Wednesday, August 5, 2020

শিল্প সাহিত্য ১১৩

মঙ্গলবার ২০শে শ্রাবণ ১৪২৭, ৪ঠা আগষ্ট ২০২০




কবিতা

সাব্বির হোসেন
শুধু এক হাত জায়গা দিতে চাই

হাঁটতে হাঁটতে কাঁচা মাটির পরশ পেরিয়ে
কংক্রিটের দেয়ালে আমার আশ্রয় হল।
এখন এই নগ্ন পা বড্ড ক্লান্ত
তন্ত্র মন্ত্র রীতি নীতি সব কিছু অবলোকন করে পরিশেষ জানলাম এখানেই শেষ নয়
ওপারেও হাঁটতে হবে নিদ্রাকাল জুড়ে।

জঠরে থাকা কালে
পৃথিবীর মানুষেরা একে একে এসে বলেছিল,
“আমরা বাঁচতে চাই।
খেতে চাই।
সম্ভ্রম ঢাকতে পেতে চাই কিছু কাপড়।”
পরিশেষে বলেছিল আরও কিছু
আরও অন্তহীন কিছু সুখ।

এসবের কোন কিছুই আমি তাদের দিতে পারিনি
শুধু দিয়েছিলাম এক হাত জায়গা।
যতবার হাত বাড়িয়েছি,
ওরা ফিরিয়ে দিয়েছে কদাকার রূপে
ওরা আমাকে গ্রহণ করেনি
আমি অপেক্ষায় ছিলাম যুগের পর যুগ।

তারপর একদিন হঠাৎ,
এক মানব সন্তান এসে আমার কাছে আশ্রয় চাইল বলল,
“আমি কবি”
আমি তাঁকে একহাত জায়গা দিলাম
এই হাত,
এই এক হাত জায়গায় বুকে জড়িয়ে
তাঁর বক্ষে ঢেলে দিলাম আমার
সারা জীবনের সঞ্চয়
জ্ঞান ও ভালোবাসা।
কবি তখনই লিখল তাঁর অংশুমান কবিতা
সে চিৎকার করে বলে উঠল,
“তোমরা শুনো- এই হাত, এই আলিঙ্গন। এই নিঃস্বার্থ আশ্রয় এসবই সত্য ও পবিত্র।
এই জায়গাটা হল বিশ্বকে লালন করার মত অমোঘ আলিঙ্গন।”

নাদিম সিদ্দিকী  
মহাসঙ্গীতে

যদি প্রেম চাও
মিছিলের নারীকে সাজাও
এখানে গতানুগতিক জীবন না থাকুক
না থাকুক কামোত্তেজনা মত্ত যৌন ক্ষুধা
কিংবা যাপিত জীবনে যতো অযাচিত চাহিদা
তবু মনের গোপন ঘরে পাবে ভাবানুপাতিক প্রেম
যৌবনের মহাসঙ্গীতে পাবে সৃষ্টির সুর
বিপ্লবের হিরন্ময় হাতিয়ার।
যদি প্রেম চাও
এই ভরা যৌবনে মিছিলের নারীকে সাজাও।

স্বপঞ্জয় চৌধুরী
যদি আসতেই হয়

যদি আসতেই হয় আবার রাজার মতো এসো
তোমাকে দেখে পথ থেকে স্বেচ্ছায় সরে যাবে ধূলিকনা
তোমার পায়ের ছাপ কুড়িয়ে নিয়ে লেখা হবে গৌরব গাঁথা
তোমাকে দেখে নত হবে ঘাতক, অবিশ্বাসী আর কিছু
হেমলকবিষে প্রাণ যাওয়া আত্মা।
যদি আসতেই হয় ক্ষিপ্রঅশ্বের মতো ডেকে ডেকে এসো
প্রহর কাঁপিয়ে যেন গ্রহের সব বন্ধ কপাট ঝনঝন শব্দে ভেঙে ভেঙে পড়ে ;
দেবদূতও যেন চমকে ওঠে তোমার দুঃসাহসিক পদযাত্রায়, 
যদি আসতেই হয় বৈষম্যের খড়গ ভেঙে আসো
যেন শিকারির মাথা থেকে পাখিরা ঠুকরে খায় পাকাধান, সর্ষেদানা।
যদি আসতেই হয় আসো কেশর উড়িয়ে উড়িয়ে
বাতাসেও যেন হয় কানাকানি তোমার গর্জনে
সব বহ্নিশিখার মুখ বন্ধ করে তুমি নিজেই হয়ে ওঠো মুক্তির অগ্নিশ্বর, 
মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা নাবিকের দল
ছেড়া পালে সুই লাগিয়ে আবারো উঠবে জেগে
ওই ’তো সামনে দেখা যায় ভিনসেন্ট বন্দর।
যদি আসতেই হয় ঝড় হয়ে আসোনি পীড়িতের মুখে
লেগে খুনের ফেনা ধুয়ে মুছে করে একাকার
তুমি নিজেই হয়ে ওঠো নিরব যুদ্ধমাইন ফুঁসে ওঠা সমুদ্র।

ছোটগল্প
শাহিনদের কুরবানি
সাঈদুর রহমান লিটন

কুরবানীর ঈদ এলেই বুকের মধ্যে ধক্ করে ওঠে শাহিনের মার। বড় লোকেরা গরু, মহিষ, উট কুরবানি দেয়। কুরবানি দেয়া কত ছওয়াব, কত ফজিলত! অডিও’র কল্যাণে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল শুনে শুনে জেনেছে শাহিনের মা। ইচ্ছা হয় একটা গরু কুরবানি দিতে, পারত পক্ষে একটা খাসি দিলেও আশা পূরণ হয়। সে ইচ্ছা কখনো পূরণ হয়নাই শাহিনের মা’র। উপরন্তু শাহিনদের জ্বালাতন। শাহিনেরা দুই ভাই। শাহিন আর মাহিন। শাহিন মাহিনের চেয়ে বছর দু’য়েকের বড়। শাহিনের বয়স বছর দশেক হবে।
ওরা কুরবানির ঈদ এলে মাকে খুব জ্বালাতন করে। বিশেষ করে জুমার নামাজ পড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, মা আমরা কুরবানি দেই না কেন? হুজুর কুরবানির কত ছওয়াবের কথা কয়। কুরবানি দেয়া কত ভাল!
মা কি বলবে বুঝে ওঠে না। মা তো জানেই কুরবানি করা কত রকমের ছওয়াব, কত রকমের পাপ মোচন হয়, আল্লাহ পাক কত খুশি হয়।
কিন্তু সাধ আছে সাধ্য নাই। এই অমোঘ সত্য টুকু উপলব্ধি করার বয়স এখনো শাহিন মাহিনের হয় নাই। শাহিনদের বাবা সরকারি চাকুরী করতেন। শাহিনের বয়স যখন পাঁচ বছর তখন শাহিনের বাবা হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
শাহিনের মা পড়ে মহা সাগরে। কি করবে না করবে ভেবে ক‚ল পায় না। একা একা নীরবে নিভৃতে কাঁদে। শাহিন মাহিন বুঝে উঠে না তা। তাদের কে বুঝতেও দেন না। স্বামীর সামান্য পেনশনের টাকা আর জমি থেকে আসা কিছু শস্য দিয়ে সংসার চালিয়ে আসছেন এ পর্যন্ত।
কার দেখা কে দেখে? যার যার সংসার নিয়ে সেই সেই ব্যস্ত। অথচ স্বামী জীবিত থাকা কালীন, দেবরের সংসার, ভাসুরের সংসারে কত সহায়তা করতো। অথচ এই দুর্দিনে কেউ পাশে নেই। দেবর ভাসুরের বাড়ি কুরবানী হয়, শাহিন, মাহিন এক টুকরো গোস্তের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। এ বেদনা শাহিনের মা সইতে পারে না। গোপনে কেঁদে নেন শাহিনের মা।
মাহিন মাকে বলে মা এই টুকু গোস্ত দিয়ে পেট ভরে না, ভাত খাওয়া যায় না। মা, আর একটু গোস্ত দাও না।
মায়ের বুকটা ভেঙ্গে আসে বেদনায় । কে কার বেদনা দেখে, চোখের জল দেখে, অভাব অভিযোগ দেখে। তাই তো শাহিনের মা মাজায় কাপড় বেঁধে সংসার শুরু করেছেন। বাড়িতে একটা এঁড়ে বাছুর বর্গা পালন করতন শাহিনের মা। বাছুর টি এবার ঈদে বেঁচে দেওয়া হয়েছে । সেই খান থেকে শাহিনের মা কুড়ি হাজার টাকা পেয়েছে। শাহিনের মার মুখে হাসি। পরিতৃপ্তির হাসি। বাচ্চাদের ইচ্ছা পূরণ করার সাধ্যতা অর্জন করার হাসি।
তাই তো শাহিন এবার যেই বলেছে- মা, এবারো আমরা কুরবানি দিবনা?
সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন- এবার আমরা কুরবানি দিব।
এই কথা বলা মাত্রই শাহিনের কি উচ্ছ¡াস, কি আনন্দ, কি যে হাসি আর লাফানো। তা বলে কয়ে শেষ করা যাবে না। সেই লাফানো, সেই উল্লাসে মাহিনও যোগ দিয়েছিল, এবার আমরা কুরবানি দিবো। মায়ের চোখে আনন্দের ঝিলিক ফুটে ওঠে। মা তো এমনি সন্তানের আনন্দ দেখলে, সুখ দেখলে, হাসি দেখলে নিজেও শান্তি পান। কষ্ট ভুলে যান, অন্তরে প্রশান্তির ছোঁয়া অনুভব করেন। এরই নাম মা। শত দুঃখেও সন্তানের শান্তি কামনা করেন।
শাহিনের মা বললেন- বাবারে, এবার তো অত টাকা নাই, এবার একটা খাসি কুরবানি দিব। পরের বার বেশি টাকা জমলে গরু কুরবানি দিতে পারবো।
শাহিন মাহিন খুব খুশি হয়। এবার আর অন্য কারো দুয়ারে দাঁড়াতে হবে না গোস্তের জন্য। আমাদের বাড়ি কেউ থাকবে কেউ আসবে। তাদের কে আমরা দিব কি মজা, কি মজা। মনের খুশিতে দু’ভাই বুক উঁচিয়ে চলতে লাগলো। মা ওদের খুশিতে শতগুণ খুশি হচ্ছে। আর মনে মনে হাসছে। মায়ের মন তো সন্তানের এমন কাণ্ডকারখানায় না হেসে পারছেন না।
অবশেষে আর দু’দিন বাকি ঈদের। খাসি কিনতে গেলেন বাজারে, শাহিনের মা, শাহিন আর মাহিন। পশুর হাটে মানুষ আর মানুষ। গাদাগাদি করে মানুষ হাঁটছে। অনেক গরু ছাগল উঠেছে হাটে। তারই মধ্য থেকে একটা খাসি পছন্দ হলো সবার। দাম দর ঠিক করা হলো। মাহিন শাহিনের চোখ খুশিতে চিক করছে। অবশেষে আমরা কুরবানি দিব। খাসির দড়ি শাহিন, মাহিন হাতে নেয়।
শাহিনের মা কাপড়ের আঁচল হতে টাকা দিতে গিয়ে দেখেন আঁচলে টাকা নাই, ভাল করে ঝারি দিয়ে দেখে টাকা নাই, চার পাশ তল্লাশি করে দেখে টাকা নাই। শাহিনের মা অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকেন। গগন বিদারি কান্না। মাহিন, শাহিন মায়ের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকে। খাসির মালিক শাহিন, মাহিনের হাত থেকে খাসির দড়ি ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

No comments:

Post a Comment

সর্বশেষ

শিল্প সাহিত্য ১৩৩

সোমবার   ৯ই ভাদ্র ১৪২৭ , ২৪ই আগষ্ট ২০২০   কবিতা বিনয় কর্মকার ছবির গল্প   ভাতের ছবি আঁকতেই, ছিটকে পড়ে কালির দোয়াত! লালরঙা স্রোত, সাঁতারকাট...

সর্বাধিক