Saturday, May 16, 2020

শিল্প সাহিত্য ০৫

শনিবার ৫ই বৈশাখ ১৪২৭, ১৮ই এপ্রিল ২০২০


কবিতা
মিজান মজুমদার
মনোভূমি

আমি এক অথর্ব অর্বাচীনও বলতে পারো কেউ কেউ,
শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দিতে পারো অনায়াসেই..

প্রলয়ের সূচনায় যখন সাবধান বাঁশী বাজিয়েছিলেন
ভবিতব্যের বাংলা দর্শনে ব্যস্ত বিজ্ঞানীআমি তখন
হেসে উড়িয়ে দিয়েছি, করোনার চেয়ে ঢের শক্তিশালী
বলে করেছি আস্ফালন, এক টুকরো কাগজ মুঠোয়
পুরে দিয়ে বলেছি ; যা বাবা বাড়ী যাহ!

প্রলয়ের দামামাকে ঠুনকো হাঁড়ির শব্দ ভেবে
আমি ক্ষেপন করেছি সময় সময় আসেনি বলে,
আমার মস্তিস্কে ক্ষমতার দম্ভ বলে আমি অপেক্ষা
করেছি কাউন্টডাউন ঘড়ির কাঁটার ঘুর্ণায়মান অবয়বে,
আমার নাসারন্ধ্রে মানুষের পোড়া মাংশের ঘ্রাণ লেগে
আছে বলে আমি প্রতীক্ষায় থেকেছি, ছুটি বলে ছড়িয়ে
দিয়েছি অনুজীব জলে স্থলে।

অতঃপর আমি স্ব দর্পে ঘোষণা করেছি আমার প্রস্তুতি!
যদিও আমার কোনো একে সাতচল্লিশ নেই
ভাসমান মাইন নেই
গোলাবারুদ নেই
গুলি নেই টিয়ার শেল নেই
যুদ্ধ জাহাজ নেই
পারমানবিক শক্তি নেই।

আমার সন্মুখ সমরের যোদ্ধাদের পড়িয়ে
দিয়েছি মিছে বর্ম
হাতে তুলে দিয়েছি খেলনা পিস্তল।

আমার অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে
মরছে আমার যোদ্ধাগন
মরছে আমার প্রজাগন
অবশ্য প্রজাদের কাছে আমা কোনো
প্রতিশ্রুতি ছিলোনা।

আমার অক্ষমতার  খেয়ালে
ভেসে যাচ্ছে ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার
আমার অন্ধত্বের কালে
চাল চোরে বেড়ে উঠছে চরাচর।

অনুজীব ছড়িয়ে বলি ঘরে থাকো তুমি!
দেখে নাও কী বানাই আমার মনোভূমি!

রথীন বণিক
সেকি

সব স্তন খুব তাড়াতাড়ি গোলাপ হয়ে যাবে
দু চাকার ব্যাস ঠেলে
বৃত্ত
অদ্ভুত
এক লোভ
প্রমাণ ছাড়াই এতোর
গুটিসুটি
না খেয়ে
শত
দেখ ছোটো
অন্য কারোর
পায়খানায়

জারিফ আলম
জন্ম যদি তব এপ্রিলে এবং কিছু অদলবদল

এমন ডিপ্রেসনের কু-ঝিক-ঝিক সময় এসেছে
কে যেনো আলাদা করে রেখেছে আমার পোশাক;
হ্যাঙারে ঝুলে আছে ছায়ার শরীর, আকুল সম্মোহনে।
নির্জনাদের বাড়িতে দুপুর বেলায় শ্মশানের নীরবতা নেমে এলে
তার মনে যে তৃষ্ণার ছড়াছড়ি তা নিয়ে কাব্য করতে ছাড়ে না
বয়ঃসন্ধি পেরোনো তরুণেরা

নির্জনা গোসলটোসল সেরে টাওয়াল দিয়ে মাথা জড়িয়ে রাখে রোদে শুকায় কামিজ, সেফটিপিনে ঝুলতে দেখি
(প্রয়োজনীয় গোপন পোশাক সুগন্ধি মাখা)
মনটা যদিও দৌড়ে বেড়ায়, এইখানে সে স্বস্তি খোঁজে।
এপ্রিলে... দুপুরে... বিকেলের হেলে পড়া ছায়ায়...

মোকলেছুর রহমান
তোমার তরঙ্গ

বুকের ভিতরে বাঁ-পাশে একটা যন্ত্র থাকে
হৃদয়,
তাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না
শুধু অনুভব করি শ্বাস-প্রশ্বাসে
সেখানে থাকো তুমি।
তোমাকে লালন করি
পোষ মানাতে চাই
অথচ তুমি পোষ মানো না...

হিমালয় থেকে নেমে আসা ব্রহ্মপুত্র তুমি
তোমার জলরাশি সমুদ্র বিস্তৃত
সেই সমুদ্রজল সেঁচতে সেঁচতে
শুকাতে মরিয়া আমি!
জল শুকানোর পরিবর্তে
জলতীর্থে থৈ থৈ বিস্তৃত সীমানা
উথাল-পাথাল তোমার তরঙ্গ
তছনছ করে, চুড়মার করে আমার দুকূল
আহা কত বোকা আমি
তোমাকে লালন করি, তোমার কথা শুনি
অথচ তোমাকে দূরে সরাতে চাই।
তোমার, না না আমার
বুকে চর জাগাতে কী মরিয়া আমি!

অণুগল্প
জীবনের মহাজন
কাজী বর্ণাঢ্য

ইদানিং মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের বালাই নাই। যে যার মতো চলছে। দুই হাতে গাছের ছোট দুইটা ডাল নিয়ে এলোপাথারি তাল বাজাতে বাজাতে বটতলা থেকে বাজারের দিকে হেলেদুলে যাচ্ছে বরকত। এলাকার লোকজন তাকে 'বরকইত্তা পাগলা' ডেকে শান্তি পায়। কে কি ডাকলো, কে কি করলো বরকতের তাতে কিছু আসে যায় না। রাগ ক্রোধহীন বরকত দাঁত না মাজলেও একটা স্বর্গীয় হাসি দিয়ে পরিবেশকে সবসময় তরতাজা রাখে। স্বাধীন বাংলার একমাত্র স্বাধীন যুবক বরকত। একাত্তুরের পর জন্ম নিলেও সে বলে থাকে শেখ মুজিব তার কলিজার বন্ধু। দুইজন একসাথে মাছ ধরতো, লাটিম খেলতো, ডিগবাজি দিয়ে পুষ্কুনিতে গোসল করতো। বরকত যখন খুব ছোট এলাকার মানুষ তখন থেকেই তাকে চিনে। ছোটকাল থেকেই বাজারে তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। কেউ কেউ বরকতের লুঙ্গি ধরে টান মারে। তাতে বরকত কিছুটা লজ্জিত হয়ে জিহ্বায় কামড় দিয়ে নিজ হাতে লুঙ্গিটাকে গুছিয়ে নেয়। কেউ কেউ মায়া করে দুয়েক টাকা দেয়, কেউবা আকিজ বিড়ি কিনে দেয়, কেউ রুটি-বিস্কুট-কলা। যার যা মনে চায় বরকতের সাথে সে তা- করে। এতে বরকতের কোনো আনন্দ বা দুঃখ কিছুই হয় না। বরকতকে কেউ পুরোপুরি আনন্দের ভাগ দেয় না এটা যেমন সত্য, আবার বরকতকে কেউ পুরোপুরি দুঃখও দেয় না এটাও সত্য। বরকতকে দেখে আমার একটু মায়া জাগলো। জসিমের দোকান থেকে একটা রুটি কিনে বরকতের হাতে দিলাম। বরকত রুটিটা হাতে নিয়ে দেখলো তার হাতের তৈল চকচক রুটিটার দিকে তিন দিক থেকে তিনটা কুকুর তাকিয়ে আছে। দ্বিতীয় কোনো চিন্তা না করেই রুটিটাকে তিন ভাগ করে বরকত তিনটা কুকুরের দিকে ছুড়ে মারলো। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলাম। যার নিজের খাবারের নিশ্চয়তা নাই সে কিনা এই দূর্দিনে অভুক্ত কুকুরকে নিজের পুরো ভাগটাই দিয়ে দিলো। তিনটা কুকুর যে অনাহারে ভুগছে এতে সন্দেহ নাই। গত সপ্তাও এদের মধ্যে বেশ লাফালাফি ঝাঁপাঝাপি ছিলো। আজ দেখি কেমন রুগ্ন মলিন মুখ। পেটের চামড়াও মিশে যাচ্ছে বুকের হাড়-হাড্ডির সাথে। বরকত কুকুরগুলোর রুটি খাওয়ার দৃশ্য দেখে মিটিমিটি হাসছে। বরকতের বাড়ি কোথায়, বাপ মা কে। এসব তথ্য মানুষের অজানা। মানুষ কেবল বরকইত্তা পাগলাকেই চিনে, জানে। একবার বাজারের এমাথা থেকে ওমাথা আবার ওমাথা থেকে এমাথা যাওয়া আসা করা লোকটার নামই বরকত। কোনো কোনো সময় দুয়েক জনকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দেয়। বিড়ি ফুকতে ফুকতে দোকানদারদের দুয়েক কলসি টিউবওয়েলের পানি এনে দেয়। এভাবেই কেটে যায় বরকতের সারাদিন। রাত গভীর হলে বাজারের যে কোনো দোকানের বারান্দায় ঘুমিয়ে থাকে বরকত। হঠাৎ বাজাওে হৈ-হুল্লোর শুরু হয়ে গেলো। সকলের তাড়াহুড়ো দোকানপাটের সাটার নামানোর শব্দ। একজন আরেকজনকে বলতে লাগলো 'বাড়িত যা বাড়িত যা' আমি খায়ের স্কুল গেটের দেয়ালে স্লোগান লিখিতেছি 'নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখি সদা সুস্থ-সবল থাকি' বাজারের পশ্চিম দিক থেকে একটা হুইশেলের শব্দ আসলো। ব্রাশে লাল রঙ নিয়ে আমি স্লোগান লেখায় মনোযোগ। খায়ের আমার কানের কাছে মাথাটা বাড়িয়ে মৃদুস্বরে বললো 'ভাই দু-তিনটে সেনাবাহিনীর গাড়ি আসতেছে' আমি ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম গাড়ি থেকে সৈনিকরা নেমে মানুষজনকে কি যেনো বলছে। আর পুলিশের কয়েকজন কন্সট্রেবল খোলা দোকান, রিক্সা, সিএনজি বাজারে জমায়েত মানুষকে লাঠিচার্জ করছে। সবাই দৌঁড়াচ্ছে নিজের মতো। খায়ের আমাকে বললো 'ভাই চলেন আমরাও যাই। পুলিশ আসলে সমস্যা' খায়েরকে বুঝালাম 'জীবনের ঝুকি নিয়ে আমরা মানুষের সচেতনতার লক্ষ্যে কাজ করছি। ভয় পেও না। পুলিশ আসলে আমি কথা বলবো।' ততক্ষণে দেখলাম বরকতের সাথে দুজন সেনাসৈনিক কথা বলছে। দেখলাম বরকতের হাতে একজন সৈনিক একটা পুটলা দিলো। বরকত পুটলাটা আবার ফেরত দিয়ে দিলো। দূর থেকে সাদা লুঙ্গি পড়া মেম্বার সাবও দেখছে দৃশ্য। মেম্বার সাবের দিকে আমার চোখ যেতেই মনে মনে একখান গালি দিলাম 'বাইঞ্চুদ। গরীবের হক মাইরা খাইয়া শরীরে তেলতেলা ভাব আনছোস! শালা চাল চোর, ডাল চোর। চোরের বাচ্চা চোর। কিভাবে দুইটা ডাকাইত্তা চোখ বের করে বরকতের পুটলার দিয়ে নজর দিছে।' অথচ বরকত সৈনিকের দেয়া পুটলা সৈনিককেই ফিরিয়ে দিলো। ততক্ষণে বরকত যে পাগল সৈনিকদের তা বুঝতে আর বাকি থাকলো না। অন্যজন কি যেনো বিড়বিড় করে বলে বরকতকে একটা মাস্ক দিলো। হাসিমুখে বরকত মাস্কটাকে গ্রহণ করলো। মাস্কটাকে মুখে না দিয়ে বরকত বাম হাতের কব্জিতে বালার মতো বাধতে বাধতে পুবে রেললাইনের দিকে চলে গেলো। ততক্ষণে আমার স্লোগান লিখাও শেষ। কয়েকজন সেনাসৈনিক দেখলো এবং একটু শব্দ করে স্লোগানটা পড়লো। আমাদের দিকে একটু তাকালো কিন্তু কিছুই বললো না। আমরাও ধীর পায়ে হেটে রেললাইনে গিয়ে দেখি রেললাইনের পাশের ডুমুর গাছতলায় বরকত শুয়ে হাসতেছে। হাসতে হাসতে স্বাভাবিক শব্দে বরকত বলতেছে 'মানুষ সব পাগল হয়া গেছে। এতদিন দেকতাম গরু-মইষের মুহে টোপা আর অহন দেহি মুহে টোপা পইরা মানুষগুলা সব গরু-মইষ হয়া যাইতাছে।' আমি বরকতের কাছে গেলাম বরকত অনর্গল হাসছে। হাসতে হাসতে বসন্ত বিকেলের মৃদু হাওয়ায় বরকতের চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। হাতে হাতে বাহারি সদাই নিয়ে সকলেই বাড়ি ফিরছে। ছুটে যাচ্ছে যে যার নির্দিষ্ট খাঁচায়। বরকত স্বাধীন বাংলার একমাত্র স্বাধীন যুবক। বিড়বিড় করতে করতে চাল খুটিহীন ঘরে পায়ের উপর পা তুলে ঘুমিয়ে গেলো তালাচাবিহীন মুক্ত জীবনের মহাজন 'বরকইত্তা পাগলা'

পুনর্পাঠ
আহমেদ ছফা
কে আর বাজতে পারে

যে শহরে বোবার মত জুলছে নীরবতা বুকের নদীর ঢেউে জাগে মাছের মত কথা কারা যেন সামনে দাড়ায় সোহাগ ভুলায় তারা ছায়ার মত চমক্কে মিলায় ছায়ার শরীরেরা কে আর বাজাতে পারে পাখী তোমার মত কে আর লুকাতে পারে পাখী তোমার ক্ষত কে আর বাজাতে পারে পাখী তোমার মত কে আর লুকাতে পারে পাখী তোমার ক্ষত

ভাষান্তরকায়েস সৈয়দ
মূল: মাও সে তুঙ
তিনটি ছোট কবিতা
(শিহ লিউ জু লিঙ এর সুরের প্রতি ১৯৩৪-১৯৩৫)
.
পর্বতমালা!
চাবুক মারি আমার ক্ষিপ্র ঘোড়ায়, জিন লাগাই পিঠে
মাথা ঘুরাই চমকে
আকাশ আমার উপরে তিন ফুট তিন
.
পর্বতমালা!
বিপর্যস্ত সমুদ্রে উত্তাল ঢেউয়ের বয়ে যাওয়ার মতো
হাজারো ঘোড়ার মতো যুদ্ধের মাথায়
পুরো দাপটে
.
পর্বতমালা!
স্বর্গের নীলকে বিদ্ধ করা, তীক্ষ্ণ তোমার তীরের হুল
পরে যেতে পারে আকাশ
কিন্তু তোমার শক্তিমত্তায় দিয়ে যায় সমর্থন

No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক