Sunday, June 7, 2020

শিল্প সাহিত্য ৫৫

রবিবার ২৪শে জ্যৈষ্ঠ ১৪২৭, ৭ই জুন ২০২০



কবিতা
গোবিন্দ সরকার
দুঃখ ব্যতীত সুখ

জীবনের গলিপথ অমানিশা
দূর হতে টিপিটিপি মোহাচ্ছন্ন সুখের ক্ষীণ আলো

এটাই বুঝি পুষ্প ছড়ানো সুখের ঠিকানা!

সিঁড়ি ভেঙে হাঁটতে গেছি যেই---
আড়ি পেতে প্রহর গুনছে দুঃখনদী
ছেনি দিয়ে পাথর সড়ানো
পৃথিবীর সব যন্ত্রণা এসে হাজির
ঠাঁয় দাড়িয়ে অহেতুক চোখ রাঙানি
মুখভারে কারি কারি অভিমান
বেদনারা পেয়ে বসেছে আশকারা
মেঘ ভেঙে গর্জন আর বৃষ্টি নামার সামিল।

বুকে হাত রেখে সহসা আশ্বাস সবেধন নীলমণি
লক্ষ্য শুরু গন্তব্যে-----
হে মহাজীবন! কে দুঃখ ব্যতীত সুখ স্পর্শ করেছে?

সুকান্ত দাস
করিডর

বারবার মুছে ফেলা বৃত্তপথ। প্রতিদৃশ্যেও ফেরানো মুখ। পলেস্তারা খসা।

মরমী গানে বিষ মেখে দেখি সেও জ্বলে ওঠে - দাবানল প্রিয়

কুহকিনীর রূপ। পড়নে শিফন শাড়ি। একান্তজনেরা চিনিয়ে দেয় প্রিয় করিডর

এখানে কোন শহীদবেদী নেই। চেনা গিলোটিন।
আপাদ চিরে নিলে কিছু ঋতুরাগ বেরোতেও পারে।

বিষাদ আব্দুল্লাহ
কাম তাড়িত চাঁদ

চাঁদের আলোর ঢেউয়ে ঢেউয়ে চলো 
কলা গাছের নৌকা বানিয়ে 
আমরা ভাসতে থাকি পুকুরে

চারদিকে নরম ঠান্ডা বাতাসের তাণ্ডবে 
আমাদের কাম দেহে ঝরো ঝরো ঘাম ঝরবে
আমরা ভুলে যাবো প্রথম ছোঁয়ার স্বাদ...

শত কিলোমিটার দূরে অথচ 
চাঁদের আলোর ভেতরে তোমার গন্ধ পাই

তুমি তুমুল নিনাদে কেঁপে কেঁপে কেঁদে ওঠছো যেনো,
দুইখানে ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের ঘুম ভেঙে তছনছ... 

সাঈদুর রহমান লিটন
ঝলসানো দুপুর

ক্রমান্বয়ে হাঁপিয়ে উঠছে সময়
প্রখর আলোয় জীবন চলে
চাঁদের সাথে প্রিয়ার সদৃশ এখন নেই
দুপুরের ঝলসানো রোদে দেখি প্রিয়ার মুখ।

প্রেম বাষ্প হয়, দূরে কোথাও উড়ে যায়
চৌচির মাঠ, অথবা নিরেট শিলা
পড়ে থাকে বিছানায়
ছুঁতে গেলে ফের আঘাতে ফিরে আসি।

চোখে দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে
বুকটা ক্রমান্বয়ে জ্বলসে গেছে
দগদগে ঘা কারো পরশে শীতল হয়না
অসহ্য যন্ত্রণায় মুখ লুকাই বালিশে,
বালিশ ভিজে আষাঢ়ের বর্ষায়।


আবু জাফর সিকদার
অনলবর্ষী

আলাপকে বলেছি বহুবার,
চুপ করে থেকো;
নীরবতা হলো শান্ত, সুবোধ
বুক টানটান নতুন কবরের মতো
আহা! কী অবলীলায় তুমি
বায়বীয় ফানুসে হাপরের বাতাস ঢুকিয়ে
মহাকাশ জয়ের রোজনামচা বানাও!
গোবরের ভেতর একটি গোলাপঝাড়
বেড়ে উঠার অর্থ কী তবে,
তার সৌরভ ও সুগন্ধিও বদলে যায়?
মাকালের লতাপাতাফলেও নাকি আছে ঔষধিগুণ
রাস্তার ধারে গজিয়ে উঠা বাঁটফুলেও লুকিয়ে থাকে শেফা
তুমিই কেবল প্রতিহিংসার অনলে
জ্বালিয়ে রেখেছো রাবণের অনির্বাণ চিতা।

ছোটগল্প
হাভাতে সময়
কায়েস সৈয়দ

সকাল জুড়ে বৃষ্টি। বৃষ্টির জল কাচের আয়নায় জীবন্ত কুয়াশা। কারো কারো চোখের আয়নায় কু-আশা। জলবিন্দু গড়িয়ে আরেক জলবিন্দু স্পর্শ করতেই বয়ে যায় ¯স্রোতধারা। এই মেঘডাকা সকালেও নড়ে ওঠে দরজার কড়া। আছিয়া। গেরস্ত মহিলা। দুদিন অন্তর অন্তর করে দিয়ে যায় এ বাসার জমানো সব কাজ। ঘর ঝাড়ু, ঘর মোছা, বাসন মাজা, কাপড় ধোয়া, আরও আনুষঙ্গিক। আছিয়া, অল্প বয়সেই গর্ভ ধারণ করে হয়েছে যে বিধবা। বাসায় মা আর এক সন্তান। উপার্জনের মানুষমাত্রই একমাত্র আছিয়া। তাই চার/ পাঁচ বাড়ীর রোজের কাজ দিয়ে পূর্ণ হয় সপ্তাহের তালিকা।

এই বৃষ্টির মধ্যেও বাসার কাজে আছিয়ার সঙ্গী তার ছোট্ট মেয়ে সুষমা। সমস্ত ঘরে পায়ের ছাপ এঁকে দিয়ে অস্থির এক দুরন্ত সময় পার করে সুষমা। মায়ের সাথে কখনো ঘর ঝাড়ু দেয়, কখনো বারান্দায় গাছে পানি দেয়, কখনো বারান্দা থেকে চুপ করে তাকিয়ে থাকে দূরে, কখনো একা একাই কথা বলে বিড়বিড় স্বভাবে।
মোটেও মনোযোগী নয় পড়াশুনায়। মাঝে মধ্যে বই নিয়ে এসে পড়তে বসে এ বাসার মালিকের বউ মেহেরের কাছে। মনে থাকে না তার কিছুই। আজকে যেই eat শব্দের অর্থ খাওয়া কালকে সেটা হয়ে যায় যাওয়া, আজকে যেই bird শব্দের অর্থ পাখি কালকে সেটা হয়ে যায় ফাঁকি। এভাবে রুই হয়ে যায় দুই, তাল হয়ে যায় খাল আর তিন হয়ে যায় মিঃ বিন!
বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলায় তার জুড়ি মেলা ভার। কল্পনা শক্তিও প্রখর। তার গল্প শুনতে শুনতে খেই হারিয়ে ফেলে মেহের। কখনো সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মেঘের সাথে ধাক্কা খায়, কখনো পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আগুনে পুড়ে যায়। তালগোল পাকানো গল্পে বানায় শাপলার সুতো, যেখানে ঝিলের শাপলায় ফুল হয়ে ফোটে কদম্ব, মাছের পুকুরের তলদেশে বুক টান করে হেঁটে বেড়ায় কাঠ ঠোকরা আর তার ছানাপোনা!

আজকের মতো সব কাজ শেষ। বাসার খালাম্মার কাছ থেকে বিদায় নেয় আছিয়া। কে জানতো বৃষ্টির এই কুয়াশার সকালে তার জন্য অপেক্ষা করছে অসময়ের কু-আশা!
গত এক মাসের টাকার সাথে এক হাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়ে করোনা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বাসায় আসতে মানা করে দিলেন খালাম্মা। আছিয়ার চোখে এসে বাসা বাঁধতে চায় সমস্ত কুয়াশা। চুপ করে টাকা নিয়ে গম্ভীর হয়ে ফিরে আসে তার বাসায়। হয়তো তার মাথার চারপাশে ভনভন করছে আগত দিনগুলোর বিবর্ণ সময়। 

পাশের মহল্লাতেই করোনায় প্রথম মৃত্যু।
এক...তিন...ছয়...নয়...
বাড়তে থাকলো করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু।
লক ডাউন হয় পাশের মহল্লা। এরপর সমস্ত পাড়া...জেলা...এখন পুরো দেশ। বলতে গেলে পুরো পৃথিবী!
হাজারো মৃত্যুর স্তুপে ভারী হয়ে ওঠছে পৃথিবী।
জমানো টাকায় ঘুণ ধরে। ফুরোয় সময়।
বাড়ে ভাতের হাহাকার।
ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে বার বার, যাদের ঘর নেই, যাদের নেই কোনো ঠিকানা কিঙবা গন্তব্য ?
ঘরছাড়া কিঙবা ঘরওয়ালা দিশেহারা হাজারো মানুষ পথহারা হয়ে তাকিয়ে থাকে পথেই,
চোখ খোঁজে ত্রানের সন্ধান!

না...
এ পাড়ায় ত্রাণ আসে না। শুনেছে তাদের কমিশনার এখন জেলখানায়, চাল চুরির দায়।
বাধ্য হয়েই আছিয়া হানা দেয় কাজের বাড়ীতে। কড়া নাড়তে সাহস পায় না সে দরজায়। জানালায় এসে ডাক দেয় মিনমিনে গলায়...
খালাম্মা...খালাম্মা...
-কে?
আমি আছিয়া। কোনো কাম কাইজ করা লাগবো খালাম্মা ?
-না বাফু, করোনা শ্যাষ অউক, তারপরে আইয়্যো।

ভিক্ষুক না হয়েও আছিয়ার চোখেমুখে করুণ ভিক্ষুকের আকুতি। আর কোনো কথা বের হয় না তার মুখ থেকে।
উচ্চস্বরে মনে মনে সমস্ত শক্তি দিয়ে বলে যায় তার সমস্ত অভিযোগের কথাগুলো-
‘সবাই খালি করোনার কতা কয়, খালি গরে থাকতে কয়, খামু কইত্তে হেইডা কয় না! করোনা ছাড়াই গরে থাইক্যা না খাইয়্যা যে মইরা যামু হেইডা কেউ বুজে না’
আছিয়ার মাথায় ভনভন করে দুঃসময়ের মাছি
মলিন হয়ে তার দৃষ্টি চলে যায় সুষমার মুখে
সুষমার মুখের চারপাশজুড়ে এখন হাভাতে সময়

No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক