Wednesday, August 19, 2020

শিল্প সাহিত্য ১২৩

শুক্রবার  ৩০শে শ্রাবণ ১৪২৭, ১৪ই আগষ্ট ২০২০


ছোটগল্প

টান

রওশন রুবী


গাজিপুর চৌরাস্তা থেকে একটা পিকাপে গাদাগাদি করে বসে বাইশজন মানুষ। সবার মুখে মাক্স। প্রচন্ড গরমে অতিষ্ঠ সবাই। হা-হুতাস করছেন কেউ কেউ। মানুষ ছুটছে এই মহামারিতেও নাড়ির টানে। ছুটছে মনির হোসেন। তার হাতে মামনি শপিং কম্পেক্সের বড় একটি ব্যাগ। তাতে তার একটা জামা একটা প্যান্ট, পাঁচ বছরের মেয়ে লাইসার একটা ফ্রক, বউয়ের জন্য লিপিস্টিক আর চুড়ি। মায়ের জন্য একটা শাড়ি। ছোট বোনের জন্য একজোড়া জুতো। আর সবার জন্য একটি করে মাস্ক।


মনির বাড়ি যেতে চায়নি। কিন্তু ভোর রাতে ছোট বোন ফোন দিয়ে বলল,

-ভাইয়া তোকে কতদিন দেখিনি। আয় না  ঈদের ছুটিতে। 

মা ওকে ধমক দিয়েছিল, “আসতে লাগবো না। করোনা মানুষ সাফ করতাছে। হে এহন আইলে পথে-ঘাটে আক্রান্ত হইবার পারে। থাক, থাক করোনা দূর হোক।


মনির ভোররাত থেকে আশা ছেড়ে দিয়ে লম্বা ঘুম দিয়েছে। ফোনের রিং টোনে তার ঘন ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম জড়ানো ঘোলা চোখে স্কিনে দেখল আমেনার নাম। ধড়ফড়িয়ে উঠলো বুক। আমেনার কাজল লেপ্টানো হরিণের মতো চোখ, ধনুকের মতো নাক, নৌকার গলুয়ের মতো ঠোঁট ভেসে উঠলো। আমেনার হৃদয় হরণ করা বৃষ্টির ধারার মতো হাসি কানে ঝঙ্কার তুলছে। 

-হ্যালো আমু! কেমন আছো?    

বলতে বলতে মনির হোসেন টের পায় উত্তেজনায় তার গলা বন্ধ হয়ে আসে। ওপ্রান্ত থেকে আমেনা বলে,

-জোরে বল। কিছু বুঝবার পারতাছি না। হাসের মতো ফ্যাসফ্যাস করতাছো ক্যা? গলায় ব্যথা করতাছে?


-আরে নারে পাগলি। তোর ফোন আইলেই আমার শরীর গরম হইয়া উডে। আর গলা বন্ধ হইয়া যায়। 

মনির কথাটি বলে আমেনাকে একটা চুমু দেয়। আমেনা ওপ্রান্তে লজ্জায় লাল হয়ে বলে,

-লাজ-টাজ সবই ধুয়ে ফেলছো দেহি।

-তা হইব কেনরে বউ। আইজ ঘরে কেউ নাই। সবাই নাড়ির টানে ছুইটা গেছে যে যার বাড়িত।

-তোমার কাছে নয় কেউ নাই, আমার কাছে মাইয়া আছে। পাগল একটা তুমি।

-হো হো হো। হাসাইলা সোনাই। কও এই সাত-সকালে ক্যান ফোন দিছো? আর তো কোনদিন এমুন সকালে ফোন কর নাই।

কথাগুলো বলে মনির উত্তরের অপেক্ষা করে। আমেনা গাল ফুলিয়ে অভিমানের স্বরে বলে,

-বাড়ি আইবা না তুমি? সেফু বলছে মা নাকি তোমারে মানা করছে? 

-হ’ করছে তো। তুমি কী চাও?

-তোমার লগের বেবাকতের নাড়ির লাইগা টান আছে। বেবাকতে চইলে গেছে তাগো পরিবারের কাছে। তুমি ক্যান রয়ে গেলা? আমারে আর মনে লয় না? সে না হয় নাই লইল তোমার মাইয়ারেও দেখবার চাও না?

কথা শেষ করে ফুঁফিয়ে উঠে আমেনা।


-আরে কি করতাছো, কি বলতাছো হিসাব আছে? তোমাগোর কাছে যাবো বইলাই তোমাগো সবার লইগা জিনিস-পত্র কিনছি। এখন মা বলল যাইতে না।

মনির হোসেন কৈফিয়তের ভঙিতে কথাগুলো বলে থামে। (পরের পৃষ্ঠায়...)


ওপ্রান্তে নাক টানার শব্দ। মনির হোসেনের অস্থির লাগে। এসময় ফোনে মনির হোসেন মেয়ে লাইসার কণ্ঠ শুনতে পায়। 


-হ্যালো বাবা! তুমি কবে আইবা? বল না বাবা? বল না কবে আইবা?

লাইসা থেকে ফোন নিয়ে আমেনা বলে,

-আচ্ছা আইতে অইবো না। ভালা থাইকো।

মনির হোসেন কিছু বলার আগেই আমেনা ফোন কেটে দিল। তারপর যতবার ফোন দিয়েছে মনির হোসেন ফোন বন্ধই পেয়েছে। মানে আমেনা অভিমানে ফোন বন্ধ করে দিয়েছে। মনির হোসেন তড়িগড়ি বিছানা-পত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল।


এয়ারপোর্ট এসে যাত্রাবড়ি যাবার জন্য একটা অটোরিক্সা ভাড়া করল তিনশো টাকায়। পথে রিক্সাওয়ালা অনুনয় করলো আরো দু’জন পেসিঞ্জার নেবে। এতে মনির হোসেনকে পঞ্চাশ টাকা কম দিলেও হবে। তবে চুপ থাকতে হবে। মনির হোসেন ভাবল পঞ্চাশ টাকা বাঁচলে মন্দ হয় না। মেয়ের জন্য একটা আইসক্রিম নেওয়া যাবে। লাইসা আইসক্রিমের ভক্ত। মনিরসহ রিক্সাওয়ালা ও অন্য দু’জন মাস্ক পরা। তাই একটু স¦স্থির নিঃশ^াস ফেলে মনির।


যাত্রাবাড়ি নেমে আবার একটি পিকাপে উঠলো সোঁনারগাঁয়ে যেতে। মানুষের উপর যেন মানুষ বসে আছে এমন ভিড়। নড়বার উপায় নেই। মনিরের একবার মনে হলো কিছু লোক কাত হয়েও বসে রয়েছে। পিকাপে তিল ধরবার জায়গাও নেই। তবে একটা ভালো দিক মাস্ক ছাড়া কেউ নেই এখানেও। গরমের তীব্রতায় মনিরের দম বেরিয়ে যাবার জোগাড়। সে মাক্স ফাঁক করে দম নেয়। মানুষের গরম আর প্রকৃতির গরম মিশে কেমন ভ্যাপসা গন্ধ বেরুচ্ছে। তিন চার জন লোক চিৎকার করে উঠল,

-এই মাস্ক খুলছেন কেন? মাস্ক ঠিক করেন! ঠিক করেন!


মনির তাড়াতাড়ি মাস্কটিকে ঠিক করে নিল। করোনা কালের রাস্তা পারাপারের যুদ্ধ শেষে মনির যখন বাড়ি পৌঁছালো তখন শেষ বিকেল। ওকে দেখে সবাই অবাক আমেনা ছাড়া। আমেনা মনিরের চোখে চোখ রেখে রহস্যময় হাসে। লাইসা দৌড়ে এসে আব্বু আব্বু বলে মনিরকে জড়িয়ে ধরে। মনির চুমোয় চুমোয় মেয়েকে ভরিয়ে দেয়।


সেফু ভাইয়াকে এতোদিন পরে পেয়ে আবেগে আপ্লুত। হাসি আর কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে ভাইয়া ভাইয়া বলে মনিরের কোল ঘেঁষে বসে। মনিরের মা ভেজা চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে আসরের নামাজ পড়তে চলে যান। মনির সবার জন্য নিয়ে আসা জিনিসগুলো সবাইকে বুঝিয়ে দেয়। 


ঈদের দিন থেকে গলা ব্যথা মনির হোসেনের। পরদিন থেকে জ¦র আর জ¦র। জ¦রে ভুগছে ছোট্ট লাইসাও। ও জ¦রের তোড়ে অস্থির হয়ে উঠছে। নিরুপায় আমেনা সারারাত সারাদিন বসে বসে ওদের মাথা পানি দেওয়া, গা মোছার কাজ করে যাচ্ছে। সেফু বাজারের ঔষধের দোকান থেকে জ¦র গলা ব্যথার ঔষধ নিয়ে এসেছে দু’জনার জন্য। চারদিনের মাথায় আমেনাও অসুস্থ হয়ে পড়ল। মনিরের মা আর বোন সেফা দেখা-শুনা করছে। চেয়ারম্যানের লোক এসে ওদের করোনা পরীক্ষা করতে নিয়ে গেল। দু’দিন পর জানা গেল ওরা কোভিড-১৯ পজেটিভ।


তাদের বাড়িসহ পাঁচ বাড়ি লকডাউন করা হলো। হঠাৎ মনিরের মায়ের বমি আর শরীর ব্যথা সাথে ডায়েরিয়া শুরু হলো। ডায়েরিয়ার বেগ বেড়েই চলেছে। ডিপেন্সারির ঔষধে কাজ হচ্ছে না। সেফা মাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করালো। ওয়ার্ডের বেডে বেডে মাস্ক পরা রুগিরা রোগের সাথে যুদ্ধ করছে। সেফা মায়ের জন্য টেনশানে ভুলেই গেল ডাক্তারকে বলতে তার ভাই গাজিপুর থেকে এসেছে। ভাই এবং তার স্ত্রী, সন্তানের করোনা পজেটিভ।


ডায়েরিয়ায় ভুগে মনিরের মা মারা গেলেন। তারও করোনা পজেটিভ ধরা পড়েছে। মারা গেলো মনিরের একমাত্র মেয়েও। মনিরের বউ আমেনা বেগম আইসোলেশনে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা নড়ছে। আছে মনিরও। মনির বা আমেনা শেষবার বিদায় দিতে পারেনি মা বা মেয়েকে। দূর থেকে দেখে জল বিসর্জিত করেছে সেফা। আইনের লোক সেফাকে ছুঁতে দেয়নি লাশগুলো। বরং তাকে কোয়ারান্টাইনে পাঠিয়ে দিয়েছে।


ধারাবাহিক গল্প

সোনার বালা গায়েব রহস্য

প্রণব কুমার চক্রবর্তী


সাত

      সোনার বালা গুলো কি মাল বাবু সত্যিই হাফিস করেছেন! নাকি অন্য কেউ!


      কয়েকদিন ধরেই শেখর মিত্র ব্যাপারটা নিয়ে সমানে ভেবে চলেছে। একবার ভেবেছিল এই ব্যাপারটা নিয়ে বড়বাবুর সাথে নিভৃতে বসে

একটু আলোচনা করবে। কিন্তু, সাহসে কুলায়নি।

নিজের মনেই চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে, আর সারাক্ষণ সুযোগের অপেক্ষায় থেকেছে।


      তিন-চার দিনের মধ্যেই সত্যি সত্যি সুযোগটা এসে গেল। হাসপাতালে জানিয়েছে, মাল বাবু আপাতত বেঁচে গেছেন। কিন্তু, একটা সাইট পড়ে গেছে। মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করছে না। কথাবার্তা ও ঠিক মতো গুছিয়ে বলতে পারছেন না। জড়িয়ে যাচ্ছে। এখনো অন্তত মাস কয়েক হাসপাতালে পড়ে থাকতে হবে।


      কি একটা বাজে কান্ড ঘটে গেল? বড়বাবু খবরটা পেয়ে বেশ মর্মাহত। বললেন - মিত্তির? আশাটা যদিও কম, তবুও বলছি - যতদিন না মাল বাবু ভালো হয়ে থানায় ফিরছেন, তোমাকেই ওই মাল খানাটা সামলাতে হবে। আমি অন্য কাউকে আর ওটা এনডোর্স করছি না। প্লিজ , অন্যথা করো না।

      - ঠিক আছে স্যার।

শেখর এই সুযোগটাই খুজছিল। অনুনয়ের সুরে বলল - স্যার? একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?

      - কি কথা ?

      - আপনার এই ব্যাপারটায় কি মনে হয়?

      - কোন ব্যাপারে?

      - মালখানা থেকে মালগুলো উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। আপনি কি মনে করেন যে, মাল বাবুই ওই বালগুলো আত্মসাৎ করেছে? সেদিন ওর কথাবার্তা, চালচলন এবং উনার বডি ল্যাঙ্গুয়েজএর ক্ষেত্রে একবারের জন্য কি আপনার মনে হয়েছে যে, ভদ্রলোক এতোটুকু ক্রিমিনাল সাইকোসিসএ ভুগছিলেন? আমার তো স্যার মনে হচ্ছিল, উনি লজ্জা আর অপমানের হীনমন্যতায় একেবারে গুটিয়ে গিয়েছিলেন।


      শেখর এর কথা শুনে জগদানন্দ মুখার্জি চোখ দুটো বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। মুখে কোনো উত্তর দেননি। তবে চোখের ভাষায় বুঝাতে চেয়েছিলেন, এত প্রমাণএর পরেও কি কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে?

    - স্যার? শেখর বুঝেছিল যে বড়বাবু ওর কথায় অসন্তুষ্ট হয়েছেন। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বলেছিলÑ স্যার? আমি ঠিক আপনাকে ব্যাপারটা ওভাবে বলতে চাইনি। আমি আপনার অভিজ্ঞতার দৃষ্টিকোণের প্রেক্ষাপটে ব্যাপারটার মতামত জানতে চেয়েছিলাম। স্যার? আইনের বাইরেও তো অনেকটা জায়গা থাকে।

      - তা থাকে। বড় বাবু জানতে চেয়েছিলেনÑ হঠাৎ কেন এমন ধারণা হচ্ছে? মনে হচ্ছে কেস্টার ব্যাপারে সে খুবই ইন্টারেস্টেড?


      শেখর জানিয়েছিল যে, সে ওর পাশের কোয়াটারে থাকে। ওর ব্যক্তিগত এবং আধ্যাত্মিক জীবন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে। বেচারা অত্যন্ত শুচিবাই গ্রস্থ চরিত্রের লোক। সকাল সন্ধ্য পুজো আহ্নিক না করে, ভদ্রলোক জল পর্যন্ত স্পর্শ করেন না। শীতকালেও ডেড বডি সংক্রান্ত কোন কিসের তদন্ত গেলে যত রাত্রি হোক না কেন, বাড়ি ফিরে স্নান না করে ঘরে ঢুকে না। এই কেসের ব্যাপারেও সেই দিন রাত্রে যে স্নান করে পুজো আহ্নিক করেছিলেন, সেটা আমি নিজেই জানি। আমার স্থির বিশ্বাস, সেদিনের ঐ মালপত্র ভর্তি কাল ভ্যানিটি ব্যাগটা মাল বাবু নিজে হাতে করে থানায় নিয়ে আনেননি।


      - ব্যাট মাইট বি! বড়বাবু হেসে বলেন - তাতে তো আর সেনবাবুকে বাঁচানো যাবে না। মনে হচ্ছে আপনি এই কেসটার ব্যাপারে খুব উৎসাহী? দেখুন না চেষ্টা করে, কিছু করতে পারেন কিনা? (চলবে...)

No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক