শনিবার ২৩শে
জ্যৈষ্ঠ ১৪২৭, ৬ই জুন ২০২০
কবিতা
শুভ্র সরকারপোস্টমাস্টারের শার্টের রঙ ছিল
হারানো জুতোর
১
এবং চিনে নিতে পারলে, কেউ কেউ পথ হয়ে যায়। পেরিয়ে গেলে, শুধু নামটাই পড়ে থাকে। কুড়িয়ে নেয়ার অজুহাতে কলতলায় আধধোয়া কাপড়ে সারাবেলা বেজে ওঠে শরীর। শরীর থেকে মন অব্দি পৌঁছানোর পথটা- তোমার চোখ। কেউ আমার কথা জানতে চাইলে, তুমি তার দিকে একবার তাকিও।
এদিকে, তোমার কথা মনে পড়লে-
এখনও হারানো জুতোর ভিতর ফেলে আসি আমার সমস্ত চেনা পথ!
২
পোস্টমাস্টারের শার্টের ভিতর, কেউ অসাবধানে
খুলে দেখে- মানুষ মূলত ডাকঘর!
৩
মানুষ একটা ঘরে- যেখানে আরও অনেক মানুষ থাকে।
সাহিন আক্তার কারিকর
সংলাপ ভাঙা স্বর
নদীর ধর্ম নিয়ে মাঝি - মল্লার তর্ক হল
প্রভাতের অন্তিম সুর
ভেসে আসছে শঙ্খচিল পোষাক...
পাতিলেবু হাত ধরে জল ভাত কর্ম খুঁজছে ।
আকারের কোনো অঙ্ক নেই
নিজস্ব শৈলীর শ্লীলতাহানির করে রক্তের দাগ চেনাচ্ছে কথক...
অথচ কল্পনার নির্দিষ্ট ফাঁদ পেতে মাছ ধরছে মাছরাঙা।
ইতিহাসের আংলোরা সমালোচনা করছে পিছনে
উইপোঁকা ঢিবি থেকে পড়ে মৃত্যু হল
বজ্জাত মেয়ের
যত সহজে না পিরিয়ড শেষ হয়।
ঠিক তখন,
নাকে রুমাল চেপে ভারতবর্ষ উঠে আসছে
ধর্মনিরপেক্ষ একটি সংবিধান।
নতুন সূর্য উদয়ের পুরাতন ভাবনা নিয়ে বাসা বাঁধছে কোকিল,
আদৌতে যার সংসার বনবাস।
তর্জনির ছিদ্র পথে গুলি ছুঁড়ে ফায়দা লুটছে ফিঙে
ফড়িং এর সাথে বাসর করল না বিল চড়–ই
আক্ষেপ দু’জনার, কারও পেট ভরেনি...
কমল কুজুর
প্রার্থনার ক্ষণ
দিনগুলি তেমনি রয়েছে
শুধু রাতগুলো হয়েছে দীর্ঘ
সন্ধ্যে হতেই শ্মশানের আঁধার যেন
গলা টিপে ধরে সমস্ত পৃথিবীর ;
আর
কোন এক অজানা শঙ্কায়
ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতোই
খাবি খেতে থাকে অসহায় মানুষ-
- নিজ নিজ বন্দীশালায়।
লক্ষ কোটি টাকার তৈরি পরমাণু অস্ত্র
ড্রোন মাইন আরো কত কি -
সবই যে ব্যর্থতায় মুখ লুকায় ;
আজ কোথায় ইতালি যুক্তরাষ্ট্র স্পেন চিন
মহাপরাক্রমশালী রাষ্ট্র যত
সব আশা ছেড়ে
- করে হায় হায়।
বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ নেই, নেই প্রতিকার
মানুষ ম’রে অকাতরে
বাতাসে যেন বিষ ভাসে
এক দুই তিন-
এমনি করেই যেন আসে এগিয়ে মৃত্যুর দিন।
রোজ তবু সূর্য ওঠে
রাঙা কিরণে আঁধার দূরে যায় সরে
দূর্বল মানুষ স্বপ্ন খোঁজে,
বাঁচার স্বপ্ন, সুন্দর এক আগামীর স্বপ্ন
“এই পৃথিবী আমাদের হবে,
হবে মানবতার জয়।”
রানা জামান
বইগুলো চলে যায় হকারের হাতে
এতো কিছু এতো সম্পদের মাঝে জুতোর হিসাব রাখে না কেহই
জুতোর উপরে ছড়াছড়ি ব্রা’র সাথে পেন্টি উভয় লিঙ্গের
রান্নাঘর শুকনো থেকে তারা গোণা রেস্টুরেন্ট ব্যস্ত থালার গুঞ্জনে
সময়ের পাগলা ঘোড়া দেশ থেকে দেশান্তরে লাগাম বিহীন
ব্যবসার লেখাপড়া গুলো দ্যুতি ছড়িয়ে ধূলোর স্তর অন্যবর্ণে
এমন দ্যুতির আকর্ষণে এক প্রকাশক তাঁকে প্রধান অতিথি করেন আগ্রহে
বইয়ের মোড়ক খোলা হলে ঘ্রাণ না শুঁকে বাহিরে এসে ফেলে দেন ডাস্টবিনে
প্রকাশক কিংবা লেখকের লাভ না হলেও নাম হলো সংস্কৃতি সেবক হিসেবে অনেক
বুভুক্ষু লেখক পাবার প্রত্যাশা নিয়ে যায় তাঁর অট্টালিকায় সময় বুঝে
লেখকের দেয়া বইগুলো জমে গেলে অনায়সে চলে যায় হকারের হাতে
ওসব বাড়িতে বই-এর আলমিরা রেখে সৌন্দর্য বৃদ্ধির বিষয় ভাবে না কেউ।
অণুগল্প
প্রেমের ধারাপাততপনকুমার দত্ত
যখন তোমার না থাকা কিছু আমি দিতে পারি, তখন তোমার পূর্ণতা দেখি আকাশ ভরা তারার মতো। যখন আমি বহু ভাবনার চাপে নীরব উদাসী হয়ে থেমে পরি, তখন তুমি এসে ‘থামলে হবে না আমি আছি’ বলে এক পশলা বৃষ্টির মতো চনমনে করে তোলো আমার হৃদয় প্রান্তর।
একেই বলে প্রেম । প্রেম তো প্রেমই।
ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা। ঝিরঝিরে হাওয়ায় জাগে প্রেম। উভয়েই হৃদয় যাপনে হয়ে ওঠে কাছাকাছি জমাট বরফ। বরফ গলে প্রেমের উত্তাপে, ঘটে ঝরণা প্রবাহ। সৃষ্টি হয় নতুন জাতক। জাতকের প্রেম। আবার পূর্ণতা। ঘনিষ্ঠতা। বরফ। ঝরণা। জাতক।
এইভাবে দিনদিন বেঁচে থাকে অন্তর্হীন প্রেমের ধারাপাত ।
সিকান্দারনামা
লোকমান হোসেন
সকাল হলে বিছনাপাটি গুটিয়ে রাখে মায়। চৌকিটা উদোম হয়ে সারা গায়ে ধুলো মাখে। বেড়ার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে সূর্যের আলোর সরু ধারা তখন ভিতরে প্রবেশ করে। পুবের ঘর থেকে বাজানের হট হট, র র, প প শব্দ এসে সিকান্দরের কানে ধাক্কা দেয়। গরুগুলো সারাদিনের জন্য প্রস্তুতি নেয়। - কইরে সিকান্দর উঠ। তর বাপের সাথে যা। রান্ধা হইলে ভাত নিয়া যাইস, চুক্কা দিয়া পুডি মাছ রান্ধুম আজকা। খুব ভোরে, ফজরের আজানের সময় হিম বাতাসে উঠে মায়ের ডাকা-ডাকিতে বাবার সাথে হাল নিয়ে যায় সিকান্দর। গরুগুলোর জিরান নাই। জিরান ততক্ষণ, বাজান নারকেলের হুক্কায় কয়েক ছিলিম তামাক দিয়ে গুড়–ক গুড়–ক টান দেয়, যতক্ষণ। ক্ষেতে আগাছা জমলেই উইডার নিয়ে যায় সে। গোছা গোছা আগাছা উইডার ঠেলে আয়নার মতন পরিস্কার করতে হয় জমি। ইউরিয়া, পটাশ সার দেওয়া লাগে মাঝে মাঝে। অগ্রহায়ণ মাস এলে ধান কেটে দুলকি তালে ঘসর ঘসর আওয়াজ তুলে কামলারা বাড়িতে নিয়ে আসে। একটার পর আরেকটা ধানের মুড়ি দিয়ে গোল করে সাজিয়ে রাখে উঠানে। শীতের সময় সেই ধান থেকে তেরি চালের পিঠা রোদে পিড়ি পেতে বসে খাওয়ার মজাই আলাদা। বছর, দুই বছরে একবার বানের পানিতে ভেসে যায় সব। তখন বড়ই অভাব। বর্ষার পানি থেকে হালুক তুলে খিদা নিবারণ করা লাগে। বড় দুর্দিন তখন সবার। গ্রামের সবাই তখন ধানের বিনিময়ে ঋণ আনে জমিদার বাড়ি থেকে। গ্রামে এই বাড়ির নাম বড় বাড়ি। সেই ঋণ শোধ না করতে পারায় এক সময় জমিই বড় বাড়ির অধীনে চলে যায়। সাঁঝবেলায় দু’মুঠো খেয়ে এশার নমাজের আগেই ঘুম। কুপির তেল বাঁচানো দরকার। লেখাপড়ার তত বালাই নাই।
সেই সিকান্দর হঠাৎ বদলে যায়। স্কুলে ভাল ছাত্রের খাতায় নিজের নাম লেখায়। তারপর ফাইভে বৃত্তি পায়। এইটে বৃত্তি পায়। মেট্রিকে বোর্ডস্ট্যান্ড করে। সম্মিলিত মেধাতালিকায় সাত। সাংবাদিকেরা তার বাড়িতে ভিড় জমায়। তিনি আজ সিকান্দার সাহেব, একটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। সেই গ্রামের সিকান্দরকে পাল্টে সিকান্দার। নামে একটি আ-কার যোগ হয়েছে। লেজ হিসেবে জুটেছে ‘সাহেব’। শহরের বিজলী বাতি আর এসির বাতাসের কারণে চৈত্রের রোদের কথা ভাবতেই দরদর করে ঘামেন তিনি নিশ্চয়ই। গ্রাম থেকে আসা সিকান্দার সাহেবের এক আত্মীয় কাম দর্শনার্থী তার ড্রইংরুমে বসে এ বিষয়গুলোই ভাবছিলেন। শহুরে, শিক্ষিত, আরামবিলাসী সিকান্দারের নস্টালজিক হওয়ার সময় কই!
কবি সৌমেন সাউ ও ‘যদি সব সত্যি বলতে পারতাম’
শান্তম
“এই পৃথিবীর কেউ জানে না / আমার একটি আশ্চর্য সুন্দর গাছ আছে / এই পৃথিবীর কেউ জানে না / এই পৃথিবীর কেউ জানে না / যার জন্য আমি আরও এক হাজার বছর বেঁচে থাকতে পারব / আরও এক হাজার বছর” (এই পৃথিবীর কেউ জানে না)।
শুধু কী মুগ্ধতা! না আলোর গান! কবি সৌমেন সাউ সন্ধান করে চলেছেন এক আলোবিন্দুর। যে শুধু তার আলো দিয়ে বহুবর্ণ পৃথিবীকে পরিচিত করে না, চিনিয়ে দেয় অন্ধকারকেও; সমূহ অন্ধকারের ভেতরের আলোকেও। এত এত অসুন্দর! সুন্দও কোথায়! সমাজ ও পৃথিবীর তির্যক দৃষ্টির পাশে সে ভীষণ একলা-
“এখানে - ওখানে / তীর্থের কাকের মতো বসে থাকা দু-একটি মানুষ / ফুল কুড়িয়ে যায় / কথার আড়ালে, চোখের আড়ালে” (নির্ভরতা)
কবিকে আহত করে এই পৃথিবীতে ক্রমশ ফুরিয়ে আসা ভালোবাসা-
“তুমি জানো না তৃণা / এখানে কেউ কাউকে ভালোবাসে না / এখানে মানুষের চারপাশে সারাদিন ধুলো ওড়ে / কেউ কাউকে দেখতে পায় না”। (নিরাশ্রয়)
তাই তাঁর প্রার্থনা-
“এই পৃথিবীকে সবাই যেন ভালোবাসে” (প্রার্থনা)
কবির চোখ পৌঁছে যায় সম্পর্কের রহস্যময় প্রদেশেও। তিনি লক্ষ্য করেছেন বহুদিন ধরে সম্পর্কের আপাত সহজ রূপের ভেতরে মিথ্যেগুলি থাবা বসায়, মিথ্যে সত্য হতে চেয়ে ধ্বংস করে সংবেদ ও সূ² হৃদয়বৃত্তিগুলিকে-
“এই ভঙ্গুর পৃথিবীতে / কেউ একজনও আর একজনকে বোঝে না / তবু প্রত্যেকে কাউকে না কাউকে জড়িয়ে ধরে বলে / আমি তোমার সবটুকু বুঝি যা কেউ বোঝে না “(এই ভঙ্গুর পৃথিবীতে)
তাই দুঃখের কাছে গিয়ে বলেন-
“আমি আমার অন্ধকার মাখা গ্রামে / একা পৃথিবীর কথা লিখছি / বিপর্যয়কে একপাশে সরিয়ে / আমাদের রাখাল ছড়ানো রোদে প্রেমের মুকুট পরেছে / আর তাকে ঘিরে চড়–ই, ফিঙে, শালিক নেচে যাচ্ছে”(এই পৃথিবী)
এত ধ্বংসে শোকসন্তপ্ত পৃথিবী । কিন্তু ধ্বংসের সমান্তরালে সৃষ্টিও নিয়ত ক্রিয়াশীল-
“বৃষ্টি হল খুব / সৃষ্টির দিকে সমস্ত দরজা খুলে গেল-” (ধর্মরাজ্য)
অসুখ আক্রান্ত এই পৃথিবীকেও তিনি দেখতে পেয়েছিলেন বেশ কয়েকবছর আগেই। তাঁর দূরদৃষ্টি পাঠককে অবাক করবেই-
“কিছু হোক কিংবা না হোক / একবার তো ভালো হোক পৃথিবীর ছোঁয়াচে অসুখ” (আয়ুষ্কাল)
এই অসুখ থেকে বেঁচে ওঠার গানও তিনি গাইলেন সেদিনই-
“বহুদিন একা হয়ে আছি, বহুদিন / বহুদিন গাছ হয়ে আছি / মানুষের ভিতর, অনন্ত নীল আকাশের নীচে / একা হয়ে নিজের কাছে একা উঠে দাঁড়াই” (একা হয়ে আছি)
বাংলা কবিতার এই সহজিয়া সাধক কত সহজ করে বলেন ভালোবাসার কথা, আশার কথা তা সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার কাছে বিস্ময় বলেই মনে হয় । কতখানি কবিতাময় তাঁর শব্দগুলি কিম্বা শব্দগুলির মাঝখানে থাকা শূন্যস্থান-
“আজ কুড়ি জুন, তোমার জন্মদিন / তুমি অশোকগাছের নীচে দাঁড়িয়ে মানুষের কথা ভাবছ / যে-কথা এর আগে কেউ এমন করে কখনো ভাবেনি / আমি একজন্ম থেকে আর-এক জন্মের দিকে পা রেখে বলি / কবি, আরও বৃষ্টি, আরও ভালোবাসা এনে ভরিয়ে দাও / এই বাংলার ভগ্ন হৃদয়গুলি” (তোমার জন্মদিনে )
পঞ্চান্নতম বসন্তের সামনে দাঁড়ানো এই কবি জীবনকে এঁকে চলেছেন গভীরতম ভালোবাসায় । আলোর সন্ধানে নিমগ্ন এই কবিকে শুধু শ্রদ্ধা নয় অন্তরের ভালোবাসাও।
No comments:
Post a Comment