Sunday, June 21, 2020

শিল্প সাহিত্য ৬৯


রবিবার ৭ই আষাঢ় ১৪২৭, ২১ই জুন ২০২০




কবিতা
আশিক আকবর
বেশ্যালয়ে এসো

তীর্থ প্রবেশ কালে প্রার্থনা করো। প্রস্থান কালে হাতাও পকেট। দ্যাখো, খুচরো টুচরো আছে কিনা বিড়ি ধরাবার। নারীসঙ্গে ঐ স্থানই শ্রেষ্ঠ দেবালয়। কোআরেনটাইন সাঙ্গ হলে, ওখানেই কবিসঙ্গে আড্ডা পেটাবো।
সর্বজনে আদরে কহিবো। স্বাক্ষাৎ যদিবা চাহ, বেশ্যালয়ে এসো। মদ মাংসে নিষেধাজ্ঞা নেই। সস্তাতেই মিলে জিলে সব। অনিষিদ্ধ পৃথিবীর মতো বড় বড় পাত্তি লাগে না। শিখতেও হয় না নারীর ব্যাকুল বোবা ভাষা। সরব এখানে নারী পুরুষ অধিক। এইস্থলে কমরেড রিক্রুট অতিব সহজ। যদি চাহ কমরেড ভ্রাত!

সজল রানভী
“বিসর্জন অথবা বিষ অর্জন”

তুমুল কবি হতে গিয়ে গলা টিপে হত্যা করেছি তুমুল ভালোবাসা । ছিঁড়ে ফেলেছি সংসারী স্বপ্নের খতিয়ান ।
মুক্ত । অথচ পেট’নীতির নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পাখির ডানা মেলতে পারিনা যখন তখন।
ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যঞ্জনা মুছে ফেলে লিখতে পারিনা কাঙ্ক্ষিত কবিতা।
আঁকতে পারিনা মায়ের মতো নারী।
পাহাড়ের জরায়ু ভেদ করে যে নদী বয়ে গেছে আমার পৈতৃক ভিটেমাটি গিলে ফেলে,
সে নদীতে নোঙর ফেলবো ফেলবো করে ছাব্বিশ ক্যালেন্ডার। প্রজাপতির নাভিতে একটাও চুমু নেই।
ফুলকে ভুল দিয়ে অংক কষতে কষতে ফলাফলে নামিয়ে ফেলি ভীষণ শূন্যতা। ভীষণ একাকীত্ব।
সঙ্গমরত টিকটিকির যাপিত সুখে অসুখ জমে যায় সমস্ত বুকে। চোখে নরকের অন্ধকার। অভুক্ত কুকুরের হা হুতাশ।
তুমুল কবি হতে গিয়ে গলা টিপে হত্যা করেছি তুমুল সংসার । ছিঁড়ে ফেলেছি, পাশাপাশি শুয়ে থাকা সাড়ে তিন দু’গুণে সাত হাত জীবনের চিত্রপট ।।

শান্তম 
একটি ভুল 

রাখালের অন্যমনস্কতা ও বই হারানোর
অনেকদিন পরে প্রভুর গোরু হারানোর
ঘটনাকে জুড়ে দিয়ে বাবা বারবার
গোপালকে সুবোধ বালক বলতেন

অথচ মা কিছুই বলত না

রাখালের যে উপায় ছিল না কোনও
সে কথা অনেক বড় হয়ে নয়
অনেক বয়স হলে যখন জানলাম
তখন দেরী হয়ে গিয়েছে ভীষণ

মোহাম্মদ আবদুর রহমান
ফুটবলের মত

আমি শিক্ষিতও নয়
আবার মূর্খও নয়
দুটোর মাঝামাঝি
ঠিক যেন ফুটবলের মত।
শিক্ষিত ও মূর্খ উভয়েই
লাথি দিয়ে ঠেলে ফেলে দিতে চাই
পরস্পরের বিপরীত দিকে ।
আমি যখন লাথি খেতে খেতে প্রবেশ করি কারও ঘরে।
অন্যরা মেতে ওঠে উল্লাসে
আবার টেনে নিয়ে যায় মাঝখানে।
আমি আর্তনাদ করে বলি
আমি শিক্ষিত
আমার কাছে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাড়পত্র।
শিক্ষিতরা জিজ্ঞাসা করে
তোর কাছে সরকারি কোন কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের কাগজ আছে?
মাথা নত করে শিকার করি না
তবে তুই কিসের শিক্ষিত?
মাথা পেতে নিই আমি মূর্খ।
শিক্ষিতরা হাসতে হাসতে লাথি দিয়ে ছুড়ে ফেলে মূর্খের দলে।
তারাকে বলি আমি মূর্খ
মূর্খরা বলে কৃষিকাজ করতে পারবি
আমি বলি না।
তবে বিশ্ব বিদ্যালয়ের মানপত্র আছে
বলি হ্যাঁ।
তাহলে তুই শিক্ষিত
আমি মেনে নিই তাদের কথাও।
তারাও আবার লাথি মেরে ছুড়ে ফেলে
শিক্ষিতদের মাঝে।
এভাবে লাথি খেতে কেটে যায় সারাবেলা
অসলে আমি তো সমাজের ফুটবল
গড়তে থাকি সবার পায়ের তলায় ।

বঙ্কিমকুমার বর্মন
চোখ

অলীক কান্না ঢেলে দেয় প্রতিটি সন্দেহ চোখ
আমার নরম শিখা ছুঁয়ে থাকুক শান্তির সমীকরণে
কেমন অবাধ্য হয়ে উঠছে চুঁইয়ে পড়া নির্জনতার সঞ্চয়

উড়ে যাও উঁচু নিচু স্বাদ ভুলে পিপাসার বুনুনে
দ্যাখো সোহাগে ডেকে নেবে কাছে ঘামফুল
উঁকি দেয় রাস্তার তৃষ্ণা এদিক ওদিক বৃষ্টি পথ ঘুরে ঘুরে

অলস্যতা ঘেঁটে ঘেঁটে এখন ক্লান্ত হয়ে উঠি
কেমন জড়িয়ে উঠছে পাবে সূর্যের ফাগুন
আস্ত শামুকের গতিপথ বদলে নিচ্ছে দূরবীনের গালিচায়

চেয়েছি ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের জ্যামিতিক চকচকে রূপকথা।

ছোটগল্প
রাসেল আহমেদ
অসমাপ্ত ভালোবাসা

সেদিন আমি একাই বের হয়েছিলাম নিজেকে নিজে সময় দিবো বলে। হ্যাঁ, সেখানেই গিয়েছিলাম যেখানে প্রায়’ই যাওয়া হত আমার মন খারাপের সময়। এখানকার সবচেয়ে মজার ব্যাপার কি জানেন? এখানকার পরিবেশটা কেন জানিনা কখনো পাল্টায় নাহ! এই তো অনেকগুলো গাছের পাশেই সেই প্রিয় বড় গাছটা। বট গাছ নয়, খুব বড় একটা রেইনট্রি গাছ। একটু দূরে বেঞ্চটা। সামান্য হেঁটে গেলেই সিঁড়ি বেয়ে পুকুর ঘাট। সবই আমার প্রিয়। আর সবথেকে ইন্টারেস্টিং বিষয় হল বেঞ্চে বসা মেয়েটি।  আমাকে এখন তাকে এই পরিবেশ এর একটি নিয়ামক বলে মনে হয়। এই মেয়েটাকে বসে থাকতে দেখলে কখনোই অস্বাভাবিক মনে হয় না। বরঞ্চ যেদিন এই মেয়েটিকে দেখতে পেতাম না সেদিন প্রকৃতিটাকেই অস্বাভাবিক ও অসম্পূর্ণ মনে হতো। সে যেন ছিল এই প্রকৃতি ও পরিবেশেরই অংশ। 

মেয়েটা অনেকটাই বোকা, দেখে যা মনে হতো। আর আমি বোকাদের প্রতি বরাবরই একটু দুর্বল। তবে মেয়েটা চোখে দেখতে পেতো না! প্রায় সময়’ই একা বসে থাকতে দেখা যায়। প্রথমদিকে কয়েকদিন একটা ছেলেকেও দেখতে পেতাম এখন মেয়েটা একাই বসে। ছেলেটা আসছেনা কিছুদিন কে জানে কি হয়েছে! সাংবাদিক হওয়ার সুবাদে সবার সাথেই মিশতে পারতাম এবং সুন্দর করে কথা বলতে পারতাম। কিন্তু তার সামনে আসলেই আমার এতো দিন ধরে জমানো সে অভ্যাস যেন নিস্তেজ হয়ে উঠে। হাজার প্রশ্নের উদ্রেক ঘটা সত্ত্বেও নির্বাক দর্শক হয়েই বসে থাকতে হয় সারাটি ক্ষণ। পাখিরা উড়ে যায়, তাদের কলকাকলীতে চারপাশ মুখোর হয়। কিন্তু বরাবরের মতোই নীরব সে আলো-আঁধারি মানবী।

সেদিন মেয়েটিকে আমার কেমন একটা সাধারণ এর মাঝে অসাধারনই লেগেছিলো। এই প্রথম যেন তার পূর্ণ আবির্ভাব ঘটল। অল্প অল্প বৃষ্টি যেমন মানুষকে ভিজতে ইচ্ছে জাগায় আমাকেও সেদিন তার অলস মায়াবী মুখখানা কিছু একটার ইচ্ছে জাগিয়েছিল। সেই কিছু একটা যে কী তা আজ পর্যন্ত আমি আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি।

“গল্পের শুরুটা এখানেই!!!”

সেদিনের পর থেকে আমার রুটিন হয়ে যায় মেয়েটিকে প্রতিদিন একবার করে দেখা। মেয়েটির সরলতাই আমার দুর্বলতার মূল, এই সত্যটা আমি আবিষ্কার করেছি বেশ কিছুদিন পর। প্রায় সময়ই মেয়েটি আসতো না। তখন মনে হতো তাকে না দেখে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া আরও শান্তির। কেন এমন হয় তার কোন সংজ্ঞা আমার জানা ছিলো নাহ। এ এক অসহ্য যন্ত্রণা। তার প্রতিটা দিনের অনুপস্থিতি আমাকে জানান দিচ্ছিল আমার হৃদয়ের অস্থিরতা সম্বন্ধে। 
আমি প্রায়ই অনুসরণ করে যেতাম তাকে। আশেপাশেই থাকতাম সবসময়।  ভাবতাম আমার উপস্থিতি সে বুঝছে নাহ। তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হতো। সাংবাদিক জীবনে অনেক কঠিন, অসহায় পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। নিজেকে দুঃখী মনে হয়নি কখনো। কিন্তু আমি যার জন্য নিজের মন বিসর্জন দিয়েছি সে আমার দিকে সামান্য দৃষ্টিপাত পর্যন্ত করে না!

একদিন তাকে খুব কাঁদতে দেখেছিলাম আমি। চোখের জ্বল পুরো গাল গড়িয়ে মাটিতে পড়ছিল। নিজেকে তখন পৃথিবীর সবথেকে দুঃখী মানুষ মনে হচ্ছিলো। না পারছি চোখের জল মুছে দিতে না পারছি সহ্য করতে। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম, “এটা কী ভালোবাসা, নাকি শুধুই একটা মেয়ের প্রতি একটা ছেলের আকর্ষণ? হ্যাঁ, এটাই ভালোবাসা। যে বোধটা আমার মাঝে এসেছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে। সেদিনই সে আমায় প্রথম ডাকল। আমি চুপচাপ বসে পড়লাম পাশেই। মেয়েটি বলল,
“আমায় চেনেন?”
“হু!!”
“কে আমি?”
“আলো-আঁধারি!”
“এ আমার কার নাম? আমি তো...
তাকে থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম,
“প্রথম আপনাকে দেখেছিলাম আলো-আঁধারের মিলনমেলায়। তখন আলোও ছিল না, আঁধারও ছিল না। আবার আলোও ছিল এবং আঁধারও ছিল।”
“কী যা তা বলছেন! পাগল হলেন নাকি?”
“সে তো অনেক আগেই হয়েছি। তা না হলে কোন সাংবাদিক প্রতিদিন এক জায়গায় বসে কারো জন্য অপেক্ষা করে না।”
মেয়েটি হাসলো। সামান্য হেসে বলল, 
“জাস্ট এতটুকুই?” 
আমি তার হাসিটার দিকেই তাকিয়ে রইলাম।  কান্নার পর মেয়েরা যখন হাসে সে হাসি পৃথিবীর সবথেকে মূল্যবান আমি সেদিনই বুঝেছিলাম। আমি উপভোগ করছিলাম পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর জিনিসটি। বৃষ্টির পর রোদ উঠলে সূর্যকে যেমন হাস্যোজ্জ্বল মনে হয় ঠিক তেমনি আরেকটি হাসি দিয়ে মেয়েটি বলল,
“আপনি আমায় অনেকদিন ধরেই দেখছেন তাই না?” 
“জ্বি, কেন?” 
“আমার পাশে একটা ছেলে থাকতো দেখেছেন হয়তো?”
“হ্যা! দেখেছি, আপনার কাছের কেউ হয়তো! আলাদা হলেন কেন?”
“আমি চোখে দেখতে পাইনা তাই আমায় নিয়ে তার ফ্যামিলি’র কাছে বলা তার পক্ষে সম্ভব নাহ।”
এ কথা শুনে আমি খানিক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে রইলাম। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যে দু’চোখে আমি পুরো জগতের প্রতিবিম্ব দেখতে পাই, সে চোখ জোড়াই কিনা এই সুন্দর জগতের দেখা পায় না! এ কথা শুনে আমি মোটেও চিন্তিত নই, এমন ভঙ্গিতে তাকে আবার প্রশ্ন করলাম,
“সেটা আগে কেন ভাবেননি?”
“আমার ভাগ্যই এমন। তার কোন দোষ নেই। যাহোক আমায় এখন যেতে হবে।”
আমি দাড়িয়ে বললাম শুনুন, “আপনাকে না দেখলে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনা। ছয় মাস ধরে দেখে আসছি। একদিন না দেখলে ভালো থাকতে পারিনা। মরে যেতে ইচ্ছে করে আমার। আপনি কি আমার সাথে থেকে, পাশে থেকে আমার চোখের মনি হয়ে আমার ভালো থাকার কারণ হবেন?”

লাল চোখ থেকে লালচে মুখটা বেয়ে আরও কয়েক ফোঁটা জ্বল আমায় উপহার দিয়ে  সে চলে যায়। ছয় মাস অপেক্ষা করেছি, অনেক খুঁজেছি পাইনি তাকে। ভালো থাকুক বলেই নিজেকে সান্তনা দিয়েছি।”

দশ বছর পর আজ আমি আমার স্ত্রী এবং তিন বছরের বাচ্চা কে নিয়ে এখানে আবার এসেছি। ভাগ্যদেবতা হয়তো আজই আমায় নিয়ে এসেছিল তাকে আরেকবার দেখার জন্য। আজ তার হাতে সাদা কাগজ দেখেছি আমি। খুলেই দেখলাম দশ বছর আগের আমাকে একেছে সে কাগজে আর কলমে।

1 comment:

  1. তরুণ লেখকদের বাগানশুদ্ধ কবিতা ও গল্পের ডালি সুন্দর সেজেছে। শুভেচ্ছা রইলো।

    ReplyDelete

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক