্ভবত: অনেক আগে এখানে পশু পালন করতো কেউ। টর্চ জ্বেলে হাসমত দেখতে পেল খড়ের একটা গাঁদাও রয়েছে। 
খুপরিটার ভিটা উঁচু না হওয়ায় সহসাই বৃষ্টির পানি প্রবেশ করতে শুরু করলো। দু’জন তাই বেয়ে বেয়ে খড়ের গাঁদাটার ওপরে উঠলো। বৃষ্টি আর ঠাণ্ডা বাতাস থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে!
কোমড় থেকে পোঁটলা বের করে ফের সিগারেট ধরালো আজমল। শরীরটা একটু গরম করা দরকার।দু’জনেই পুরোপুরি ভিজে গিয়েছে। ভাগ্যিস পলিথিনে মোড়া ছিল সিগারেটটা!
আজমলের যথেষ্ট বয়স হয়েছে। চুল, দাঁড়িতে পাক ধরেছে। হাসমত সে তুলনায় কিছুটা শক্ত সমর্থ। পরনের শার্টটা খুলে পানি নিংড়ে নিল হাসমত। তখনই খড়ের গাদা থেকে টর্চটা নিচে পড়ে গেল। বাইরে তখন প্রকৃতির উন্মত্ত লীলা চলছে। বড় বড় গাছ নুয়ে পড়ছে, ডালপালা ভেঙ্গে পড়ছে। বাতাসের সাঁ সাঁ ধ্বনিতে কান ভোঁ ভোঁ করছিল ওদের।
সিগারেট টানতে টানতে আজমল আপন চিন্তায় ডুবে গেল। ইদানীং এমনটাই হচ্ছে তার। স্মৃতিকাতরতা ভীষণভাবে পেয়ে বসেছে তাকে। একটু আনমনা হলেই নানা চিন্তায় ডুবে যায়। হুঁশ হলে বলতেও পারে না কি ভাবে সে। ভাবতে ভাবতে বহু বছর আগেকার এক স্মৃতিতে চলে যায় সে।
তখন ভরা যৌবন তার। তার ও হাসমতের। টগবগে রক্ত বইছে ধমনীতে। উড়াধুরা জীবন ছিল সেটা। বহু দূর দূরান্তে খ্যাপ মারতে যেত। এমনি একদিন ক্লান্তি আর একঘেঁয়েমি দূর করতে জঙ্গলময় একটা স্থানে গাড়ি থামিয়ে মাল খেল তারা। তারা তিনজন। সে, হাসমত আর অল্পবয়সী একটা ছেলে ছিল সাথে। কি যেন নাম ছিল তার, এখন ভুলে গিয়েছে আজমল। অল্প ক’দিন ওদের সাথে ছিল। ওস্তাদ বলে ডাকতো দু’জনকে।
ফুরফুরে বিকেলে চমৎকার আবহাওয়ায় মাল খেয়ে গামছা বিছিয়ে তাস খেলতে বসলো তারা। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে হঠাৎ আজমল খেয়াল করলো, অল্প দূরেই এক গাছের আড়াল থেকে কিশোরী এক মেয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। দেখে মাথাটা ঘুরে গেল আজমলের। শরীরটা টনটন করে উঠলো। ইশারায় হাসমতকে দেখালো মেয়েটি। অল্পবয়সী ছেলেটাকেও ইঙ্গিত করলো। যেই তারা উঠতে যাবে, অমনি মেয়েটা ছুটতে শুরু করলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। আশেপাশে কোন ঘরবাড়ি নেই। মেয়েটা ছুটতে ছুটতে একসময় মাটিতে পড়ে গেল। মেয়েটাকে বাগে পেয়ে তিনজন আচ্ছামতো ভোগ করলো। সুনসান নীরব চারপাশ। ফেরার সময় তাই মেয়েটার গলা টিপে রেখে এলো। 
মেয়েটার নিথর দেহটার দৃশ্য মনে আসতেই আজমল একটু কেঁপে উঠলো। মেয়েটা কি দোষ করেছিলো?
এতো বছর পর এই প্রশ্ন তার ভেতর জাগরূক হলো হঠাৎ! একটু আনমনা হয়ে গেল আজমল। হাসমত মৃদু ধাক্কা দিলো তাকে। ‘কিরে আজমইল্যা?’
আজমল হাতে ধরা সিগারেটটা এগিয়ে দেয় হাসমতের দিকে। তারপর হাসমতকে বলে, ‘হেদিনের ঘটনা মনে আছে তর, হাসমইত্যা?’
কোনদিন?
হাসমত অবাক হয়ে তাকায়। আজমল বলতে থাকে, ‘গফুরগাঁওয়ে গেসিলাম আমরা। ফিরনের সোমায় জঙ্গলে বইয়া মাল খাইসিলাম... পাশা খেলসিলাম!’
এক ঝটকায় হাসমতেরও মনে পড়ে যায় ঘটনাটা। সে তো ভুলেই গিয়েছিলো সেদিনের কথা!
প্রথম প্রথম কয়দিন ভয় ভয় লাগতো। কিছুদিন বারি গিয়ে থেকে এসেছিলো। কিন্তু আস্তে আস্তে ভুলে গিয়েছিলো একসময়। ৪৩ বছরের জীবনে তো কতকিছুই ঘটেছে! কিন্তু হঠাৎ করে আজমল আবার সেই ঘটনা তুলছে কেন?
‘তয়, কি অইসে?’
হাসমত গম্ভীর কণ্ঠে বলে। সে এসব কথায় আগ্রহী নয়।
‘আমার ক্যান জানি হেই মাইয়াডার কতা মনে পড়তাসে!’ আজমলের কণ্ঠে ভয় টের পায় হাসমত।
‘তর কি মনে অয় হাসমইত্যা, হেদিনের পাপ আমগো এই অবস্থায় টাইন্যা আনসে?’
হাসমত বিরক্ত হয়। সিগারেটে জোরে টান দেয়। বস্তুটা ফুরিয়ে আসছে। বাইরে দুর্যোগ। কোনমতে আশ্রয় নিয়েছে এই খুপরিতে। রহস্যজনক কারণে ট্র্যাকের দরজা খুলছে না। পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে বিরাট গাছের ডাল। এর ভিতর আজমলের এমন উল্টাপাল্টা প্রশ্ন। হঠাৎ বাতাসের প্রতিক‚লে যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়ে মাথার ওপরের পুরনো টিনটা ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ তুলে উড়ে যায়। সেই সাথে ওরা ফের বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে, ঝড়ো হাওয়ায় কাঁপতে থাকে। নিচ থেকে পানি উপচে উঠে খড়ের গাদাও অর্ধেক ভিজে গিয়েছে।
এভাবে কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর ফের আজমল প্রশ্নটা করেত হাসমতকে।
“তর কি মনে অয় হাসমইত্যা, হেদিনের পাপ আমগো এই অবস্থায় টাইন্যা আনসে?”
কাঁপুনিতে ঠক ঠক করে দাঁতে দাঁত লেগে যায় আজমলের।
“দ্যাখ আজমইল্যা, একটার মইদ্যে আরেকটা টানবি না!” হাসমত কাঁপতে কাঁপতে বলে।
এসময় বিদ্যুৎ চমকায়। আলোর বিচ্ছুরণ ঘটলে দু’জন দেখে সাদা কাপড় পড়া অল্প বয়সী একটি মেয়ে বড় বড় চোখ করে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। দু’জনই ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। একে অন্যের দিকে তাকায়। কেউই কিছু বলতে পারে না।
ফের বিদ্যুৎ চমকালে দেখে মেয়েটা আঙ্গুল দিয়ে তার গলার কাছটায় কিছু দেখাচ্ছে। ধবধবে সাদা মেয়েটার গলায় বেশকিছু আঙ্গুলের ছাপ। রাগান্বিত চোখে বাতাসে ভর করে মেয়েটা ওদের দিকে এগোতে থাকে।
খড়ের গাদা ততক্ষণে বৃষ্টির পানিতে ভেসে যেতে শুরু করেছে।


শিল্প সাহিত্য ৬০


এক টুকরো হিটলার
অনিন্দ্যকেতন গোস্বামী

দয়া করে আপনারা গুঞ্জন বন্ধ করুন। ন্যুরেমবার্গের এই বিচার ঘরে সূচপতনের শব্দ এনে দেবো। আমি স্মিরনভ, অকাট্য প্রমাণের পাহাড় ছুঁড়ে দেবো ন্যাৎসী আসামীদের মুখে। আহ্বান করি সেই সব মানুষের আত্মাদের, যারা মাজডানেক, অসওয়েইসিম, বুখেনভাল্ড বা ডাউচে মানুষ পোড়ানোর ফার্নেসে কুঁকড়ে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছেন... আর তারাও আসুক যাদের দেহকে পঁচিয়ে ফেলা হয়েছিলো বাবিয়ার আর খারকভের ভয়ঙ্কর গর্তে। এই আদালত তবেই ঝলসে উঠতো যদি আসামীর পাটাতনে এই শয়তানগুলো পাগল হয়ে যেত। হুজুর, আমি এখানে এ্যালেক্স তলস্তয়ের কথা বলবো ‘লোভ, হীনতা, নীচতা, আর কাপুরুষতার কেন্দ্রিভ‚ত বিশুদ্ধ সারাংশই হলো ফ্যাসিবাদ।’

মহামান্য বিচারক এই ফ্যাসিবাদী কাপুরুষতার তথ্যচিত্র আলোকরশ্মিতে আদালত কক্ষেই দেখাবো- ১৯৪১ । ২৯শে নভেম্বর। রোস্তভ শহরের সম্পূর্ণ রাস্তা জুঁড়ে অসামরিক নাগরিকদের মৃতদেহের ডাঁই। ঐ দেখুন একটি মৃত বালকের উঁচু হাতে একটি পোষা বুলবুলি ছটফট করছে...পাখিটিতে হঠাৎ গুলি এসে লাগলো...গুলি এবং পাখির আত্মা দুজনেই মুক্ত... কি আশ্চর্য তাই না ?

আর ঐ যে স্টেশন চত্বরে দেখেছেন কাঠের গুড়ির মত পাটপাট সাজানো। আসলে ওগুলি কাঠেরগুড়ি নয় মৃতদেহ ডাঁই করে রাখা। যদিও প্রথমে মনে হবে ওগুলি সোভিয়েতের লালবাহিনী কিন্তু ভালো করে কছে গেলে দেখা যাবে সাদা ব্যান্ডেজ দিয়ে হাত পা মাথা মুড়ে এ গুলি একেকটা ন্যাৎসী সৈনিকেরই দেহ। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈনিককে বোঝার মত বয়ে বেড়ানোর চেয়ে মৃত্যুও থেকে সহজতম পন্থা আর নেই...

আরেকটি কক্ষের তথ্যচিত্র দেখুন- ড্যানজিং প্রযুক্তিবিদ্যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কক্ষ। ভ‚গর্ভস্থ মৃতদেহের কবরখানার গুদামে মুন্ডুহীন লাশ বোঝাই হয়েছে। যদিও ন্যাৎসীদের ভাষায় তা কাঁচামাল। মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে কেটে টুকরো টুকরো করে এ্যালকালিনে ডুবিয়ে টগবগ করে ফোটানো হচ্ছে। মানুষের চর্বি দিয়ে সুগন্ধি সাবান তৈরি হবে। পিশাচেরা সাবান মেখে স্নান করে পবিত্র হবে...

কাঠগড়ায় দাড়ানো এনারা আবার গোসা করে থাকেন, মাননীয় মন্ত্রী বা মাননীয় রাইখমার্শাল বা এ্যাডমিরাল না বললে। আমি স্মিরনভ এনাদের কাছে প্রতিবাদী। আমি অবশ্যই এদের বলতে পরি ঠগ, গলাকাটা, খুনী অপরাধী।

গোয়েরিং একটা শিকারী কুকুরের মত। আর বারবারোসা পরিকল্পনায় মেতে উঠেছিলো হিটলারের সাথে। কেইটেল, জডল, জেনারেল ওয়ারলিমোন্ট, সেই লাল দাড়ি শয়তান যার পিপাসাই ছিলো রক্তের...

মহামান্য, বিচারক আমার প্রতিপক্ষের উকিল বন্ধু রুদেনকো সুপরিপাট্য করে আপনাদেরকে জানিয়েছেন...

যদিও ভাবি হিটলারের মতন লোকেরাও উকিল পায়। হাজার হাজার মানুষকে যারা মেরে ফেলে অথবা মারার জন্যে সুপরিকল্পনা করেন, তারাও উকিল পায়...হাঁ হাঁ হাঁ... আমার হাসি পায়... এইসব নাটুকে ভাঁড় রাষ্ট্রনায়কদের দেখলে আমার হাসি পায়... যাইহোক রুদেনকো আপনাদেরকে যা জানিয়েছেন ভালোই জানিয়েছেন...

ঐ পরিকল্পনায় জনসংখ্যা হ্রাস করতে অজস্র গ্যাস চেম্বার, প্রচুর গ্যাসভ্যান, মৃতদেহ ফেলার প্রচুর মৃত্যুফাঁদ, বিষপূর্ণ পানীয় জলক‚প, দুর্ভিক্ষ আর মহামারী....

হুজুর একটু চেয়ে দেখুন মিঃ হেস কি রকম নির্বিকার। কাঠগড়ায় দাড়িয়ে জীবন্ত মানুষ মারার যন্ত্র এখন নির্বিকার। অথচ অদ্ভুত স্বাভাবিক।

একটু পরেই ফন পলাসকে এনে দেবো সাক্ষীর কাঠগড়ায়, যাকে গুম করে রাখা হয়েছিলো আর মিথ্যে মিথ্যে ফন পলাসের শবাধারে জার্মানীর রাষ্ট্রীয় সম্মান দিয়েছিলেন এডলফ হিটলার। ফন একের পর এক সত্যতা দিয়ে ভরে দেবে আপনার কক্ষ

এরপর সত্যতা নামে... একের পর এক সত্যতা নামে সভ্যতার বুক জুড়ে... এবং দীর্ঘ শতাব্দী ব্যাপি নামতেই থাকে... আর একেক টুকরো হিটলারের মুখোশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্রনায়ক নায়িকাদের মুখ ঠেসে....

শিল্প সাহিত্য ৫৫
হাভাতে সময়
কায়েস সৈয়দ

সকাল জুড়ে বৃষ্টি। বৃষ্টির জল কাচের আয়নায় জীবন্ত কুয়াশা। কারো কারো চোখের আয়নায় কু-আশা। জলবিন্দু গড়িয়ে আরেক জলবিন্দু স্পর্শ করতেই বয়ে যায় ¯স্রোতধারা। এই মেঘডাকা সকালেও নড়ে ওঠে দরজার কড়া। আছিয়া। গেরস্ত মহিলা। দুদিন অন্তর অন্তর করে দিয়ে যায় এ বাসার জমানো সব কাজ। ঘর ঝাড়ু, ঘর মোছা, বাসন মাজা, কাপড় ধোয়া, আরও আনুষঙ্গিক। আছিয়া, অল্প বয়সেই গর্ভ ধারণ করে হয়েছে যে বিধবা। বাসায় মা আর এক সন্তান। উপার্জনের মানুষমাত্রই একমাত্র আছিয়া। তাই চার/ পাঁচ বাড়ীর রোজের কাজ দিয়ে পূর্ণ হয় সপ্তাহের তালিকা।

এই বৃষ্টির মধ্যেও বাসার কাজে আছিয়ার সঙ্গী তার ছোট্ট মেয়ে সুষমা। সমস্ত ঘরে পায়ের ছাপ এঁকে দিয়ে অস্থির এক দুরন্ত সময় পার করে সুষমা। মায়ের সাথে কখনো ঘর ঝাড়ু দেয়, কখনো বারান্দায় গাছে পানি দেয়, কখনো বারান্দা থেকে চুপ করে তাকিয়ে থাকে দূরে, কখনো একা একাই কথা বলে বিড়বিড় স্বভাবে।
মোটেও মনোযোগী নয় পড়াশুনায়। মাঝে মধ্যে বই নিয়ে এসে পড়তে বসে এ বাসার মালিকের বউ মেহেরের কাছে। মনে থাকে না তার কিছুই। আজকে যেই eat শব্দের অর্থ খাওয়া কালকে সেটা হয়ে যায় যাওয়া, আজকে যেই bird শব্দের অর্থ পাখি কালকে সেটা হয়ে যায় ফাঁকি। এভাবে রুই হয়ে যায় দুই, তাল হয়ে যায় খাল আর তিন হয়ে যায় মিঃ বিন!
বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলায় তার জুড়ি মেলা ভার। কল্পনা শক্তিও প্রখর। তার গল্প শুনতে শুনতে খেই হারিয়ে ফেলে মেহের। কখনো সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মেঘের সাথে ধাক্কা খায়, কখনো পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আগুনে পুড়ে যায়। তালগোল পাকানো গল্পে বানায় শাপলার সুতো, যেখানে ঝিলের শাপলায় ফুল হয়ে ফোটে কদম্ব, মাছের পুকুরের তলদেশে বুক টান করে হেঁটে বেড়ায় কাঠ ঠোকরা আর তার ছানাপোনা!

আজকের মতো সব কাজ শেষ। বাসার খালাম্মার কাছ থেকে বিদায় নেয় আছিয়া। কে জানতো বৃষ্টির এই কুয়াশার সকালে তার জন্য অপেক্ষা করছে অসময়ের কু-আশা!
গত এক মাসের টাকার সাথে এক হাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়ে করোনা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বাসায় আসতে মানা করে দিলেন খালাম্মা। আছিয়ার চোখে এসে বাসা বাঁধতে চায় সমস্ত কুয়াশা। চুপ করে টাকা নিয়ে গম্ভীর হয়ে ফিরে আসে তার বাসায়। হয়তো তার মাথার চারপাশে ভনভন করছে আগত দিনগুলোর বিবর্ণ সময়। 

পাশের মহল্লাতেই করোনায় প্রথম মৃত্যু।
এক...তিন...ছয়...নয়...
বাড়তে থাকলো করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু।
লক ডাউন হয় পাশের মহল্লা। এরপর সমস্ত পাড়া...জেলা...এখন পুরো দেশ। বলতে গেলে পুরো পৃথিবী!
হাজারো মৃত্যুর স্তুপে ভারী হয়ে ওঠছে পৃথিবী।
জমানো টাকায় ঘুণ ধরে। ফুরোয় সময়।
বাড়ে ভাতের হাহাকার।
ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে বার বার, যাদের ঘর নেই, যাদের নেই কোনো ঠিকানা কিঙবা গন্তব্য ?
ঘরছাড়া কিঙবা ঘরওয়ালা দিশেহারা হাজারো মানুষ পথহারা হয়ে তাকিয়ে থাকে পথেই,
চোখ খোঁজে ত্রানের সন্ধান!

না...
এ পাড়ায় ত্রাণ আসে না। শুনেছে তাদের কমিশনার এখন জেলখানায়, চাল চুরির দায়।
বাধ্য হয়েই আছিয়া হানা দেয় কাজের বাড়ীতে। কড়া নাড়তে সাহস পায় না সে দরজায়। জানালায় এসে ডাক দেয় মিনমিনে গলায়...
খালাম্মা...খালাম্মা...
-কে?
আমি আছিয়া। কোনো কাম কাইজ করা লাগবো খালাম্মা ?
-না বাফু, করোনা শ্যাষ অউক, তারপরে আইয়্যো।

ভিক্ষুক না হয়েও আছিয়ার চোখেমুখে করুণ ভিক্ষুকের আকুতি। আর কোনো কথা বের হয় না তার মুখ থেকে।
উচ্চস্বরে মনে মনে সমস্ত শক্তি দিয়ে বলে যায় তার সমস্ত অভিযোগের কথাগুলো-
‘সবাই খালি করোনার কতা কয়, খালি গরে থাকতে কয়, খামু কইত্তে হেইডা কয় না! করোনা ছাড়াই গরে থাইক্যা না খাইয়্যা যে মইরা যামু হেইডা কেউ বুজে না’
আছিয়ার মাথায় ভনভন করে দুঃসময়ের মাছি
মলিন হয়ে তার দৃষ্টি চলে যায় সুষমার মুখে
সুষমার মুখের চারপাশজুড়ে এখন হাভাতে সময়

শিল্প সাহিত্য ৪৯  সোমবার ১৮ই জ্যৈষ্ঠ ১৪২৭, ১লা জুন ২০২০

রহিম উদ্দিন
গল্পটি করুণার

আজ যে গল্পটি বলবো এটা কেবল করোনার গল্প নয়; করুণার গল্পও বটে। সরকারি একটা চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের প্রায় সবজায়গায় গিয়েছি এটা বলতে না পারলেও প্রায় সব উপজেলার মানুষের সাথে মিশেছি এটা বলতে পারি। পৃথিবীতে মানুষের শ্রেণিবিভাগ সে অনেক আগে থেকেই চলে এসেছে। তবে, এই শ্রেণিভেদের কাছে আমাদের মানবিকতা কখনো কখনো উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে দাড়ায়। আবার সেই মানবিকতার  মৃত্যুতে কখনো কখনো মানুষ হয়ে যায় কুকুর হায়েনার চেয়েও ঘৃণ্য ও জঘন্য রকম খারাপ। বাংলাদেশ সরকার করোনার মহামারি থেকে বাঁচার জন্য দশদিনের জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে দেখে অনেকেই এখন গ্রামের বাড়িতে কিংবা ঢাকা শহরের বাসায় কার্যত গৃহবন্দী। আমরা চাকুরেরা আছি চাকরিরত। গতকাল আমিও আমার দলের সকলে টহলে বের হয়েছি। সরকারের পক্ষ থেকে আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গণপরিবহন লকডাউনের পাশাপাশি সকল প্রকার দোকানপাট ও বিপনি বিতান বন্ধ থাকবে। তবে, সেক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় দব্য ও ওষুধের ফার্মেসি এবং সরকার ঘোষিত কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। আমরা সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক স্থানীয় প্রশাসনকে সহয়তার জন্য একসাথে কাজ করার জন্য মাঠে নেমেছি। আমরা যখন টহলে বের হয়েছি, আমাদের দলের নেতৃত্বে দিচ্ছিলেন উপজেলা কর্মকর্তা জিন্নাত আরা। আমরা কিছুদূর হেটে কিছুদূর গাড়িতে, এইভাবে স্থানীয় রাস্তাঘাট ও বাজার এলাকায় টহল দিচ্ছি। পুরো এলাকা জনমানব শূন্য, নেই কোন শহুরে গোলমেলে বেসুরে শব্দ ও সমাগম, নেই কোনা গাড়ির হর্ন,  বিরক্তির সাইরেন। যেতে যেতে আমরা ঢুকে পড়লাম স্থানীয় একটা বাজারের পথে। দলের ম্যাজিস্ট্রেট পাওয়ার প্রাপ্ত উপজেলা কর্মকর্তা নির্দেশ দিলো সবাইকে বাজারের একটু আগেই গাড়ি থামাতে। বাকিটা পথ আমরা বাজার পর্যন্ত হেঁটে যাবো। কেননা, গাড়ির শব্দে স্থানীয় কেউ যদি বাজারে জমায়েত করে কিংবা বিনা প্রয়োজনে ঘুরাফেরা করে তারা সরে যেতে পারে। আমরাও নির্দেশ মতো গাড়ি থামিয়ে নেমে গেলাম। লোকজন আমাদের দেখে বুঝতে পেরেছে। কেউ কেউ কেনাকাটা করছে। কেউ বা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে বাড়ির পথে কিংবা আড়ালে পা বাড়িয়েছে।  হঠাৎ আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হয় দুইজন বৃদ্ধ লোক। আমরা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার আগে ম্যাজিস্ট্রেট এগিয়ে গেলো তাদের দিকে।

ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞেস করল, ‘এই আপনারা এখানে ঘুরাফেরা করছেন কেন?’
বয়স্ক বৃদ্ধলোক দুটির মুখে তখন কোন কথা বের হচ্ছে না।

এই পরিস্থিতিতে কথা বের না হওয়া স্বাভাবিক।   আর্মি পুলিশ একসাথে। তাদের সামনে যদি অন্য বড় মাপের একজন অফিসার গ্রামের একজন সাধারণ মানুষকে নিজের নামও জিজ্ঞেস করে, সেক্ষেত্রে তার কাছে আমতা আমতা করা ছাড়া উত্তর দেবার মত হিতাহিত জ্ঞান কিংবা শক্তি থাকে বলে মনে হয় না। তাদের নিরবতা দেখে জিন্নাত আরা খুব রাগান্বিত হয়ে উচ্চস্বরে বলল, কান ধরো, কান ধরো দুজনে।

কথাগুলো শুনে, বয়স্ক বৃদ্ধলোক দুটির তখন শরীর প্রায় অবশ হয়ে আসছিলো। চোখ জোড়া তাদের ধীরে ধীরে লাল হয়ে এলো। তারা কে কী করবে ভেবে না পায়। এমন সময় ম্যাজিস্ট্রেট আবারো চেচিয়ে উঠলো, এখনো কান ধরেননি?

অসহায় বৃদ্ধ লোকদুটি মাথা নিচু করে নিজেদের কান ধরেছে। রক্তাক্ত চোখ দিয়ে অঝোরে জলের স্রোাত বইছে। শিশিরের রাতে টিনের চাল বেয়ে টুপ টুপ শব্দে ঝরে পড়া স্বচ্ছ জলের মতো, দু’জোড়া চোখের পবিত্র পানি ঝরছে ভাঙ্গা চোয়ালের দুপাশ বেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট তখন নিজের মোবাইলে তাদের কয়েকটা ছবি তুলেছে। ভিডিও করেছে। তারপরও, তাদের এভাবে দাঁড়িয়ে রেখে সামনে দিকে হাঁটা শুরু করেছে। আমি এতক্ষণে লোক দুটির সামনে আসতে পারলাম। ম্যাজিস্ট্রেট, অনেক দূর এগিয়ে প্রায় অন্যদিকে মোড় নিয়েছে।

আমি বললাম, চাচা, কান ছাড়েন। হাত নামান। যদিও তাদের একজন কে জিজ্ঞেস করলাম, কী নাম আপনার?
বললো, দবির উদ্দিন।
চাচা, আপনারা জানেন, ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ, তারপরও বের হয়ে কয় গেছেন?
বাজান, আমরা গরিব মানুষ, ঘর থেকে বের না অইলে খামু কী? ঘরে যা খাওন আছে, কোন রহমে আইজকে রাইত চলবো। তাই, নামায পড়ে বাজারে আইলাম, দেখি, কেউনি কোন কাজে ডাহে। তো, বাজান, তোমরা আমাদের যে শাস্তি দিয়েছো, তা আমরা মাথা পাইতে নিলাম। আমাদের তারপরও কোন কাজকাম দিবানি? না হলে,আমাদের যে না খাইয়া মরা লাইগবে।

এতক্ষণ, চাচার চোখের পানি দেখেছি, এখন আমার চোখের কোণেও জল জমেছে, নোনাজল। আরেকটু হলে ঝরে পড়বে, বাধভাঙ্গা পানির স্রোতের মতে অঝোরে।
বিষয়টি বুঝতে পেরে শুধু এতটুকু বলেছি; ‘চাচা, চলি’ আর নিজের অপারগতা ও সীমাবদ্ধতা রেখার দংশনে দংশিত হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করেছি, এই আমি শোষক না শোষিতদের দলে।

শিল্প সাহিত্য ০৯  বুধবার ৯ই বৈশাখ ১৪২৭, ২২ই এপ্রিল ২০২০

জামা

আমিনুল ইসলাম সেলিম

 

নূরগঞ্জ প্রতিনিধি অনন্য জাহেদ মাউথপিস নিয়ে প্রস্তুত। তার গায়ে মোটা পিপিই, মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক, হাতে গ্লাভস। প্রেস টিভির সংবাদ উপস্থাপিকা ইরিকা জান্নাত বলছেন-দর্শক, এই মুহুর্তে আমাদের নূরগঞ্জ প্রতিনিধি জাহেদ রয়েছেন নবপল্লী ইউনিয়ন পরিষদের সামনে যেখানে চাল চুরির অপরাধে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে চেয়ারম্যান মোদাচ্ছের হাওলাদারকে। জাহেদ, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? -জান্নাত, আমি শুনতে পাচ্ছি। জাহেদ রিপোর্টিং শুরু করলেন। জান্নাত এবার মূল প্রশ্নে এলেন, -জাহেদ, আপনি কি আমাদের বলতে পারবেন, গণপিটুনির সময় হাওলাদারের পরনে কী ছিলো? -হ্যাঁ জান্নাত, ধন্যবাদ। আসলে আমি যেটা বলতে চাচ্ছি আসলে, সেটা হলো, মানে, এলাকাবাসী এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা আমাকে যেটা আসলে বলছিলেন, তাতে আসলে এটা বোঝা যায়, আসলে তার পরনে যা ছিলো, তা কারো আসলে দৃষ্টিগোচর হয়নি। -জাহেদ, জাহেদ আপনি থামেন। আপনি কি বলতে চাচ্ছেন- তিনি, মানে আমার বলতে খুব লজ্জা করছে, মানে তিনি কি উলঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন? -না জান্নাত। বিষয়টা আসলে রকম নয়। আসলে, আমাকে আসলে একজন প্রত্যক্ষদর্শী যেটা বলছিলেন, সেটা হলো- তার পরনে আসলে কোনো কাপড় ছিলো না। বিষয়ে আমি আসলে জানতে চাইলে একজন আসলে আমাকে জানাচ্ছিলেন যে, তাকে আসলে উলঙ্গ হয়েছিলেন বলা ঠিক হবে না আসলে...’ জান্নাতের মেজাজ কিছুটা লাফালাফি করে। উপরে নিচে। তিনি বলেন, ‘আহা জাহেদ, কী বলছেন বুঝতে পারছি না! আচ্ছা, আমাদেরকে আপনি কি এটা বলতে পারবেন, মানে, যে লোকটা আপনাকে বলেছে যে, চেয়ারম্যানকে উলঙ্গ হয়েছিলো বলা যাবে না, সে আসলে চেয়ারম্যানের সহযোগী কিনা এবং চেয়ারম্যান বিষয়ে তার আর কী বক্তব্য ছিলো? জাহেদ... -হ্যাঁ, জান্নাত। না, মানে তারা, মানে লোকটিসহ অন্য আরও কমপক্ষে তিনজন আসলে আমাকে নিশ্চিত করেছেন যে, তার পরনে আসলে অনেক আগে থেকেই আসলে কাপড় ছিলো না। এবার উপস্থাপিকা পুরোপুরি বিরক্ত। -আচ্ছা জাহেদ, থামেন। আমরা জানতে পেরেছিলাম যে চেয়ারম্যান পলাতক রয়েছেন, আপনি কি জানতে পেরেছেন, তিনি কোথায় পলাতক রয়েছেন? জাহেদ, জাহেদ, হ্যালো, হ্যালো, জাহেদ, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? -অপর প্রান্ত থেকে স্পষ্ট কোনো সাড়া না পাওয়ায় লাইন কেটে দিয়ে ইরিকা জান্নাত আবার দর্শকমুখি হলেন, -দর্শক, আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, আমাদের প্রতিনিধি কী বলতে চেয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, তার পরনে অনেক আগে থেকেই কাপড়, মানে জামা ছিলো না। তাহলে একটা কাপড়হীন লোককে গণপিটুনি দেয়া কতোটা যুক্তিসঙ্গত, আমাদের অবশ্যই ভেবে দেখা উচিত। দর্শক, আমরা এবার একটা ছোট্ট 'চুতরা পাতার বিড়ি' ব্রেক নিচ্ছি। ফিরছি আরও সঙবাদ নিয়ে। সঙ্গেই থাকুন।

শিল্প সাহিত্য ০৮  মঙ্গলবার ৮ই বৈশাখ ১৪২৭, ২১ই এপ্রিল ২০২০

পরিচয়ের খোঁজ
ইসরাত জাহান আঁখি

বাংলাদেশে বর্তমানে সাড়ে ষোল কোটি জনসংখ্যার মধ্যে তিন কোটি আঠাশ লাখ মানুষ দারিদ্র্যতায় ভুগছে। তারই মধ্যে সুজন একজন। একদিন সম্ভবত দুই থেকে আড়াই বছর পূর্বে নতুল্লাবাজ এর রাস্তা পেরিয়ে বাসা এর দিক আসছি। হঠাৎ এক বিচ্ছু বাহিনীর দল রিকশার সামনে এসে রিকশা থামাল। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম 'তোমরা কী কিছু চাও?' তারা ক্ষাণিক সময় চুপ থাকার পর তাদেরই মধ্যকার এক বালক আমার দিকে আগালো। মনে হলো সে- বুঝি দলের দলনেতা। পার্স ব্যাগ দিয়ে বলল 'আফা এই ন্যান ওহানে পইড়া গ্যাছেলো। দ্যাহেন সব আছে কিনা। আমাগো ঘরে আইজগো খাওনের লইগা টাহা আছে। জানেন তো অভাবে স্বভাব নষ্ট।' 'দেখা লাগবে না। তোমার নাম কী?' সঙ্গে সঙ্গে হাসির যেন তোড় পরে গেল। হতভম্বি হয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলাম 'তোমার পরিচয়টা কী?' কিছু না বলেই মন খেয়ালে চলে যেতে লাগল। ওদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম যেন কোন কিছুর সন্ধান করছি। দলের কে যেন বলে উঠল 'সুজন, দ্যাখ দ্যাখ, মেমসাহেব এদিকে তাকাইয়া আছে।' অতঃপর সুজন অদ্ভুত হাসিতে মুখ ফিরিয়ে বলল 'মেমসাহেব দুই বছর পর কমু...' আমি যেন সেই হাসিতে রহস্য খুঁজে পেলাম।
আমি বরাবরই বেশ কৌতুহলি। তাই ওদের দলকে অনুসরণ করলাম। নতুল্লাবাজের একটা বস্তিতে ঢুকলাম অনুসরণ করতে করতে। এতটা গোলমেলে স্থান বসতের জন্য হতে পারে আগে কখনো ভাবিনি। হারিয়ে ফেললাম ওদের দলকে। তবে একজনকে বলতেই সামনের দিকে ইশারা করল। হঠাৎ কিছু লোক ছুটে আসছে এইদিকে। কিছুটা হতচকিত। তবুও দিকেই আগাচ্ছি। কয়েকজন বাসিন্দা ডাক দিয়ে বলল 'ওদিকে যাইয়েন না ঝামেলায় পরবেন।' তবুও যে আমার মাথার সেই কৌতুহলের সে তো দমে থাকতে নারাজ। কয়েক পা এগোতেই এক বয়স্ক বৃদ্ধা ডেকে বলে 'ওদিকে যাও কই মা? তুমুল কান্ড হইতেছে সামনে।' বৃদ্ধার কথা ফেলতে না পারায় কৌতুহলকে দমিয়ে রাখলাম। এরপর অবশ্য একবার খোঁজ নিয়েছিলাম বটে। শুনেছি সেদিনের দাঙ্গায় ছেলেটা মারামারি থামাতে গিয়ে আহত হয়েছে। একবার দেখতে যাব ভেবেছিলাম তবে তা হাজারো ব্যস্ততার মাঝে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
এবার যখন করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে তখন আমরা কয়েকজন একটা সংগঠন দিয়ে দরিদ্রদের সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। বস্তিতেও গেলাম। সেখানে যেতেই সেদিনের কথা স্মরণ হলো। বোধ হয় কোন এক সুপ্ত আকাক্সক্ষা ছিল রহস্যের কিনারা করার। রিমি, সুইটি, রুপম ওদেরকে বলে আমি একাই সামনের দিক আগালাম। একটা শিশুকে বলতেই সে সুজনের বাড়ির দিক নিয়ে যেতে রাজি হলো। শিশুটি সাথে ক্ষুদ্র সময় এর ভিতর ভারি ভাব জমলো। সে বয়সে ছোট তবে বেশ চালাক। সুজনের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই এক প্রশংসার ঝুলি ধরিয়ে দিল। আমারও অবশ্য মনে হয়েছিল ছেলেটি ভদ্র। সুজন যে এই বস্তিবাসিদের কাছে খুব প্রিয় তা বুঝতে আর অন্ত রইল না। তবে ওকে দেখার পর ভারি দুঃখ হলো। সেদিনের হাঙ্গামায় ওর এক পা পঙ্গু হয়ে গেছে। হৃদয় বিদারক কাহিনীর কাছে আমার কৌতুহল বড্ড ফিকে ছিল।

ভাবিনি সুজন আমায় দেখে চিনতে পারবে। দেখেই বলে উঠল, 'আফা পরিচয়ের খোঁজে ঠিক আইছেন। আমনে তো টিভিতে যারা মাইক হাতে লইয়া কথা কয় হ্যাগো মতোন। আমি দেখছি যে আমনের মতৌ এইরম কইরাই খবর নেয়।' 'ওস্তাদ, যে মতিন মিয়ার খুনের সময় আইছেলে?' ' তুই এহন যা আফার লইগগা চা লইয়া আয়।' 'তোমার আমার কথা মনে আছে?' 'মনে থাকবে না আবার! দিনের কোন কথা ভুলা যায় মেমসাহেব!' মনে হচ্ছিল ওর হাসিতে আমি কান্না খুঁজে পাচ্ছি। ঐদিনের সকল ঘটনা শুনে ভাবলাম হয়তো বা ওকে না খুঁজে পেলেই ভালো হতো। সমাজকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল, গরিবরা কী মানুষ নয়? এতো চিকিৎসা সেবা সবই ওই টাকাওয়ালা ক্ষমতাওয়ালাদের জন্য তৈরি? তা না হলে কেন সুজনকে চিকিৎসার অবহেলায় আজ পঙ্গু থাকতে হবে?' আফা, শোনলাম আমনেরা নাকি আমাগো দান করতে আইছেন? আগে এমপি মন্ত্রী চেয়ারম্যান-মেম্বারগো দিয়া আন্। কত গরিবই তো মরতেছে আমরা না হয় আরো কজন করোনা আর খিদার জ্বালায় মরমু। এই কথার উপর ঠিক কী বলে শান্তনা দেয়া যায় বুঝে উঠতে পারছি না। তাই কিছু না বলেই সুজনের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম। সুজন তার যন্ত্রণাকৃত পা নিয়ে বাইরে এসে ডাক দিয়ে বলল 'আফামনি, আমার জানতে আইয়া না জাইনাই চইলা যাইতেছেন। শোনেন, আমার মতো মানুষদের পরিচয় একটাই, আমি গরিব।
 
শিল্প সাহিত্য ০৫  শনিবার ৫ইা বৈশাখ ১৪২৭, ১৮ই এপ্রিল ২০২০
Rxe‡bi gnvRb
KvRx eY©vX¨
B`vwbs gvby‡li mv‡_ gvby‡li m¤ú‡K©i evjvB bvB| †h hvi g‡Zv Pj‡Q| `yB nv‡Z Mv‡Qi †QvU `yBUv Wvj wb‡q G‡jvcv_vwi Zvj evRv‡Z evRv‡Z eUZjv †_‡K evRv‡ii w`‡K †n‡j`y‡j hv‡”Q eiKZ| GjvKvi †jvKRb Zv‡K 'eiKBËv cvMjv' †W‡K kvwšÍ cvq| †K wK WvK‡jv, †K wK Ki‡jv eiK‡Zi Zv‡Z wKQz Av‡m hvq bv| ivM †µvanxb eiKZ `uvZ bv gvR‡jI GKUv ¯^M©xq nvwm w`‡q cwi‡ek‡K memgq ZiZvRv iv‡L| ¯^vaxb evsjvi GKgvÎ ¯^vaxb hyeK eiKZ| GKvËy‡ii ci Rb¥ wb‡jI †m e‡j _v‡K †kL gywRe Zvi KwjRvi eÜz| `yBRb GKmv‡_ gvQ ai‡Zv, jvwUg †Lj‡Zv, wWMevwR w`‡q cy®‹ywb‡Z †Mvmj Ki‡Zv| eiKZ hLb Lye †QvU GjvKvi gvbyl ZLb †_‡KB Zv‡K wP‡b| †QvUKvj †_‡KB evRv‡i Zvi RbwcÖqZv Zz‡½| †KD †KD eiK‡Zi jyw½ a‡i Uvb gv‡i| Zv‡Z eiKZ wKQyUv jw¾Z n‡q wRnŸvq Kvgo w`‡q wbR nv‡Z jyw½Uv‡K ¸wQ‡q †bq| †KD †KD gvqv K‡i `y‡qK UvKv †`q, †KDev AvwKR wewo wK‡b †`q, †KD iæwU-we¯‹yU-Kjv| hvi hv g‡b Pvq eiK‡Zi mv‡_ †m Zv-B K‡i| G‡Z eiK‡Zi †Kv‡bv Avb›` ev `ytL wKQyB nq bv| eiKZ‡K †KD cy‡ivcywi Avb‡›`i fvM †`q bv GUv †hgb mZ¨, Avevi eiKZ‡K †KD cy‡ivcywi `ytLI †`q bv GUvI mZ¨| eiKZ‡K †`‡L Avgvi GKUz gvqv RvM‡jv| Rwm‡gi †`vKvb †_‡K GKUv iæwU wK‡b eiK‡Zi nv‡Z w`jvg| eiKZ iæwUUv nv‡Z wb‡q †`L‡jv Zvi nv‡Zi ˆZj PKPK iæwUUvi w`‡K wZb w`K †_‡K wZbUv KzKzi ZvwK‡q Av‡Q| wØZxq †Kv‡bv wPšÍv bv K‡iB iæwUUv‡K wZb fvM K‡i eiKZ wZbUv KzKz‡ii w`‡K Qz‡o gvi‡jv| Avwg AevK †Pv‡L ZvwK‡q _vKjvg| hvi wb‡Ri Lvev‡ii wbðqZv bvB †m wKbv GB `~w`©‡b Afz³ KzKzi‡K wb‡Ri cy‡iv fvMUvB w`‡q w`‡jv| wZbUv KzKzi †h Abvnv‡i fzM‡Q G‡Z m‡›`n bvB| MZ mßvI G‡`i g‡a¨ †ek jvdvjvwd SuvcvSvwc wQ‡jv| AvR †`wL †Kgb iæMœ gwjb gyL| †c‡Ui PvgovI wg‡k hv‡”Q ey‡Ki nvo-nvwÇi mv‡_| eiKZ KzKzi¸‡jvi iæwU LvIqvi `…k¨ †`‡L wgwUwgwU nvm‡Q| eiK‡Zi evwo †Kv_vq, evc gv †K| Gme Z_¨ gvby‡li ARvbv| gvbyl †Kej eiKBËv cvMjv‡KB wP‡b, Rv‡b| GKevi evRv‡ii Ggv_v †_‡K Igv_v Avevi Igv_v †_‡K Ggv_v hvIqv Avmv Kiv †jvKUvi bvgB eiKZ| †Kv‡bv †Kv‡bv mgq `y‡qK Rb‡K Pv‡qi KvcUv GwM‡q †`q| wewo dzK‡Z dzK‡Z †`vKvb`vi‡`i `y‡qK Kjwm wUDeI‡q‡ji cvwb G‡b †`q| Gfv‡eB †K‡U hvq eiK‡Zi mvivw`b| ivZ Mfxi n‡j evRv‡ii †h †Kv‡bv †`vKv‡bi eviv›`vq Nywg‡q _v‡K eiKZ| nVvr evRv‡I ˆn-û‡jøvi ïiæ n‡q †M‡jv| mK‡ji Zvovû‡ov †`vKvbcv‡Ui mvUvi bvgv‡bvi kã| GKRb Av‡iKRb‡K ej‡Z jvM‡jv 'evwoZ hv evwoZ hv'| Avwg I Lv‡qi ¯‹zj †M‡Ui †`qv‡j †¯øvMvb wjwL‡ZwQ 'wbivc` `~iZ¡ eRvq ivwL m`v my¯’-mej _vwK' evRv‡ii cwðg w`K †_‡K GKUv ûB‡k‡ji kã Avm‡jv| eªv‡k jvj iO wb‡q Avwg †¯øvMvb †jLvq g‡bv‡hvM| Lv‡qi Avgvi Kv‡bi Kv‡Q gv_vUv evwo‡q g„`y¯^‡i ej‡jv 'fvB `y-wZb‡U †mbvevwnbxi Mvwo Avm‡Z‡Q'| Avwg Nvo wdwi‡q ZvwK‡q †`Ljvg Mvwo †_‡K ˆmwbKiv †b‡g gvbylRb‡K wK †h‡bv ej‡Q| Avi cywj‡ki K‡qKRb K݇Uªej †Lvjv †`vKvb, wi·v, wmGbwR I evRv‡i Rgv‡qZ gvbyl‡K jvwVPvR© Ki‡Q| mevB †`uŠov‡”Q wb‡Ri g‡Zv| Lv‡qi Avgv‡K ej‡jv 'fvB P‡jb AvgivI hvB| cywjk Avm‡j mgm¨v'| Lv‡qi‡K eySvjvg 'Rxe‡bi SzwK wb‡q Avgiv gvby‡li m‡PZbZvi j‡¶¨ KvR KiwQ| fq †cI bv| cywjk Avm‡j Avwg K_v ej‡ev|' ZZ¶‡Y †`Ljvg eiK‡Zi mv‡_ `yRb †mbv‰mwbK K_v ej‡Q| †`Ljvg eiK‡Zi nv‡Z GKRb ˆmwbK GKUv cyUjv w`‡jv| eiKZ cyUjvUv Avevi †diZ w`‡q w`‡jv| `~i †_‡K mv`v jyw½ cov †g¤^vi mveI †`L‡Q G `…k¨| †g¤^vi mv‡ei w`‡K Avgvi †PvL †h‡ZB g‡b g‡b GKLvb Mvwj w`jvg 'evBÂz`| Mix‡ei nK gvBiv LvBqv kix‡i †Zj‡Zjv fve Avb‡Qvm! kvjv Pvj †Pvi, Wvj †Pvi| †Pv‡ii ev”Pv †Pvi| wKfv‡e `yBUv WvKvBËv †PvL †ei K‡i eiK‡Zi cyUjvi w`‡q bRi w`‡Q|' A_P eiKZ ˆmwb‡Ki †`qv cyUjv ˆmwbK‡KB wdwi‡q w`‡jv| ZZ¶‡Y eiKZ †h cvMj ˆmwbK‡`i Zv eyS‡Z Avi evwK _vK‡jv bv| Ab¨Rb wK †h‡bv weoweo K‡i e‡j eiKZ‡K GKUv gv¯‹ w`‡jv| nvwmgy‡L eiKZ gv¯‹Uv‡K MÖnY Ki‡jv| gv¯‹Uv‡K gy‡L bv w`‡q eiKZ evg nv‡Zi Kwâ‡Z evjvi g‡Zv eva‡Z eva‡Z cy‡e †ijjvB‡bi w`‡K P‡j †M‡jv| ZZ¶‡Y Avgvi †¯øvMvb wjLvI †kl| K‡qKRb †mbv‰mwbK †`L‡jv Ges GKUz kã K‡i †¯øvMvbUv co‡jv| Avgv‡`i w`‡K GKUz ZvKv‡jv wKš‘ wKQzB ej‡jv bv| AvgivI axi cv‡q †n‡U †ijjvB‡b wM‡q †`wL †ijjvB‡bi cv‡ki Wzgyi MvQZjvq eiKZ ï‡q nvm‡Z‡Q| nvm‡Z nvm‡Z ¯^vfvweK k‡ã eiKZ ej‡Z‡Q 'gvbyl me cvMj nqv †M‡Q| GZw`b †`KZvg Miæ-gB‡li gy‡n †Uvcv Avi Anb †`wn gy‡n †Uvcv cBiv gvbyl¸jv me Miæ-gBl nqv hvBZv‡Q|' Avwg eiK‡Zi Kv‡Q †Mjvg eiKZ AbM©j nvm‡Q| nvm‡Z nvm‡Z emšÍ we‡K‡ji g„`y nvIqvq eiK‡Zi †PvL eÜ n‡q Avm‡jv| nv‡Z nv‡Z evnvwi m`vB wb‡q mK‡jB evwo wdi‡Q| Qz‡U hv‡”Q †h hvi wbw`©ó LuvPvq| eiKZ ¯^vaxb evsjvi GKgvÎ ¯^vaxb hyeK| weoweo Ki‡Z Ki‡Z Pvj LywUnxb N‡i cv‡qi Dci cv Zz‡j Nywg‡q †M‡jv ZvjvPvwenxb gy³ Rxe‡bi gnvRb 'eiKBËv cvMjv'|

শিল্প সাহিত্য ০৪  শুক্রবার ৪ঠা বৈশাখ ১৪২৭, ১৭ই এপ্রিল ২০২০
gvqv
†gvnv¤§` Rwmg
Nyg fvO‡ZB GK Qz‡U Iqvkiæ‡g- bv Kivi g‡Zv †Kvbg‡Z eªvk K‡i gy‡L cvwbi SvcUv w`‡q †eWiæ‡g wd‡i G‡jv AvwbKv|
Zvi gb GLb bZzb Avb›`, D‡ËRbv I f‡qi †`vjPv‡j `yj‡Q|
wP‡ji g‡Zv †Quv †g‡i mvBW e¨vMwU Zz‡j wb‡jv †m| MZiv‡Z ¸wQ‡q ivLv RvgvKvco Avi UzKUvK `iKvwi wRwbmcÎ G‡K G‡K e¨v‡M fi‡Z jvM‡jv| mewKQy fiv n‡q †M‡j GKUz nuvd †Q‡o evuP‡jv †hb| PzcPvc `uvwo‡q fve‡Z jvM‡jv wKQz ev` co‡jv wK bv|
evievi Nwo †`L‡Q AvwbKv| Nwo‡Z ZLb 5Uv 23|
GZUzKz e¨v‡M Lye †ewkwKQy †bqvi my‡hvM †bB| MZ Rb¥w`‡b evevi †`qv njy` †WªmwUi Rb¨ gbLvivc nq AvwbKvi| †WªmwU‡K †ei K‡i e¨v‡Mi cv‡k ivL‡jv †m| gbLvivc n‡jv `v`xgvi †`qv Rwicvo †giæb kvoxwUi Rb¨| †mwU‡KI G‡b nv‡Zi Kv‡Q ivL‡jv|
mg‡qi mv‡_ mv‡_ evo‡Z _v‡K gbLviv‡ci gvÎv| G evwo‡Z Avi †Zv †divi m¤¢vebv †bB, A_P-¯§„wZweRwoZ gvj-mvgvb¸‡jv †hb Ki‡Rv‡i wgbwZ Ki‡Q m‡½ hv‡e e‡j| AvwbKvI Zv‡`i‡K nvZQvov Ki‡Z Pvq bv|
AvwbKvi ¯§„wZKvZi †Pv‡Li mvg‡bB ÿz`ªvqZb e¨vMwU †hb f~uBqvevwoi eo `xwN n‡q hvq! AvwbKv †Nv‡ii g‡a¨ `v`yi †`qv bxj d«K, fvBqvi †`qv †gKvc e·, gv‡qi †`qv Mnbv, Rb¥w`‡b cvIqv K‡qKwU wcÖq Dcnvi, wcÖq †jLK‡`i eB; Ggb A‡bK wcÖq wcÖq wRwbm R‡ov Ki‡Z _v‡K| wKš‘ e¨vMwU †m¸‡jv wMj‡Z A¯^xKvi Ki‡Q Zxeªfv‡e|
evB‡i cvwL WvK‡Q| cvwL‡`i GB WvK AvwbKvi Lye wcÖq, Av‡iv wcÖq GB evwoUv| evwoi Qv` Avi KvVev`vg Mv‡Qi mv‡_ Szj‡Z _vKv †`vjbv| Avi G evwoi gvbyl¸‡jv? Zviv wK Kg wcÖq?
AvwbKv _g‡K `vuovq| gb e`‡j hvq| †dvb ev‡R| iæ`« †dvb w`‡q‡Q|
AvwbKv †dvbwU wiwmf K‡i| e‡j—m¨wi iæ`ª, Avwg AvmwQ bv| Avgv‡K †c‡Z n‡j evev-gv‡K ivwR Kiv‡bvi †Póv K‡iv|

Pvj †Pvi
iwdKzj bvwRg
GK`g nv‡Z bv‡Z aiv c‡o‡Q| ZvI Ggb gnvgvixi w`‡b!hLb c…w_exi me gvbyl Bqv bvdwm Bqv bvdwm Ki‡Q|wVK ZLb †nwKg †g¤^v‡ii N‡ii †g‡S †_‡K G‡K G‡K Îv‡Yi AvVv‡iv e¯Ív Pvj D×vi K‡i‡Q cywjk|evZv‡mi MwZ‡Z LeiUv Qwo‡q †M‡jv cy‡iv kvwšÍinvU MÖv‡g| †jvKRb †`uŠ‡o Avm‡Q †g¤^v‡ii evwo w`‡K|B‡Zvg‡a¨ Le‡ii KvMR I wUwfi †jv‡KivI P‡j G‡m‡Q| †KD †KD cy‡iv NUbv †gvevBj jvB‡f cÖPvi Ki‡Q|
`y'Rb Kb‡÷ej †nwKg †Pviv‡K Miæi `wo w`‡q †eu‡a †i‡L‡Q| Kyievwbi Miæi g‡Zv MÖvgevmx Zv‡K AvMv‡Mvov †`L‡Q| †g¤^v‡ii mKj Kv‡Ri mnKvix gwR` †nwKg‡K Kv‡bgy‡L ej‡jv,'KBwQjvg ûRyi,GB MR‡ei wf‡Î Pzwi KB‡ib bv| ûb‡Qb Avgvi KZv?hvb,Gnb †R‡j wMqv cuBPv g‡ib|' gv_v wbPz K‡i jvwU‡gi g‡Zv wSg a‡i Av‡Q †nwKg| nVvr †m gwR‡`i UzwU †P‡c a‡i,'nvivwgi ev”Pv gwR`, ZzB Avgvi j‡M Bgyb wbgyKnvivwg Ki‡Z cviwj?'

শিল্প সাহিত্য ০৩  বৃহস্পতিবার ৩রা বৈশাখ ১৪২৭, ১৬ই এপ্রিল ২০২০
cuvwPj
†mvgbv_ †ewbqv
bbx mvnvi evwo‡Z cvovi G-`j G‡m ej‡jv, KvKz evwoi evB‡ii cuvwPj PzbKvg Kiv‡eb bv| ï‡b bbxevey AvgZv-AvgZv K‡i ej‡jb, †Kb ej‡Zv! gv‡b, wVK eyS‡Z cvijvg bv|
- LyeB mnR KvKz| Avcwb bv Ki‡j Avgiv K‡i †`‡ev| kZ© ïay GKUvB| IB PzbKv‡gi Dci Avgv‡`i cvwU©i cÖwZwbwai bvg _vK‡e| mvg‡b wbe©vPb, eyS‡ZB cvi‡Qb| bbxevey †`L‡jb GB my‡hvM| ej‡jb, wVK Av‡Q| Z‡e kZ© n‡jv †fvU wg‡U hvIqvi ci Avevi PzbKvg K‡i cÖwZwbwai bvg gy‡Q w`‡Z n‡e| G-`j k‡Z© ivwR n‡q †Mj|
iv‡Z cvovi we-`j G‡m GKB cÖ¯Íve ivL‡jv Ges bbxevey G-`j‡K hv e‡jwQ‡jb, we-`j‡K GKB K_v ej‡jb| we-`jI k‡Z© ivwR n‡q †Mj|
G-`j h_vixwZ cuvwPj PzbKvg K‡i c‡ii w`b bvg wjL‡e e‡j P‡j †Mj| we-`j welqwU Rvb‡Z †c‡i G-`‡ji m‡½ Sv‡gjv euvwa‡q w`j Ges mgvav‡bi Rb¨ bbxeveyi Kv‡Q Avm‡jv| bbxevey `yB `‡ji w`‡K nvZ‡Rvo K‡i ej‡jb,
- †Zvgiv mevB cvovi †Q‡j| †Zvgv‡`i mevB‡K Avwg †mœn Kwi| ZvB KvD‡K †div‡Z cvi‡ev bv e‡j IB K_v e‡jwQjvg| GLb ejwQ cuvwPjUv wb‡R‡`i g‡a¨ mgvb fv‡e fvM K‡i `‡ji cÖPvi Pvjv‡Z cv‡iv|
bbxevey f`ª †jvK e‡jB cvovq cwiwPZ| †ek ¸wY gvbyl| GKevi ejv‡ZB cuvwPj e¨envi Ki‡Z w`‡”Qb GUvB wekvj e¨vcvi|
`yÕ`jB bbxeveyi K_vq mvq w`‡q cuvwPjwU A‡a©K K‡i cvwU©i cÖPv‡ii Kv‡R e¨venvi Ki‡jv| †fvUce© wg‡U †Mj| `y-`jB cybivq G‡m cuvwP‡ji wb‡R‡`i e¨eüZ Ask cybivq mv`v PzbKvg K‡i w`‡q †Mj|
GLb bbxevey is wgw¯¿ †W‡K cuvwPjwU‡K wb‡Ri g‡bi g‡Zv K‡i is Kiv‡Z-Kiv‡Z fve‡Qb Avm‡j cuvwPjwU Kvi ...

শিল্প সাহিত্য ০২  বুধবার ২রা বৈশাখ ১৪২৭, ১৫ই এপ্রিল ২০২০
Bb‡fjvct `¨ †b·U wm‡bgv
†gvnv¤§` Rwmg
†`vZjvi wmuwoi mv‡_ wZbZjvi wmuwoi SMov GLb Zz‡½| †KD Kv‡iv gyL †`‡L bv| G‡K A‡b¨i KvQ †_‡K `~‡i m‡i †M‡Q| ga¨LvbUv duvKv, ay‡jv Do‡Q| GLb PviZjvq †cŠQz‡Z n‡j jvd w`‡Z n‡e|
jvdv‡bvi Af¨vm †bB ¸jRv‡ii| fvix kixi wb‡q GZUv jvdv‡bv hvq bv|
K¨v‡givq †PvL †i‡L ¸jRvi †Ui cvq Zvi †fZ‡iI Ggb wekvj GKUv duvKv RvqMv| †mLv‡b KZ¸‡jv Ue, gvwUfwZ©| g„ZcÖvq K¨vKUvm, fvOv †MvjvcMvQ, g„Z iRbxMÜv ï‡q e‡m mgq cvi Ki‡Q U‡e U‡e|
GZw`‡b ¸jRv‡ii KvQ †_‡K `~‡i m‡i †M‡Q eD-ev”Pv, eÜy-KwjM, GgbwK kÎyivI| duvKv n‡q †M‡Q, `yfvM n‡q †M‡Q Rxeb| weev`gvb wmuwoi g‡Zv|
¸jRvi GLv‡b G‡mwQ‡jv wm‡bgv evbv‡Z| A_P †m PviZjvq †cŠQz‡Z cvi‡Q bv|
AMZ¨v `vjvbwU †_‡K †b‡g G‡jv †m, Ab¨ `vjv‡b hv‡e|
Awf‡bZv `xj gyn¤§‡`i evwo‡Z DB‡KÛ cvwU©| cv_y‡i Rwg‡Z Ryg‡¶Z, †Mvjvc †ejx wkgyj| †bwZ‡q cov eq¯‹v ayZzivI| ¸jRvi GKwU nvmœv Zz‡j wb‡Z †P‡qwQ‡jv,  wKš‘ Zvi Av‡MB nvmœv‡nbv wb‡RB Zv‡K Zz‡j wb‡jv|
nvmœv wKsev †nbvi †Mvjvwc wkdb kvox, nvZvKvUv eøvDR Avi wPKb ÷ª¨v‡ci eªv| 36 eqm wKsev ey‡Ki gvc Dfq †¶‡ÎB gvbvbmB| `y'‡Uv wmuwo G‡K Ac‡ii w`‡K G¸‡”Q| Zviv †U‡i‡mi w`‡K P‡j †Mj|
†nbv h_v_©B iƒcmx| Sjg‡j| Zvi Rxe‡b Ab¨ wm‡bgv Av‡Q| ¸jRvi †mBme wm‡bgvq XyK‡Z PvB‡jI †nbv wd‡i ZvKv‡Z Pvq bv| Lvg bv Lyj‡j †hgb †fZ‡ii `ytmsev`wU cov nq bv| ¸jRvi LvgwU †Lv‡jwb, eis bv Ly‡j nv‡Z a‡i ivL‡Z fvj jvMwQ‡jv Zvi|
LvgwU‡K ¯úk© K‡i cyjK cvq ¸jRvi| Pzgy Lvq| KPjvq| `jvB gjvB K‡i| 36 Av`k©| cuvP AvOz‡j Lvc †L‡q hvq|
GKUv AvU©wdj¥ Ki‡ev Gevi| Bb‡fjvc| †Zvgv‡K Kv÷ Ki‡Z PvB|
Avgv‡K Lv‡g fi‡Z PvI? Av‡M wb‡R †Zv †Xv‡Kv gkvB|
†nbvi nvwm wibwSwb‡q ev‡R| g„`y g„`y Uzs Uvs kã nq|
¸jRvi mixm…c nq, †`vZjvi j¨vwÛs‡q Kv‡iv cv‡qi AvIqvR †bB, wbf©‡q Lv‡g Xz‡K hvq †m|
wdi‡Z wdi‡Z ivZ cÖvq †kl| †nbv †h wmuwo¸‡jv †e‡q Dc‡i DV‡Q †m¸‡jvi ga¨LvbUv duvKv| ¸jRv‡ii wmuwo‡ZI Ggb GKUv duvKv Av‡Q| A_P Zviv †hLv‡b wm‡bgv K‡iwQ‡jv †mB wmuwo¸‡jv †Kgb GKUv Av‡iKUvi Dc‡i Dey n‡q c‡o wQ‡jv| GË KvQvKvwQ!
Avjv`v Avjv`v `iRvi Zvjvq cÖvq GKB mg‡q Pvwe †XvKvq Zviv| †h hvi Lv‡g Xz‡K hvq|
duvKv wmuwo¸‡jv c‡o _v‡K †hgb wQ‡jv| Avi †mB k~b¨ RvqMvq K‡qKwU Ue c‡o _v‡K Ah‡Zœ, U‡e U‡e ïK‡bv †XuomMvQ|

শিল্প সাহিত্য ০১  মঙ্গলবার ১লা বৈশাখ ১৪২৭, ১৪ই এপ্রিল ২০২০
gwng †R‡M I‡Vv
Kwei weUz
nVvr `xN© c_ †nu‡U †nu‡U hLb cv'Uv GKUz a‡i G‡m‡Q, gwn‡gi †m gyn~‡Z© †Lqvj nq †m †Kgb GKUv †Pbv A‡Pbvq †gkv‡bv RvqMvq P‡j G‡m‡Q| gvby‡li †Kvjvnj †bB, wiKkvi Nw›U, Mvwoi kã A_ev †Kv‡bv wKQzi MÜ, wKQyB Zvi †MvP‡i Avm‡Q bv †h‡bv|
gwng Abygvb Kivi †Póv K‡i RvqMvUv †Kv_vq| Ggb wbS©ÅvU RvqMv ïay ¯^‡cœB †`Lv hvq, nVvr g‡b DuwK w`‡q hvq -Avwg ¯^cœ †`LwQ bv †Zv? cigyn~‡Z©B †n‡m I‡V| Ggb fvebv fvevi h‡_ó KviY †_‡K hvq| ¯^cœ‡K †hgb Abvqv‡mB †R‡MB AvwQ †f‡e †bqv hvq, †Zgb †R‡M †_‡KI DrKÉv ¯úk© K‡i hvq - G ¯^cœ bq‡Zv! gwng g‡b Kivi †Póv K‡i †Kv_vq hv‡”Q †m| wVK g‡b co‡Q bv| - wVK Av‡Q Amyweav bvB nuvU‡Z _vwK, g‡b c‡o hv‡e|'
Ggb K‡iB AvRKvj fvebvi Af¨vm n‡q †M‡Q| wKš‘ MšÍe¨ g‡b Ki‡Z bv cvi‡j †Kvb w`‡K nvuU‡e †m| GKUz `vuovq Mv‡Qi Qvqvq, †Pv‡L c‡o `ywU m‡`¨vRvZ KzKz‡ii ev”Pv †e‡Nv‡i Nygvq GKUv Av‡iKUvi kix‡i kixi Wzwe‡q| - `y'‡Uv †K‡bv, Avi ev”Pv KB? gwng Gw`K Iw`K ZvKvq| evwK ev”Pv‡`i †Luv‡R| ev”Pv‡`i gv‡KI| kxZ kxZ jvM‡Q kix‡i - Avnv‡i ev”Pv¸‡jv wbðB iv‡Z Lye Kó †c‡q‡Q! - Av‡kcv‡k gqjvi fvMviI‡Zv †Pv‡L co‡Qbv, evwo N‡ii wPýI †bB| gwng AvU‡K c‡o GLv‡b| cvk w`‡q GKRb gvbyl P‡j hvq, wVK fv‡e ZvKv‡j †Pv‡L co‡Zv `yRb w`bgRyi GKUz `~‡i `uvwo‡q m¨v‡Ûj nxb gwn‡gi w`‡K Lye †KŠZznj wb‡q ZvwK‡q Av‡Q| nVvr GKwU †cvqvwZ weovj jvd w`‡q †b‡g Av‡m †Kv_v †_‡K †hb| †mw`‡K ZvwK‡q ev”Pv `y‡Uvi gv‡K cvIqv †M‡jv g‡b K‡i e‡m gwng| †Kv‡bv LUKv †bB, AmvgÄm¨I g‡b nq bv| gwng †`‡L wK my›`i AvKvk †P‡q Av‡Q Zvi w`‡K|
nVvr †cUUv †gvPo w`‡q I‡V, †m `ªæZ evwo †divi iv¯Ív †Luv‡R, A_P g‡b c‡o bv| Gici `…k¨ cv‡ë mvg‡b a~a~ ïb¨Zv| †Pv‡L c‡o Kviv †hb †nu‡U hvq, ûm K‡i †cQb †_‡K D‡o hvq, Zvici Zvi cy‡iv kixiUvi `Lj wb‡q †bq| gwng †MvOvq- Avwg evwo hvgy| wb‡Ri Kv‡QB bvwjk K‡i Avwg evwo hvgy| ÿzav jvM‡Q| wKQy‡ZB g‡b K‡i DV‡Z cv‡i bv wKfv‡e evwo wdi‡e †m| GKUy AwbwðZ AvksKv wb‡q wb‡R‡K cÖ‡eva †`q -GUv ¯^cœ, GUv ¯^cœ| wbðB Avwg †R‡M DV‡ev...

No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক