বুধবার
১০ই আষাঢ় ১৪২৭, ২৪ই জুন ২০২০
কবিতা
রহমান মুজিবমল্লিকপাড়া
সুস্বাদু ডাল-ভাত সানকিতে রেখে যায় তৃপ্তির ঢেকুর
আত্ম নির্মাণের পথে পা রেখে ভাবি-আমিও আবার
লক করা প্রোফাইল খুলে সুঁতো কাটা ঘুড্ডি হবো
যদিবা গন্ধমের অমার্জনীয় পাপে ফুটে প্রণয়ের গোলাপ
আমার যে স্বরুপ-কাঁচা মুদ্রায় ঝনঝন করে উঠে
অবজ্ঞার যে আমজনতা- ঘাম ঝরানো দিনের দেবতা
তাদের গন্ধ, স্পর্শ টিপে টিপে আজ ঘণীভুত
করে নিতে চাই আমার প্রতিস্বর, আমার জন্মভিটা-মল্লিকপাড়া
একদিন দূরন্ত হাওয়ার শাঁশাঁ আমায় ভবঘুরে পথে
রেখে এসেছিল, মেঘর সতীর্থ হয়ে উড়েছি আকাশ
হতে আকাশে আর মুখস্ত করেছি ঠিকানাহীন ভ‚গোল
কোথায় যাব-মজাখালের তলানীতে আটকে থাকা
পিতৃপুরুষের প্রেম, একান্নবর্তীর শেকল ছেঁড়া হাহাকার
কোথায় যাব-শষ্য রঙে সাজানো কাঁথায় মায়ের নকশা
আঁকা গ্যালাক্সি, নত হয়ে থাকা সংসারের বোবা বৃক্ষ
কোথায় যাব-নিমাই মাঝি বিলের দাড়িয়াবান্দার ছক
গোধুলির মায়া রংয়ে আঁকা সন্ধ্যার বাড়ি ফেরা
কোথাও যেতে পারিনা, রাতের কণ্ঠে আমার অতীত
ধরে ঝাঁকি দেয় কৃষাণীর মেয়ে, পোয়াতির ঘ্রাণ সে,
মুখে গোলাধানের হাসি- ইচ্ছে করে আজো তাকে নিয়ে বাঁচি
অপার অরণ্য
পয়গাম্বর
শুনেছি বাপ-দাদারা নাকি বেজায় গরীব আর
ঋণগ্রস্থ ছিলেন
রাক্ষুসে পেট গিলে নিত অনাহারী নাড়ি-ভুড়ি
ক্ষুধার্ত সূর্যের রঙ আর নদীর নাব্য মেখে তাদের
আঙুল হয়ে উঠত ধারালো ত‚র্যনিনাদ
এভাবেই সুতীক্ষ্ন উজ্জ্বলতায় পাকা ধান কাটতেন তারা
এখন বাপ-দাদারা বড়লোক হয়েছেন
ধারালো তাদের অস্ত্র ও আভিজাত্যের স্ফুলিঙ্গ
ধর্ষিতার বোঁটায় কামড় খেয়ে বলেন- বাতাবিলেবুর
বাম্পার ফলন!
ফণাধর সাপ প্রশ্নবোধক সুসজ্জায় সুন্দর- ম্লান
চেঁচায় নাগরিক, নারীবাদ,
হাঁসে উপাসনালয়, শাণঘর
কাঁদে রোবটবিজ্ঞান, শপিংমল
বেদগ্রন্থ ও শরীয়া মোতাবেক প্রকাশ্যে পয়গাম্বর
স্বৈরাচারী ছুঁড়ি পরম্পরায় খুন করো নিঃস্পৃহ
যোনিপথ ও নিরীহ নির্বিষ পালক!
রাজীব পাল
ভ্রমণ
নিজের ভেতর ক’পা চুবিয়ে হাঁটা দিলে হে?
চু কিত্ কিতে কাটা দাগ ডিঙিয়ে ফেরা
সন্ধেরা, ও পায়ের পাতায় কুঁকড়ে যাওয়া,
কতটুকু ভ্রমণ মেপেছো বুকের ভঙ্গুরতায়?
লক্ষ যোনি, হাঁপিয়ে ওঠো, শ্বাসকষ্টের
শ্বাসযন্ত্রে নামিয়ে রাখা ঘোড়ার মাথা
স্বপ্ন দেখুক ঘাসের মাঠ, সূর্য ডুবে যাচ্ছে
নিজের ভেতর হেঁটে ফিরে আসছো কি?
সাব্বির হোসেন
আঁধার থেকে আলোয়
এই শহরের প্রত্যেকটি অলিগলি
দরজা, জানালা, দেয়ালের কার্নিশে
এঁটে থাকা ভেন্টিলেটর,
বিছানার চাদর,
ড্রেসিংরুমের বোবা চিরুনি,
বেসিনের আয়না,
আর চুমকি বসানো লাল পার্সে
জ্বলতে থাকা কালো টিপ
আমার নিত্যকার বিষাদের সাক্ষী।
এক একটি হিংস্র নটরাজের থাবায়
বিকিয়েছি পুষ্পমঞ্জরি
এলিয়েছি বসন্তের টগবগে শরীর
নখের আগ্রাসনে
রাজপথ থেকে রাজপথে
চৌকাঠ থেকে পালঙ্কে
আঁধারের মৃত শিল্প হয়ে
সময়ে অসময়ে ঘড়ির কাঁটার
ইশতেহার হয়ে।
আমি মুনিয়া,
তবুও স্বপ্ন দেখি হয়তো একদিন
কবির বনলতা হব
হয়তো হব ডার্ক লেডি অফ শেক্সপিয়ার
নিষ্প্রাণ প্রতিমা আবার জীবন্ত হবে
দুর্লভ ফুল হয়ে স্বজন সভ্যতায়।
ছোটগল্প
খুনরিয়ানো
একটা আধ ভাঙ্গা চৌকি। কিছু ছাড়পোকা। একটা পুরনো টেবিল। পোকায় খাওয়া কিছু একাডেমিক বইপত্র। ধুলাবালি। নষ্ট হওয়া টেবিল ল্যাম্প। দেয়ালজুড়ে মাকড়সার জাল। এলোমেলো পড়ে থাকা জামাকাপড়। বন্ধ জানালা। একরাশ বিষণ্নতা। দম বন্ধ করা অন্ধকার।
ছেলেটাডুবে আছে এসবের ভেতর। কেটে গেছে ২৮ টি বছর। ডুবে যাওয়ার কাল শুরু হওয়ার পর থেকে ঘড়ির কাঁটার সাথে সাথে ডুবছে তো ডুবছেই। কিন্তু সে কি মরতে চায়?
বোধহয় না। তাইতো রোজ রাতে আঁকড়ে ধরে সিগারেট। রোজ রোজ সিগারেটের পয়সাটা জোগাড় করাও এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।
ক্রিং! ক্রিং!
সমস্ত নীরবতাকে তীব্র শক্তিতে পদানত করে আগুনের মতো ঝলসে উঠলো ফোনের রিংটোন। সিগারেটের আগুন ছাড়াও ঘরে তৈরী হলো আলোর উৎস। আর তার নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়াও তৈরী হলো নতুন শব্দ। ছেলেটা চিন্তায় ডুবে ছিল। বাস্তবে ফিরতে যতখানি সময় লাগলো, তারই মাঝে ফোনটার শব্দ থেমে গেল।
কে ফোন দিয়েছে? দেখার জন্য ফোনটা হাতে নিতেই আবারও সেই আলোর ঝলকানি, সঙ্গে তীব্র শব্দে।
ছেলেটা ফোনের কাছে মুখ নিয়ে বললো- হ্যালো!
ওপাশ থেকে ভেসে এলো অন্য একটা কণ্ঠস্বর। উচ্ছ্বাসে প্রাণবন্ত, তার মতো প্যাঁতপ্যাঁতা নয়। উচ্ছ¡াসভরা কণ্ঠস্বরের মালিক তার বন্ধু- চাকরিটা হয়ে গেছে আমার!
একটা ধাক্কা। হজম করতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগলো তার। একসাথেই ইন্টারভিউ দিয়েছিলো তারা। বন্ধুর চাকরি হয়েছে, তার হয়নি!
ইন্টারভিউ বোর্ডে সেদিন কেতাদুরস্ত এক ভদ্রলোক তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘আচ্ছা, আপনার চোখের নিচে অমন কালশিটে দাগ কেন? নেশা-টেশা করেন বুঝি?’
সে জবাব দিতে পারেনি। প্রতিরাতের মতো আজও যখন সে ডুবে আছে, তখন সেই স্মৃতিটা তাকে আরেকটু ডুবিয়ে দিলো। ডুবতে ডুবতেই বন্ধুকে অভিনন্দন জানালো সে। বিনিময়ে পেল আশার বাণী আর সান্ত¡না।
‘তুই দুঃখ করিস না দোস্ত, চেষ্টা কর। এক জায়গায় না এক জায়গায় চাকরি হয়েই যাবে!’
এমন মূল্যবান উপদেশ! তাকে বাধ্য হয়েই একখানা হাসি উপহার দিতে হলো।
বন্ধু ফোন রাখলো। আসলে সবাই এখন ব্যস্ত। ব্যস্ত তার প্রেমিকাও, যে একসময় ছিলো তার ব্যস্ততার কারণ, এখন সব ব্যস্ততাই তাকে ছুটি দিয়ে চলে গেছে। মাসের পর মাস চলে গেলেও একটা চাকরি সে জোগাতে পারেনি -এই অজুহাতে।
চলে গেছে টিউশন, হাত খরচের একমাত্র উৎস। চলে গেছে সুখ।
এখন এই পৃথিবীতে অল্প ক’জনই নিয়মিত তার খোঁজ নেয়। এ তালিকায় প্রথমেই আছে তার বাড়িওয়ালি। রোজ সকালে দরজায় শব্দ কওে দেখে সে আছে কিনা। ব্যস, এতোটুকুই!
থাকগে, সে বোঝায় নিজেকে, না-ই জিজ্ঞেস করুক আমি কেমন আছি, কি অবস্থায় আছি, অন্তত আছি কিনা এটা তো খেয়াল রাখে! তার অস্তিত্বের খেয়াল রাখার জন্য এই যে একটা মানুষ আছে, এটা তাকে বেশ স্বস্তিÑ দেয়। সেই স্বস্তির বিনিময়ে সে অনুভব করে, তার সঙ্গী ছাড়পোকারা ক্ষুধার্ত হয়ে আছে। তাদের খাদ্য দেয়া প্রয়োজন।
খেয়াল হয়, আরে! ক্ষুধার্ত হয়ে আছে আরো কিছু প্রাণী! রোজ রোজ খাদ্যের জন্য চেঁচায় তারা। অন্য ভাষায় এটাকে বলা যায় তাগাদা। সকাল হলেই যে তার অস্তিত্বের খেয়াল রাখে, তাকে দিয়ে শুরু হয়। এরপর আছে মুদি দোকানদার, চা ওয়ালা, বাদামওয়ালা--- আরো কত কে! সকলকে নিজের অস্তিত্বটা জানান দিয়ে একটা সিগারেট জোগাড় করে ছাদের একাকী রুমটায় ফিরে আসে সে। সকলের শান্তির জন্য রোজ একটু বেরোতে হয় তাকে। ‘আমি আছি!’ হাজিরা দেয়ার পর কিছুক্ষণের জন্য লেকচার। এরপর বিদায় নিতে হয় তার কাছ থেকে। এরপর আরেকজন। এরপর আরেকজন!
‘ আছি!’ আছি! আছি!’ তবু যেন সে নেই! শহর যখন সন্ধ্যার অন্ধকারে ডুবতে শুরু করে,তখন তার মাথার ভেতর কে যেন চিৎকার করে, ‘আমি কি সত্যিই আছি...?
‘আমি কি সত্যিই আছি?’
‘আমি কি সত্যিই আছি?’
ওহ! সে কি যন্ত্রণা! এমন লাগে কেন? সে ছুটতে থাকে। এ গলি, সে গলি ছুটতে ছুটতে যেখান থেকে ছোটা শুরু করেছিলো, সেখানে এসেই থামে। কারণ, পৃথিবী গোলাকার। হাঁপাতে হাঁপাতে পকেট হাতড়ে ঘরের চাবি বের করে। বিক্রির মতো জিনিসের সংখ্যা ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। পুরনো তালা কেউ কেনে কিনা, জানতে হবে।
বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ঘরটায় ছেলেটা শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ায়। চৌকির মচমচ করা শব্দ তাকে জানায়, তোমার ওজন কমে আসছে।
সিগারেটের অপ্রয়োজনীয় অংশটা ফেলে সে টেবিলের কাছটায় গিয়ে দাঁড়ালো। অল্প সময়েই খুঁজে পেল নতুন পত্রিকায় যত্ন সহকারে মুড়ে রাখা চকচকে জিনিসটা। অন্ধকারেই তার ঔজ্জ্বল্য অনুভব করে। হাতের তালুতে ঘষে উপভোগ করে জিনিসটার ধার। পরীক্ষা করে ওজন। আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায় তার অন্তরে। খুব সহজেই ব্যবহার করা যাবে এমন একটা জিনিস সেটা। ‘চমৎকার!’
তার মতো শীর্ণকায় ব্যক্তির পক্ষে খুব কঠিন কিছু নয়।
এলাকার যে বড় ভাই এই অত্যন্ত চমৎকার কিন্তু মূল্যবান জিনিসটা তাকে উপহার দিয়েছে, তাকে মনে মনে ধন্যবাদ জানায় সে। জিনিসটাকে পরম মমতায় বুকে আগলে রাখে, চুমু খায়। চোখ বুজে চলে যায় সময়ের কিছুটা পেছনে।
ছোটবেলায় তার মা তাকে বলেছিলো, ‘বাবা, ব্লেডের মত ধারালো হবি। যাতে করে সামনে যত বাঁধা আসবে, সব কেটে কুটে বেরিয়ে যেতে পারিস!’ কিন্তু না। সে ব্লেডের মতো ধারালো হতে পারেনি। কারণ বাবা তার জন্য কোন হীরার টুকরা রেখে যাননি। তাই তাকে এ সমস্ত বড় ভাইদের দেয়া ধারালো জিনিসের সাহায্য নিতে হয়।
‘বাধা!’ ‘বাধা!’ ‘বাধা!’
সে বেশ কয়েকবার শব্দটা উচ্চারণ করে।
হ্যাঁ আসলেই তো! ‘বাঁধা।’
পাঁচ মাসের জমে থাকা ঘরভাড়া একটা বাঁধা।
মুদি দোকানের বাকির খাতা একটা বাঁধা।
চা ওয়ালার দাগওঠা চায়ের কাপ আরেকটা বাঁধা।
এমনি বাঁধা বাদামওয়ালা, লন্ড্রি দোকান, ভাতের হোটেল......উফফফ! তাকে এসব বাঁধা কেটে বেরিয়ে আসতেই হবে! তাই সে টুক করে দরজা খোলে। শব্দ না করে সিঁড়ি বেয়ে হেঁটে যায় নিচের দিকে। এ সময় তার মনে হয়, সে যেন একটু একটু করে ভেসে উঠছে। সিঁড়ির প্রতিটা পদক্ষেপে পানির ওপরে দেখা যাচ্ছে সূর্যালোকের প্রতিফলন।
দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাই সে বাড়িওয়ালির ফ্ল্যাটের কলিংবেলে চাপ দেয়।
No comments:
Post a Comment