সোমবার
১লা আষাঢ় ১৪২৭, ১৫ই জুন ২০২০
কবিতা
সৌরভ বর্ধনখিদে
এখন আমি ফোঁটা ফোঁটা চোখ
প্রবল আত্মসাৎ করি দিনে তিনবার :
একবার ধুলোর বদলে সকালে
দুপুরের দিকে একবার রোদের পরিবর্তে
আর একবার জলের স্থলে রাত্তির বেলা
ফলত আমার যাপন থেকে ক্রমশ
এই ধুলো-রোদ-জল হারিয়ে যাচ্ছে
তাদের স্বাদ ঘ্রাণ অনুভব আমি ভুলে যাচ্ছি
তাই জীবনের কাছে পরিবেশের
এসব জৈবিক উপাদানের গুরুত্ব কী
তা জানবার অঙ্গীকার আমাদের নেই আর
আমি ধুলোহীন বায়ুর সখ্য
আমি রোদহীন আলোর স্পর্শ
আমি জলহীন নদীর ক্ষত বয়ে চলেছি দেহে
একদিন এই সময় আমাকে মাটি খুঁড়ে বার করবে
আমার ছত্রে ছত্রে লেখা থাকবে ভগ্নাংশের ইতিহাস
-কী প্রবল খিদে নিয়ে আজ ঘুমোতে চাইছি আমি
প্রণবকুমার চক্রবর্তী
আমাকেই যেতে হবে
স্বপ্ন ভেঙে পড়ার আর্তনাদে
চিন্তিত ঠোঁটের মতো কেঁপে ওঠে
আকাশের ঝুল বারান্দা
চমকানো সূর্যের
চমকানো চোখে
মরুপ্রান্তরের ধূসর ছায়া
আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভেঙে
নেমে আসে মনের অভ্যন্তরে
যেখানে
মৃত্যুর গন্ধমাখা রাজ-প্রহরী
ঋতুবতী কবিতার অক্ষরগুলোকে
ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে .....
আলাপন সঙ্গীত মুলতুবি রেখে
অভিমানে
বাসন্তিকা সুন্দরী
কোনও এক ঊষর ভূমিতে হেঁটে হেঁটে
নিজের মতো চলে গেছে
আমাকেই যেতে হবে ফেরাতে তাকে ...
রওশন রুবী এর সাক্ষাৎকার
কবি, গল্পকার, উপন্যাসিক।
বিএসএস সম্পন্ন করে এখন যুক্ত আছেন শিক্ষকতায়।
প্রকাশিত গ্রন্থ: ৫টি কাব্যগ্রন্থ, ৩টি গল্পগ্রন্থ, ৩টি উপন্যাস, ১টি কিশোর গল্পগ্রন্থ।
সম্পাদিত পত্রিকা: প্রগতি ও স্বপ্নীল অনুভব
স¤পৃক্ত আছেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনে।
লেখার শুরুটা কিভাবে ?
নিজেকে আবিষ্কার করার মধ্য দিয়ে লেখার শুরু। মানে যখন নিজেকে চিনতে শুরু করলাম। তখন কাউকে বুঝতে দিতে চাইনি আমাকে। আর এই গোপন করার কৌশলের জন্য শব্দের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে আমাকে। শব্দ নিয়ে খেলতে খেলতে লেখাটা শুরু। পরে অবশ্য মানুষ এবং প্রকৃতি নিয়ে কাজ করবার চেষ্টা করছি। শব্দ প্রকৃত বন্ধু আমার, “সব বুঝে, সব বলে এবং আগলে রাখে।”
আর সিরিয়াসলি কবে লিখতে শুরু করা?
আমি সব সময় খেয়ালি। আমার সমস্ত স্বতন্ত্র তন্ত্র জুড়ে কেউ গেয়ে ওঠে, আমি গাই। কেউ শব্দের সীমান্ত খুলে দেয় আমি ভেসে যাই। তবে জানি, কোন কিছু অপূর্ণতা, ভাঙা-চোরা পরিতৃপ্ত আনে না। তাই প্রচেষ্টার পর প্রচেষ্টা চলে। ভেঙে গড়ি আর গড়ে ভাঙি। তারপর হয়তো কখনো মননের ভেতরের ঝড় থামে। কখনো থামেই না। আমি অবলোকন করি ভিন্ন এক মনোরম প্রকৃতি। একটা ঘোর। ঘোর ছাড়া কিছু কি হয়েছে কখনো? সব জন্মই ঘোরের ফসল।
কেন কবিতা লেখেন? প্রেরণার কোন জায়গা আছে কি?
বেঁচে থাকার জন্য, ভুলে থাকার জন্য আর প্রতিবাদের মাস্তুলে ধাবমান হাওয়াকে আয়ত্ব করার জন্য লিখি। প্রত্যেকের প্রেরণার একটা জায়গা থাকে। নিরেট সত্য হলো আমার প্রেরণার কোন জায়গা নেই। মানুষের দেয়া নিকৃষ্ট আচরণ আমার প্রেরণা। আর সব শেষে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিয়ে আমার মধ্যে আমাকে খুঁজে পাওয়ার নাম প্রেরণা।
কবি বা লেখেককে কতটুকু রাজনীতি সচেতন হতে হয়?
কবি বা লেখককে সর্বেসর্বা হতে হয়। যে যত জানবে এবং সচেতন হবে তার লেখা ততই মেধহীন, সরস, ভাবপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ হবে। যা পাঠক মনকে নৃত্যকলার মতো আচ্ছন্ন করে রাখবে। সংগীতের মতো মুগ্ধ করে রাখবে।
লেখার সন্তুষ্টি নিয়ে কোন লেখককে কি কখনো থেমে যাওয়া উচিত? আপনার মতামত কি?
প্রকৃত লেখকের জীবনকাল সন্তুষ্টি আসে না। তাই থেমে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। লেখা স্রষ্টার দান, প্রকৃতরা চর্চায় থাকেন।
কবিতার নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা বা প্যাটার্ন আছে?
অবশ্যই আছে। আমরা জানি পুঁথিবদ্ধ ভাবে কবিতার তিনটি ছন্দ আছে স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত এবং অক্ষরবৃত্ত। এছাড়াও কবিতা মুক্তকছন্দ এবং গদ্যছন্দে লেখা হয়। কবিতা হলো শব্দ, ছন্দ, ভাব, ভাষা, চিত্রকল্প ভাবকল্প, রূপকের সমন্ময়ে গঠিত শিল্পোত্তীর্ণ মুগ্ধ এবং সুগন্ধী এক অধ্যায়, যেখানে দর্শন, রসায়ন, বিজ্ঞান, তত্ত¡বিদ্যা, তথ্য প্রভৃতি বিষয়ের অবস্থা বুঝে উপনীত হবে। তখন পাঠে কবিতা পাঠ শেষে কবিতার নির্যাস বিমুগ্ধ হবে। যা তার বোধকে জাগ্রত করে ভাবনাকে প্রসারিত করবে। কবিতার সবটা পড়তে পারে সবাই কিন্তু বুঝা পারে না। এটা ধীরে ধীরে আবিষ্কার করতে হয়।
এখন কোন বইটা পড়ছেন?
ভি.এস.নাইপল এর ‘এ হাউজ ফর মিঃ বিশ্বাস’( ২০০১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জয়ী উপন্যাস)। শেক্সপিয়র থেকে কীটস, রবার্ট ফ্রস্ট থেকে ইলিয়ট (কালাতীত ইংরেজি কবিতার অনুবাদ সংকলন)। সিকদার আমিনুল হক এর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ পড়ছি।
এ সময়ের কোন কোন কবির কবিতা আপনাকে ভাবায়, থমকে দেয় ?
এটা বলা মুসকিল। অনেকর কবিতা ভাবায়, থমকে দেয় না। অনেকে আছেন লিখছেন, তবে ভাবনা সুদূর প্রসারি নয়। চিত্রকল্প আর ভাবকল্পে ফাঁটল। কিছু একটা জোড়াতালি দিয়ে ভীষণ পরিতৃপ্ত। কবিতার শুরু থেকে শেষ ভাবগত যেমন একটা মিল আছে। তেমনি তার শব্দে সুর লয় তালেও আছেন। শব্দ নিয়ে যিনি যত খেলবেন তিনি তত পাকা খেলোয়ার হয়ে উঠবেন। এখন দেখি কবিরা আত্ম-প্রসারে নিমগ্ন থাকেন। আত্ম-প্রসারের চেয়ে কবিদের কর্তব্য আত্মমগ্ন হয়ে কবিতাকে দাঁড় করানো। কবিতা তো শুধু শব্দের সাম্পান নয়। এ এক সত্তার আলোকপ্রবাহ। এই প্রবাহকে ধারণ করতে হবে। সৃষ্টি আর স্রষ্টাকে সবাই ধারণ করতে পারে না। ধারণ করতে পারে না বলেই বিপত্তি থেকে যায়। এর জন্য আত্ম-অহংকার দায়ী। তবু যদি বলতেই হয় তবে বলব এ সময়ের কবিদের মধ্যে যাদের কবিতায় প্রচুর দর্শন শিল্পোত্তীর্ণ চিত্রকল্প থাকে। যা ভিন্ন একটা আবেস সৃষ্টি করে। সেই সুদক্ষ শব্দচাষাদের কবিতাই ভাবায়। তবে থমকে দেয় না।
আপনার কবিতা আপনার সমসাময়িকদের থেকে কোন জায়গাটায় আলাদা বলে আপনি মনে করেন?
এ বিষয়ে বলব, “যে কথা পাঠক এবং বিশ্লেষকগণ বলবেন। সে কথা আমার না বলাই ভালো।” তবে আমার মনে হয় এখনো শুরুই করতে পারিনি। কবিতা বাতাসের মতো হাল্কা কিছু নয়। সে রহস্যেও সৌরজগত। যাকে আয়ত্তে¡র বিদ্যে রপ্ত করতে হয় ধ্যানমগ্ন হয়ে। যা পেরে উঠিনি।
লেখা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুককে কিভাবে দেখেন ?
মন্দ কী? যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে মানুষ। চলুক।
আপনি কি এক বসায় কবিতা লেখেন, না কি বারবার সংশোধন করেন?
কিছু কিছু গতি নিয়ে আসে। তাকে রোধ করার করো শক্তি নেই। বেশির ভাগই বহুবার বহুরূপে সংশোধিত। অনেক সময় দেখি প্রথমে প্যাটানটিই নেই। কত কত প্রিয় বাক্য, বাক্যাংশ ফেলে দিয়ে নতুনকে আঁকড়ে নিতে হয়।
বর্তমান সময়ের কবিতার বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতা ও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ বিষয়ে কিছু বলেন। কবি কি পাঠকের রুচির সাথে আপোষ করে কবিতা লেখা উচিত?
বর্তমান সময়ের কবিরা দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছেন এটা ঠিক। এতে করে তারা পাঠক থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছেনও। কবিতার সহজলভ্যতা হৃদয়কে আন্দোলিত করে। মনন এবং মস্তিষ্ককে ভাবনায় জড়িয়ে রাখে। নতুন স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করে। সহজে যা হৃদয় দোলায় তাকে কাঠিন্যে কেন জাড়ানো? কবিতা হবে মেঘের চেয়ে পেলব, শুভ্রতার চেয়ে স্নিগ্ধ, সমুদ্রের হাওয়ার চেয়ে প্রশান্তিময়, আগ্নেগিরির চেয়ে দীপ্ত, তলোয়ারের চেয়ে তীক্ষ্ন দুলদুলের চেয়ে চপল, ঝর্ণার চেয়ে মোহময়, আসলে কবিতা হবে নিসর্গের অনন্য ব্যঞ্জকে তৈরি ব্যাঞ্জন। যা অমর অমৃত। এর জন্য একজন কবিকে হতে হবে সাধক। সাধনায় জানতে চেষ্টা করবেন তাবত বিষয়। পড়তে হবে অধিক। পড়ার বিকল্প নেই। অনুভবে অন্যকে নিজের ভেতর নিজেকে আবিষ্কার করতে হবে অন্যের ভেতর। নিজ ধমনির রক্ত বিন্দু চলাচলের গতিবিধি নখদর্পনে থাকতে হবে। সর্বোপরি শব্দ ভান্ডার থাকতে হবে অপরিসীম। একজন কবি সব সময় পাঠকের রুচির উপর নির্ভর বা আপোষ করে কবিতা লিখতে পারবেন না। তবে তিনি পাঠকের কথা ভাববেন এবং চেষ্টা করবেন তাদের জন্য। তিনি যত জ্ঞানার্জন করবেন ততই তিনি আবিস্কার করতে পারবেন পাঠকের মন এবং জয় করবেন অসাধ্যকেও। তখন তিনি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন না।
কবির স্বাধীনতা কবিতা কে কিভাবে প্রভাবিত করে?
কবির স্বাধীনতা কবিকে পুরোপুরি প্রভাবিত করে। কবিকে শৃঙ্খলে বন্দী বা কারা বন্দী করলেও তিনি থাকেন মুক্ত। একজন কবিকে অবশ্যই স্বাধীন সত্তার অধিকারী, বিচক্ষণ, স্ববিবেচক হতে হবে। কবি তার চিন্তার স্বাধীনতা দিয়ে অপার কাব্যময় এক কাল্পনিকজগত সৃষ্টি করবেন। সে জগতে তিনি ঘোরেমগ্ন শ্রেষ্ঠচাষা। তাঁর শ্রম অনাবাদী জমির বুকেও সোনালি ফসলের হাসি। তিনি সেই ফসলের মাঠ ছাড়িয়ে শিল্পময়তায় ঢুকে পড়বেন মানুষ থেকে মানুষের ভেতর, যুদ্ধ, শান্তি, মানবতা এবং সমস্ত সৃষ্টির ভেতর। তিনি সমাজের সর্বস্তরে প্রবেশ করে মর্মস্পর্শী আনন্দ বেদনা খুঁটে খুঁটে তুলে আনেন বিষ এবং মধু। তারপর তিনি তার ইচ্ছে অনুঃপাতে বিচরণে রূপকের আশ্রয় নেন। কবি তাই তার জগতে অবারিত, সুচিন্তিত এবং ব্যাপ্তিশীলতায় সুদীপ্ত ছাপ রেখে যান। যা কবিকে বাঁচিয়ে রাখে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
একজন কবি সমাজের এমন এক চোখ, যে চোখ দিয়ে সমাজের অন্তর-আত্মাকে এফোঁড় ওফোঁড় করা যায়। তিনি স্বাধীন ভাবে বিচরণ করতে যদি না পারেন, তবে এ চোখের মৃত্যু হয়। সেই মৃত চোখ কেতকী ফলের সমতুল্য।
সাহিত্যের বিশ্বাস আর ধর্মের বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য বা দ্বন্দ্ব কোথায়?
এটা একটা ব্যাখ্যা করার মতো প্রশ্ন। সংক্ষেপে এটুকু বলতে পারি “সাহিত্য আর ধর্ম দুটোই আলাদা বিষয়। একটা ঈশ্বর বা স্রষ্টার আরাধনা এবং তাঁর হুকুম মেনে চলার ক্রিয়া কলাপ। আরেকটা ঈশ্বর বা স্রষ্টার প্রদত্ত জ্ঞান চর্চা থেকে অর্জিত ফল।”
ধর্ম এবং সাহিত্য ভিন্ন হলেও সাহিত্য চর্চায় অবশ্যই ধর্ম আসবে এবং আসে। কবিতা লিখে কোন কোন মানুষ নিজেকে ঈশ্বর ভাবেন। আমি মোটেই সেই দলে নই। ঈশ্বর এক আলোকিক সর্বশক্তির মালিক। যিনি সর্বজ্ঞান সম্পূর্ণ। যতো মানুষ নিজেকে ঈশ্বর ভেবেছেন তত মানুষ একদিন না একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করেছেন বা করবেন। কিন্তু ঈশ্বর বা স্রষ্টা কখনো তা গ্রহণ করবেন না। তিনি কারোর থেকে জন্ম গ্রহণ করেননি। মানুষ অবশ্যই জন্মগ্রহণ করেন। মানুষ কবিতা লিখতে পারবেন, চাঁদ, সূর্য, তারা, পানি, বাতাস, গাছ-পালা ইত্যাদি সৃষ্টি করতে পারবেন না। তাই বলতে পারি সাহিত্যে ধর্ম থাকবে, ধর্মে সাহিত্য নাও থাকতে পারে।
আপনার প্রিয় লেখক কারা?
এই তালিকা অবশ্যই লম্বা। সবার নাম নাইবা বললাম। যাঁদের নাম না বললেই নয়, তাঁরা হলেন- জীবনান্দ দাস, রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, শেক্সপিয়র, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বেগম রোকেয়া, সমরেশ মজুমদার, হাসান আজিজুল হক, ম্যাক্সিম গোর্কি, শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হেলাল হাফিজ, রফিক আজাদ, পাবেলো নেরুদা, নাজিম হিকমত, ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি, কহলীল জিব্রান, সিকদার আমিনুল হক, কবিতা সিংহ, আল মাহমুদ, মহাদেব সাহা, আবু হাসান শাহরিয়ার।
No comments:
Post a Comment