বুধবার
২১শে শ্রাবণ ১৪২৭, ৫ই আগষ্ট ২০২০
কবিতা
অসীম মজুমদার
এসো, রূপকথা’র গল্প বলি
কৃষ্ণচ‚ড়া গাছের নীচে পড়ে আছে তাঁর রোদচশমা,
তাঁর চুড়ি ভিজে আছে অসময়ের বর্ষার জলে।
এখন তাঁর কপালে কোনো নাম না জানা ফুলের সিঁদুর।
বহুবার প্রেমের পান্ডুলিপি নিয়ে গেছি তাঁর কাছে,
জানাতে চেয়েছি আমার সব পুরোনো কথা!
বোধহয় সেই থেকেই সে খুব ভয়ে ভয়ে থাকে!
তাই সে যমুনাকে জানিয়ে রেখেছে আগে থেকেই
আমাকে দেখলেই যমুনা তাঁর জলে রঙ গুলে দেয়
করে দেয় শুধুই অন্তহীন কালো আর কালো
যমুনা চলতে থাকে তাঁর পরম প্রয়াগের পথে...
কতবার তার মৃদুশ্বাস ভরে নিয়েছি বুকের পাঁজরে
প্রভাত থেকে বিকেল আর বিকেল থেকে সাঁঝবেলা
তাঁর খোঁজেতে রাতদুপুরে আমার হয় পথচলা
পার হই তেপান্তর মাঠ তবুও হাঁটার নেই তো শেষ
পার হই রঙিন দরজা মেকী উৎসবের মিথ্যে বেশ।
অচেনা মানুষের মতো দেখে মেঘের আড়ালে কিছু তারা
মরিচিকা হয়ে যাও আমার ডাকে দাও না তবু সারা
মেঘদুত যদি তোমায় শোনায় এই পান্ডুলিপির কথা
বিষণ্নতার মলাট ছেড়ে বের হবে কোন নীল রূপকথা।
অঞ্জন চক্রবর্তী
যুগান্ধ
চুপ করে শুনে গেলে
কথা দু’টো...
চৈতন্যের আঙুল ছাপ সাক্ষী অতীত!
পুরনো বৃক্ষের ছায়া রেখে যায় জন্মপাঠ
বীজের ভিতরে।
হারিয়ে গেলে, অন্তরীণ বাক্যালাপ মুখ বুজে কাঁদে
প্রকাশ্যে আসুক শব্দ উলঙ্গ সহবাসে।
বল ভুল নয়, আছি অত্মসমর্পণে।
নির্মাল্য ঘোষ
দেহাতীত
শব্দবিছিন্ন হয়ে যখন তুমি আর
আমি চেয়ে থাকি...
লিঙ্গভেদ থাকে না...
শুধু প্রাণ ঘুরে বেড়ায় এদিক সেদিক...
আমি একটু একটু করে স্পর্শ ভুলি...
চৈতন্য হই...
আমার অন্নময় কোষ আর মনোময় কোষ
তখনো নামানোর চেষ্টায় ক্লান্ত...
আমি তখন তোমাকে নিয়ে দেহাতীত
দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায়
দিওতিমা
হে অতল , নির্বাক জল আমি
কস্তুরীর ছদ্মনামে ঘ্রাণ বলে ডেকেছি তোমাকে।
ব্যক্তিগত জল চাই।
শুশ্রুষা প্রত্যয় নিই
নদী নামে তৃষ্ণাকে করেছি আহ্বান।
এসো, বৃষ্টি নামে কুড়িয়েছি মেঘ
জ্যোৎস্নার পঙক্তিগুলি সাজিয়েছি ঘুমের স্তবকে।
নর্সিসাাস ঝর্ণাজলে ভাসিয়েছি স্রোতের অক্ষর।
এসো। এসো হেমলক। দুহাতে অযুত মাখি বিষ।
দিওতিমা - দিওতিমা। হে মৃত্যু সুধাপারাবার।
আমাদের পূর্ণ হোক শূন্যের তটরেখা ছুঁয়ে।
মিলন ইমদাদুল
আমাকে ভুলে যাও হে প্রিয়তমা
আমাকে ভুলে যাও হে প্রিয়তমা
ভুলে যাও আমাকে-
ভুলে যাও জীবনের সকল সফল বেদনাকে!
ভুলে যাও অতীতের গ্লানিমাখা রুদ্ধ দুঃসময়কে-
উঠে দাঁড়াও, সম্মুখে তাকাও, দেখো জীবনের উজ্জ্বল নক্ষত্রকে...
সাঁজাও নিজেকে সাঁজাও; বাঁচো নতুনরূপে!
রুখে দাঁড়াও প্রতিরোধ করো সমস্ত অসম্ভবকে!
ভুলে যাও প্রিয়তমা ভুলে যাও; ভুলে যাও এই আমাকে!
এই নষ্ট আমার জন্য আর কোনো প্রতীক্ষা নয়
এই নষ্ট আমার জন্য আর কিছু হারাবার নয়!
ইয় কোন পিছুটান, সম্মুখে হাঁটো
হাতের মুঠোয় আনো রঙিন স্বপ্নকে,
তবু ভুলে যাও প্রিয়তমা, ভুলে যাও এই নষ্ট আমাকে...
সুজাউদ্দৌলা
উড়নচন্ডির মাঠে
উড়নচন্ডির মাঠে ফেলে এলাম কিছু খেয়াল
আরও কী কী ফেলে দেব ভাবতেই
আত্মধিক্কারে ভেঙে ফেলি আয়নার মসৃণ
নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে নেই। তাই
একদিন ফেলে আসব ভাঙা আত্ম প্রতিকৃতি উড়নচন্ডির মাঠে।
ছোট গল্প
লাল ফোরাক
আপন রহমান
-এবার পূজায়, আমারে কিন্তু একটা লাল ফোরাক দেওয়া লাগবেই বাবা।
-হ্যা; মা দেবো।
-সঙ্গে একটা লাল জুতা, লাল কিলিপ আর লাল ফিতা।
-ঠিক আছে মা, এবার তুই ঘুমো।
-ঘুম যে আসে না বাবা; কেবল মায়ের কথা মনে পড়ে। আচ্ছা বাবা, মা আমাদের ছেড়ে এমন করে কেন চলে গেল? মায়ের কি আমাদের কথা একটুও মনে পড়ে না ?
মেয়ের কথা শুনে প্রচন্ড এক ধাক্কা লাগে শ্যামলের মনে। সারাদিন নানান জায়গায় ছুটো-ছুটি করে বেড়ায় কাজের সন্ধ্যানে। কাজও মেলেনা তেমন। গ্রামে চলছে এক নীরব হাহাকার। অনাবৃষ্টির কারণে এবার ফসল ফলাতে পারেনি কৃষক। তারা নিজেরাই খেতে পায় না, শ্যামলকে কাজে নিয়ে কি করবে। তবুও মাঝে মাঝে দুই একজন গৃহস্তের কাঠ ফেড়ে কিংবা ছোট খাট কোন কাজ করে দিয়ে দুই এক পোয়া চাল পায়। তাই নিয়ে বাড়ি ফিরে পানি-পানি করে রেধে খুব তৃপ্তির সাথে খায় বাবা-মেয়ে। দিনটা কোন রকম কেটে যায়। কিন্তু রাতে ছোট্ট মেয়ের নানান বেদনাদায়ক প্রশ্নে বুকের ভেতরটা হু-হু করে ওঠে তার। মেয়ের প্রশ্নগুলো শুধু মা সম্পর্কে হলে তো হতো। মাঝে মধ্যে মেয়ে এমন প্রশ্ন করে!
-আচ্ছা বাবা আমরা এতো গরীব কেন? পাশের বাড়ির রত্না, রূপালী ওরা তিন বেলা কত্তো ভালো ভালো খাবার খায়, ভালো পোষাক পরে। কিন্তু আমাকে কেন না খেয়ে থাকতে হয়? ছেঁড়া জামা-কাপড় পরতে হয় ? ইত্যাদি ইত্যাদি।
আজ মেয়ে আরও একটি বেদনাদায়ক ঘটনা শোনাল। জানো বাবা আজ কি হয়েছে-সকালে না খেয়ে স্কুলে গেছি রাতেও তো তেমন খাওয়া হয়নি। দুপুরে যখন টিফিন হয়েছে। তখন আমার সেকি ক্ষুধা লাগছে! ক্ষুধার যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। দেখি রত্নাদি টিফিন খাচ্ছে। আমি রত্নাদিকে গিয়ে বল্লাম রত্নাদি, আমাকে অল্প একটু খাবার দেবে? রত্নাদি বিরক্ত হয়ে আমার গালে কষে একটা চড় মারল! চড় মারার পর আমি চারদিকে কেমন যেন অন্ধকার দেখতে লাগলাম। তারপর আর কিছু বলতে পারি না। কিছুক্ষণ পর দেখি আমি লাইব্রেরিতে শুয়ে আছি। দিদিমনি আমাকে পাখা হাতে বাতাস করছে। তারপর আমাকে আস্তে করে উঠিয়ে বড় একবাটি নুডুলস আমার সামনে এনে দিল। আমি একদমে পেট পুরে খেয়ে নিলাম। তারপর দিদিমনিকে আমি সব ঘটনা খুলে বল্লাম।
Ñজানো বাবা দিদিমনি বলেছে এখন থেকে প্রতিদিন ওনার সাথে টিফিন খেতে। কিন্তু আমার যে তোমাকে রেখে একটুও খেতে ইচ্ছে করে না। মেয়ের কথাগুলো এতক্ষণ চুপচাপ শুনল শ্যামল। কথাগুলো শুনে কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে তার। কি বলবে কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না সে। শুধু এটুকুই বলল তুই ঘুমো মা।
রাত্রি দ্বিপ্রহর কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। সমস্ত পৃথিবীটা যেন ঘুমিয়ে গেছে। শুধু ঘুম নেই শ্যামলের চোখে। এ মুহুর্তে তার মনে হচ্ছে সমগ্র পৃথিবীর প্রাণীকুল ক্ষণিকের জন্য মরে গেছে-সেই পৃথিবীর একমাত্র জীবিত প্রাণী হঠাৎ শ্যামল নিজের চিন্তাকে শুধরে নিয়ে ভাবে-ধ্যাৎ কি ভাবছি আবোল-তাবোল। পৃথিবীর সকল প্রাণীরা কি একত্রে ক্ষণিকের জন্য মরে নাকি? তাছাড়া পৃথিবীতে আমি একাই জীবিত প্রাণী হতে যাবো কেন? আমি তো মৃতদের চেয়েও মৃত। তা না হলে শেফালী আমাকে ছেড়ে এভাবে চলে যাবে কেন? স্বামী জীবিত থাকতে কোন স্ত্রী কি অন্যের হাত ধরে চলে যেতে পারে? কতো ভালোই না বাসতাম তাকে। আমি না হয় মৃত হলাম। কিন্তু এত সুন্দর একটা ফুটফুটে মেয়ে সে কি এমন অপরাধ করেছিল?
যে সেই অপরাধে তাকে মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত করল সে ? ক্রোধে শরীরের সমস্ত শিরা উপশিরা ভেসে ওঠে তার।
তবুও মাঝে মাঝে আবার মায়াও হয় বউটার জন্য। বউটা যেদিন পাশের বাড়ীর দীনুর সাথে চলে গিয়েছিল সেদিন পরপর তিন ওয়াক্ত কোন রুটি-রুজির ব্যবস্থা করতে পারিনি সে। সে জানে বউটা তাকে অনেক বেশি ভালোবাসত। সেও বউকে ভালোবাসতো। কিন্তু বাসলে কি হবে সে তো ভালো করেই জানে।” অভাব যখন দরজায় এসে দাঁড়ায় ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়”। তার ভালোবাসাও যে অভাবের কারণেই জানালা দিয়ে পালিয়েছে। এটা তার বুঝতে বাকি থাকে না। সে তো একেবারে মূর্খ না। অভাবের সংসারে অনেক কষ্টে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে।
সকাল হয়েছে মেয়েটা ঘুম থেকে উঠে খাবারের জন্য বায়না ধরেছে। রাতে না খেয়ে মেয়েটার জন্য কিছু ভাত রেখে দিয়েছিল শ্যামল। সেগুলো বের করে ওর সামনে দিল। খেতে খেতে মেয়েটি বল্ল
- বাবা কাল তো মহালয়া-পূজাও তো এসে গেছে। কিন্তু আমার লাল ফোরাক তো কিনে দিলে না বাবা? মেয়ের কথা শুনে শান্ত স্বভাবের মানুষটার মাথা কেমন যেন গরম হয়ে গেলো। সে মেয়ের গালে জোরে এক চড় বসিয়ে দিয়ে বল্ল।
-তিন বেলা খেতে পারছিস না; আবার লাল ফোরাকের শখ হইছে তোর ? আমাকে আর কত জালাবি ...?
বলে ঘর থেকে একটানে গামছাটা ঘাড়ে নিয়ে রাগে গজ-গজ করতে করতে বেরিয়ে যায় শ্যামল।
পেছন থেকে মেয়েটা ডেকে বলে আমি তোমাকে আর কখনো জালাবো না বাবা।
তখন শেষ বিকেলের সূর্যটা পশ্চিমের আকাশে প্রায় ডুবু-ডুবু অবস্থা। শ্যামল গৃহস্তের বাড়িতে কাজ করে কিছু চাল গামছায় বেঁধে নিয়ে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে আসছে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই তার বুকের ভিতর বড়ো একটা ধাক্কা লাগে। সমস্ত বাড়িটা মানুষে গিজ-গিজ করছে। শ্যামল দৌড় দিয়ে এসে বাড়িতে ঢুকে দেখে তার সোনার প্রতিমা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। তার হাতে একটা চিরকুট-“ আমি তোমাকে আর জালাবোনা বাবা...।”
কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে শ্যামল-মা তুই আমাকে রেখে এভাবে কেন চলে গেলি? আমি এখন কি নিয়ে বাঁচবো? তুই কেন বুঝলি না। আমার সাধ থাকলেও সাধ্যের কোটাটা একেবারেই শূন্য।
গল্পটি সুন্দর
ReplyDelete