শুক্রবার
১২ই আষাঢ় ১৪২৭, ২৬ই জুন ২০২০
কবিতা
অমিতাভ মীরহেঁটে যায় সন্ধ্যামণি
মৈনাকের জলপ্রপাত পাহাড় থেকে নেমে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলে নদীর কাছে- নদীও যদি চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দেয়; বলো, ঝর্ণার কি দোষ আছে তাতে?
কাঁখের কলসিতে চোখের সবটুকু আলো ভরে হেঁটে যায় সন্ধ্যামণি দিগন্তের পথ ধরে, প্রগাঢ় অনুরাগে অন্ধকার মৈথুনে মেতে মনের সব রঙ ছিনিয়ে নিয়ে,
যদি সময়ের গল্প পটে এঁকে রাখে; জোছনার দোষ কতটুকু দেয়া যাবে?
বিনিদ্র রাতে আমিও বাতায়নে জেগে হংস মিথুনের মৈথুনের রঙে ভিজে, নিজেকে পুড়িয়ে যাই অনিদ্রার হাতে, তুমি;
বিলাসিতা বোলো না যাপিত এই সময়কে।
শুভ্রা কোনার
আমি আধুনিক
ধানবাদ -- ভারত
আধুনিকতার মোড়ক মুড়ে --তুমি আমি অস্থির,
বলে চলেছি অনর্গল- অন্তরাত্মা বধির,
একলাফে ওপরে উঠি--- একলাফে নীচে, সামাল দিতে আমিও কাবু- বেসামাল তুমিও নিজে
স্বাধীনতা ভাসছে দেখো--- ফাঁকা অন্তরীক্ষে,
আধুনিকতা চেপে ধরে- রেখেছি কেমন বক্ষে।
আমি ধবল হয়ে চেয়েছিলাম বাঁচতে---
চেয়েছিলাম চেতনার বিকাশ ঘটাতে।
শূন্য হয়ে রয়েছি সব একাকী---
বহমান মরীচিকা সভ্যতার প্রেক্ষাপটে।
তবুও তুমি কি যেন--- বলতে চাও আমায়, আমি শুনবো না ভেবেও-- বার বার ফিরে তাকায়।
আজকাল কেউ পথে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয় না,
গুমরে ওঠে স্নিগ্ধ নিশ্বাস আধুনিকতার বাতাবরণে
আমি-তুমি আধুনিক হয়ে বসে আছি কিনারায়,
ভুলে গেছি সব সত্য-মিথ্যে---
শুধু বেঁচে আছি--- অন্যের ইশারায়।।
জাহাঙ্গীর ডালিম
বর্ষার প্রেম
বর্ষণ মন্দ্রিত সন্ধ্যায়
ভিজে ভিজে
হতে হবে একসায়
ই-ভরা ভাদরে ভাদরে
জ্বর বিনে গতি নেই আমার ?
ঠিক এখনটায় তুমি যদি আসতে
ওগো দরদিয়া
এক খানা কালো কুচ কুচেছাতা
শীলা ঘটক
য়তো এটাই জীবন
কখনো কখনো একটা হৃদয় আকাশ হয়ে যায়
একটা মন নদী হয়ে যায়
এক টুকরো অভিমান বয়ে আনে বৈশাখের নতুন উষ্ণতা।
হয়তো এটাই জীবন।
কখনো কখনো কিছু রাগ সাইক্লোন হয়, কালবোশেখের গোধূলিতে।
কিছু চুপ করে থাকা কথারা
গান অথবা স্লোগান হয়
কালের বিবর্তনে!
হয়তো হয়তো-বা!
অনুভবে অনুরণনে
বুকের মাঝেই রেখো তাকে।
ভালো-বাসা যদি না দিতে পারো
ভালোবাসাটুকু দিও তাকে।
হয়তো এটাই জীবন।
কিছু দুঃস্থের কান্না আর্তের চিৎকার
পৌঁছায় না সহায়তার হাত
কেঁদে ওঠে মন
হয়তো এটাই জীবন!
কিছু অন্যায় কিছু অবিচার
মানতে পারেনা মন
ছিন্নভিন্ন করে রক্ত দিয়ে মুছে দিতে চায় মন
এই কলঙ্কিত ক্ষণ!
পিছুটানে অক্ষমতা
হয়তো এটাই জীবন।
রুহুল আমিন (রনি)
হাটে হাঁড়ি ভাঙা
বেলাশেষে কোথায় হারিয়ে যাবো কে জানে?
সবাই স্বার্থপরতা দেখায়,
কেউ কেউ দেখায় উদারতা!
কে জানে?
কোথায় হারিয়ে যাবো আমরা......
অন্যায়ের বিচারটা কার গরমে,
যেনো কিছুই হয়নি!
মোরলরা সব টাকার গরমে ভাবসে গেছে।
কে জানে?
কোন বেলায় কোকিল আমারে ডাক দেয়!
যতোদিন থাকবে তুমি, থাকবে হাতে শক্ত লাঠি,
কে জানে?
কার কপাল পুড়বে, পড়বে সেদিন পিঠে লাঠি।
দেখবে আগে বিবেক, দেখবে সুধী করবে বিচার,
ভাঙবে হাটে হাঁড়ি।
ভাষান্তর: কায়েস সৈয়দ
মৌগিনস সুবিশাল দিগন্ত
১২ সেপ্টেম্বর ৩৭
মূল: পাবলো পিকাসো
জাহাজঘাটে বিহারের শেষে
ক্যাসিনোর পিছনে ভদ্রলোক
যথেষ্ট বিনীত পরিপাটি খুব
তার ভাজা
গলিত মলমূত্রের ব্যাগ খায়
তার প্যান্টের ডোরাকাটা
থুথু ফেলে অমায়িকভাবে
সমুদ্রের মুখে
জলপাইয়ের দাগ
তার প্রার্থনাকে
মাল্যাকারে সুতায় গাঁথে
ফ্ল্যাগ গ্রিলিং এর রশিতে
শপথ বাক্য শেষে
যা আলোকিত করে দৃশ্য
সংগীতটি আড়াল করে
তার পাকস্থলী রঙ্গভূমিতে
এবং মুক্ত করে
এর ভয়
ভীমরূলের দেহ থেকে
ছড়িয়ে পড়ে পা
পাখাটি তার মোম গলায়
নোঙরের উপর
অণুগল্প
চম্পাকলির দিনরাত্রিস্বপঞ্জয় চৌধুরী
শহরের ব্যস্ততম রাস্তা তার পাশে একটি পার্ক। পার্কে লাগানো সারি ঝাঊগাছ, নানা পদের দেশি বিদেশী ফুলের গাছ। প্রাত ভ্রমণে বুক ভরে নিশ্বাস নেয়ার একটি জায়গাই আছে ফ্রিডম পার্ক। এখানে সবাই বুক ভরে স্বাধীন ভাবে নিশ্বাস নিতে পারে। যারা এখানে নিয়মিত মর্নিং ওয়াকে আসেন তারা হয়তো দেখে থাকবেন। একটা দশ বারো বছরের মেয়ে প্রতিদিন ভোর বেলা এখানে শিউলি ফুল কুড়াতে আসে। ফুল ভালোবাসে এজন্য নয়, এ ফুল কুড়িয়ে ওরা মালা তৈরি করে। শুধু ও নয় ওর মতো অনেকেই ফুল কুড়ায় এই পার্কে। মেয়েটির নাম চম্পাকলি। জন্মের সময় দাদি নাম রাখতে চেয়েছিল চম্পা আর নানি রাখতে চেয়েছিল কলি। নাম রাখা নিয়ে সেকী বিশাল বাহাস। তারপর বাপ বুদ্ধি দুইজনের নামই চ‚ড়ান্ত করেন -ওর নাম হবে চম্পাকলি। আজ দাদি, নানি, বাপ কেউই বেঁচে নেই। ভিটে বাড়িটাও গিলে খেয়েছে নদী। বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো তাকে এই ফ্রিডম পার্কে ফুল কুড়াতে হতো না। প্রতিটি শিউলি ফুলের ভেতর সে এক একটি ভাতের দানার ছবি দেখতে পায়।
ওদের মহাজন কলিমুদ্দি সরদার। বিশজনের ফুল কুড়ানো ও ফুল চুরি করার একটা টিম আছে। ফুল কুড়িয়ে মালা বিক্রি করে কমিশন দিতে হয় কলিমুদ্দিকে। দুইশ টাকা ফুল বেঁচলে পঞ্চাশ টাকা কলিমুদ্দির। এভাবে প্রতিদিন বিশজনের কাছ থেকে মোট এক হাজার টাকা কমিশন আদায় করে কলিম। চম্পাকলির মা বাসায় কাজ করে। চম্পাকলি ফুল বিক্রি চাল, ডাল, তেল, নুন এসব কিনে নিয়ে যান। গায়ে গতরে বড় হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। মায়ের তাই অনেক চিন্তা। এভাবে আর কতদিন ফুল বিক্রি করে চলবে। আর কয়েক বছর গেলে তাকে গার্মেন্টস এ চাকরি নিতে বলবে। আজ খুব বেশি বেচা বিক্রি হয়নি। শহরের মানুষগুলো বেরসিক হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। ফুল কেনা কমিয়ে দিয়েছে। এখন প্রেমিক প্রেমিকারা পার্কে যায় না। তারা ঘুরতে যায় রেস্টুরেন্ট অথবা সিনেপ্লাক্সে। তার উপর দেশে নাকি কী এক ভাইরাস এসেছে তাই রাস্তাঘাটে গাড়ি ঘোড়া মানুষজন দিনদিন কমে যাচ্ছে। সামনের সপ্তাহ থেকে নাকি গাড়ি ঘোড়া সব বন্ধ করে দিবে। তখন কী হবে? মায়ের কামাই চলে যায় ঘর ভাড়া দিয়াই। আগে মা পাঁচ- ছয়টা বাসায় কাজ করতো। গেলোবার টাইফয়েড হয়ে শরীরের বল কমে গেছে। ভারী জিনিস উঠাতে পারেনা তেমন। দুই তিনটা পুরোনো বাসায় তাকে কাজে রেখেছে। তাই বাধ্য হয়েই তাকে ফুল বিক্রি করতে হয়। নতুবা তাদেরকে না খেয়ে থাকতে হবে।
সপ্তাহ খানেক পর শহরে লকডাউন ডাকা হলো। চম্পাকলির মা শোমেলাকে বেতন দিয়ে আপাতত এক মাসের জন্য বিদায় দিয়েছে। বেতনের টাকা বস্তির ঘর ভাড়া দিয়েই শেষ। ফুল বিক্রি বন্ধ। রাস্তায় গাড়ি নেই মানুষ নেই। পুলিশ যাকে দেখছে তাকেই লাঠি পেটা করছে। কলিমুদ্দিরও ধান্দা বন্ধ। এদিকে শোমেলার শরীরেও জ্বর। ঘরে চাল ডাল নেই। শুনেছে বড়লোকেরা নাকি রাস্তায় এসে চাল, ডাল, আটা, মুড়ি দিয়ে যাচ্ছে। চম্পাকলি খাবারের সন্ধানে ঘরের বাহির হয়। অনেক ক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়েও কোন ত্রাণদাতার দেখা পেলোনা। আজ তাদের না খেয়ে থাকতে হবে। মায়ের জ্বর বাড়ছে ক্রমশ। একটা ওষুধ পাতি কিনে দিবে সেই টাকাও নাই। বিষণ্ন মনে সে বস্তিতে ফিরে আসে। বস্তির মোড়ে কলিমুদ্দির সাথে দেখা। কলিমুদ্দি নাকি নতুন কোন ব্যবসা বাহির করছে শর্টকাটে ইনকাম। চম্পাকলি তার কাজের কথা জিজ্ঞাসা করে। কলিমুদ্দি খিল করে হেসে বলে। এই ব্যবসা হইলো ত্রাণের ব্যবসা। যাবি ত্রাণ নিবি সেইখান থিকা আমারে কমিশন দিবি, যাবি? চম্পাকলি সরল মনে মাথা নাড়ে। সে কলিমুদ্দির সাথে পাশের গলিতে এক অভিজাত বাড়ির ভেতরে যায়। দারোয়ানকে আগে থেকেই বলা আছে সব। দারোয়ান কলিমুদ্দির দিকে তাকিয়ে বুড়ো আংগুলের থামস আপ দেখায়। চম্পাকলির বাড়ির ভেতরে পা রাখা মাত্রই তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো। পাঁচতলা ফ্ল্যাটে ওকে ঢুকিয়ে দিয়ে নিচে চলে আসলো কলিমুদ্দি। ফ্ল্যাটের মালিক শরাফত সাহেব বউ বাচ্চাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন গ্রামের বাড়ি। চম্পাকলিকে আনার জন্য তাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন। এমন সুরভিত না ফোটা ফুলের দাম পাঁচ হাজার টাকায় বিকোলো? চম্পাকলির নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সে পালাতে পারছেনা, চিৎকার দিতে পারছে না। তার মতো দূর্বলদের জন্য এ পৃথিবী নয়। যে এতদিন ফুল কুড়িয়ে সংসার চালিয়েছে সে আজ নিজেই ফুল হয়ে গেছে। এক ঘণ্টা পর মাথা নিচু করে সে ফ্ল্যাট থেকে বেড়িয়ে আসে। তার চুল উস্কো খুস্কো, চোখ বিধ্বস্ত নীড় ভাংগা পাখির মতো। কলিমুদ্দি তার হাতে এক হাজার টাকার দুটো নোট ধরিয়ে দেয়, দারোয়ানকে এক হাজার টাকা দেয়। আর পকেট থেকে গুলের কৌটা টাবের করে ঠোঁটের ভিতর গুল গুজতে গুজতে বলে আমি কাউরে ঠকাই না। হে হে হে। চম্পাকলি এলোমেলো চুল গুচ্ছ খোঁপা করে নেয়। বাজার থেকে চাল, ডাল আর মায়ের জন্য ওষুধ কিনে নিয়ে যায়। তার পা গড়িয়ে পড়ছে ফিনকে ফিনকে কাচা রক্ত।
No comments:
Post a Comment